প্রখ্যাত ফিলিস্তিনি সাহিত্যসমালোচক ফয়সাল দারাজ তার এক প্রবন্ধে নিজ জাতির দুর্ভাগ্য বর্ণনা করতে গিয়ে লিও টলস্টয়ের সাহায্য নিয়েছেন। এই মহান কথাকার তার ক্ল্যাসিক উপন্যাস আনা কারেনিনা-র ভূমিকায় বলেছেন: ‘সুখী পরিবারগুলো সব একই রকম; কিন্তু প্রত্যেক অসুখী পরিবার অসুখী তার নিজস্ব ধরনে।’ ফিলিস্তিনিদের দুর্ভাগ্যও ঠিক সেই রকম, তার কোনো তুলনা চলে না। যে রকম বহুমুখী দমন-পীড়নের শিকার তারা, যুগের পর যুগব্যাপী, সত্যিই তার কোনো উদাহরণ নেই পৃথিবীর ইতিহাসে। জায়নবাদী প্রকল্প গোটা জাতিটাকেই শরণার্থীতে রূপান্তরিত করেছে, বারবার, আর তা এতটাই নির্মম যে, তারা শরণার্থী এমনকি নিজ জন্মভূমি-মাতৃভূমিতেও। তাদের এই দুর্ভোগ একেবারেই অনন্যসাধারণ, একেবারেই তাদের নিজস্ব ধরনের। ফিলিস্তিনি সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণে তাদের এই দুর্ভাগ্যের অনন্যতার সত্য বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
১৯৪৮ সালের ‘মহাবিপর্যয়’ (নাকবাহ)-এর সময় সাত লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি তাদের বাড়িঘর থেকে বিতাড়নের শিকার হয়, তাদের মেনে নিতে হয় নির্বাসন এবং বিদেশ বাস ও শরণার্থী ক্যাম্পে অনিঃশেষ প্রতীক্ষার অভিজ্ঞতা। এদের অনেকেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে প্রথমত প্রতিবেশী দেশগুলোয়, তারপর ইউরোপ-আমেরিকায় পর্যন্ত। এসব প্রবাসী ফিলিস্তিনির সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৬০ লাখ। তথাকথিত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানাধীন পশ্চিমতীর ও গাজায় এখন বাস করছে প্রায় ৫০ লাখ ফিলিস্তিনি যারা, বিশেষত গাজাবাসীরা, প্রতিনিয়ত ইসরাইল কর্তৃক অবরোধ এবং বোমাবর্ষণের অভিজ্ঞতার শিকার। অন্যেরা, তারাও এখন সংখ্যায় অন্তত ২০ লাখ, মাটি কামড়ে পড়ে আছে মাতৃভূমিতে, যেটা এখন ইসরাইল রাষ্ট্র বটে, টিকে আছে সেই রাষ্ট্রের অসম্ভব ধরনের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে, দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের অপমান নিয়ে, বঞ্চিত হয়ে অনেক নাগরিক অধিকার থেকে। ‘ইসরাইল ভূমিতে বসবাসরত আরবরা’ কখনো একজন ইসরাইলি নাগরিক অর্থাৎ ইহুদির সমান হতে পারে না। এবং, অসলো চুক্তির পর থেকে, ‘শান্তি প্রক্রিয়া’র গুণকীর্তনে মিডিয়ার (বিশেষত পশ্চিমা গণমাধ্যমের) বিশেষ পারঙ্গমতা সত্ত্বেও, পশ্চিমা ও জায়নবাদী আশীর্বাদপুষ্ট ‘শান্তি’ নিজেই ফিলিস্তিনিদের নজিরবিহীন দুঃখভোগের সম্মুখীন করেছে।
অসলো-য় ইসরাইলিরা যা চেয়েছিল আমেরিকা তাকে নিশ্চিতরূপে তা-ই পাইয়ে দিয়েছে। এই তথাকথিত ‘শান্তি’র আগে ফিলিস্তিনিরা অন্তত একটা সুন্দর ভবিষ্যতের কল্পনা করে আশাবাদী হতে পারতো, লাভ করতে পারতো তাৎক্ষণিক স্বস্তি, উঠে দাঁড়াতে পারতো নতুন উদ্দীপনা ও সাহসে বলীয়ান হয়ে। কিন্তু ‘শান্তি আসার পরে’, বাস্তবে যার সাক্ষাৎ কখনোই মেলেনি, একজন ফিলিস্তিনিকে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে আশাকে পাশে ঠেলে রেখে, এখন তাদের সামনে কেবল বেপরোয়া নৈরাশ্যময় অপেক্ষা- যদি কখনো অধিকতর ভালো সময় আসে! আসবে কি? এই প্রশ্ন তাদের নিয়ত আরো হতাশ করে তোলে।
প্রায় শত বছর হতে চললো তাদের এই আশা অব্যাহতভাবে মুলতবি হয়ে আছে- এক আশার জন্ম হয়, তারপর তা স্থগিত হয়ে যায়, তারপর আবার আশা জেগে ওঠে, তারপর আবার তা হারিয়ে যায়। ফিলিস্তিনিদের এ হচ্ছে নৈমিত্তিক দুর্ভাগ্য। সম্ভবত সেটাই ফিলিস্তিনি লেখকদের ঠেলে দিয়েছে অতীতচারিতার পথে, স্মৃতিকাতর লেখক বঞ্চনার গল্পের জগতে পরিভ্রমণ, এবং তার পুনর্লিখন, এবং তারও পুনর্লিখন করতে থাকেন, যদিও নিত্য নতুন কঠোর পরীক্ষা তাদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত দুঃখের সঙ্গে যোগ করেছে বিষাদের অজ্ঞাতপূর্ব গভীরতা।
