মেহেরপুরে এসডিও তৌফিক এলাহী চৌধুরীর নির্দেশে আমরা যেদিন গাছ কেটে রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করি সেদিনও মন্টু আমাদের সঙ্গেই ছিল। সঙ্গে ছিল মানে আমরা কেউ ডেকে সঙ্গে নিয়ে আসিনি। সে নিজেই এসে হাজির। জয়নালের চাচা হান্নান মাস্টার আওয়ামী লীগ নেতা, তার ডাকে আমরা সবাই পাকা রাস্তার কাছে এসে দাঁড়াতেই এসডিও সাহেব সংক্ষেপে মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কের গুরুত্ব বুঝিয়ে বলেন এবং দু’পাশের গাছ কেটে রাস্তায় ফেলে মিলিটারিদের কিভাবে প্রতিরোধ করতে হবে তার ব্যাখ্যা দিয়ে জিপে উঠে চলে যান। এরপর একযোগে শুরু হয় গাছ কাটা অভিযান।
গাছ কাটার খটখট শব্দ কানের দরজায় এসে আছড়ে পড়ে। তবু এরই ফাঁকে ফাঁকে টুকিটাকি মন্তব্য ছিঁটকে বেরোয়-যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে আর্মি বেরিয়ে পড়েছে, ঝিনেদা হয়ে এই পথে চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরে ঢুকবে। এদিকে হারুন মুন্সি বিজ্ঞের মতো আচনক এক তথ্য ফাটায়-আর্মি আসবে কুষ্টিয়া হয়ে। তার বলার ভঙ্গিটা এমনই নিশ্চিত যে কেউ কেউ তার দিকে ফিরে তাকাতে বাধ্য হয়। কুষ্টিয়া জজকোর্টের মুহুরি সে, দৈনন্দিন যাতায়াত, এক সময় সবার কথাই তলিয়ে যায়। থেকে থেকে জেগে ওঠে কেবল ‘জয় বাংলা’ হুঙ্কার। কুড়াল বা দায়ের প্রতিটি কোপের সঙ্গে ওই ধ্বনি মিশে অন্য রকম উন্মাদনা সৃষ্টি করেছে। গোড়া কাটা বড় কোনো গাছ যখন রাস্তার উপরে হুড়মুড়িয়ে পড়েছে, তখন রাতের আঁধার চিরে মিলিত কণ্ঠে আছড়ে পড়েছে ওই কোরাস। দক্ষিণপাড়ার তফেল ঘরামির মনে অন্য রকম আনন্দের খই ফোটে, এবার সে টের পেয়েছে এক যাত্রায় দুই ফল ফলে কী করে। রাস্তার পাশের সরকারি গাছের ডাল কাটার অপরাধে সদ্য দু’মাস জেল খেটে বেরিয়েছে সে, এখন স্বয়ং এসডিও সাহেবের হুকুমে গাছ কাটতে গিয়ে যেন মনে মনে তারই বদলা নেয়। কুড়ালে কুপিয়ে চলেছে গাছের গোড়া, তফেল ঘরামির পাশে দাঁড়িয়ে দা হাতে করে বাহাদুরি ভাঁজছে মন্টু। কাজের চেয়ে ওর কথার চট্পটানি বেশি। মুখে বকবকানির অন্ত নেই। জয়নাল এক সময় চেপে ধরে,
কী রে মন্টু, তুই?
হ্যাঁ, আমি। চাইলি আলাম।
এভাবেই চলে আসে মন্টু। আমরা কেউ ডাকি না। তবু খেলার মাঠে, ক্লাবের নাটকে ঠিকই সময়মতো হাজির হয়ে যায়। কারো ডাকের অপেক্ষা করে না। কী এক কঠিন অসুখে ওর ডান পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ সরু হয়ে গেছে শৈশবে। খোঁড়া, লুলা, ল্যাংড়া বলে আমরা ঠাট্টা করি। ও গায়ে মাখে না। কারো উপরে বিশেষ মান-অভিমানও নেই। আমরা না ডাকলেও যথাসময়ে সব কিছুর মধ্যে মাথা গলিয়ে দেয়া ওর স্বভাব। তাই বলে এই গাছ কাটার ডামাডোলেও। আমি এগিয়ে যাই, জিজ্ঞেস করি তোর মামু যদি জানতে পারে?
