স্পেন, সিসিলি ও সিরিয়া-ফিলিস্তিনে খ্রিস্টিয় ইউরোপ মুসলিম সভ্যতার মুখোমুখি হয়ে বুঝতে পারলো, নিজের মধ্যে কী নেই! কোন কোন ক্ষমাহীন দারিদ্র্য তাকে পরাজিত ও অবনমিত করে রেখেছে? অতএব সে নিজেকে বুঝতে চাইলো এবং বুঝতে চাইলো মুসলিম দুনিয়াকে, যাকে সে প্রতিপক্ষ হিসেবে হুমকি জ্ঞান করে! ক্রুসেডের পরাজয়ে এই হুঁশ তাদের হয়ে যায় যে, নিজেদেরকে মুসলিম অগ্রগতির সমান্তরালে নিয়ে যেতে হলে দুস্তর পথ পাড়ি দিতে হবে এবং এ ছাড়া উপায় নেই । দ্বাদশ শতকে এই পথ পাড়ি দেয়ার জ্ঞানগত উদ্যম আমরা দেখি স্পেনের খ্রিস্টান অঞ্চলে; আরবি ভাষী খ্রিস্টানদের মধ্যস্থতায়, ফ্রান্সে, ইতালিতে, ব্রিটেনে! অতঃপর স্পেন থেকে উচ্ছেদ হলো মুসলিম শাসন। ১৪৯২ সালের এ ঘটনার পরে বাকি দুনিয়া দখল ও শাসনের পশ্চিমা স্বপ্ন থৈ থৈ করতে থাকে।
প্রাচ্য তখন সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র। তাদের উপর আধিপত্য জরুরি। তাদের যতটুকু জানা যাবে, ততই সহজ হবে আধিপত্য, শাসন । মুসলিমদের জানতে হবে বিশেষ করে। তাদের পরাস্ত না করলে প্রাচ্যকে করতলগত করা যাবে না। স্পেন ও পর্তুগাল ইতোমধ্যে দুনিয়াজুড়ে উপনিবেশ তৈরির প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। আমেরিকা ও ল্যাতিন আমেরিকা মহাদেশ চলে আসছে খ্রিস্টবাদের হাতে। অভিযানসমূহ ছুটছে প্রাচ্যের দিকে। মুসলিমদের বিরুদ্ধে শক্তিপ্রদর্শন করছে পর্তুগিজ যোদ্ধারা। উজ্জ্বল হয়ে উঠছে বিভিন্ন এলাকায় সফল হবার সম্ভাবনা। ফ্রান্স এখানে পিছিয়ে থাকতে পারে না। বিশেষত ওসমানী সালতানাতের সাথে বুঝাপড়ার নানা প্রসঙ্গ রয়েছে। তাদের অগ্রসর কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিকতার সাথে সমঝোতা জরুরি। তাদের সাথে সংঘাত এড়িয়ে মুসলিম জাহানে প্রবেশের দরোজা খুলতে হবে। রাজা ফ্রান্সিস আই অফ ফ্রান্স (১৪৯৪-১৫৪৭) এর কাছে ইসলামকে জানার প্রয়োজনটা হয়ে উঠলো তীব্র।
গিয়োম পোস্টেল (১৫১০-১৫৮১) এর লক্ষ্য ছিলো কাছাকাছি। বিশ্বময় এক অখণ্ড খ্রিস্টবিশ্বাসের বাতাবরণ দেখার প্রেরণা তাকে ঘরছাড়া করেছে। ক্রুসেডের উত্তরাধিকারে জ্বলন্ত নরম্যান্ডির বেয়ারটন গ্রামে জন্ম গ্রহণ, বেড়ে ওঠা আর প্যারিসে কলেজ সেইন্ট ভার্ভে পড়াশোনা তাকে চিনিয়েছে মুসলিম শত্রুদের। কিন্তু তিনি ছিলেন সেই দলের একজন, যারা হলেন মুসলিম জ্ঞানচর্চা মাধ্যমে জাতিগোষ্ঠীকে আলোকিত করে তাদের মোকাবেলার প্রবক্তা। তিনি মুসলিম দুনিয়াকে একান্তভাবে বুঝার জন্য আনাতোলিয়া অঞ্চল ও মিসর ভ্রমণ করেন। আরবি জ্ঞান তিনি অর্জন করেন তখনকার অন্যান্য অগ্রসর পশ্চিমা পণ্ডিতের মতো। মুসলিম জাহানে তিনি বিভিন্ন বিদ্যায়তন এবং জ্ঞানসম্পদের অনুসন্ধানে ছিলেন, তাও বুঝা যায় তার নানা সঞ্চয় থেকে। এখানে নতুন পুরাতন যতো উদ্দীপক গ্রন্থ তিনি পেয়েছেন, নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছেন স্বদেশে। এসবের উপর কাজ করেছেন তিনি ও তার পরবর্তীরা। ইমাম আবু মুহাম্মদ আবদুল জব্বার আল কারাখির মুনতাহা আল ইদরাক ফি তাকিসিমিল আফলাক (The Ultimate Grasp of the Divisions of Spheres) গ্রন্থের উপর তার তৈরি নোট এখনো অক্ষত রয়েছে হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ।