কোনো ফিলিস্তিনিই নিজেকে ‘একা’ ভাবে না। তাদের মধ্যে ‘আমি’ নেই, ‘আমরা’ই তাদের অস্তিত্বের প্রধান স্মারক। ফিলিস্তিনি লেখকরাও এর ব্যতিক্রম নন। তারা, আজকে পর্যন্তও, তাদের দুঃখকে বহুবাচনিক উত্তম পুরুষে গঠন করেন, তারা টলস্টয়ের মন্তব্য শুনুন বা না শুনুন। কারণ, ফিলিস্তিনি জনগণের একটা সমষ্টিগত আখ্যান রয়েছে- সেটা এমন একটা গল্প যার শেকড় বিস্তৃৃত ইতিহাসের মধ্যে, এবং সাধারণত তার শুরু ১৯১৭ সালের বালফুর ঘোষণা অর্থাৎ ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য বাসভূমি প্রতিষ্ঠার ইয়োরোপীয় অঙ্গীকার থেকে। এই জাতির, মানবিক অর্থে, রয়েছে গল্পের ভাণ্ডার- নির্বাসন, প্রতিরোধ এবং বাসভূমির থিমের মধ্যে দিয়ে এগুনো বিচিত্র অভিযান ও গন্তব্যের গল্পের সম্ভার। এইসব গল্প, যা অনবরত পুনরাবিষ্কৃত হয়ে চলেছে, এবং যা এখনও ঘটমান, তার অবস্থান ‘সাধারণ মানবাধিকার’-এর একেবারে কেন্দ্রস্থলে, যা থেকে বঞ্চিত ফিলিস্তিনিরা। এভাবে তারা রূপান্তরিত হয় ধ্বস্ত মানব অস্তিত্বে, ফিলিস্তিনি লেখকরা তাই কেবলই বর্ণনা করে চলেন নিজেদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, এবং সেই সূত্রে জাতিগত ধ্বংসের গল্প।
আরব ঐতিহাসিকরা যেমন বলেন, ১৯৪৮ সালের নাকবাহ-র আগে, যখন পশ্চিমা শক্তির সমর্থন ও সাহায্যে জায়নবাদী সক্রিয়তা বৃদ্ধিমান, তখন ফিলিস্তিনিরা বাস করতো ভিটেমাটি হারানোর আতঙ্কের মধ্যে। নাকবাহ মানে ইসরাইল রাষ্ট্রের পত্তন এবং তার ফল হিসেবে ফিলিস্তিনি সমাজের ধ্বংস, দেশান্তর ও পরাধীনতা। প্রকৃতপক্ষে নাকবাহ-র পরেই ফিলিস্তিনিরা জানতে পারলো ধ্বংস এবং উচ্ছেদ বলতে আসলেই কী বোঝায়। পরবর্তী কালে, প্রতিরোধ এবং সশস্ত্র সংগ্রামের সময়, তারা কল্পনায় দেখতে চেষ্টা করেছে বিপদ এবং মৃত্যুকে। ‘শান্তি সুদূরপরাহত’ হওয়ার পর, মানবিক বিচারের সম্ভাব্যতার প্রশ্নে, অপমান এবং নৈরাশ্যের সঙ্গে যুক্ত হয় গভীর সংশয়। ফিলিস্তিনি লেখালেখি, আগাগোড়া, আবশ্যিকভাবেই, জায়নবাদী শক্তির সঙ্গে সংঘর্ষের প্রতিবেদন ছাড়া আর কিছু নয়, যে জায়নবাদী শক্তি স্বাভাবিক মানবিক অবস্থাসম্পন্ন ফিলিস্তিনিদের নিজভূমি থেকে উচ্ছেদ করে বানিয়েছে ‘অভিবাসী’, অথবা ‘শরণার্থী’, বঞ্চিত করেছে সেইসব মানবিক অধিকার থেকে যা পৃথিবীর আর সবাই ভোগ করে।
গত শতাব্দীর প্রথম দশকের শেষভাগে, রওভি ইয়াসিন আল-খালিদী (১৮৬৪-১৯১৩), আধুনিক আরবি সাহিত্যের অন্যতম অগ্রনায়ক, তার জায়নিজম গ্রন্থে আধুনিক ইহুদি কৃষকের সাচ্ছল্য এবং দরিদ্র ফিলিস্তিনি চাষিদের দুরবস্থার তুলনা করেছেন। এখানে তিনি মান্ধাতা আমলের এবং আধুনিক কালের কৃষিব্যবস্থার পার্থক্য বিশ্লেষণ করেননি, বরং ‘ইউরোপীয় ধ্যান-ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন জায়নিস্ট শক্তির মোকাবেলায় ‘ওসমানীয় রীতির অনুসারী লোকদের’ সক্ষমতার প্রশ্নে সন্দেহ ব্যক্ত করেছেন। ফ্রান্সে বসবাস করার সুবাদে জায়নবাদী প্রকল্প সম্পর্কে সত্যিকারভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি, অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন সাহিত্যিক আগ্রহকে পাশে ঠেলে রেখে মনোযোগ নিবেদন করতে ‘অবশ্যকর্তব্য বিষয়’-এর প্রতি, যা সরাসরি তার এবং তার জাতির অতীত এবং ভবিষ্যৎ জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই ধরনের নৈরাশ্য ও আশঙ্কা একজন সাধারণ মানুষের জীবন ধ্বংস করে দিতে পারত, কিন্তু এই বুদ্ধিজীবীকে তা আরো উদ্দীপিত করে।