ওর মামা বিলাত মুন্সিকে ওর সাংঘাতিক ভয়। বাপ-মা নেই, থাকে এই মামা বাড়ি। বিলাত মুন্সি কড়া মেজাজের লোক। জয় বাংলা নিয়ে দেশে যা শুরু হয়েছে, এসব তার দুচোখের বিষ। মন্টুর এই মাতামাতির খবর পেলে যে মারাত্মক পরিণতি হবে সে আমরা জানি। কিন্তু মন্টুই উল্টোপাল্টা চোট দেখায় আমাদের উপরে, বেশ মেজাজে মেজাজে বলে,
– জানুক জানুক। তোরা তোদের কাজ কর।
এতদিন পরে, সেই মন্টু রাজাকার হয়েছে শুনে আমরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। আমাদের গ্রামের উত্তরপাড়ার হাতেম ফারাজির ছেলে মুকু, পুকুরপাড়ার উছু, বোয়ালমারির নওশাদ মকছেদ, সাত্তার, বারি রাজাকার হয়েছে তাতে অবাক হইনি। গ্রামের ম-ল-মাতুব্বরদের চাপে এবং খানিকটা পেটের দায়ে তারা রাজাকারের খাতায় নাম লিখিয়েছে। এই দুর্যোগের সময়ে দু’পয়সা রোজগারের নিশ্চয়তা পেয়েছে, শোনা যায় ওরা ভালোই আছে। কিন্তু আমাদের মন্টু? কিসের অভাবে রাজাকার হলো মন্টু? ওর তো খাওয়া-পরার চিন্তা নেই। তাছাড়া ওকে চাপ দেবারইবা কে আছে? ওর মামা বিলাত মুন্সি হয়েছে শান্তি কমিটির মাথা, এখন তার কথার উপরে কথা বলার তো কেউ নেই! তাহলে? এমন অঘটন ঘটল কী করে? সত্যিই আমাদের মন্টু রাজাকার হয়েছে? মন্টুই তো, নাকি মন্টুর মতো অন্য কেউ?
নাসির এবং রাজ্জাক সংশয়ের কালো মেঘ সরিয়ে দু’জনেই অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে জানায় তারা খুব ভালো করে দেখে এসেছে বোয়ালমারি ব্রিজ পাহারা দিচ্ছে যে রাজাকারের দল, তার মধ্যে মন্টুও আছে, এটা নিশ্চিত। ওই ব্রিজ উড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব নিয়ে গিয়েছিল ওরা, রেকি করে ফিরে এসেছে, আবারও যাবে। এবার ফাইনাল। কিন্তু সত্যিই রাজাকার হয়েছে মন্টু? ওর পক্ষে আদৌ সেটা সম্ভব? ওই শরীরে? নাসির চূড়ান্ত ভাবেই শনাক্ত করে-হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি তাকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখেছি। সে ওই মন্টুই। একেবারে খোঁড়া মানুষের মতো মন্টু যে সম্পূর্ণ খুঁড়িয়ে হাঁটে, এমনও নয়। ততোটা বিকলাঙ্গও নয়। ডান পায়ে জোর পায় না ঠিক মতো। বাম পায়ের সাথে সমান তালে ওঠানামা করে না। সামান্য দেরি হয়ে যায় স্টেপ ফেলতে। সামান্যই। মন্টু আপ্রাণ চেষ্টা করে এই ত্রুটিটুকু ঢেকে রাখতে। কিন্তু নাসির রাজ্জাক কিংবা আমাদের বন্ধুদের ফাঁকি দেবে কী করে! ওর হাঁটা চলার ওই বিশেষ ভঙ্গিটুকুর সঙ্গে আমাদের পরিচয় বলতে গেলে আশৈশব। ওকে ক্ষেপিয়ে উত্ত্যক্ত করার প্রধান পুঁজিই হচ্ছে ওই শারীরিক অক্ষমতাটুকু। এ রকম অক্ষম শরীরের ওকে রাজাকারে নিলো!