দীর্ঘ ভ্রমণ সমাপ্ত করে সবেমাত্র ফিরেছেন, সাথে তার বিচিত্র গ্রন্থসম্ভার, রাজা ফ্রান্সিস তাকে মুসলিম ও ইসলাম বিষয়ক জ্ঞান বিস্তারে নিয়োজিত করলেন। ১৫৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো College Royale। ১৫৩৮ সালে ব্যাপক উদ্দীপনার সাথে তাকে করা হলো এর অধ্যাপক। এ কলেজ পরবর্তী কালে College de France- এ পরিণত হয়। আরব ব্যাকরণ সমূহের ভিত্তি করে তিনি রচনা করলেন Grammatics Arabica (প্রকাশ : ১৫৩৮ খ্র.)। উসমানী সাম্রাজ্যকে পাঠ ও এর সম্রাটের সবলতা-দুর্বলতা বুঝার জন্য তিনি ফরাসি ভাষায় লিখেন অসাধারণ এক গ্রন্থ La République des Turcs (The Turkish Republic) (প্রকাশ : ১৫৬০)। কুরআনের মোকাবেলায় বাইবেল এর প্রচার কিভাবে করা যায় এবং কিভাবে বাইবেলের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করা যায় সে নির্দেশনাসহ লিখেন Le Livre de la concorde entre le Coran et les Évangiles (The Book of Concordances between the Quran and the Gospels, (প্রকাশ : ১৫৫৩)। প্রথম ফ্রান্সিস বিবিধ কারণে তার প্রতি রুষ্ট হন এবং ১৫৪৩ সালে তাকে বরখাস্ত করেন রয়েল কলেজ থেকে। কিন্তু তিনি ছিলেন একটি প্রভাব। একটি আন্দোলন। রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও আধ্যাত্মিক অভিব্যক্তি দিয়ে তিনি একটি শ্রেণীকে নাড়িয়ে দেন। ফরাসি ইনকুইজিশনের সাথে ভিন্নমতের কারণে শেষ জীবন প্রায় গৃহবন্দিত্বে কাটালেও তিনি খ্রিস্টধারণায় মসিহের শুভাগমন এবং মহাপ্রলয়ের আগে সমগ্র বিশ্বে খ্রিস্টবাদ প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতির ধারণাসমূহকে দেন বিশেষ সজ্জা। যেখানে মুসলিম শত্রুরা আছে গগমেগগ ও এন্টিক্রাইস্টের দলে!
পশ্চিমের ইসলামপাঠে প্রাতিষ্ঠানিকতা আসে অবিলম্বে। নেতৃত্ব দেয় নেদারলেন্ডসের লাইডেন বিশ্ববিদ্যালয়। ১৫৭৫ সালে এর প্রতিষ্ঠা। স্পেনের দীর্ঘস্থায়ী অবরোধের জবাবে শহরটি বীরত্ব প্রদর্শন করে। ১৫৭৪ সালে সে নিজেকে স্বাধীন রাখতে সক্ষম হয়। পুরস্কার পাওয়াটা ছিলো নিশ্চিত। সেটা এলো বিশ্ববিদ্যালয়রূপে। অরেঞ্জির রাজপুত্র উইলিয়ামের হাতে তা প্রতিষ্ঠিত হয়। হল্যান্ডের রাজবংশের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়টির সম্পর্ক বরাবরই গভীর ছিলো, এখনো অনেক ঘনিষ্ঠ। রানি জুলিয়ানা ও বিয়েট্রিক্স এবং যুবরাজ উইলেম-আলেক্সান্ডার এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। সতেরো, আঠারো ও উনিশ শতকে সে ছিলো ইউরোপের অন্যতম প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়। বিভিন্ন র্যাঙ্কিংয়ে লাইডেন এখনো বিশ্বের শ্রেষ্ঠ একশত বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে। ২০২০ সালে অধ্যয়নের তেরোটি ক্ষেত্রে সারা বিশ্বে অগ্রসর পঞ্চাশটি বিশ্ববিদ্যালয়ে লাভ করে বিশেষ জায়গা। ক্ষেত্রগুলো হলো, ক্লাসিক ও প্রাচীন ইতিহাস, রাজনীতি, প্রত্নতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, ইতিহাস, ফার্মাকোলজি, আইন, জনগণের