এ রকম একজন আলোকিত বুদ্ধিজীবী যখন জায়নবাদী প্রকল্পের মোকাবেলায় স্ব-আরোপিত ‘অবশ্যকর্তব্য’ বিশেষণ জুড়ে দিচ্ছেন বিভিন্ন সাহিত্যিক আশঙ্কার সঙ্গে, তখন নাজিব নাসার (১৮৬৫-১৯৪৮), অন্যদিকে, ১৯০৮ সালে, ফিলিস্তিনের প্রথম সংবাদপত্র আল-কারমেল প্রতিষ্ঠা করার মুহূর্ত থেকে, তার পুরো জীবন উৎসর্গ করে দিলেন ফিলিস্তিনি জনগণের ‘অবশ্যম্ভাবী উচ্ছেদ’ এবং ‘এক ধরনের জবরদস্তি অভিবাসন’ সম্পর্কে তাদের সতর্ক করার কাজে। ইংরেজি, জার্মান এবং ফরাসিতে বহুলপঠিত একজন তীক্ষèধী বুদ্ধিজীবী নাসার তার প্রিয় আইনব্যবসা পরিত্যাগ করলেন সাংবাদিকতা নামক এক পেশার জন্য, যা ‘প্রয়োজনের খাতিরে’ গ্রহণ করতে তিনি বাধ্য হন। এটা আশ্চর্যের ব্যাপার নয় যে, তার উপন্যাস দি টেল অফ মুফলিহ আল-গাজ্জালি-তে, এটাই প্রথম ফিলিস্তিনি আখ্যান, বালফুর ঘোষণার কথা শুনে তিনি তার ভয়ার্ত অনুভবের কথা বলেছেন। নাসার এই বিশ্বাস পোষণ করতেন যে, ‘শেকসপিয়রের জাতি’ এমন কোনো কাজ করবে না যাতে তার ‘উন্নত সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ’-এর সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু তার ‘সংস্কৃত আশা’ খুব দ্রুত ‘বর্বর নৈরাশ্যে’ পরিণত হয়।
ফিলিস্তিনের মহান শিক্ষাবিদ খলিল আল-সাকাকিনির (১৮৭৮-১৯৫৩) ক্ষেত্রেও বিষয়টা খুব একটা আলাদা নয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের সর্বপ্রধান ফিলিস্তিনি বুদ্ধিজীবী তিনি, সম্প্রতি কয়েক খ-ে প্রকাশিত হয়েছে তার ডায়েরি। এর একটা বড় অংশই তিনি উৎসর্গ করেছেন ‘অপরিহার্য উদ্বেগ’ বিষয়ে, যা দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির গভীরতাকে তুলে ধরে। এই কারণে, আল-সাকাকিনি-র জীবন দুই পর্যায়ে বিভক্ত হয়ে পরিচালিত হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে তিনি সাংবিধানিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, রচনা করেন বিখ্যাত রিডিংস ইন ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড লিটারেচার, এবং কায়রো-র আরবি একাডেমি-র সদস্যের দায়িত্ব পালন করেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে তাকে মিসরে অভিগমন করতে হয়। ‘ইসরাইল-ভূমি জেরুসালেম রেডিও স্টেশন থেকে বলছি’ এই ঘোষণা দেওয়ার প্রতিবাদে তিনি জায়নবাদের সমর্থক ব্রিটিশ হাইকমিশনার হারবার্ট স্যামুয়েল-এর কর্তৃত্ব প্রত্যাখ্যান এবং রেডিও-র কর্মকর্তা পদের চাকরি ত্যাগ করেন। ১৯৪৮ সালে, নাকবাহ-বিপর্যয়ের পরে, তিনি মিসরে পালিয়ে যান, পেছনে পড়ে থাকে তার বিখ্যাত লাইব্রেরি।
জায়নবাদ, অথবা এর প্রতিক্রিয়া, এইসব বুদ্ধিজীবীর এবং একই সঙ্গে অন্যান্যদেরও, গন্তব্যকে যুক্ত করার মাধ্যমে একটা অভ্যন্তরীণ পরস্পরসম্পৃক্ত সূত্র তৈরি করে। এই কারণে তারা যা লিখতে চেয়েছেন সব সময় তা লিখতে পারেননি, এবং তারা তাদের পছন্দের কাজ করতে পারেননি পূর্ণ স্বাধীনতার সঙ্গে। তাদেরকে এমনকি কখনো কখনো ডুবে থাকতে হয়েছে অপ্রত্যাশিত বিষয়ের মধ্যে। এটা এমন যেন- জায়নবাদ ফিলিস্তিনিদের একটা নতুন, জবরদস্তিমূলক পুনর্জন্ম দিয়েছে তাদের প্রথম জৈবিক জন্মের পর। জায়নবাদ নির্ধারণ করতে পারেনি ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত হবার পর কোথায় হবে তাদের নতুন ‘জন্মস্থান’, কিন্তু ঠিকই যোগ করেছে ‘ঐশ্বরিক পছন্দ’র সঙ্গে ‘ক্ষমতার পছন্দ’, ‘প্রাকৃতিক