ইস্! কী চমৎকার সব লোকেশন! কত সুন্দর সব ছবি! ওরা কত ঈর্ষণীয় সুখী জীবন যাপন করছে। আজ সকালের ছবিগুলো দেখে খুব ভালো লাগলো সীমার। তিথির জন্য ওর বুকভরা মায়া। মেয়েটা সেই সাত বছর বয়সে তার মাকে হারিয়েছে। মা মারা যাওয়ার পর ভাই-ভাবীর কাছে থাকত। মায়ের অনুপস্থিতিতে বেড়ে ওঠা ছেলে-মেয়েকে অনেক কষ্ট স্বীকার করতে হয়। এটা তো জানা কথাই। স্বামীর সংসারে সুখে আর আনন্দে আছে এটাই তো অনেক খুশির ব্যাপার। আমেরিকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় গিয়ে তোলা ছবিগুলো দেখে সীমা অনেকটা প্রশান্তি অনুভব করে। সেই সাথে নিজের জীবনটাকেও তিথির সাথে তুলনা করার চেষ্টা করে। ভাবে, শফিক যদি একটু বৈষয়িক হতো, আর সংসার পরিচালনায় সীমাকে সহযোগিতা করতো, কতই না ভালো হতো! ছুটিতে ওরাও ইউএসএ, ইউকে গিয়ে ঘুরে আসতে পারতো। নিজের অজান্তেই ওর বুক চিরে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। নিজের মনকে এই বলে সান্ত¡না দেয়, “আল্লাহ যা করেন মঙ্গলের জন্যই।” বেশি স্বচ্ছলতা থাকলে মানুষ অনেক সময় আল্লাহর নির্ধারিত সীমার মধ্যে থাকতে পারে না। অন্যায় কাজ করতে শুরু করে। তার চেয়ে তো টানাপড়েনের মধ্যে থাকাই ভালো।
তিথির ফেসবুক অ্যাকাউন্ট জুড়ে, ওর কর্মস্থলের অসংখ্য ছবি। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং খেলাধুলার আয়োজনে তিথির হাসিমুখের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। সরকারি কলেজের শিক্ষক হওয়ার কারণে সে অনেক সুযোগ সুবিধা পায়। আগে সরকারি চাকরিতে তেমন ভালো বেতন ছিল না। এখন ঈর্ষণীয় বেতনে সবাই কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে।
মেসেঞ্জারে ফোনটা এলো সকাল এগারোটার দিকে। তিথি ওকে ফোন দিয়ে জানতে চাইল কোনো মানবাধিকার সংস্থার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারবে কি না। সীমা ওর কথায় বেশ অবাক হয়ে গেল, যখন শুনল নিজের ব্যাপার নিয়ে সে কথা বলতে চায়।
: শোন সীমা, আমি নারী নির্যাতন বিষয়ে মামলা করতে চাই। আমাকে একজন ভালো অ্যাডভোকেট এর খোঁজ দিতে পারবে?