নীতি, ধর্ম শিক্ষা, কলা ও মানবিক বিদ্যা, ভাষাতত্ত্ব, আধুনিক ভাষা এবং সমাজবিজ্ঞান। লাইডেন ষোড়শ শতকেই জ্ঞানের নানা শাখায় অর্জন করে বিশেষ সুনাম। ডাচদের জাতীয় জীবনের বিশেষ এক প্রেক্ষাপটে তার জন্ম, যখন তারা ঔপনিবেশিক স্বপ্নে নিজেদের অংশ বুঝে নিতে চাইছিলো। সমুদ্রে তাদের জাহাজের পাল উড়ানো এবং বাণিজ্যবহরের ডানাবিস্তার স্বাভাবিক ঐতিহ্য। এখন এতে কম্পন তুলেছে নতুন ভাবাবেগ। ওসমানী সাম্রাজ্যের সাথে তাদের রয়েছে সম্পর্ক, মরক্কোতে রয়েছে বিশেষ স্বার্থ। আরবি জানা ও মুসলিম সভ্যতার পাঠ সময়ের চাহিদা। এই পাঠ যদিও ইতঃপূর্বে হয়ে আসছিলো, এর পদ্ধতিগত অগ্রগতিতে নেতৃত্ব দিলেন ফ্রান্সিসকাস রাফালিং গিউস (১৫৩৯-৯৭ খ্রি.) এবং জোসেফ জাস্টাস স্কালিগার (১৫৪০-১৬০৯)। উভয়েই ছিলেন পোস্টেল দ্বারা অনুপ্রাণিত। গিউস ছিলেন লাইডেনে হিব্রুর শিক্ষক। ১৫৯৩ সালে সেখানে তিনি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আরবি শিক্ষা চালু করেন। রচনা করেন খবীরপড়হ অৎধনরপঁস যা প্রকাশিত হয় তার মৃত্যুর পরে, ১৬১৩ সালে। স্কালিগার ছিলেন ঐতিহাসিক, বহুভাষাবিদ এবং ফরাসি ক্যালভিনীয় ধর্মীয় নেতা। জীবনের শেষ ষোলো বছর তিনি নেদারলেন্ডসে কাটান। লাইডেনে তিনি শিক্ষক হন ১৫৯৩ সালে; কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের জন্য নয়। আরবিতে তার ছিলো বিজ্ঞতা। অচিরেই তার উদ্যমে সেখানে আরবি ভাষার জন্য আলাদা এক চেয়ার তৈরি হলো। সময়টা ১৫৯৯ সন। এরপর লাইডেন এ ধারায় পেয়েছে বহু মনীষা। এগিয়েছে নানা খাতে। টমাস ভেন আর্প ( ১৫৮৪-১৬২৪ খ্রি.) ছিলেন এখানকার প্রথম দিককার ছাত্র। বহুভাষিকতায় তিনি ছিলেন বিখ্যাত। লাইডেনে তিনি হন প্রাচ্য ভাষাবিষয়ক অধ্যাপক। তার যোগাযোগ ছিলো স্প্যানিশ আলেম আহমদ বিন কাসিম আল হাজারির (১৫৭০-১৬৪০) সাথে, যিনি আফবিকাই (মুজারেব ভাষায় অনড়মধফড়) নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। ১৬১০-১১ সনে তিনি ফ্রান্সে অবস্থান করেন। লাইডেনেও ছিলো তার যাতায়াত। টমাস ভেন তার সহায়তা নিয়ে রচনা করেন এৎধসসধঃরপধ অৎধনরপধ, (প্রকাশ : ১৬১৭) যা পরবর্তীতে আরবি ভাষা শেখার প্রধান সেতু হিসেবে বিবেচিত হয়। এর চাহিদা থেকে বুঝা যায় আরবি শেখার কী উদ্যম ছিলো তখনকার পশ্চিমা জ্ঞানকেন্দ্রগুলোতে। ১৬৩৬ সালে প্রকাশিত হয় এর পরিবর্ধিত সংস্করণ, অচিরেই শেষ হয় সংস্করণটি। ১৬৫৬ সালে আরেকটি সংস্করণ আসে। এভাবেই চলছিলো প্রায় দুই শতাব্দী। বিচিত্র সম্পর্ক ও ভ্রমণের মাধ্যমে তিনি সংগ্রহ করেন আরব গ্রন্থরাজির বড় সংগ্রহ। যা লাইডেনের গ্রন্থাগারে স্থান পায় অবশেষে।
জোসেফ জাস্টাস স্কালিগার এর সম্পাদিত উব বসবহফধঃরড়হব ঃবসঢ়ড়ৎঁস (প্রকাশ : ১৫৮৩ এবং পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশ : ১৫৯৮) এক ব্যাপক ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ গ্রন্থ। যা আপন সময়ে প্রাচ্য গবেষণা ও অধ্যয়নের অগ্রসর ফলশ্রুতি। এতে প্রাচ্যে অনুশীলিত ও রচিত বিভিন্ন কালপঞ্জির এমন সমাহার ঘটেছে, যা একে বিশ্বের ইতিহাসের সঞ্চয় করে তুলেছে!