পছন্দ’র সঙ্গে ‘ইউরোপীয় আধুনিকতার পছন্দ’। ফলে একজনের ভাষার সৌকর্যে ‘জাতীয় প্রশ্ন’, অথবা অন্য একজনের ‘জায়নবাদী চ্যালেঞ্জ’ এই শতাব্দীর অর্থাৎ নাকবাহ-র ফলে ফিলিস্তিনিদের হিজরত বা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ার আগের কালের ক্ল্যাসিক আরবি ক্কাসিদাহ কবিতায় গৌরবের স্থান অধিকার করেছে। তার প্রকাশ দেখা যায় আবু সালমা, আবদেল রহিম মাহমুদ, ইবরাহিম তুক্কান, এবং অন্যান্য কবিদের কাজে। এটা যেন ফিলিস্তিনি কবিদের ভবিতব্য যে তাদেরকে অস্বাভাবিক, অমানবিক অবস্থার শিকার হতেই হবে, যা তাদের বাধ্য করে আবেগময়, উত্তেজক কবিতা লিখতে, কারণ যারা বেঁচে আছে আশার ওপর ভর করে তাদেরকে যোগাতে হয় আশা- প্রতিরোধের জন্য আশা। এভাবে ইবরাহিম তুক্কান, অল্প বয়সেই মারা গেছেন তিনি, অনেককে অবাক করে দিয়ে কবিতা লিখেছেন প্রেম এবং জীবনের সৌন্দর্য নিয়ে, ঠিক তার ‘দেশপ্রেমমূলক’ কবিতার সমান্তরালে।
সকল কৃষিজীবী সমাজে যা হয়, ফিলিস্তিনি জাতীয় সংস্কৃতিতেও তেমনি কবিতা মূল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, ইসরাইলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত। যে সামান্য কয়টি নাটক বা আখ্যানের পা-ুলিপি এখনো টিকে আছে, সেগুলো শিক্ষামূলক, তাতে হয় জায়নবাদীদের কাছে জমি বিক্রি না করার জন্য অনুপ্রাণিত করা হয়েছে, না হয় আরবের অতীত গৌরবের স্মৃতিচারণ করা হয়েছে। কিন্তু বাগদাদ, বৈরুত এবং দামেস্ক-র মতো আরব শহরগুলোয় কয়েকজন সুশিক্ষিত এবং সংস্কৃতিবান ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব উপন্যাসের বিকাশে অবদান রাখে, কবিতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে খর্ব না করেই। উপন্যাসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান আসে জাবরা ইবরাহিম জাবরার কাছ থেকে। তিনি তার প্রথম উপন্যাস এ স্ক্রিম ইন এ লং নাইট লেখেন ১৯৪৮ সালে, পরে, ফিলিস্তিন থেকে পালিয়ে বাগদাদে যাওয়ার পর, এটি প্রকাশের মুখ দেখে। ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট এই ঔপন্যাসিক আরব ঔপন্যাসিকদের মধ্যে অগ্রগামী হিসেবে আবির্ভূত হন একের পর এক উপন্যাস প্রকাশ করে, বিশেষত তার বিখ্যাত উপন্যাস আস-সাফিনা লিখে। এই উপন্যাসটি আরবি কথাসাহিত্যকে অভূতপূর্ব আধুনিকতা এবং নতুনত্বের পথ দেখায়। তিনি ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, সমালোচক, অনুবাদক এবং ছোটগল্পকার। তার পাশাপাশি আবির্ভূত হন আরেক প্রবাদপুরুষ গাস্সান কানাফানি (১৯৩৬-১৯৭২)। তিনি সৃজনশীল লেখালেখিকে বিভিন্ন আঙ্গিকে যুক্ত করেন উদ্দেশ্যবাদী রাজনীতির সঙ্গে। শুরুতে কানাফানি পরিচিত হয়ে ওঠেন ঔপন্যাসিক হিসেবে, বিশেষত তার বিখ্যাত উপন্যাস মেন ইন দ্য সান-এর জন্য, কিন্তু তার ছোটগল্প অধিকতর সৃজনশীল এবং উন্নত। সন্দেহ নেই, বিংশ শতাব্দীর আরবি ছোটগল্পের প্রধান শিল্পীপুরুষদের অন্যতম তিনি। তার সঙ্গে তুলনীয় আরেক ফিলিস্তিনি ছোটগল্প লেখিকা সামিরা আজম। তার ছোটগল্প চর্চার শুরু ফিলিস্তিনে, এবং ১৯৬৭ সালে অপ্রত্যাশিত মৃত্যু পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল। তৃতীয় প্রধান ব্যক্তিত্ব, এমিলি হাবিবি, ফিলিস্তিনি-আরব কথাসাহিত্যের অগ্রনায়কদের শেষ পুরুষ। তার সিক্স ডেজ সেক্সটেট এবং দ্য স্ট্রেঞ্জ সারকামস্ট্যান্সেস সারাউন্ডিং দ্য ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স অফ সায়িদ আবি নাহাস, দ্য পেস্অপটিমিস্ট হচ্ছে বিখ্যাত দু’টি রচনা। এগুলো লেখা হয় ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে আরবদের পরাজয়ের সময়, নিজভূমে ‘শরণার্থী’ হওয়া ফিলিস্তিনিদের অভিজ্ঞতা এতে বর্ণিত হয়েছে।
