বাংলা কাব্যনাট্যে সৈয়দ শামসুল হক অগ্রগণ্য একজন নাট্যব্যক্তিত্ব। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে নাট্যরচনা ও মঞ্চায়নে যে জোয়ার লক্ষণীয়, সে জোয়ারে তাঁর অবদান অসামান্য। তাঁর মঞ্চসফল নাট্যগুলোর মধ্যে এক ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ (১৯৭৫)-ই মঞ্চস্থ হয়েছে অজস্রবার। কাব্যনাট্যের শিল্পকৌশল ও অনুপ্রেরণার জন্য তিনি টি.এস. এলিয়টের নিকট ঋণী- স্বীকার করেছেন। তদুপরি তার রচনায় বিষয়বৈচিত্র্য ও রচনাকৌশলে লৌকিকত্ব অর্জন করেছে- এ কথা নিঃসন্দেহে বলা চলে। ‘নূরুল দীনের সারাজীবন’ তাঁর অসাধারণ এক শিল্পসৃষ্টি।
সৈয়দ শামসুল হক বহুল আলোচিত ঐতিহাসিক নাটক ‘নূরুল দীনের সারাজীবন’ রচনার মধ্য দিয়ে বাংলা নাট্যসাহিত্যে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেছেন। এ নাটকে নাট্যকার অতিমাত্রায় স্বদেশচেতনার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। বলতে গেলে, সম্পূর্ণ নাটকটিতেই তিনি ‘নূরলদীন’ চরিত্রের মাধ্যমে এদেশের সাধারণ মানুষদের ব্রিটিশ বেনিয়াদের হাত থেকে এবং তাদের এ দেশীয় দোসর জমিদার, মহাজনের হাত থেকে রক্ষার কথা বলেছেন। এ কাব্যনাট্য রচনায় তিনি গণনাট্যের আঙ্গিক ব্যবহার করেছেন। নাটকের সংলাপ ও কাহিনী সবসময় গতিশীল ও প্রাণবন্ত। এছাড়াও বাঙলার প্রাচীন ঐতিহ্য, ইতিহাস, স্বদেশ ও সমাজকে তিনি উপস্থাপন করেছেন নতুনভাবে। সর্বোপরি, আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের দ্বারা সাধারণ মানুষকে প্রতিষ্ঠিত করার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন তিনি। ফলে নাটক আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়েছে।
এ কাব্যনাট্যে এর প্রধান চরিত্র নূরলদীনের ‘ফ্লাশ ব্যাক’-এর মাধ্যমে গতানুগতিক নাটকের মতো একটি ক্রমপরিণতি পাওয়া যায়। সে একজন সাহসী ও প্রতিবাদী কৃষকনেতা। তার ডাকে শোষিত, নির্যাতিত কৃষক শ্রেণীর মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়; সে তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে ইংরেজ ও তাদের দালাল এদেশের জমিদারদের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলে। এখানে নূরলদীন-ই একমাত্র উজ্জ্বল ও অধিকতর বিকশিত চরিত্র। তবে তার বন্ধু আব্বাসও নাট্যঘটনায় গুরুত্বসহ, তাৎপর্যমণ্ডিত। কেননা অন্য সবাই নূরলদীনের ক্রিয়াকর্মের সঙ্গে সবসময় যুক্তির ও বাস্তবতার একটা বোঝাপড়া করতে চায়, যা অন্য কোনো চরিত্রের মধ্যে পাওয়া যায় না। এ ছাড়াও নূরলদীনকে ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে কিভাবে লড়াই করতে হবে, তার মূল নকশা প্রণয়ন করেছেন আব্বাস।
আব্বাস। ধৈর্য সবে- ধৈর্য ধরি করো আন্দোলন
লাগে না লাগুক, বাহে, এক দুই তিন কিংবা কয়েক জীবন।