ভাবনার এই জায়গায় এসে আমি ভীষণ ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ি, তার যোগ্যতাকে আমরাই কি তবে চিনতে পারিনি! শরীরের ওই ত্রুটিটুকুকে ওর অক্ষমতা এবং অযোগ্যতা ভেবে আমাদের সকল আনন্দ কোলাহল থেকে দূরে ঠেলে রাখতে চেয়েছি চিরদিন। শোনেনি মন্টু। বাধা মানেনি। খোঁড়াতে খোঁড়াতেই হাজির হয়েছে সব কিছুতে। বরং আমাদের আপত্তির কারণে কদাচিৎ কোনো কাজে ও না এলে আমাদেরই খারাপ লেগেছে পরে। গালি দিয়েছে। জড়িয়ে ধরেছে। আবার একাকার হয়ে গেছি। মাঝখানে এই মুক্তিযুদ্ধটা এসে আমাদের বিচ্ছিন্ন করে দিলো, কেমন যেন অচেনা করে দিলো।
মন্টু তো আমাদের বন্ধুই বটে। বয়সে বছর দুই-তিনের বড়। গ্রামে অমন দু’বছরের সামনে এবং পেছনে ধরেই বন্ধুত্ব হয়। তা ছাড়া লেখাপড়াতেও আমরা অনেকেই ওকে ধরে ফেলেছি সেই নাইন-টেনে থাকতেই। সেই অর্থে মন্টু আমাদের সহপাঠীও। আমরাই কেউ কেউ তাকে স্কুলের গ-িতে ফেলে রেখে গত বছর কলেজে চলে এসেছি। আমাদের এই চলে আসা নিয়েও ওর কোনো ক্ষোভ নেই। বরং গভীর উৎসাহে জানতে চায়-কলেজে নাকি ছেলে-মেয়েতে খোলামেলা বন্ধুত্ব হয়! তোমাদের হয়েছে? হয়নি এখনো? ও হয়ে যাবে ঠিকই। নারীজাতি নিয়ে মন্টুর কৌতূহলের অন্ত নেই। এ প্রসঙ্গ নিয়ে প্রতিদিনই ইনিয়েবিনিয়ে কথা বলা চাই। সমস্যা হয়েছে ওর মামাতো বোন সুফিয়াকে নিয়ে। সেও আগামী বছর ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবে। এবারও যদি মন্টুর পাস না জোটে! সুফিয়াকে অবশ্য ম্যাট্রিক পাস করানোর বিশেষ কোনো আগ্রহ নেই বিলাত মুন্সির। বিয়ের কথাবার্তা চলছে। হয়েও যেতে পারে যে কোনো দিন। কিন্তু সমস্যার এ রকম সমাধানও মন্টু কিছুতেই চায় না। এরই মাঝে যুদ্ধ এসে গেল। তারপর সব কিছুতেই টালমাটাল, সব হিসাব নিকাশেই গোলমাল। এতদিনে সুফিয়ার বিয়ে হয়ে গেছে কি না কে জানে!
সে খবরও জানা গেল রাজ্জাকের কাছে! কোথায় নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছিল সুফিয়ার। দিনক্ষণ পর্যন্ত পাকা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সুফিয়া রাজি হয়নি সে বিয়েতে। গায়ে-হলুদের দিন আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়ে গেলে নিশুতিরাতে গলায় দড়ি দিয়ে সে আত্মহত্যা করেছে। পরদিন সকাল থেকেই নাকি বোয়ালমারি স্কুলের সিরাজ বিএসসিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সুফিয়াকে প্রাইভেট পড়াতেন সিরাজ স্যার, এর অধিক সম্পর্কের কথা আমাদের জানা ছিল না। রাজ্জাক জেনে এসেছে, সম্পর্ক মানে তলে তলে গভীর প্রণয় ছিল। বিলাত মুন্সি সেটা টের পাবার পর লোক লাগিয়ে গুম করে দিয়েছে সিরাজ মাস্টারকে। গ্রামের কেউ কেউ গলা খাটো করে বলাবলি করে, সে নাকি মুক্তিযুদ্ধে গেছে। রাজ্জাকের ধারণা-এটাও স্রেফ বিলাত মুন্সির রটনা। এপারে শরণার্থী শিবির কিংবা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প-কোথাও পরিচিত কেউ তাকে দেখেনি। তাহলে কি লোকটাকে সত্যি সরিয়ে দিলো। সিরাজ মাস্টারের ঘোড়েল চেহারার পাশাপাশি মন্টুর মুখটাও ভেসে ওঠে আমার চোখে। সুফিয়াকে হয়তো মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনি কোনোদিন, কিন্তু তার বুকের গভীরে সুফিয়ার জন্য ভালোবাসা ছিল বাতাবিলেবু ফুলের মতো মিষ্টি সুবাসে ভরা, শুভ্রতায় ঢাকা। তবে কি ব্যর্থ প্রেমের হাহাকারই তাকে রাজাকার বানিয়েছে। আমার ভাবনা হয়, তাহলে সে সাধ করেই নিজেকে এভাবে ধ্বংসের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে?