জ্যাকব গোলিয়াসের (১৫৯৬-১৬৬৭ খ্রি:) আবির্ভাব ছিলো আরো প্রভাবশালী ভূমিকাসহ। লাইডেনে তিনি টমাসের স্থলাভিষিক্ত হন ১৬২৪ সালে। নেদারলেন্ডসের হেগে জন্ম নেয়া এ প্রাচ্যবিদ ও গণিতবিদ ছিলেন আরব জ্ঞান ও ল্যাতিন অধ্যয়নের সেতু। তার আরবি ল্যাতিন অভিধানগ্রন্থ খবীরপড়হ অৎধনরপড় – খধঃরহঁস প্রকাশিত হয় ১৬৫৩ সালে। এ শুধু এক গ্রন্থ ছিলো না, আরব্যজ্ঞানে প্রবেশের জন্য অনুরাগীদের হাতে সক্ষম একটি চাবির কাজ করে বইটি। জ্যাকব এখানে কেবল অভিধানপ্রণেতা ছিলেন না, মুসলিম অভিধানজ্ঞান এ অবধি যে পথ পাড়ি দিয়েছে, সে অভিজ্ঞতার ইউরোপীকরণের চেষ্টার প্রবক্তা হয়ে ওঠেন। গ্রন্থগুলো দৃষ্টি উন্মোচনের জন্য প্রাথমিক পথ তৈরি করে দেয়, যা দিয়ে মুসলিম জ্ঞানের দুনিয়ার সদর দরোজায় হাজির হওয়া যায়। আরবি শব্দ ও বাক্যতত্ত্ব কিংবা অলঙ্কারশাস্ত্রের পরিচিতিমূলক গ্রন্থাবলির পাশাপাশি মুসলিম চিন্তা, মনন ও সমাজনৈতিক অভিজ্ঞতার অনুধাবনে প্রজ্ঞাকথন ও প্রবচনসমূহের অনুসন্ধানী সঙ্কলনও লাইডেনে আমরা দেখবো, যার নজির রয়েছে টমাস ইরপেনিয়াসের খড়প সধহর ঝধঢ়রবহঃরং ঋধনঁষধব গ্রন্থে; (প্রকাশ : ১৬১৫)। এসব নীতি ও ভাষাতাত্ত্বিক এলাকার কাজ মুসলিম মনের অনুবাদের চেষ্টা করে, প্রবচনসমূহে যুক্ত করে টীকা এমনকি এর মূল আরবির উচ্চারণের স্বরচিহ্নগুলোর ব্যাপারে উদাসীন থাকেনি। এর পাশাপাশি আল কুরআনে প্রবেশের নিজস্ব চেষ্টাও জারি থেকেছে। ১৬১৭ সালে সূরা ইউসূফ এর ল্যাটিন অনুবাদে ইরপেনিয়াসের প্রয়াস এবং এর নানা ক্ষেত্রে ছোট ছোট ব্যাখ্যাজাত মন্তব্য এ সময়ের পশ্চিমা ইসলামপাঠে এক উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। সাহিত্যিক অনুবাদসমূহ ইতোমধ্যে লাতিন ভাষায় প্রশস্ত সঞ্চয় গড়েছে। বিজ্ঞানের নানা দিকের রচনাবলিও কয়েক শতক ধরে আরবি থেকে ল্যাতিনে যাচ্ছিলো। জ্যাকব গোলিয়াস অনূদিত আল ফারগানীর জ্যোতির্বিজ্ঞান একটি সম্পাদিত ও সম্প্রসারিত প্রচেষ্টা। ১৬২৯ সালে প্রকাশিত হয় তার শাযারাতুল আদাব। তার কাজের প্রতি আমরা যখন লক্ষ্য করি, দেখবো, ইসলাম অধ্যয়নের ইউরোপীয় সাবেক ধারা ও আধুনিক ধারার মধ্যবিন্দু রচিত হচ্ছিলো তার ও লাইডেনের তখনকার পাণ্ডিত্য প্রয়াসে। রাজা প্রথম ফ্রান্সিস পোস্টেলকে মুসলিম জ্ঞানসম্পদের তথ্য ও জ্ঞানসংগ্রহের সংকলনসমূহ অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেন। তিনি কাজটির জন্যে বিভিন্ন মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্রে সফর করেন, যেমনটি করে আসছিলেন তার আগেকার অনেকেই। পরে একই দায়িত্ব পান গুলিয়াস। মুসলিম জাহানের নানা জ্ঞানকেন্দ্রে তিনি যাযাবরের মতো ঘুরে চলেন ১৫২৯ থেকে ১৬২৫ অবধি। যেভাবে একদা ফ্রান্সের গারবার্ট ডি অরিলাক (৯৪৬-১০২৩) স্পেনের বার্সিলোনায় চলে যান আরবি জ্ঞান শিখবেন বলে। সেখানে লাভ করেন গণিত, জ্যামিতি, ভূগোল, জ্যোতির্বিজ্ঞান। এমনকি এস্ট্রোল্যাব তৈরির প্রযুক্তি। ফ্রান্সে নিয়ে আসেন গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থভাণ্ডার। একসময় তিনি হন খ্রিস্টবিশ্বের পোপ; স্যালভেস্টর দুই! ইউরোপে ঘটান গণিত ও জ্যামিতিশিক্ষার প্রচলন, চালু করেন কম্পাস-এস্ট্রোল্যাবের ব্যবহার! যা কয়েক শতকের মধ্যে ইউরোপে নিয়ে আসবে নৌবিপ্লব। যার পথ ধরে বিশ্বময় আধিপত্য নিশ্চিত হবে।
বণিক হিসেবে ইউরোপে আগত লিউ আফ্রিকানাস কনস্টান্টাইন (১০৯৮-৯৯) খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে মুসলিম জ্ঞানকে ইউরোপে স্থানান্তরে সচেষ্ট হন। ভারত, পারস্য, সিরিয়া, ইথিওপিয়া, হেযায, মিসর, পশ্চিম আফ্রিকা ঘুরে ঘুরে তিনি লাভ করেছিলেন জ্ঞান এবং গ্রন্থসম্ভার নিয়ে যান ইউরোপে! পড়েছিলেন ফেজের কারাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিউনিস থেকে যখন তিনি ইতালিতে ফিরছিলেন, তার সঙ্গে ছিলো একটি সমৃদ্ধ সভ্যতার বারুদ, যা আরেক মহাদেশের অন্ধকারে সফর করেছিলো জ্বলে উঠবে বলে!
