জাগতিক এবং মহাজাগতিক চিন্তা চেতনা এবং দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দর্শন ও বিজ্ঞানের যাত্রা। জগৎ এবং জীবন সম্পর্কীয় মানুষের যে অলঙ্ঘনীয় প্রশ্ন তার সন্তোষজনক উত্তর দানের চেষ্টা হলো দর্শন। এ চেষ্টা পৃথিবী শুরু হওয়া থেকে চলতেই আছে আবার পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়া পর্যন্ত চলতেই থাকবে। আর প্রকৃতির কোনো বিশেষ শাখাকে নির্বাচন করে পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে যে জ্ঞান অর্জন করা হয় তাকে বিজ্ঞান বলে। বিজ্ঞানের বহু শাখা প্রশাখা আছে। তাকে খন্ডিত করে পাঠের জন্য মনোনয়ন করা হয়। কিন্তু দর্শন হল অখন্ড। বিজ্ঞানের লব্ধ জ্ঞানকে কেন্দ্র করে যে জ্ঞান মানবসমাজে প্রতিষ্ঠা পায় তার উপর নির্ভর করে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। লেমার্ক, ডারউইন, হার্বট স্পেন্সার তারা বিভিন্ন মতামত প্রচার করেছে বিশ্বতত্ত্ব এবং মানুষ সম্পর্কে। ডারউইন এর মতামত দ্বারা পাশ্চাত্য সমাজ আজ প্রবাহিত। Survival of the fittest, Natural selection, Struggle for existence- এর কথা প্রচার করলে শিক্ষিত সমাজ বিনা দ্বিধায় সেটা মেনে নেয়। মানুষ যদি বানর এর বংশগত হয় এবং মানুষের পূর্বপুরুষ যদি বানর সাদৃশ্য হয় তাহলে তার আর কোন জবাবদিহিতা থাকে না। সে খেয়াল খুশি মত আচরণ করতে থাকবে এটা স্বাভাবিক। আবার মানুষ যদি স্রষ্টার সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হয় তাহলে তার জবাবদিহিতার একটা জায়গায় থাকে। তার আচরণ সংশোধন ও পরিমার্জনের সুযোগ থাকে। সে হয়ে পড়ে পতিত মানবতার বন্ধু। মানুষ হয় প্রকৃত মানুষ।
মানুষের ভিতর সত্য মিথ্যার দ্বন্দ্বের কারণে বিভিন্ন মত ও পথের সৃষ্টি হয়েছে। গুহাবাসী-মানুষ যখন ছিল তখন পাথরের তৈরি হাতিয়ার ব্যবহার করত এবং দল বেঁধে চলত। গুহাবাসী মানুষ স্বপ্ন দেখতে পাখির মতো আকাশে উড়তে এবং মাছের মত সাঁতার কাটতে। মানুষের এই চাওয়া পাওয়া থেকে আবিষ্কার হয়েছে উড়োজাহাজ, ডুবোজাহাজ, রকেট, স্টিমার প্রভৃতি। মানুষ আজ মহাকাশে স্টেশন তৈরি করেছে এমনকি চাঁদে বসবাসের মত স্বপ্ন সফল করতে চলেছে। প্রয়োজনীয়তাই আবিষ্কারের জনক। মানুষের প্রয়োজনে মানুষ আবিষ্কার করবে এটা স্বাভাবিক। পকেটের কলম থেকে হাতের ঘড়ি এমনকি টুটপেস্ট থেকে মোবাইল পর্যন্ত বিজ্ঞান আবিষ্কার করে চলার পথকে সহজ করে দিয়েছে। মানুষ আজ মহাকাশে প্রবেশ করেছে। সাগরের গভীরে প্রবেশ করেছে। এমনকি নক্ষত্রের আলো নিয়ে গবেষণা করেছে। মানুষ হয়েছে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ। কারণ অন্যান্য জীব তার দৈহিক সৌন্দর্য ও চলার পথকে যতটুকু উন্নত করেছে মানুষ তার চেয়ে কোটি কোটি গুণ বেশি করতে সক্ষম হয়েছে। বিজ্ঞানের জ্ঞান চলার পথকে সহজ ও সৌন্দর্যময় করে তুলেছে। তবে বিজ্ঞানের জ্ঞানে জ্ঞানী হয়ে যদি মানুষের মতাদর্শ বস্তুবাদী হয় তাহলে তার জীবন দর্শন হবে এক রকম আবার তার মতাদর্শ যদি আধ্যাত্মবাদী হয় তাহলে