উপন্যাস এবং ছোটগল্পও, ‘নিপীড়িতদের সাহিত্য’কে উপস্থাপন করে, হতাশদের মনে আশার সঞ্চার করতে। এই বৈশিষ্ট্যকে উপন্যাসের তিনটি মৌলিক লক্ষ্মণ এবং মাত্রার মাপকাঠিতে বিবেচনা করা যায়। প্রথমত, এতে রয়েছে হৃত বাসভূমির অতিকল্পিত সৌন্দর্যায়ন, ‘পুরনো ফিলিস্তিন’কে পৃথিবীর অবিকল্প স্বর্গ হিসেবে প্রদর্শন এবং পবিত্র মাতৃভূমির ভাবমর্যাদা উপস্থাপনে ফিলিস্তিনিদের উদ্বুদ্ধকরণ। যেমন, প্রত্যাশিতরূপে, জাবরা যিশুখ্রিষ্ট এবং মুসাকে ফিলিস্তিনি মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যা তিনি নিজেও। কানাফানি ‘মানবীয় ইচ্ছার সৌন্দর্য’ এবং ‘সুপারম্যানের মিথ’ থেকে সেচে বের করেছেন খাঁটি ফিলিস্তিনিকে।
দ্বিতীয় মাত্রাটির উদ্ভব প্রথমটি থেকে, সেটা হলো স্বপ্নের চলমানতা ও ব্যাপ্তির আখ্যান- শুরু হতে ভবিষ্যৎ পর্যন্ত ব্যাপ্তির ছবি, যা আধুনিক, কিন্তু অতীতেরই চিত্র: আসল পুরনো ফিলিস্তিন, যা ছিল আশীর্বাদপুষ্ট, সেটা তার সকল পবিত্রতাসমেত ফিরে আসবে ভবিষ্যতে এবং অতীতের মতোই সুখী ও সমৃদ্ধ হবে, এই স্বপ্নের ব্যাপ্তি প্রসারিত হয় অনাগত ভবিষ্যতের মধ্যে।
ফিলিস্তিনি উপন্যাসের তৃতীয় মাত্রাটি ওপরের দু’টি বিষয়ের যোগফল। এর প্রকাশ দেশত্যাগ এবং আশ্রয়সন্ধানের গুরুত্বের প্রেক্ষাপটে- এটা দারুণ ক্লেশের একটা অসুস্থ সময় যা ফিলিস্তিনিদের তেজস্বিতার পরীক্ষা নেয়, এবং তারপর ঘোষণা করে তার আসন্ন বিজয়। এই পুরো ধারণাটির সুস্পষ্ট সূচনা, স্বাভাবিক ভাবেই, বোধগম্যরূপেই, পতনের কালে, অর্থাৎ নাকবার সময় থেকে। তারপর সময় আসে ক্ষতি এবং ভোগান্তির, যা শেষ পর্যন্ত পরিণতি পায় নি®কৃতি এবং নির্বাসন ও বিচ্ছিন্নতার মোকাবেলার কালে। সংগ্রাম, অথবা ইচ্ছাশক্তি, প্রথম এবং শেষ মেয়াদের মধ্যবর্তীর ভূমিকা পালন করে। নির্বাসিত লেখকরা যখন অতিরিক্ত ‘ধর্মীয় আশাবাদে’ আস্থাশীল, যা তাদের অতীত এবং বর্তমানকে একসূত্রে গাঁথতে সাহায্য করে, তখন ইসরাইলি দখলদারিত্বের মধ্যে বসবাসকারীরা, যেমন এমিলি হাবিবি, পছন্দ করেন সবচেয়ে কুৎসিত ব্যঙ্গ, যা অতীতের জন্য কাতর কিন্তু একই সঙ্গে ফিসফিস করে বলে, অতীত আর ফিরছে না।
দেশ হারানোর প্রেক্ষাপটে কবিতা একটা নতুন ধারাবাহিকতা লাভ করে, যা, ১৯৬৭ সালের জুন পরাজয়ের পর, গাস্সান কানাফানি কথিত ‘প্রতিরোধের কবিতা’র রূপ নেয়। এখানে উল্লিখিত হবার দাবিদার অনেকের মধ্যে তওফিক জাইয়াদ, সামিহ আল-ক্কাসিম, এবং মাহমুদ দারবিশ-এর নাম বলতেই হয়, বিশেষত দারবিশ অনেকগুলো ধারাবাহিক প্রবর্তনা আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। ১৯৬৫ সালে ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) গঠন এবং সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হওয়ার সঙ্গে এক নতুন প্রজন্মের কবিদের আবির্ভাব ঘটে, সৃষ্টির সংখ্যা এবং শিল্পমান উভয় বিচারেই এরা বিশিষ্ট। এই প্রজন্মের তালিকায় রয়েছেন ইজ্জাদ্দিন আল-মানাস্রাহ, মুরিদ আল-বারগুতি, আহমেদ দাহবুর, ইবরাহিম নাসরাল্লাহ, প্রমুখ। এদের সঙ্গে রয়েছেন মুঈন বাসিসু, তিনি তার কাব্যচিন্তার দিক থেকে একাধিক প্রজন্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং কবিতাকে আবিষ্কার করেন ‘ভবিষ্যৎ’ এবং ‘ফিলিস্তিন’-এর সম্পৃক্ততার মধ্যে।