: খোঁজ দেয়া যাবে। কিন্তু, তুমি কেন মামলা করতে যাবে? ইকবাল ভাইয়ের সাথে তুমি সুখে আছো বলেই তো জানি।
: এটা সম্পূর্ণ ভুল কথা। তুমি জানো না? অনেক আগে থেকেই সে আমার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করে? একবার যে বাচ্চাদের রেখে, একা একা তোমার বাসায় গিয়ে সারা দিন কাটিয়ে এসেছিলাম মনে নেই? তখন থেকেই তো ও এমন? মানুষের স্বভাব কি এত সহজে বদলায়? আমি ওকে নিষেধ করেছি ওয়াইন খেতে। কিন্তু, ও তো আমার কথাই শোনে না। বলে ফরেন ডেলিগেটসরা আসে। তাদের সাথে সম্মান রক্ষার্থে খায়। আজ বড় মেয়েটার গায়েও হাত তুলেছে। চড় মেরেছে। চুল ধরে টেনেছে। মেয়েটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ফেলেছিল, জানো? ওর গভীর ঘুম ভাঙছিল না দেখে ডাক্তার ডাকা হয়েছিল। তখনই জানা গেল, এই ঘটনা। ভাগ্যিস ডোজ অনেক বেশি পরিমাণে ছিল না। তাই আমার মেয়েটা বেঁচে আছে। মেয়ে ও লেভেলে পড়ে। এখন ওকে এভাবে মারা কি ঠিক? মেয়ে ওর মায়ের পক্ষ নিয়ে কথা বলেছে, এটাই অপরাধ ছিল। আমাকে যে ভাষায় বকাবকি করে, তা মারের চাইতেও বেশি। অন্তরাত্মা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। তুমি একজন ভালো মহিলা অ্যাডভোকেট এর সন্ধান দাও। আমি সত্যিই ওর সাথে আর থাকতে চাই না।
: মাথা ঠা-া রাখো তিথি। আচ্ছা, সকালেই তো ফেসবুকে তোমাদের ছবি দেখলাম। মেয়েদের নিয়ে আমেরিকার সুন্দর সব লোকেশনে ঘুরছো। এর আগে থাইল্যান্ডে গিয়েছিলে। ব্যাংককে গিয়ে যে রেস্টহাউজে থেকেছো, সেই পারিবারিক গ্রুপ ছবিটা ফেসবুকের কভার ফটোতে শোভা পাচ্ছে। আজ কিছু নতুন ছবিতে মেয়েদের সাথে হাসিমুখে তুমি আর ইকবাল ভাইকে দেখলাম। তোমাদের ছবি দেখে তো আমার মনটা খুশিতে ভরে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল, তোমরা কত সুখী! ইকবাল ভাইয়ের কাঁধে মাথা রেখে হাসছো। সেই ছবিটা তোমার প্রোফাইল পিকচার দেখে মনে মনে ভাবছিলাম, ইকবাল ভাই বেশ রোমান্টিক। তার প্রতি তোমার ভালোবাসাও খুব গভীর। যার সাথে এমন ছবি প্রোফাইলে দিয়েছ, এখন বলছো তার সাথেই থাকতে চাও না?
: ওর মন খুশি করতে ছবিটা দিয়েছিলাম। ও চায় না আমার কোনো ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থাকুক। আমাকে রীতিমতো সন্দেহ করে। আমার নাকি কার কার সাথে অ্যাফেয়ার আছে।
: হা হা হা ! কী বলছো এসব? এই বুড়ো বয়সে এসে আবার তুমি কাকে পছন্দ করতে যাবে? স্বামী, সংসার, সন্তান, চাকরির ব্যস্ততা… এতকিছুর পর আবার… অদ্ভুত লাগছে শুনতে।
: তোমার ইকবাল ভাইয়ের সামনেই আমি এতক্ষণ ধরে কথা বলছিলাম। ও এখন তোমার সাথে নিজেই কথা বলতে চাইছে।
: আচ্ছা দাও। হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম ইকবাল ভাই। কেমন আছেন?
: ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ। সীমা তোমার বান্ধবীকে একটু বুঝাও তো। ও ফেসবুকে চ্যাটিং করতে গিয়ে একজনের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ঐ লোক তার কানাডায় অনেক বড় ব্যবসা আছে, নিজের ভালো ভালো ডিগ্রি আছে এসব প্রোফাইলে লিখে অ্যাকাউন্ট খুলেছে। তোমার বান্ধবীতো কোনো কিছু হলেই ফেসবুকে আগেভাগে দিয়ে বসে থাকে। নিজের জন্মদিন, কলেজের অনুষ্ঠানে কি করলো না করলো এইসব। নিজে চাকরির টাকা দিয়ে গাড়ি কিনেছে। নিজে সেটা ব্যবহার করে। আমি আমার কেনা গাড়িতে চলাফেরা করি। আমার যে ব্যবসা আছে তা থেকে মোটামুটি ভালোই টাকা-পয়সা আসে। চার হাজার ছয়শত স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট কিনেছি উত্তরার অভিজাত এলাকায়। সেখানে থাকি। এছাড়া আমাদের ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় আরো পাঁচটা নিজস্ব বাড়ি আছে। তার মধ্যে তিনটাই ওর নামে কেনা। তাহলে তিথির কোনো অভাব আছে বলো? ও কেন আমার সাথে এমন করছে? আমার কথা শুনতে চায় না। ঐ লোকটা ওকে প্রায় দুর্বল করে ফেলেছিল। যখন ওর কাছে একসাথে অনেকগুলো টাকা চেয়েছে, তখন আমাকে বলেছে। ওর তখন লোকটাকে সন্দেহ হয়। এরপর বুঝতে পারে, বন্ধু সেজে আসলে সবাই বন্ধু হয় না। আমি চাই ওর যেন কোনো ফেসবুক অ্যাকাউন্ট না থাকে। দরকার হলে আমার অ্যাকাউন্টের মেসেঞ্জারে তোমরা যারা ওর বান্ধবী আছো, তাদের সাথে যোগাযোগ করবে।
: তিথি কি সত্যিই এমন বোকামি করেছে?