কনস্টান্টাইন ল্যাতিনে অনুবাদ করলেন এর অনেকটাই। বহু গ্রন্থকে নিজের নামে দিলেন চালিয়ে। স্টিফেন অব এন্টিওক দেখালেন অনুবাদের নামে তিনি কতভাবে জালিয়াতি করেছেন। মূল লেখকের কথা এড়িয়ে গেছেন। তবুও তার অনূদিত বহু গ্রন্থ কয়েক শতক ধরে পাঠ করেছে পশ্চিমা বিদ্যালয়গুলো। যার মধ্যে আছে, চিকিৎসাবিদ্যার যুগান্তর নিয়ে আসা আবু বকর রাযীর (৮৫৪-৯২৫) আল হাবী, আহমাদ ইবনে আল জাজারের (৮৯৮-৯৮০) জাদুল মুসাফির, আলী ইবনে আব্বাসের (৯৩০-৯৯৪) আল কামিল, ইসহাক ইবনে ইমরানের (৯০৩-৯০৯) কিতাবু নুযহাতিন নাফস, ইবনে ইসহাক সোলায়মানের (৮৩২-৯৩২) ঞযব নড়ড়শ ড়ভ ঃযব ঢ়ঁষংব, ঁৎরহব ধহফ ভড়ড়ফ ৎবমরসব (মূলগ্রন্থ বিলুপ্ত) ইত্যাদি।
ইতালির পণ্ডিত ক্রিমোনার জেরার্ড (১১১৪-১১৮৭) মুসলিম স্পেনের বিভিন্ন বিদ্যায়তন ঘুরে সংগ্রহ করতেন আরবি গ্রন্থাবলি। তিনি ল্যাতিনে ভাষায় খোঁজে পাচ্ছিলেন না টলেমির আলমাজেস্ট। কিন্তু আরবিতে দেখা গেলো এমন বই বিপুল। এমনকি টলেমিকে সংশোধন করেও রচিত হয়েছে নানা গ্রন্থ। নিজেদের ভাষা ও জ্ঞানজগতের সীমাহীন দারিদ্র্য তার মনে রোদন করছিলো। আরবি ভাষা শিখে এবং টলেডোর গ্রন্থাগারসমূহ মন্থন করে অগণিত আরবি বই নিয়ে ফিরেছিলেন তিনি। ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন বিজ্ঞানের নানা শাখার ৮৭টি গ্রন্থ।
লিওনার্দো ফিবোনাসি (১১৭০-১২৪০-৫০) একে অবলম্বন করে এগিয়ে যান। তিনি ইতালিয়ান এমন গণিতবিদ, যাকে মধ্যযুগের সবচেয়ে প্রতিভাবান পশ্চিমা গণিতজ্ঞ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তাকে যে ফিবোনাচ্চি নামে ডাকা হয়, এই নাম দিয়েছিল ফ্রেঞ্চ-ইতালিয়ান ইতিহাসবিদ গিলাইম লিব্রি, ১৮৩৮ সালে। তার মূল নাম ছিলো ফিলিপ বোনাচ্ছি। ১২ বছর বয়সে তিনি আলজেরিয়ার বুগিয়ায় বসবাসের সুযোগ পান আপন পরিবারের সাথে। শিক্ষা লাভ করেন মুসলিম ও আরব পণ্ডিতদের কাছে। শিখেন আরবি ভাষা ও গণিত। গণিত, আলজাব্রা, জ্যোতির্বিদ্যা, ভূগোল ইত্যাদিতে উচ্চতর পারদর্শিতার জন্য সিরিয়া, মিসর, সিসিলি ও প্রোভেন্সের জামেয়াসমূহে ভ্রমণ করেন। সমৃদ্ধ লাইব্রেরিসমূহে পাঠের সুযোগ লাভ করেন। ১২২৮ সালে তিনি তার বিশ্ববিখ্যাত বই খরনবৎ অনধপর রচনা করেন। আরব্য সংখ্যাতাত্ত্বিক বিজ্ঞানকে পশ্চিমে তিনি দেন প্রতিষ্ঠা। গণিতে আনেন নতুন বিপ্লব, মুক্তি!
তারা চাচ্ছিলেন পশ্চিমা দুনিয়ার প্রতিকারহীন অন্ধকারের অবসান। কিন্তু এই জ্ঞানের জন্য তাদের হতে হয়েছে নিগ্রহের শিকার। জাদু ও অবিশ্বাসের বিস্তারের জন্য সন্দেহ করা হয় এই অনুশীলনকে। আক্রমণ করা হয় নানাভাবে।
পশ্চিমের তখন গভীর অন্ধত্ব। ৪১০ সালে জার্মান ভিজিগথ রাজা আলারেস তিন দিনের অভিযানে তুমুল ঝড় হয়ে রোমকে লণ্ডভণ্ড করে এর পতনডঙ্কা বাজিয়ে দেন। আক্রমণ করেন এবং তিনদিনের এক অভিযানে তিনি এ মহান নগরী লুণ্ঠন করেন। ৪৭৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর উচ্ছেদ হন রোমান সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট রোমোলুস আগুস্তুলুস। রোমান সাম্রাজ্যের অবসান হয়, সেখানে শিক্ষার শেষ আলোকবিন্দুও নিভে যায়। ক্রমে ক্রমে অন্ধকার ছাড়া আর সবকিছুর উপর উচ্ছেদযজ্ঞ চলে। সভ্যতার জন্য কোনো জায়গা রাখা হয়নি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ ধ্বংস করা হয়। জ্ঞানীদের করা হয় হত্যা। এক হাজার বছর ধরে নিশ্চিদ্র অন্ধকার ইউরোপকে শাসন করতে থাকে। জোনাথন লিয়ন্স তার বিখ্যাত ‘দ্য হাউজ অব উয়িজডম: হাউ দি অ্যারাবস ট্রান্সফরমড দ্য ওয়েস্ট’ গ্রন্থে ঠিকই লিখেছেন :
‘রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর বহু শতাব্দী ধরে পশ্চিম ইউরোপ ছিল পশ্চাৎপদ ও অজ্ঞতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন ও অন্ধকার যুগে আবদ্ধ। ইউরোপীয়রা কদাচিৎ দিনের সময় বলতে সক্ষম ছিল। অন্যদিকে আরব সংস্কৃতির সমৃদ্ধি ঘটছিল এবং এ সংস্কৃতি বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধান ও আলোচনার একটি শক্তিকেন্দ্রে পরিণত হয়। আরবদের এ সমৃদ্ধি বাথের ব্রিটিশ অভিযাত্রী এডিলার্ডের মতো ব্যক্তিদের হতবুদ্ধি করে দিয়েছিল। আরবরা পৃথিবীর পরিধি পরিমাপ করতে পারতো (আট শত বছরের আগে পশ্চিম ইউরোপে এমন সাফল্য খুঁজে পাওয়া যায় না); তারা বীজগণিত উদ্ভাবন করেছিল; জ্যোতির্বিজ্ঞান ও নৌবিজ্ঞানে প্রাজ্ঞ ছিল; এস্ট্রোল্যাব করেছিল আবিষ্কার; এরিস্টোটলের গুরুত্বপূর্ণ কর্মসহ সকল গ্রিক বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক পাণ্ডুলিপি করেছিল অনুবাদ। তাদের অবদান এবং এডেলার্ডের মতো অভিযাত্রীগণের আহরিত জ্ঞান ছাড়া বিগত সহস্রাব্দে পশ্চিম ইউরোপের স্থান হতো সম্পূর্ণ ভিন্নতর।’
এডেলার্ড অব বাথের যে অভিযানের উল্লেখ করলেন জোনাথন, তা মূলত আরব ও মুসলিম জ্ঞানসম্ভারের অনুসন্ধান ও আত্তীকরণের অভিযান। যার অগ্রপথিকদের একজন ছিলেন আফ্রিকানাস-জেরার্ড-স্যালভেস্টর । পরে এই ধারা বাথ অব এডেলার্ড ( ১০৮০-১১৫২) হয়ে অগ্রসর হয়। তিনি সিসিলি ও সিরিয়ায় সাত বছর ধরে শিখেন মুসলিম জ্ঞানকলা। দেশে ফিরেন বিপুল সম্ভারসহ! ব্রিটেনে শুরু করেন আরবি চর্চার আন্দোলন। অনুবাদ, সম্পাদনা, পাঠদান ও গবেষণার উদ্যম ছড়িয়ে দেন। তার দ্বারা অনুপ্রাণিত ও পথপ্রদর্শিত হন অগ্রসর এক শ্রেণী। যাদের মধ্যে ছিলেন ইংরেজ রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ দার্শনিক, ধর্মতত্ত্ববিদ, বিজ্ঞানী এবং লিংকনের বিশপ রবার্ট গ্রোসেটেস্ট (১১৭৫-১২৫৩) ইংরেজ দার্শনিক, অভিজ্ঞতার আলোকে প্রকৃতির অধ্যয়নের পশ্চিমা গুরু, আধুনিক পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের পথিকৃৎ রোজার বেকন (১২২০-১২৯২)। তারা পশ্চিমা সভ্যতার আধুনিক উত্তরণের প্রাণপুরুষ। তাদের জ্ঞানচর্চা আলোকলাভ করছিলো মুসলিম জ্ঞানসম্ভার থেকে। পশ্চিমা দুনিয়ার আরবি ও ইসলাম চর্চার ফসলগুলো এভাবেই পরিপক্ব হচ্ছিলো আপন চরিত্রে । গ্রিক অধ্যয়নের পাশাপাশি মুসলিম সোনালি যুগের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের ইহজাগতিক উপাদানগুলোকে আত্তীকৃত করার পথে অগ্রগতির পরবর্তী ধাপ ছিলো পশ্চিমা রেনেসাঁ ।
বস্তুত ৯০০ থেকে ১০১৩ সাল পর্যন্ত মুসলিম জ্ঞানসম্পদের বিশাল এক ধারা বাগদাদ থেকে মিসরের কায়রো, স্পেনের কর্ডোভা, সিরিয়া ও ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপ সিসিলিতে এসে ভিড়ে। ১০৮৫ থেকে ১২০০ সাল পর্যন্ত স্পেনের কর্ডোভা থেকে টলেডো ও সিসিলিতে জ্ঞান বিজ্ঞান পাড়ি জামায়। ক্রুসেডার অনেকেই একে নিয়ে আসে সিরিয়া-ফিলিস্তিন থেকে। ১২০০ থেকে ১৫৫০ সাল অবধি বিশেষত টলেডো, কর্ডোভা ও সিসিলি থেকে পশ্চিম ইউরোপে জ্ঞান পাচার হয় সেই জ্ঞান। স্পেন-সিসিলিতে মুসলিম শাসনের উচ্ছেদে হাজার হাজার জ্ঞানাগার ও লাইব্রেরির গ্রন্থসম্ভার এবং অগণিত মুসলিম জীবিত বিশেষজ্ঞকে কাজে লাগিয়েছে অনুবাদের এই ধারা। স্পেনের আরবিভাষী মুজারিবগণ করেছে দূতিয়ালি। ইউরোপের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়া মরিস্কো মুসলিমকে এই কাজে নিয়োজিত করা হয়। তবে দ্বাদশ শতকেই এতে সম্পন্ন হয় ব্যাপক ও অবিশ্বাস্য এক অগ্রগতি।
এ অগ্রগতি আরো অগ্রগতি কামনা করছিলো। ফলে মুসলিম সভ্যতার প্রাণকেন্দ্রসমূহে অভিযান ছড়ায়। একের পর এক। শতাব্দীর পর শতাব্দী। সাধারণত শাসকগণ, জ্ঞানকেন্দ্র বা গির্জা কোনো দল বা ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতো। তিনি সফর করবেন মুসলিম দুনিয়ায় এবং ফিরে আসবেন বিপুল গ্রন্থসম্পদসহ। জ্যাকব গোলিয়াস সরকারের তরফে এ দায়িত্ব লাভ করেন এবং সম্পন্ন করেন কাজ। তিনি লাইডেনে ফিরে আসেন প্রায় ৩০০ দুষ্প্রাপ্য আরবি, ফারসি ও তুর্কি পাণ্ডুলিপি নিয়ে, যা জ্ঞান-বিজ্ঞানে ইউরোপকে পথপ্রদর্শন করবে!