ক্কাসিদায় এমন কিছু দুর্লভ নয় যা নেই উত্তেজনায় ব্যথাতুর উপন্যাসগুলোয়, এমনকি তখনও, যখন কোনো কোনো কবি কখনো কখনো ‘আদর্শ’কে পাশে সরিয়ে রাখেন আত্মার মানবীয় পরিস্থিতির প্রসঙ্গে কবিতার অর্থ অনুধাবন করার মানসে, যেমন মুরিদ আল-বারগুতি, এবং সাম্প্রতিক গাস্সান জাক্কতান। যদিও ফিলিস্তিনি কবিরা আরবি কবিতার আধুনিকায়নে উল্লেখযোগ্য শ্রম নিয়োজন করেছেন, তবু মাহমুদ দারবিশই, সামগ্রিকভাবে আরবি, এবং বিশেষভাবে ফিলিস্তিনি কাব্যজগতে, বিশিষ্ট সৃজনশীল কণ্ঠস্বর- যিনি ‘নিপীড়িত’দের অভিজ্ঞতাকে কালাতিক্রমী করে তোলেন। একইভাবে, দারবিশের কবিতা মানবিক সংস্কৃতির ধারাবাহিকতাকে তার সমগ্রতাসহ পঠনের মধ্য দিয়ে একটি ‘আরবি ক্কাসিদা’ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে, যা পরিণত হয় ‘সর্বজনীন ক্কাসিদা’য়, এখানে সর্বজনীন কবিতাকে কথোপকথনের মধ্যে ব্যাপৃত করা হয় এবং আবিষ্কার করা হয় একটা নতুন সৌন্দর্যচেতনা। সে কারণে ‘দারবিশকে রিট্সস, এলুয়ের, এবং রেনি চর-এর কবিতার আলোকে পড়া চলবে না,’ বরং তাঁকে পাঠ করতে হবে ঐসব কবিদের পাশাপাশি, সর্বজনীন এবং ‘প্রাচীন-নতুন’ ক্কাসিদার আলোকে, যেগুলো সৃষ্টি করতে সাহায্য করেছেন তারা সবাই।
জাবরা, কানাফানি এবং হাবিবি তাদের সাহিত্যকর্ম সম্পাদন করেছেন একই সময়ে পিএলও-র সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এবং দূরত্ব বজায় রেখে। জাবরা ছিলেন উদার, এবং উদারনীতির প্রতি অনুগত থেকেছেন। কানাফানি ছিলেন মার্ক্সবাদী এবং জাতীয়তাবাদী, আর হাবিবি কমিউনিস্ট। এই তিনজনের প্রত্যেকেই তাদের নিজস্ব ধরনের সাহিত্য রচনা করেছেন, স্বাধীনতার দাবিতে এবং স্বাধীন লেখার অনুশীলনের দাবিতে। এই কারণে তাদের সাহিত্য পিএলও কর্তৃক বিকশিত ও লালিত ‘উদ্দীপনার নতুন সাহিত্য’ ধারার কবি ও কথাকার ইয়াহ্ইয়া ইয়াখ্লুফ, তওফিক ফায়্যাদ, রাশাদ আবু শাওয়ার প্রমুখ থেকে আলাদা। এই ধারার লেখকদের রচনার বৈশিষ্ট্য হলো দরিদ্র, বিশেষ করে শরণার্থী শিবিরে বসবাসকারী, ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। উদাহরণ হিসেবে ইয়াহ্ইয়া ইয়াখ্লুফ-এর উপন্যাস এ্যাপল্স অব দ্য ক্রেইজ্ড এবং রাশাদ আবু শাওয়ার-এর উপন্যাস দ্য লার্ভাস-এর নাম উল্লেখ করা যায়। শরণার্থী শিবিরের প্রেক্ষাপটে লেখা এ দুটি চমৎকার উপন্যাসে খুবই দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগের কথা। এটা স্বাভাবিক যে এই ধরনের সাহিত্য হয়ে ওঠে সশস্ত্র যুদ্ধের জীবন্ত এবং চলমান সামাজিক দলিল, এবং বিশ্বাসের চরম পরাকাষ্ঠায় পৌঁছার জন্য প্রয়োজনীয় আশাবাদ তৈরির হাতিয়ার।
বিকাশের শুরুতে ফিলিস্তিনি কবিতার ক্ষেত্রে যেমন হয়েছে- আদর্শবাদের গদ্যায়নের চাপ হালকা করার চেষ্টা, উদাহরণ আল-বারগুতি-র সাইডওয়াক ক্কাসিদাজ, উপন্যাস এবং সমধর্মী অন্যান্য প্রকরণের ক্ষেত্রেও একই রকম প্রয়াস লক্ষ্যযোগ্য। তবে লিয়ানা বদর কিংবা ফারুক ওয়াদি সাহিত্যকে বিবেচনা করেছেন ভাষার প্রথম এবং সর্বোচ্চ অনুশীলন হিসেবে, তাদের এই বিশিষ্ট সৌন্দর্যচেতনা সব সময় দেশপ্রেম বা জাতীয় আকাক্সক্ষার মধ্যে দিয়ে উৎসারিত হয় না।
ফিলিস্তিনি সাহিত্যে বিশিষ্ট অবদানের জন্য শহর খলিফার নাম প্রতিনিধিস্থানীয়। কবিতা যখন প্রত্যক্ষ করছে ফাদওয়া তুক্কান-এর মতো প্রধান নারী কণ্ঠস্বর, ছোটগল্পে তখন সামিরা আজাম, এবং উপন্যাসে শহর খলিফা নারীবাদী উচ্চারণ বা নারীর সরব উপস্থিতিকে, কথাসাহিত্যে, করছেন বিশেষভাবে উচ্চকিত, তাদের বিভিন্ন প্রকৃতির রচনা পাঠকদের উপহার দেয়ার মধ্য দিয়ে। খলিফা ইসরাইলি দখলদারিত্বের সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী ফিলিস্তিনি সমাজের পুরুষতন্ত্রেরও সমালোচনা করেন এমন এক বিতর্কিত আঙ্গিকে যে, তা যেন ঘোষণা করে- নারীর মুক্তি জাতীয় মুক্তির প্রয়োজনীয় প্রথম ধাপ।