তার মতাদর্শ হবে অন্য রকম। কিন্তু জগতের জটিল গোলকধাঁধায় মানুষ এক মতাদর্শে আসতে পারেনি। তাই স্রষ্টা তাকে শিখিয়েছেন আমাদের সত্য ও সরল পথ দেখাও ওদের পথ নয় যারা অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্ট। মানুষের ভিতর যারা আলোক সন্ধানী তারা সত্য পথ থেকে নিজকে গাফিল রাখতে পারেন না। তারা মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখে থাকেন। আদি সত্তা বস্তু না অবস্তু তা নিয়ে যেমন আছে ঝগড়া তেমন আছে গবেষণা। একটি বস্তু ভাংতে থাকলে অনু, পরমাণু, কোয়ার্ক শেষ পর্যায়ে Light, energy এবং Motion এ পরিণত হয়। আবার Light, energy এবং Motion থেকে বস্তুর অস্তিত্ব ঘটে থাকে। তাই আমরা বলি ঘড়ঃNothing to Existence and Existence to Nothing,, স্রষ্টা তার নিজস্ব কুদরতে বস্তু থেকে অবস্তু এবং অবস্তু থেকে বস্তুর সৃষ্টি করেন, যা বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণিত সত্য।
আজ বিজ্ঞানের যুগে মানুষ নভোমন্ডল এবং ভূমন্ডলে উথালপাথাল শুরু করেছে। জগৎ আজ ছুটে চলেছে। মানুষের ব্যস্ততার গতি বেড়ে গেছে। মানুষ আজ আলোর গতির সম্পন্ন যান আবিষ্কারের চিন্তা করছে। যদি মানুষ আলোর গতি সম্পন্ন যান আবিষ্কার করতে পারে তাহলে সে থাকবে চির তরুণ। তার আর বার্ধক্য আসবে না। দুনিয়ার জীবন যাপন যত সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্য হচ্ছে মানুষের দুনিয়ায় টিকে থাকা তত দুরূহ হচ্ছে। মরণব্যাধি, উৎকণ্ঠা, ষড়যন্ত্র এবং দুর্ঘটনা মানুষকে নিয়ে যাচ্ছে অনিশ্চয়তার দিকে। এই সংশয়বাদী মন থেকে মানবসমাজ বেরিয়ে আসতে পারবে কি না সন্দেহ। কারণ মানুষের যাত্রা যদি অন্ধকার পথে মন গড়া নিয়ম অনুসারে হয় তাহলে তার মুক্তির পথ প্রশস্ত হবে কিনা সন্দেহ। কারণ মানুষের জটিল সমস্যার পথ সহজ করা আরও জটিল। এই সরল ও সত্য পথ কিভাবে মানুষ পাবে তা আজ ভাববার বিষয় হয়েছে। মানুষের ভিতর যদি খোদাহীন জ্ঞান ঢুকে এবং সে যদি দুনিয়ার জীবনই একমাত্র জীবন মনে করে তাহলে সে হয়ে পড়ে অহঙ্কারী এবং সাম্রাজ্যবাদী। সে নিজে সুখে থাকার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়বে এটা স্বাভাবিক। যার ফলে ‘নগদ যা পাও হাত পেতে বাকির খাতা শূন্য থাক।’ এই শিক্ষায় মহোগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ভারতীয় চার্বাকরা একটা কথা প্রচার করেছিলেন। তারা বলতেন যাবৎ জীবং সুখং জীবেৎ, ঋনং কৃত্ত্বা, ঘৃতং পীবেৎ। অর্থাৎ যত দিন বাঁচ সুখে বাঁচ ঋণ করে হলেও ঘি খাও। মানুষের ভিতর এই শিক্ষার দানা চরমভাবে প্রবেশ করেছে। যার কারণে জগৎ জুড়ে হানাহানির সৃষ্টি হয়েছে। এই হানাহানির দল কোন দিন শান্তি চাইবে না এটা স্বাভাবিক। জগতের দিকে ঝুঁকে পড়ে মানুষ বস্তুবাদী হয়ে থাকে তাহলে মাওলানা জালাল উদ্দীন রুমি একটা কথা এখানে বলেছেন- ‘‘আমি কোরআনের মগজ তুলি জ্বালাই মোমের বাতি, ছুড়ে ফেলা হাড়ে কুকুরের দল উঠেছে কলহে মাতি।’’ জাগতিক চাকচিক্য মোহ এবং সুখভোগ মানুষকে ঘোর অন্ধকারের ভিতর ফেলে দিয়েছে। এই মোহের অন্ধকার কাটিয়ে আলোক পাওয়া অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। মানুষের ভিতর যদি দুনিয়ার আকর্ষণ বৃদ্ধি পায় তাহলে তার অবস্থা হবে মাংসের হাড় নিয়ে কুকুর যেভাবে কলহ করে ঠিক তার অবস্থা হবে পার্থিব বস্ত নিয়ে হানাহানি করা। যার কারণে জগৎ ধ্বংস স্তুপে পরিণত হতে পারে। বিজ্ঞানের জ্ঞান দ্বারা মানুষের চিন্তার জগৎ পরিবর্তন হয়। মানুষ যদি বিজ্ঞানের দ্বারা প্রভাবিত হয় তাহলে বিজ্ঞানের চরম ও চূড়ান্ত জ্ঞান থেকে অনেক সময় বঞ্চিত হয়। বিজ্ঞানের জ্ঞান বস্তু জগতের ভিতর সীমাবদ্ধ। কিন্তু মানুষের জ্ঞান বস্তু জগতের ভিতর সীমাবদ্ধ নয়। কারণ তার জ্ঞান অদৃশ্য কল্পনার জগতে চলে গেছে। যে জ্ঞানে যাওয়ার বিজ্ঞানের অধিকার নেই। তাই তো বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানীর মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। অধ্যাপক Weber তার History of Philosophy গ্রন্থে বলেন- ‘‘দর্শন ছাড়া বিজ্ঞান হলো ঐক্য ছাড়া সমষ্টি মাত্র। আত্মাহীন দেহ, বিজ্ঞান ছাড়া দর্শন হলো দেহহীন আত্মা, নিছক কবিতা এবং মূলত স্বপ্ন থেকে তার বিশেষ কিছু পার্থক্য নেই।’’ দর্শন এবং বিজ্ঞানের লক্ষ্য একই রূপ। সত্য অর্জন ও জগৎ ও জীবনের মৌলিক জ্ঞানের রহস্য উদঘাটন। দর্শন প্রকৃতিক সামগ্রিকভাবে আলোচনা করে আর বিজ্ঞান খ- খ- ভাবে আলোচনা করে।
মানুষের সামনে বিজ্ঞান আসছে লাগামহীন ঘোড়ার মতো। যা দিয়েছে বেগ কিন্তু কেড়ে নেছে বিবেক ও নিশ্চয়তা। মানুষ আজ পারমাণবিক যুগে প্রবেশ করেছেন। ‘Nature Food’- জার্নাল সম্প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, যদি পারমাণবিক যুদ্ধ বেঁধে যায় তাহলে পৃথিবীতে ৫০০ কোটি লোক মারা যাবে। যারা থাকবে তাদের স্মৃতিহীন, বিকলঙ্গ, অন্ধ, বোবা, প্রভৃতি শ্রেণির হওয়ার সম্ভাবনা আছে। মানবজাতির দশা এমন যেন না হয় তার জন্য যন্ত্রের সাথে মানুষের আচরণ সংযত করতে হবে।
আজ প্রাচুর্যের ভিতরেও কোন শান্তি ও নিশ্চয়তা দেখা দিচ্ছে না। বিজ্ঞান সুপথে পরিচালনার জন্য লাগাম দরকার। আর এই লাগামহীন হচ্ছে সত্য জ্ঞানের শিক্ষা। মানুষের মাঝে সত্য জ্ঞানের শিক্ষা যত বেশি প্রচার প্রসার ঘটবে মানুষের মুক্তি তত সহজ হবে। মানুষ পাবে স্বস্তির ঠিকানা। বিশ্ববাসী আজও এক সত্যে আসতে পারেনি। আর কবে যে পারবে তা নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্বের শেষ নেই। তবে কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা এ নিয়ে সে গোলকধাঁধার ভিতর পড়ে গেছে। মানুষ পাচ্ছে না কোন সঠিক পথ। মানুষের এই বস্তুবাদ এবং আধ্যাত্মিকতার দ্বন্দ্বে পড়ে গেছে। কে তার দ্বন্দ্বের মীমাংসা দেবে? আজ বিশ্ববাসীর কাছে এটা বড় প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিশ্ববাসীর কাছে সত্য উন্মুক্ত হওয়া সব চেয়ে সুসংবাদ এবং যার মাধ্যমে মানবজাতির মুক্তির পথ প্রশস্ত হবে আজকের দিনে এই পরিস্থিতিতে এর চেয়ে বড় সংবাদ আর হতে পারে না।