লাইডেন চাইছিলো জ্ঞান ও চিন্তায় অন্যান্য জ্ঞানকেন্দ্রসমূহের ঈর্ষার যোগ্য হতে। আরব-সংযোগে সে বস্তুত এগিয়ে গিয়েছিলো এবং তার দিকে অন্যরা তাকাচ্ছিলো সর্বাধিক উজ্জ্বল আলোক শিখাটির জন্য!
জ্ঞানসম্পদ সংগ্রহের এ কাজে পেশাদার পণ্ডিত, পাদ্রি, পর্যটক, ব্যবসায়ী কিংবা শিক্ষার্থীদের অনেকেই যেমন সক্রিয় ছিলেন, কূটনীতিকদের প্রচেষ্টাও কম ছিলো না। লেভিনাস ওয়ার্নার (১৬১৮-১৬৬৫) এর উল্লেখ করা যায়। তিনি ছিলেন জার্মান বংশোদ্ভূত পণ্ডিত। পড়াশোনা করেন লাইডেনে। আরবি-তুর্কি শেখেন এবং ১৬৪৪ সাল থেকে বসবাস শুরু করেন ইস্তাম্বুলে। ১৬৫৫ সালে তাকে ওসমানী সাম্রাজ্যে ডাচ প্রজাতন্ত্রের কূটনীতিক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এখানে তিনি নানাবিধ কাজের পাশাপাশি বিরল ও গুরুত্ববহ গ্রন্থাবলির তালাশে ছিলেন। সংগ্রহের সুযোগ ছিলো প্রসারিত। তিনি জানতেন, কী ধরনের গ্রন্থাবলি পশ্চিমা অধ্যয়নে আসা দরকার! যা তাদের বিরাজমান অন্ধকারের অবসানে কাজ দেবে। তার সংগ্রহ স্ফীত হতে থাকে এবং লাইডেন বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি প্রদান করেন গবেষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক হাজার গ্রন্থ! লাইডেন হতে থাকলো ইসলাম ও আরব অনুসন্ধানী গবেষকদের জন্য এমন এক কেন্দ্র, যেখানে আরব সূত্রসমূহ উপস্থিত আছে আর আছে তাকে পশ্চিমা পরিশোধনের প্রয়াস! এ প্রয়াসে লাইডেন একা ছিলো, ভাবার কারণ নেই। বিভিন্ন কেন্দ্র পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতা করছিলো। মুসলিম জ্ঞানসম্পদের সংগ্রহ হয়ে উঠেছিলো বিশাল। গ্রন্থপঞ্জি সাজালে তা হয়ে উঠছিলো বড় আকারের বই। এসবের আলোকে প্রাচ্যকে পাঠ ও এর সুলুকসন্ধান যে মাত্রা পেয়েছিলো, তার নজির হতে পারে যেমন স্কালিগারের কাজ, তেমনি ফরাসি প্রিস্ট রিচার্ড সাইমনের (১৬৩৮-১৭১২ খ্রি:) কাজ। সাইমন ছিলেন বাগ্মী, ব্যাখ্যাতা, যাজক, বাইবেলের সমালোচক। আপন সময়ে প্রভাবশালী খ্রিস্টিয় এই চিন্তক প্রাচ্যবিদ্যায়ও ছিলেন নিবেদিত। তার বিখ্যাত ঐরংঃড়রৎব পৎরঃরয়ঁব ফব ষধ পৎবধহপব বঃ ফবং পড়ঁঃঁসবং ফবং হধঃরড়হং ফঁ ষবাধহঃ মুসলিম সভ্যতা, প্রাচ্য এমনকি গোটা দুনিয়ার ইতিহাস, কলা ও সংস্কৃতিকে নিজেদের হাতে রচনার ব্যাপক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার নমুনা হয়ে ওঠে!