‘১৯৮২-র পতন’-এর প্রেক্ষাপটে পিএলও-র বৈরুত ত্যাগ ফিলিস্তিনি উপন্যাস, এবং সাধারণভাবে সৃজনশীল সাহিত্যকে, প্রকৃত অর্থেই, ফেলে দেয় বিভ্রান্তি এবং বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে। ততদিনে কানাফানি গত হয়েছেন, আর জাবরা এবং হাবিবি বয়োবৃদ্ধ। কবিরা কবিতা সৃষ্টির ‘সাহিত্যিক যোগ্যতা’ ছাড়া আর কিছুই বাকি রাখেননি। এই কালপ্রেক্ষিতে, জর্দানে জন্মগ্রহণকারী এবং সেখানেই বসবাসরত ফিলিস্তিনি কবি ইবরাহিম নাসরাল্লাহ লিখলেন তার চমৎকার উপন্যাস ডেজার্ট ফিভার, এবং তারও পরে আরো কয়েকটি উপন্যাস। তার অব্যাহত প্রয়াস ছিল, তার নিজের ভাষায়, ‘ফিলিস্তিনি কমেডি’-র আঙ্গিক প্রতিষ্ঠা করা। হুসেইন আল-বারগুতি, সম্প্রতি মৃত, ফিলিস্তিনি সাহিত্যের গদ্য-জগতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। সিয়াটল ইউনিভার্সিটির এই মেধাবী ছাত্র ও সংস্কৃতিবান ব্যক্তিত্বের আত্মজীবনী দু’টি পরস্পরসংযুক্ত গ্রন্থের জন্ম দিয়েছে- দ্য গ্রিন লাইট এবং আই উইল বি এমিড্স্ট দ্য এ্যালমন্ড ট্রিজ। এই বই দু’টিতে জনপ্রিয় শ্রুতি-স্মৃতি এবং শিশু-কিশোরদের জন্য রচিত গল্পের মধ্যে দিয়ে জাগরূক ফিলিস্তিনের কথা বলা হয়েছে, বিবৃত করা হয়েছে ‘স্বজনহারানোর ফিলিস্তিন’ এবং ইসরাইল বসতিস্থাপনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের পরস্পর বিচ্ছিন্ন, দেশান্তরিত, নির্বাসিত ও সম্বলহীন হওয়ার কথা।
তাহলে বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে ১৯৮২-তে পিএলও-র বৈরুত ছাড়ার পূর্ব পর্যন্ত কাল-পর্যায়ে ফিলিস্তিনি সাহিত্যচর্চা তার বিকাশ-যাত্রার মধ্যে দিয়ে কী প্রধান বিষয়-চিন্তা বহন করেছে? এবং কিসব রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে? প্রথম পর্যায়ে, ১৯৪৮-এর নাকবাহ দেশান্তর পর্যন্ত কাল পরিসরে, ফিলিস্তিনি বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় তাদের আলোকিত চেতনার দ্বারা সমাজকে মুক্ত করতে চেয়েছেন অজ্ঞতা, নিয়তিবাদিতা এবং বিচ্ছিন্নতা থেকে, উৎসাহিত করেছেন আধুনিকায়নকে। আর দ্বিতীয় পর্যায়ে, দেশত্যাগের বছর থেকে পিএলও-র জন্ম পর্যন্ত কালে, জাবরা, কানাফানি, সামিরা আজাম-এর মতো লেখকরা ফিলিস্তিনি জনগণের শিক্ষার কথা বলেছেন, এবং ইসরাইল রাষ্ট্রের সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের সাংস্কৃতিক সংঘর্ষের তাৎপর্যকে গভীরভাবে অনুধ্যান ও তার সম্পর্কে তাদের সচেতন করে তুলতে চেয়েছেন। আর তৃতীয় পর্যায়ে, সশস্ত্র সংঘর্ষের সময়, এটা পূর্ণরূপে জড়িয়ে পড়ে মুক্তিতন্ত্র, খাঁটি আদর্শবাদী এবং বিমূর্ত মূল্যবোধের সঙ্গে: সে হলো ‘ফিদাই’, বা মুক্তিযোদ্ধা; রাইফেল; বিজয়। ফিলিস্তিনি সাহিত্য, সশস্ত্র সংগ্রামের আগে, ফিলিস্তিনে প্রত্যাবর্তনকে একটা রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রকল্প হিসেবে বিবেচনা করত। এর বিপরীতে, সশস্ত্র সংগ্রাম-পরবর্তী সাহিত্য সংস্কৃতিকে মৌলিকভাবেই পাশে ঠেলে দিয়েছে এবং আবেগপ্রবণ আশাবাদী স্লোগানকে আলিঙ্গন করেছে। বৈরুত থেকে প্রস্থানের পর এই ধরনের সাহিত্যে অবাক হওয়ার মতো কিছু পাওয়া যায় না।