: করেছে মানে? অবশ্যই করেছে। তুমি নিজে ওকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবে। আমি বকা দেই আর যাই করি আমি তো আর ওকে ছেড়ে যাবো না। ওকে একটু বুঝিয়ে বলো। হাজব্যান্ড ওয়াইফ ঝগড়া হতেই পারে। তাই বলে, বাইরের মানুষের সাথে সব সময় এগুলো শেয়ার করতে হয় না। তাতে নিজেদেরই ক্ষতি। আমি ওর ভাইদের সাথেও এটা নিয়ে কথা বলেছি। এখন তুমিও একটু বুঝাও। তোমার প্রতি আমার বিশ্বাস আছে। ওকে তুমি ভালো পরামর্শই দিবে।
এরপর অনেক দিন আর তিথি সীমাকে ফোন করেনি। সীমা ভাবে, হয়তো ওদের সমস্যাটা মিটে গেছে, তাই আর সীমার সাথে এসব ব্যাপারে কথা বলেনি। যেহেতু সীমা ওদের ভেতরের কথাগুলো জেনে গেছে, এ কারণে ওর সাথে খুব বেশি যোগাযোগ রক্ষা করতে ওরা বিব্রতবোধ করছে। তবে, তিথি ফেসবুকে ওর স্বামীর অ্যাকাউন্ট থেকে, সীমাসহ অন্যান্য বন্ধু-বান্ধবী, আত্মীয় আর পরিচিতদের পোস্টে কমেন্ট করে। রিঅ্যাকশন দেয়। নিজের অ্যাকাউন্ট ক্লোজ করে দিয়েছে।
সীমাদের বাড়ির পাশের এক রিকশাওয়ালার ছেলে অনেক মেধাবী। ছেলেবেলা থেকেই পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ দেখে বাবা খুব কষ্ট করে হলেও, ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছে। লেখাপড়া শেষ করে ছেলেটি একটা ছোটখাটো চাকরি করছে। কিন্তু, বাবার অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। অনেক কষ্টে সংসার খরচ চালায়। ছেলেটার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করার পর সীমা বিস্মিত হয়ে দেখে, কত স্মার্টলি ফ্যাশনেবল পোশাক পরে যে ছেলেটা ছবি পোস্ট দেয়! যারা ওর সম্পর্কে ভালোভাবে জানে না, তারা ধরেই নেবে, এই ছেলে খুব সচ্ছল পরিবারের।
মেয়েদের কিছু বিজনেস গ্রুপে, ছেলেদের ঢোকা নিষেধ। এমন একটা ফেসবুক গ্রুপে সীমা মেম্বার হয়েছে। ওখান থেকে অনলাইনে কেনাকাটা করে। এক সময়ে জানাজানি হয়ে গেল, একটা মেয়ের নামে গ্রুপে ঢুকে তার ব্যবসায়ী স্বামী সেই গ্রুপে পণ্য বিক্রি করে। গ্রুপ অ্যাডমিন শর্ত দিল, সেই মেয়েটির নাম দিয়ে যে পণ্য দেখানো বা বিক্রি করা হবে, তা ঐ মেয়ের নিজস্ব পণ্য হতে হবে। সেসব পণ্যের মালিকানা তার স্বামীর বলে বিবেচিত হলে তাকে গ্রুপে রাখা হবে না। এ ছাড়া, আরো কিছু গ্রুপে এমন বিধি নিষেধ দেয়া আছে যে, মেয়েদের নিজস্ব যেসব গ্রুপ আছে, তাতে কোনোভাবেই কোনো পুরুষ থাকতে পারবে না। ভার্চুয়াল গ্রুপে কে নারী, কে পুরুষ এটাই তো অনেক সময় নিশ্চিত হওয়া কঠিন। অনেকেই নিজের পরিচয় গোপন রেখে ফেক আইডি খুলে বসে আছে।
সীমা সাধারণত নিউজ ফিডে ঢুকে আপডেট কিছু খবরাখবর জানার জন্য। ফেসবুককে বন্ধু এবং আত্মীয় পরিজনের সাথে সহজ যোগাযোগের উপায় হিসেবে মনে করে। মাঝে মধ্যে অবশ্য এখান থেকে অনলাইনে কেনাকাটাও করে। কেনাকাটা করতে গিয়ে ওর পরিচিত এক মহিলাকে কিছু পণ্যের ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন দিতে দেখে তাকে ফোন করে।
: হ্যালো মীনা ভাবী, আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন? আপনি যে পণ্যের ছবি দিয়েছেন ওগুলো তো স্বপ্না ভাবীর পেজে দেখেছি। আপনি দেখি সেইম পণ্য রেখেছেন। আপনারগুলো দাম কেমন?
: আরে সীমা আপা, আর বলবেন না। আপনি তো গত মাসে তার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। সেই সময় তার কাছ থেকে কিছু পণ্য এনেছিলাম। একেবারে সামান্য লাভে ছেড়ে দিচ্ছি। কেউ জানতে চাইলে বলি, এগুলো আমি করাই। কেউ তো বুঝতে পারে না। উনার কারখানার শ্রমিকদের কাজের ছবি, আর ভিডিও এনে কয়েকটা বিজনেস ক্লাবে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজের নাম যুক্ত করে নিয়েছি। এখন তো বিভিন্ন জায়গায় মেলায় অংশ নিই। ক্লাবের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে নানা ধরনের প্রশিক্ষণের সুযোগ পাচ্ছি। এই এক মাসের মধ্যেই আমার উদ্যোক্তা হিসেবে একটা পাকাপোক্ত অবস্থান তৈরি হয়ে গেছে।
: ও, আচ্ছা। কিন্তু, কখনো কেউ জেনে ফেললে? আপনার ইমেজের উপর খারাপ প্রভাব পড়বে না?
: আপনার ভাই তেমন কিছু করে না। কিছু উপার্জন করলে সংসারটা একটু ভালোভাবে চালাতে পারি। কী করবো বলেন? এইটুকু চালাকি বুদ্ধি খাটিয়ে কিছু উপার্জন করে খাচ্ছি।
সীমা আর কোনো কথা বাড়ায় না। কে কিভাবে নিজের উপার্জনের পথ তৈরি করে নেবে, সেটা ভালো না মন্দ পথে, তার দায় দায়িত্ব তো তারই ওপর বর্তায়। এখানে সীমার বলার মত কিইবা আছে?
এরপর স্বপ্নাভাবীর সাথে কথা হলে, তিনি অভিযোগের সুরে বললেন,
: আমার শ্রমিকদের ছবি আর ভিডিও দেখিয়ে সে নানা জায়গায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছে। এটা তো ঠিক না। সমাজ কল্যাণ অধিদফতরের প্রশিক্ষণেও সে অংশ নিতে চেয়েছিল। আমি তাকে কিছু বলিনি। যদি নিজে কিছু করে অধিদফতরের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পারে, করে নিক। এখানে তো আরেকজনের উদ্যোগ নিজের নামে চালিয়ে দেয়ার সুযোগ নেই।
সীমা সেদিন ফেসবুকে ঢুকে তার কাজের বুয়ার মেয়ের অ্যাকাউন্টের ছবি দেখে অবাক হয়ে গেল। বুয়া মেয়ের সাথে তাকে যুক্ত হতে বলেছিল, যাতে মেসেঞ্জারে কথা বলতে পারে। প্রথমে তো নাম দেখেই অবাক হয়েছিল। কী আধুনিক, স্মার্ট এবং অভিজাত একটা নাম। এটা যে ওর আসল নাম না, এটা সীমা জানে। তাই সে মনে মনে একটু বিরক্ত হয়। যখন ওর প্রোফাইলের ছবিটা দেখে, অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। নানারকম ভারী গহনা আর ভারী বিয়ের পোশাকে সজ্জিত সুন্দর একটা মেয়ের ছবি। ওর আপলোড করা ছবিগুলো সব বাছাই করা। সম্ভবত কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে, কমিউনিটি সেন্টারে গিয়ে তোলা। ছোটবোনগুলোর গায়ে সুন্দর সাজ-পোশাক। ওর নিজেরও কিছু পরিপাটি করে সেজে তোলা ছবি আছে। দেখে বুঝবে না কেউ এরা ছোট্ট বস্তির ঘরে অনেক কষ্টে দিন যাপন করে। এক ঘরে ঠাসাঠাসি করে থাকে পুরো পরিবারের মানুষগুলো।
ভার্চুয়াল জগতে, মানুষ মনে মনে নিজেকে যতটা সুখী এবং সচ্ছল হিসেবে কল্পনা করতে পছন্দ করে, সেইভাবে নিজেকে উপস্থাপনের সুযোগ আছে। এই ব্যাপারটাকে একেবারে খারাপ মনে হয় না। তবে, অন্যরা কাউকে এভাবে দেখে বিশ্বাস করলে, তার ঠকে যাওয়াটা দুঃখজনক। আর প্রতিনিয়ত এমনটাই ঘটে যাচ্ছে। সীমা ওর অনেক পূর্ব পরিচিত মানুষকে এই ‘মুখবই’ এর মাধ্যমেই খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু, তারপরও ফেসবুককে ওর কাছে সময় নষ্ট করার একটা ভাইরাস মনে হয়। এখানে খুব সাবধানে চোখ কান খোলা রেখে যুক্ত থাকতে হয়। তা না হলে প্রতি পদক্ষেপে ঠকে যাওয়ার, বিপদে পড়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। ভার্চুয়াল জগতের অনেক কিছুরই বাস্তবতার সাথে মিল নেই। মিল থাকে না।
মাঝে মধ্যে যখন অনলাইন বিজনেস পেজগুলো সামনে চলে আসে, সীমার খুব অবাক লাগে কিছু মেয়ে এবং ছেলেকে লাইভে এসে কথা বলতে দেখে। স্পষ্ট উচ্চারণে, কত স্বাভাবিকভাবে স্মার্টলি কথা বলে! অথচ, এদের অনেকেই মোটামুটি শিক্ষিত। হয়তো উচ্চমাধ্যমিকের গ-িও পার হয়নি। এরা তো রীতিমতো প্রতিভা এক একজন! সরকার চাইলে, এদেরকে বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রচারণায় মাঠ পর্যায়ে ক্যাম্পেইনের কাজে লাগাতে পারে। একটা পণ্য বিক্রির স্বার্থে প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে ক্যামেরার সামনে যারা অনবরত কথা বলে যেতে পারে, তারা উপযুক্ত প্রশিক্ষণ পেলে যে কোনো ক্যাম্পেইনের জন্য সুন্দরভাবে কাজ করতে পারবে। জাতীয় সমস্যাগুলোর ব্যাপারে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার জন্য আকর্ষণীয় পারিশ্রমিক দিয়ে এই সব ছেলেমেয়েদের মেধা এবং দক্ষতাকে কাজে লাগানো যেতে পারে। যেমন : দেশে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ অনেক বেশি। কিভাবে এডিস মশার বংশবৃদ্ধি ঠেকানো যায়, পরিচ্ছন্ন পরিবেশে বসবাস কতটা জরুরি, এই বিষয়গুলো ভার্চুয়াল মাধ্যমে বেশি বেশি উপস্থাপন করে জনসচেতনতা তৈরি করা যায়। ফেসবুকে, কোনো সেলস পেজের লাইভ দেখতে গেলে সীমার এই কথাগুলো প্রায় সময়ই মনে হয়। তবে, একটা বিষয় ওকে খুব কষ্ট দেয়। তা হলো মেয়েগুলোর অতিরিক্ত মেকআপ এবং সাজগোজ। এরচাইতে কম মেকআপেও তো ছবিতে চেহারা ভালো আসে। অথচ, কেন যে ওরা এত বেশি সাজে?
কিছু ভালো পেজ এবং গ্রুপ আছে। যেখানে অনেক ধরনের লেখাপড়া, হাতের কাজ শেখা, স্বাস্থ্যবিষয়ক আলোচনা ইত্যাদি হয়। সেগুলোর সাথে যুক্ত থাকলে লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই। সীমা ওর শ্বশুরকে একটা গ্রুপে যুক্ত করে দিয়েছে। যারা কর্মজীবন থেকে এখন অবসরে চলে গেছেন, গ্রুপটা তাদের নিয়ে। এরা সবাই একসাথে প্রাতঃ এবং বৈকালিক ভ্রমণে যান। মাঝে মধ্যে এ ওর বাসায় আড্ডায় অংশ নেন। একসাথে শরীরচর্চা এবং খেলাধুলা করেন। মাঝে মধ্যেই ওর শ্বশুর ওকে ডেকে বলেন,
: তোমাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেব বৌমা! এই মানুষগুলোর সাথে পরিচিত হয়ে আমার জীবনটা আবার ছন্দ ফিরে পেয়েছে।
জাহাঙ্গীর কবীর নামের এক ডাক্তারের কিটো ডায়েটপ্ল্যান তো মানুষের কাছে অনেক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। তার ফেসবুক লাইভে দেয়া বক্তব্যগুলো সীমার কাছে ভালোই লাগে। বিশেষ করে সুস্থ থাকার জন্য মাঝে মধ্যে রোজা রাখার পরামর্শটা তার দারুণ পছন্দ। সীমা ওর মাকে এই ডাক্তারের একটা ভিডিও দেখিয়েছিল। এরপর থেকে তিনি নিয়ম করে ডাক্তার জাহাঙ্গীরের ভিডিও দেখেন এবং তার পরামর্শ মেনে চলার চেষ্টা করেন। একদিন তো বলেই বসলেন,
: মা রে, তোরা ছেলেমেয়েদের বকা দেয়ার আগে খেয়াল করে দেখিস তো ওরা আসলে কম্পিউটারে কি নিয়ে ব্যস্ত আছে? যদি ভালো কোনো কিছু দেখে শিখে তাহলে ওদের কিছু বলিস না।
যে মা ইন্টারনেট সংযোগ নেয়াটাই পছন্দ করতেন না, সেই মায়ের এখন নেটপ্রীতি, ফেসবুকে সময় দেয়া দেখে হাসে সীমা। মায়ের পছন্দের বক্তার ধর্মীয় বক্তব্য শোনা, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণের অভ্যাস তৈরি, এসব কিছুতে ‘মুখবই’ এর ভূমিকা আছে এটা সত্যি। তবে, এই জগতে বুঝেশুনে পা ফেলতে হয়। ইদানীং রিল বা শর্ট ভিডিও একটা যুক্ত হয়েছে। যা সীমার কাছে খুব বিরক্তিকর মনে হয়। বন্ধু নয় এমন মানুষদেরও ভিডিও চোখের সামনে চলে আসে। বিশেষ করে সিনেমা-নাটকের অভিনেতা অভিনেত্রীদের। হঠাৎ করে রিলের উপর চাপ লেগে গেলে সেগুলো সচল হয়ে ওঠে। অর্থহীন কিছু সময়ের অপচয় ঘটায়। তাই, এখন সে ফেসবুকে খুব কম লগ ইন করে। সীমা জানে, সময় খুব মূল্যবান।