মুহাম্মদ আশ শাইবানী, জাবির ইবনে হাইয়ান, ফারাবী, জাকারিয়া রাজী, আল বেরুনী, আল খাওয়ারিজমী, ইমাম গাযালি, আবুল কাসিম জাহরাবী, আল বাত্তানী, ইবনে সিনা, নেযামুল মুলক, নাসিরুদ্দীন তুসী, ইবনে হাইসাম, ইবনুন নাফিস থেকে নিয়ে ইবনে হাযম, ইবনে বাযা, ইবনে তুফায়েল ইবনে রুশদ, ইবনে খালদুন, আল ইদ্রিসী, ইবনে হাবাশ সোহরাওয়ার্দীর মতো প্রসিদ্ধ মনীষী তো বটেই, অপ্রসিদ্ধ বা কম প্রসিদ্ধ মুসলিম লেখক-চিন্তকদের রচনা ও চিন্তাসার সেখানে তৈরি হচ্ছিলো। বিশ্লেষিত হচ্ছিলো। বিতর্ক হচ্ছিলো তা নিয়ে। এসবের অভিঘাত ছিলো চিন্তা ও মনের মুক্তি। পশ্চিমা দুনিয়ার জগদ্দল বন্দিত্ব থেকে স্বাধীনতা। লাইডেন তার পরিচিতি নির্মাণ করলো নতুন চিন্তা ও দৃষ্টির পথপ্রদর্শক হিসেবে। তার নীতিবাক্য হয়ে উঠলো খরনবৎঃধঃরং চৎধবংরফরঁস বা স্বাধীনতার দুর্গ। এটি সেই সময়ে, যখন স্বাধীন চিন্তাশক্তি ও বুদ্ধিচর্চা ছিলো এমন অপরাধ, যার জন্য অজস্র জ্ঞানানুরাগী ও মুক্তিকামীকে হত্যা করা হয়েছে আগুনে পুড়িয়ে!
অচিরেই লাইডেন নিশ্চিত করলো ডাচ স্বর্ণযুগ। ইউরোপের নানা দিক থেকে পণ্ডিতবর্গ সেখানে খোঁজে পেলেন আপন তীর্থস্থান। লাইডেন গড়ে দেয় নতুন চিন্তার অগ্রপথিকদের মনোভূমি। তার শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেখা যাবে সেই সব চেহারা, যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন পশ্চিমা রেনেসাঁয়; রনে দেকার্ত, রেমব্রন্ট (১৬০৬-১৬৬৯) ক্রিস্টিয়ান হাইগেনস (১৬২৯-১৬৯৫) হুগো গ্রোশিয়াস (১৫৮৩-১৬৪৫) বারুখ স্পিনোজা (১৬৩২-১৬৭৭) ব্যারন ডি’হোলবাখ (১৭২৩-১৭৮৯) সেই অগ্রপথিকদের কয়েকটি নাম। তারা অন্যান্য পশ্চিমা মনীষার সাথে গণিতে, দর্শনে, শিল্পকলায়, সমাজ বিজ্ঞানে, আইনে, ধর্মতত্ত্বে, সাহিত্যে, ইতিহাসে, জ্যোতির্বিজ্ঞানে, পদার্থে যে অগ্রসরমানতা রচনা করেন, এর উপর দাঁড়িয়ে যায় পরবর্তী আধুনিকতার সৌধ।
কিন্তু তাদের চিন্তা ও জ্ঞানমণ্ডলের সৌধ দাঁড়িয়েছিলো যে ভিত্তির উপর, তাকে গড়ে দিয়েছিলো মুসলিমদের জ্ঞানচর্চা ও চিন্তাসাধনার হাত। লাইডেন এর পেছনে শতাব্দীর পর শতাব্দী শ্রম ঢেলেছে, সংগ্রহ, অনুবাদ, বিশ্লেষণ, আত্তীকরণের বিশাল, ব্যাপক ও ধারাবাহিক সাধনা চালিয়ে গেছে।
তখনকার অন্যান্য পশ্চিমা জ্ঞানকেন্দ্রের এমনই চরিত্র ছিলো কম-বেশি। সারা বিশ্ব থেকে জ্ঞানসঞ্চয় একত্রীকরণের যে প্রয়াস বাগদাদের দারুল হিকমাহ হাতে নিয়েছিলো, এর অনুকরণে তাদের প্রয়াস কখনো থামেনি। রেনেসাঁর পরেও লাইডেনের সংগ্রহধারা নতুন চরিত্রে বিস্তৃত হয়। ঔপনিবেশিক বিস্তারণের সাথে ছিলো এর গভীর যোগ। প্রাচ্যতত্ত্বের সাথে ছিলো যার হাত ধরাধরি। এখন লাইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে রয়েছে ৫২ লক্ষেরও অধিক বই। ইন্দোনেশিয়া অঞ্চল সম্পর্কে দুনিয়ার সবচে’ বেশি গ্রন্থসম্ভার রয়েছে সেখানে। তেমনি রয়েছে ক্যারিবিয়ান অঞ্চল নিয়েও!
নিজেকে এবং অপরকে বুঝার জন্য এবং প্রগতির জন্য জানার যে প্রক্রিয়া, সে অধ্যয়ন প্রাচ্যতত্ত্বকে যে স্ফীতি ও ব্যাপকতা দিয়েছে, মুসলিমদের জ্ঞানঐতিহ্য ও জ্ঞানসম্পদের পশ্চিমা চর্চা এর বুনিয়াদ গড়ে দেয়। সেই চর্চা এখনো গতিমান।