১৯৮৯ এবং ২০০২-এর প্রথম ও দ্বিতীয় ইন্তিফাদা-র পরে, ফিলিস্তিনিরা ভিন্ন রকম সাহিত্য রচনা করতে শুরু করেন- জীবন্ত বাস্তবতাকে প্রস্থানবিন্দু হিসেবে গ্রহণ, এবং ‘স্বপ্ন’ ও ‘বাস্তবতা’কে পৃথকভাবে শনাক্ত করার মধ্য দিয়ে। এই সাহিত্য গড়ে ওঠে ভিন্ন ভিন্ন প্রজন্মের হাতে, আর এর বৈশিষ্ট্যসমূহ অধিকতর সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে তথাকথিত ‘শান্তি প্রক্রিয়া’র করুণ ব্যর্থতার পর। এই নতুন পরিস্থিতিকে ভাষা দান করেন মাহমুদ দারবিশ তার কবিতা (দিওয়ান) ‘স্টেট অব সিজ ২০০২’-এ। এতে কবি অবরোধ এবং সঙ্কীর্ণ বন্দিশালায় যাপিত জীবনের একটি দিনের বর্ণনা দিয়েছেন। মেধাবী গল্পকার মাহমুদ শুক্কাইরও একই কাজ করেছেন। তাঁর লেখালেখির শুরু চার দশক আগে, তিনি প্রতিদিনকার স্বজনবিচ্ছেদের যন্ত্রণাকে ভাষাতাত্ত্বিক অভিজ্ঞতায় পরিণত করেন যা কবিতা এবং গদ্য উভয়কেই স্বীকার এবং সূত্রবদ্ধ করে। একই ধারার দু’জন কবি-ঔপন্যাসিক জাকারিয়া মুহাম্মাদ এবং গাস্সান জাক্কতান। এছাড়া রয়েছেন তরুণ ঔপন্যাসিক আদানিয়া শিবলি, এবং ইসরাইলি নেসেট-এর সদস্য আজমি বিশারা, যার বিখ্যাত দুটি উপন্যাস দ্য চেকপয়েন্ট এবং লাভ ইন দ্য রিজিয়ন অব শ্যাডোজ। সম্ভবত দ্য চেকপয়েন্ট একটা প্রতিনিধিস্থানীয় রচনা যেখানে ফিলিস্তিনিদের দৈনন্দিন জীবন সবচেয়ে বোধগম্য প্রয়াসে চিত্রিত হয়েছে, যে জীবনের অর্থ হলো অনিঃশেষ, আঁকাবাঁকা, একের পর এক চেকপয়েন্টের মধ্য দিয়ে পথ বের করার চিরকালীন সংগ্রাম।
এইসব, এবং অন্যান্য আরো সব, লেখাকে তিনটি বৈশিষ্ট্য দ্বারা চিহ্নিত করা যায়: এক, প্রতিনিধি পর্যায়ের জীবনকে, তা যে রকম যাপিত, অনাবৃত এবং নিরলঙ্কার, ঠিক সেইভাবে, তার পূর্ণ অনুপুঙ্খসহ, বর্ণনা করার কাজে সকল প্রয়াসকে সীমাবদ্ধ রাখা, যা কোনো আশাবাদী বা নৈরাশ্যবাদী আদর্শ এবং ইচ্ছা-তাড়িত চিন্তা দ্বারা প্রাণিত নয়; দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো, বিবর্ণ দৈনন্দিনতার মধ্যে শেকড়বদ্ধ হয়ে থাকা, এ তাদের চরিত্রসমূহের জীবনের ভেতর ও বাইরের দৈনন্দিনতা, যা প্রায় দুঃস্বপ্নের মতো, যার সঙ্গে কোনো সংযোগ-সূত্র নেই কোনো নিকট অথবা দূর ভবিষ্যতের; এবং তৃতীয়ত, যে কোনো নিশ্চয়তার বিলোপ ঘটিয়ে তার জায়গায় প্রতিস্থাপন করা সন্দেহ এবং সম্ভাবনা ও আকাক্সক্ষাহীন প্রতীক্ষাকে।
একেবারে সাম্প্রতিক লেখক, যেমন কবি হালা শুরুফ (জন্ম ১৯৭৮ সাল), এদের লেখায় ‘ফিলিস্তিনি জাতীয় কর্তৃপক্ষ’র অধীনস্থ পশ্চিম তীর ও গাজা এলাকায় বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের পরিস্থিতি উঠে আসছে যা ‘প্রতিবিম্বিত করে অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনি অস্তিত্বের বহুমুখী করুণ দিগ¦লয়কে: বঞ্চনা, অভিভাবকহীনতার অনুভূতি, ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতি, ন্যূনতম, ছোট ছোট আকাক্সক্ষা থেকেও বিচ্ছেদ, সূক্ষ্ম দৈনন্দিন বিষয়গুলোকেও বড় বড় স্বপ্নে পরিণত করা…।’ এইসব লেখার সবগুলোতেই ‘খোলা মাঠে দরিদ্র শিশু’র কথা আছে, কখনো কখনো প্রবোধ খোঁজার আশায়। এ যেন এমন একটা অসুস্থ শিশু, যে তার জীবনের ঝুঁকিকে লুকিয়ে রেখেছে অভিজ্ঞ দিগি¦জয়ী বীরের দৃঢ়সঙ্কল্প নিয়ে, কালব্যাপী- ১৯৪৮-এর ট্র্যাজেডি থেকে শুরু করে আজকের দিন পর্যন্ত।
ফিলিস্তিনি সাহিত্য শিল্পের আধুনিক ও বৈশ্বিক প্রকরণকে আত্মসাৎ করেই বিকশিত হয়েছে, কিন্তু অর্জন করেছে নিজস্ব চারিত্র্য। নিজস্ব অভিজ্ঞতার রূপায়ন প্রচেষ্টা তাকে শক্ত ভিত্তিমূল সরবরাহ করেছে, অনন্য চারিত্র্য দিয়েছে, টলস্টয়ের কথা ধার করে বলা যায়, যা একেবারেই, অবিকল্পরূপে, তাদেরই মতো। কারণ ফিলিস্তিনিদের অভিজ্ঞতা আর কারো মতো নয়, পূর্ণতঃই তাদের নিজস্ব ধরনের। তাদের সাহিত্যের রূপ ও রূপান্তর এই নিজস্বতাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে।