বুক উঁচু শান বাঁধানো বেদির মাঝ বরাবর ফুট উঁচু গোলাকার কাঠে চিত করে শোওয়ানো চকচকে চপার। উপরে লোহার পাইপ থেকে এস আকৃতির হুকগুলো ঝুলছে খা-খা। অন্যদিন এই সময়েই ছাল ছাড়ানো আস্ত দুটো পাঁঠা, দুটো খাসি ঝোলানো থাকে তাতে। যাদের বুক, পাঁজর, দাবনা কিংবা গর্দান থেকে কাস্টমারের পছন্দ সই মাংস কেটে কেটে ডিজিটাল পাল্লায় রেখে ওজন করে চাচা। এখনো তার কোনো প্রস্তুতি নেই? পাশের দোকানটায় তো সব রেডি। কাস্টমার এলেই কিনতে পারবে মাটন। আসলে খান চাচার মাটনের স্বাদই আলাদা। শর্বরীরও খুব পছন্দ। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে শর্বরী বলেছিল কাল সকালে উঠে চা খেয়েই বাজারে যেও। বাজারদর চড়া হলেও মাটন চাই। ছেলেটা মাছ আর মুখে তুলতে চাইছে না। করোনাকালে বডির রেজিস্ট্যান্স বাড়াতে এখন মাটন খাওয়া দরকার। কিন্তু খান চাচার দোকানে এসেও তো লাভ হলো না । না আছে মাংস, না পাচ্ছি চাচার টিকি!
অন্যমনস্ক হয়ে কথাগুলো ভাবছে সৌকর্য। হঠাৎ চমকে উঠল ‘ব্যা-ব্যা’ আর্ত চিৎকারে। শব্দের উৎপত্তিস্থলটা আন্দাজ করে তাকালে সেদিকে। উঁচু শানের বেদির ওপাশ থেকে শব্দটার কিয়দংশ আর একবার ভেসে এসেই থেমে গেলো।
উৎসাহী সৌকর্য এবার দু’হাতে ভর দিয়ে ঝুঁকে দেখতে পেলে খান চাচার ডান হাতে রক্তাক্ত ছুরি। নিচে হালাল হয়ে পড়ে রয়েছে সুঠাম খাসি। আর খাসির পা-চারটে শক্ত করে ধরে রয়েছে চাচার সাগরেদ। যে সব সময় চাচার পাশে বসে ওজন করা মাংস পলিথিনে ভরে এগিয়ে দেয় কাস্টমারকে। ওর চোয়ালও বেশ শক্ত। তেজি খাসিটাকে নিস্তেজ করতে চার-পা গায়ের জোরে চেপে ধরার পরেই চাচা ছুরি চালিয়ছে। পাশেই দড়ি বাঁধা একটা খাসি, দুটো পাঁঠা নিগূঢ় ভয়ে চেয়ে রয়েছে চাচার দিকে। ওদের চোখের সামনেই জবাই হতে দেখেছে ওদের সাথীকে। হয়ত ভাবছে এরপর কার পালা চাচার হাতে হালাল হবার!
ছুরি হাতে খান চাচাকে দেখে শিউরে উঠল সৌকর্যের ভেতরের সৌকর্য। কেমন যেন একটা কাঠিন্য ছেয়ে রয়েছে চাচার সারা মুখে। চাচার এমন রুদ্ররূপ আগে দেখেনি সৌকর্য। যখনই এসেছে হ্যাঙ্গারে ঝোলানো পছন্দসই মাংস হাসিমুখে কেটে ওজন করতেই দেখেছে চাচাকে। আজ চাচাকে এমন কঠোর দেখাচ্ছে কেন? তবে কি যারা খুনি তাদের মুখও খান চাচার মতই কঠিন হয়ে যায়?
এবার ভেতরের সৌন্দর্য সৌকর্যকে থামিয়ে দিয়ে বললে, কী যাতা ভাবছো খান চাচার সম্পর্কে? খান চাচা তো মানুষ খুন করে না। পশু জবাই করে। চাচা যেটা করে তা তো তোমাদেরই জন্য। চাচার মত কসাইরা যদি পশু জবাই না করত তাহলে তোমরা মাংস পেতে কোথা থেকে? তুমি চাচাকে খুনিদের সঙ্গে তুলনা করতে পারো না।
‘ভাইপো, ও ভাইপো, তুমি ওখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে কি ভাবছ বলোদিকি! এদিকে এসো না। আজ চিকেন নেবে না তা তো বুঝতে পারছি। তবু কাছে এলে একটু দিনকালের খবরাখবর তো জানতে পারি। তোমরা সব খবরা খবর রাখ কিনা। এই ভোট ভোট করে কোথায় কি ঝামেলা হলো, কাকে কে মারধর করল এইসব? শোনো আর কিছুক্ষণের মধ্যেই খান চাচা দুটো খাসি, দুটো পাঠা রেডি করে ঝুলিয়ে দেবে। আসলে চাচা কাল অনেক রাত করে ভোট দিয়ে গ্রাম থেকে ফিরেছে কিনা। তাই দেরি হচ্ছে।’
উল্টো দিকে মুরগির দোকান থেকে শ্যামল কাকার কথাগুলো শুনেই চমকে উঠল সৌকর্য। দেখে বঁটিতে বসে বাঁ-পায়ের নিচে একটা মুরগির দেহ চেপে ধরে ডান হাতে মু-হীন গলাটা ধরে আছে শক্ত করে। মুরগিটার দেহের শেষ রক্তবিন্দু বেরিয়ে শান্ত হলেই ফরফর করে ছাড়িয়ে ফেলবে ওর ছাল-চামড়া। কাত্তানের মত ধারালো বঁটির গা দিয়ে গড়িয়ে পড়েছে রক্ত। শ্যামল কাকার কোনো ভ্রƒক্ষেপ নেই। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এমন এক-দেরশো মুরগির মাথা ধরে থেকে আলাদা করা ওর নিত্য অভ্যেস। মাথা কাটা মুরগিটা পায়ের নিচে চেপে ধরেই দিব্যি কথা বলছে শ্যামল কাকা। কই ওর শরীরী ভাষায় তো কোনো কাঠিন্যের ছাপ নেই! তাহলে খান চাচার চোখ মুখ অমন শক্ত কেন!
সৌকর্য মনে মনে কথাগুলো আওড়ে আমতা আমতা করে বললে, কাকা ভোটের গ-গোল নিয়ে তোমাকে কিযে বলব আর কিযে বলব না তাই ভাবছি। গ-গোল তো এক আধটা নয়, অনেক। তার মধ্যে একটা গ-গোলের কথা শুনলে তো ঘাড়ের রক্ত হিম হয়ে যাবে।
এবার শ্যামল কাকা ছাল ছাড়ানো মুরগির টকটকে লালদেহের প্রায় অর্ধেক মাংসসহ একটা রান স্টিলের গামলায় রেখে বললে, সেকি গো ভাইপো!
এতক্ষণে আশপাশের তিন চারজন মাংসঅলাও বিস্ময়ে তাকিয়েছে সৌকর্যের পানে। ওরাও আগ্রহী রক্ত হিম করা খবরটা কি জানার জন্য।
: কেন, চার দফা ভোটের দিন সেনাবাহিনীর গুলিতে চারজন সাধারণ মানুষের মরার খবর শোনোনি? সকালে ভোট দেয়ার জন্য তারা লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল। সামান্য কথা কাটাকাটি হতেই সেনা গুলি করে মেরে ফেললো। সঙ্গে সঙ্গে খবরটা নিয়ে তো টিভিতে ঢিঢি পড়েছিল। আর তোমরা..!
: বলো কি গো ভাইপো? এতদিন তো শুনেছি ভোটে একদলের সমর্থক অন্যদলের সমর্থকদের ওপর চড়াও হয়ে মারপিট করতে? এখন বলছো সেনাই গুলি করেছে…?
শ্যামল কাকার অবাক করা প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই ওর উল্টো দিক থেকে একজন বললে, শালাদের গুলি করবে না তো জামাই আদর করবে? চার পাঁচশ মেয়ে মরদ মিলে সেনাদের ঘিরে ধরেছিল। আর ওদের হাতে কি ছিল জানিস? মরদদের হাতে ছিল তির, ধনুক, বল্লম, মেয়েদের ছিল ঝাঁটা, হাতা, খুন্তি, বেলুনি। শালারা বড্ড বাড় বেড়েছিল? সেনা পুলিশের বন্দুককেও থোড়াই কেয়ার!
দ্বিতীয় জনের অযাচিত মন্তব্যে একেবারে আকাশ থেকে পড়ল সৌকর্য। ভাবে, যারা রাজনীতির র বোঝে না তাদের মুখে এমন কথা! তবে কি ওর মগজটাও ধোলাই করা হয়েছে? আচ্ছা লোকটাকে কি একটু বুঝিয়ে বলবে যে সেনা যা করেছে ঠিক করেনি? নাহ্ দরকার নেই। শেষে কি বুঝতে কি বুঝবে? এক মুহূর্ত কথাগুলো ভাবছে সৌকর্য। ফের চমকে উঠল শ্যামল কাকার কথায়।
: কি গো ভাইপো, তুমি যে আবার চুপ হয়ে গেলে। আর কোনো খবর আছে কাছে?
: না না চুপ হইনি। একটু অন্যকথা ভাবছিলুম। কী যেন বলছিলে আর কোনো খবর টবর আছে কিনা? আছে তো, করোনার খবর আছে। ছ-দফা ভোট মিটতে না মিটতে আমাদের রাজ্যে করোনায় ছেয়ে গেছে। রোজই পঞ্চাশ ষাঠ জন মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। তাতে কোনো মাথাব্যথা নেই রাজনৈতিক নেতাদের। কেবল ভোটে জেতার জন্য মানুষগুলোকে নিয়ে একদল অন্য দলের উপর কী জঘন্য কাদা ছোড়াছুড়ি না করেছে! এখন এর বিহিত কে করবে বলদিকি ?
সৌকর্যের কথায় শ্যামল কাকা মাথা চুলকে বললে, তাহলে তো ভাইপো যত নষ্টের গোড়া ওই কমিশন। খামোখা একমাস ধরে ভোট পব্ব না করলেতো এখেনে করোনার এত বাড় বাড়ন্ত হোতুনি?
: একশবার। ওদের উদাসীনতা যার জন্যই তো এতো মানুষ মরছে।
: আচ্ছা দাদা, আপনি যে করোনা নিয়ে এত ভাষণ দিচ্ছেন তা করোনা কি শুধু আমাদের রাজ্যেই বেড়েছে? আর কোথাও বাড়েনি? ভোট হয়নি এমন অনেক রাজ্যেও তো করোনার বেড়েছে, তার বেলায় কি বলবেন? একপেশে কথা বললে তো চলবে না দাদা।
উল্টো দিকের লোকটা উপযাচক হয়ে পুনরায় কথাগুলো বললে সৌকর্য এক মুহূর্ত ওর পানে চেয়ে মুখ নামিয়ে নেয়। ভাবে এরপর ওকে কিছু বললে হিতে বিপরীত হতে পারে। যা সব জান্তা ভাব। শর্বরীও পইপই করে বলেছে দিনকাল ভালো নয়, পথেঘাটে বিতর্ক এড়িয়ে চলবে। শর্বরীর কথাই ঠিক। লোকটাকে কিছু বোঝাতে গেলে গোঁয়ার গোবিন্দর মত দ’’ কথা শুনিয়েদেবে। তাতে শ্যামল কাকারও খারাপ লাগবে। কিন্তু করোনায় যে রোজ পঞ্চাশ ষাট জনের মৃত্যু হচ্ছে, তার দায় কার? খান চাচার রক্তমাখা ছুরি আর শক্ত চোয়াল দেখে ভাবছিলুম খান চাচা নিষ্ঠুর, খুনি। আদপে তা তো নয়। বরং কমিশনের উদাসীনতায় মানুষের যে অপমৃত্যু তাতো খুনেরই শামিল…?
: কাকা লেগপিস দুটো ওজন করত দেখি কতটা হয়? মালটা আজ সকালে নাকি কাল রাতের?
কাস্টমারের কথায় চমকে ওঠে শ্যামল কাকা। সম্বিত ফেরে সৌকর্যেরও।
শ্যামল কাকা একটা লেগপিস কাস্টমারের মুখের কাছে তুলে ধরে বললে, না বাবু না, একটু আগেই কেটেছি। সৌকর্যের দিকে মুখ করে বললে, এই ভাইপোও তো দেখেছে। হাত ঠেকিয়ে দেখুন না এখনও গরম আছে। বউনির খরিদ্দারকে মিথ্যে বলব?
কথাগুলো বলেই শ্যামল কাকা দুটো লেগপিস ইলেকট্রনিক পাল্লায় রাখছে। এমন সময় সৌকর্য শুনতে পেলে খান চাচার গলা।
: কইগো ভাইপো এসো তোমার মাংস রেডি। তুমি যে অনেকক্ষণ আগেই এসেছো দেখেছি। দোকানের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কখন যে শ্যামলের কাছে গেছো তাও দেখেছি। ভোট দিয়ে কাল বাড়ি থেকে ফিরতে অনেকটা রাত হয়ে গিয়েছিল বাবু। তাই সকালে মাল রেডি করতে একটু লেট হয়ে গেল।
কথাগুলো শুনতে শুনতে সৌকর্য পা পা করে দোকানের সামনের গিয়ে দাঁড়াতেই খান চাচা একটার ছুরির সাথে অন্য একটা ছুরি ঘষতে ঘষতে জিজ্ঞেস করলে।
: বলো ভাইপো কোনখান থেকে দেব, দাবনা না ঘাড়ের দিক থেকে?
: কি হলো কিছু বলছ না কেন? বল তোমার যেখানে পছন্দ সেখান থেকেই দেব। কি-ই মনে করছ, বৌমা কোথা থেকে নিতে বলেছে?
মুখে কিছু না বলে সৌকর্য খান চাচার মুখের পানে ফ্যাল ফ্যাল চেয়ে মনে মনে ভাবছে। একটু আগে ছুরি হাতে যে খান চাচাকে দেখেছে এতো সে নয়। সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। এ মানুষ মানুষের জন্যে পশু হত্যা করলেও খুন করতে জানেনা! অথচ কমিশন!
: আরে ভাইপো তুমি অমন হাঁ করে দেখছটা কি? বলছ না কেন কোন জায়গার মাংস দেব? এখুনি অন্য কেউ এসে যাবে! আমি চাই তোমাকে দিয়েই বউনি করতে।
খান চাচার কথায় এবার সৌকর্য দু-ঠোঁটে হালকা হাসি ছড়িয়ে বললে, না না, তা নয়। ঠিক আছে তুমি যেখানে থেকে ভালো মনে কর সেখান থেকেই কেটে পাঁচশ ওজন করে দাও।
মাংস কিনে খান চাচার দোকান থেকে বেরিয়ে বাজারের মেন গেটের দিকে হাঁটছে সৌকর্য। গলি রাস্তর দুপাশে চাল-আটার হোলসেল, মনোহারি, হার্ডওয়ার, মুদিখানার, দশকর্মারদোকানগুলো পেছনে রেখে চিন্তিত মনে এগিয়ে যাচ্ছে। মাথায় কথা প্রসঙ্গে শ্যামল কাকার উল্টোদিকে মুরগিওলার উপযাচক হয়ে বলা কথার অনুরণন।
সৌকর্য হাঁটতে হাঁটতে গেটের কাছে পৌঁছেই অবাক। গেটের দুপাশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পতাকায় ছয়লাব। গেট থেকে বেরনোর মুখেই বাজার কমিটির তরফে রাখা লিকুইড স্যানিটাইজার। হাতদুটো সেনিটাইজ করতে করতেই সৌকর্য দেখতে পায় পতাকাগুলো পতপত করে উড়ছে স্বমহিমায়। মুহূর্ত তাকিয়ে ওর মনে হলো কই পতাকাগুলোর তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না উড়ে উড়ে একে অপরের গায়ে লাগতে। যত সমস্যা শালা মানুষের! বিষধর সাপের মত একদলের লোক অন্যদলের ছায়া দেখলেই ছোবল মারা! শালার ওই মুরগিওলাও তার কথায় বোঝাতে চায় ও আর আমি ভিন্ন দলের সমর্থক? করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে এই যে সেনিটাইজের ব্যবস্থা, শালা মানুষের মনের ভাইরাস মারতে যদি এমন কোনো সেনিটাইজার আবিষ্কার হতো তো ভালো হতো…!