নাসিরও সেই অনিবার্য ধ্বংসের কথাই উচ্চারণ করে, তবে ভিন্ন মাত্রায়। সে জানায়, বোয়ালমারি ব্রিজের যে পজিশনে মন্টুর অবস্থান, তাতে ওকে রক্ষা করা যাবে না কিছুতেই। শুনে আমি বিস্মিত হই, জিজ্ঞেস করি,
কেন, ওকে রক্ষা করতে চাস নাকি?
নাসির ইতস্তত করে,
না মানে মন্টুকে জীবিত ধরে আনা যায় কি না ভাবছি।
চমৎকার আইডিয়া। কিন্তু ব্যাপারটা রিস্কি হয়ে যাবে না?
রাজাকার মন্টুকে জীবিত দেখতে পাবার সম্ভাবনায় যতোটা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠি, তা আবার নিমেষে অন্তর্হিত হয়ে যায়, আবার বিষণœতায় ভিজে যায় বুকের জমিন। মন্টু আমাদের বন্ধু নয়- এই কথাটা কী করে নিজেকে বুঝাই! শারীরিক অক্ষমতার জন্য ওকে আমরা খেলায় নামতে দেইনি, তবু প্রতিটি বিকেলে খেলার মাঠে ঠিকই হাজির হয়েছে। ফুটবলে ওর দারুণ আগ্রহ। খেলতে না নামলেও খেলার ব্যাকরণ মুখস্থ। খেলাশেষে সবার ভুলত্রুটি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা ওর নিয়মিত রুটিন। গোলকিপার আনোয়ার একদিন রেগে-মেগে ওকে ঠেলতে ঠেলতে গোলপোস্টের নিচে দাঁড় করিয়ে দিলে সেদিন সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে স্বপনের তুখোড় কর্নার কিক্ ও সাবড়ে দিয়েছিল। তারপর অবশ্য আরো দুটো গোল হয়ে যায়, হাতের অ্যাটেম্প ঠিক থাকা সত্ত্বেও সেই ডান পায়ের কারণে ওকে হার মানতে হয়। শুধু ফুটবল নয়, নাটকেও অপরিসীম উৎসাহ ওর। কামাল ভাইয়েরা ক্লাবের পক্ষ থেকে সিরাজউদৌলা নাটক ধরলে জুনিয়রদের মধ্যে থেকে আমাদের তিনজনকে অভিনয়ের সুযোগ দেয়া হলো। আমরা তো মহাখুশি। এদিকে মন্টুর সে কী গোঁয়ার্তুমি-নাটকেও পাঠ দিতে হবে, অভিনয় করবেই। ল্যাংড়া-খোঁড়া বলে কিছুতেই ওকে নিরস্ত করা গেল না। শেষ পর্যন্ত শচীন সেনের ঐতিহাসিক নাটক কেটে কুটে ফাঁকফোকর তৈরি করে কামাল ভাই নিজে একটা অনৈতিহাসিক চরিত্র ঢুকিয়ে ল্যাংড়া ভিক্ষুকের বেশে মন্টুকে মঞ্চে ওঠার সুযোগ করে দিলে মন্টু মহাখুশি। ভিক্ষুকটি মূলত, ভিক্ষাবৃত্তির আড়ালে দেশের জন্য গুপ্তচরের দায়িত্ব পালন করে। একটি মাত্র দৃশ্য, অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ভূমিকা। তবু রিহার্সেলের সময় কী গভীর তার মনোযোগ! অভিনয়ও করেছিল চমৎকার।
আমাদের সেই মন্টু রাজাকার হয়ে মৃত্যুবরণ করবে এবং তাও আমাদেরই হাতে। এই ছিল তার নিয়তি। কিন্তু মন্টু কেন রাজাকার হয়ে গেল। ভেতরে ভেতরে আমাদের শরীর গুলিয়ে ওঠে ওই এক প্রশ্নে। আমি হঠাৎ নাসিরকে জাপটে ধরি,
আচ্ছা নাসির! বল তো দেখি মন্টু কেন রাজাকার হলো? তোর কী মনে হয়?
এ প্রশ্ন ইতোমধ্যে বেশ কবার উচ্চারিত হয়েছে। সম্ভাব্য নানাদিক নিয়ে আলোচনাও হয়েছে। নিঃসংশয় সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারিনি কেউ-ই। নাসিরও নিরাসক্ত কণ্ঠে জবাব দেয়,
জীবিত ধরে আনতে পারলে সেটা তার কাছেই জানা যাবে।
এ কথা শুনে কী যে হয় ভেতরে ভেতরে, আমি হঠাৎ চমকে উঠি,
না না, ওই প্ল্যান বাদ দে। ওটা খুব রিস্ক হয়ে যাবে।
আচ্ছা ঠিক আছে, ওপারে যাইতো আগে।
নাসির এবং রাজ্জাক যেদিন শক্তিশালী ডিনামাইট নিয়ে বোয়ালমারি চলে গেল, সেই দিন আমার ছিল বিশেষ এক গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন। পাঁচজন সহযোদ্ধার রক্তাক্ত লাশ এবং অন্যান্যদের মর্মছেঁড়া আহাজারির দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে রণাঙ্গন থেকে ফিরেছি সেদিন। আমি নিজেও মারাত্মক আহত। গুলি লেগেছে বাম পায়ে। আমাদের ক্যাম্প থেকে বহরমপুর পাঠালে চিকিৎসা দেয়া হয়, কিন্তু হাঁটুর নিচে থেকে কেটে বাদ দিতে হবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য কলকাতা পাঠানো হবে শুনে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আমি চিৎকার করে বলতে চাই, মুক্তি আমাদের মোটেই দূরে নয়, আমাকে এখনো যুদ্ধ করতে হবে, খোঁড়া হয়ে গেলে যুদ্ধ করব কিভাবে? চেষ্টা করি, তবু গলায় স্বর ফোটে না। হঠাৎ মনে হয়, আমিও কি মন্টুর মতো খোঁড়া হয়ে যাবো? ল্যাংড়া, লুলা? কিন্তু মন্টু তো খোঁড়া হয়েও যুদ্ধ করবে। হোক প্রতিপক্ষ তবুও তো মন্টু যুদ্ধে নেমেছে। শুধু পাকিস্তানি মিলিটারি নয়, মন্টুদের বিরুদ্ধেও এখন আমাদের যুদ্ধ। এ সময়ে একজন মুক্তিযোদ্ধার পা হারালে চলে? আবারও প্রশ্ন জাগে-রাজাকার কেন হলো মন্টু?
হাসপাতালের বেডে শুয়ে এত মানুষের আর্তস্বরের মধ্যেও রাজাকার মন্টুর চেহারা ভেসে আসে। বুকের ভেতরে ধস নামে। কে যে নদীর মতো ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলে তোর ডান পা নেই, আর এই দ্যাখ, আমার হচ্ছে বাম পা, তফাতটা কোথায়! কিন্তু তুই কেন রাজাকার হলি মন্টু?
হঠাৎ আমার উঠে বসার ইচ্ছে হয়। কিন্তু পারি না। দু’হাতে বিছানা খামচে ধরি। আহত পায়ের বুড়ো আঙুল থেকে টেলিপ্রিন্টারের মতো ইশারায় দুর্বোধ্য খবর যায় অদৃশ্য শিরা উপশিরা বেয়ে একেবারে মগজের কেন্দ্রবিন্দুতে। কপালের দু’পাশের রগ দুটো দপ দপ করে দাপিয়ে ওঠে নতুন চিন্তায়, মন্টুকে কি তবে আমরাই রাজাকার করেছি! ওর অক্ষমতার কথা ভেবে আমরা এড়াতে চাইলেও আমাদের সব কাজে সেও হয়েছে সঙ্গী। এবারও এড়াবার জন্যই আমরা মুক্তিযুদ্ধে আসার আগে ওকে কিছুই বলিনি। জানলে কি সে আমাদের সঙ্গ ছাড়তো? অনেক দেরিতে যখন জেনেছে আমাদের যুদ্ধযাত্রার খবর, তখন কি তাহলে ইচ্ছে করেই প্রতিপক্ষে দাঁড়িয়ে গেছে? আমি আর ভাবতে পারি না। বালিশে মাথা হেলিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
পরদিন বিকেল নাগাদ নাসির আসে ঝড়ো বকের চেহারা নিয়ে। সঙ্গে রাজ্জাক নেই। আমি চমকে উঠি। নাসির আমার কপালে হাত রাখে। উঠে গিয়ে গুলিবিদ্ধ পায়ের ব্যান্ডেজ দ্যাখে। আমি বিরক্ত হয়ে শুধাই,
কী হয়েছে নাসির? রাজ্জাক কই?
নাসির একপাশে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আমার আবারও উঠে বসতে ইচ্ছে করে। সে চেষ্টাও করি একা একা। আবার বাম পায়ের বুড়ো আঙুলে টান লেগে মাথা ঘুরে ওঠে। কিন্তু নাসির এসে আমাকে ধরে ফেলে। আমি চিৎকার করে জানতে চাই,
বোয়ালমারির খবর কী? ব্রিজ ওড়াতে পারিসনি?
নাসিরের সংক্ষিপ্ত জবাবা-হ্যাঁ।
সাকসেস্ফুল অপারেশনের খবরে আমি উচ্ছ্বসিত হই। আমার ভেতরে তখন কৌতূহলী প্রশ্ন আকুল হয়ে মাথা কোটে,
সেই রাজাকারটা কোথায়? মন্টু?
এতক্ষণে নাসির ডুকরে কেঁদে ওঠে। বিস্ময়ে আমার চোখের পাতা পড়ে না, মন্টুর জন্য ওর এই কান্না? কিন্তু কেন? যুদ্ধের মাঠে এমন আবেগপ্রবণ হলে চলে?
তারপর নাসির যে বিবরণ শোনায় তা কোনো ইতিহাসে ঠাঁই পায়নি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তো নেহাত কম লেখালেখি হয়নি! কিন্তু সে সবের কোথাও কোনোখানে মন্টুর নাম গন্ধ নেই। আজ এতদিন পর তা গল্পের মতো শোনাবে। পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার শিরোপার আড়ালে মন্টু আমাকে সেই গল্পের জীবনটাই দিয়ে গেছে বয়ে বেড়াবার জন্য। এ গল্পের বাহক নাসির। সেদিন নাসির আমাকে জানিয়েছিল, বোয়ালমারিতে গিয়ে ওরা অতি সহজেই মন্টুর সঙ্গে যোগাযোগ করে ফেলে। মন্টু যেন হাত বাড়িয়েই ছিল। রাজাকার জীবন থেকে সেও মুক্তির পথ খুঁজছিল। শারীরিক অক্ষমতার কথা ভেবে আমরা সঙ্গে না নিলেও ওর মামা বিলাত মুন্সি মোটেই ক্ষমা করেনি। গ্রাম থেকে রাজাকারের কোটা পূর্ণ করার স্বার্থে ল্যাংড়া-ভাগ্নের নাম তুলে দিয়েছিল তালিকায়। সে নাসিরকে জড়িয়ে ধরে পুরনো ভঙ্গিতে, জোর দাবি জানায়, সেও মুক্তিযুদ্ধে যাবে। যাবেই। বোয়ালমারি ব্্িরজের তলে ডিনামাইট চার্জের এই কাজটুকু কিছুতেই নাসির বা রাজ্জাককে করতে দেবে না। এই শুভ কাজ দিয়েই মন্টু শুরু করতে চায় নতুন জীবন। তারপর ওপারে।
দশদিক কাঁপিয়ে গর্জে ওঠে ডিনামাইট। প্রচ- সেই বিস্ফোরণের শব্দে আমার কর্ণকুহরে তালা লেগে যায়। নাসির কত কথা বলে যায়, আমি আর কিছুই শুনতে পাই না। আপন মনে নাসির যেন বা প্রলাপ বকে, রাজ্জাক ধরা পড়েছে… মন্টু শহীদ হয়েছে..।