নিসর্গ ও লোকজীবনের অনুসন্ধানে প্রতিভাত হয় একটি জনপদের পরিপূর্ণ চরিত্র। এই নিসর্গ ও লোকজীবনকে আধুনিক কাব্যনাট্যের জনক টি.এস. এলিয়ট (১৮৮৮-১৯৬৫) কিংবা ডব্লিউ. বি. ইয়েট্স (১৮৬৫-১৯৩৯), জে.এম. সিঙ (১৮৭১-১৯০৯), ক্রিস্টোফার ইশারইড (১৯০৪-১৯৮৬), ডব্লিউ. এইচ. অডেন (১৯০৭-১৯৭৩), স্টিফেন স্পেন্ডার (১৯০৯-১৯৯৫) প্রমুখ কবি নাট্যকারগণ এড়িয়ে যাননি। তাঁদের কাব্যনাট্য রচনায় বিষয়বস্তুর গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে স্থান পেয়েছে এই নিসর্গ ও লোকজীবন। আধুনিক বাংলা কাব্যনাট্য চর্চায়ও নিসর্গ ও লোকজীবন নানান কাব্যনাট্যকারের শৈল্পিক তুলির আঁচড়ে নান্দনিক মর্যাদায় স্থান পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), শাহাদৎ হোসেন (১৮৯৩-১৯৫৩), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৫) দিলীপ রায় (জন্ম-১৯১৯), মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় (জন্ম-১৯২৫), রামবসু (জন্ম-১৯২৫), শাহাদৎ হোসেন (১৮৯৩-১৯৫৩), গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭-১৯৬৪), নুরুল হোসেন (১৯০৮-১৯৮৬), আ. ন. ম. বজলুর রশীদ লোকজীবনের চিত্রপট অঙ্কনে স্বকীয় কিন্তু মনোহর ও নিপুণতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
আধুনিক বাংলা কাব্যনাট্যে নিসর্গ ও লোকজীবনের চিত্রায়ণে যিনি সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন, তিনি হলেন সৈয়দ শামসুল হক। তাঁর কাব্যনাটসমূহে নিসর্গ ও লোকজীবন-এর যে চিত্র তিনি অঙ্কন করেছেন, তা কাল্পনিক কোনো সৃষ্টি নয়; বরং তা জীবন অভিজ্ঞতা ঋদ্ধ। তিনি সমাজ জীবনের নানান স্তরের মানুষের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মিশেছেন এবং স্থানে, কালে ধরা সমাজ সম্পর্কের মধ্যে বিচরণ করেছেন। তাই সমাজকে, সমাজের মানুষকে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে জানার ব্যক্তিগত পরীক্ষা, নিরীক্ষা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বোঝার অবকাশ তাঁর হয়েছে। আর এর মধ্য দিয়েই তিনি জেনেছেন সকল মানুষের আশা, আকাক্সক্ষা, ইচ্ছা ও স্বপ্নকে। ফলে তাঁর কাব্যনাট্যসমূহের পরতে পরতে জেঁকে আছে নিসর্গ ও লোকজীবন।
সৈয়দ শামসুল হক লৌকিক জগৎকে, জীবনকে তাঁর কাব্যনাট্যসমূহে স্থান দিয়েছেন বাস্তবতা তথা লৌকিক বাস্তবতাসহ। সহজ-সরল লোকমানুষের আচার, বিশ্বাস, প্রথাসহ ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ ও ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ কাব্যনাট্যদ্বয়ের বেশির ভাগ চরিত্র তাই হয়ে উঠেছে স্বাদে, বর্ণে ঘ্রাণে লৌকিক। তাই বলা যেতে পারে, আধুনিক কাব্যনাট্যে যে সমাজচিত্র প্রতীয়মান কিংবা বর্ণিত যে সমাজ, তার ওপর সামান্য হলেও সাহিত্যিক কল্পনামিশ্রত রঙিন আবরণের প্রলেপ রয়েছে। কিন্তু সৈয়দ হকের ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ ও ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ কাব্যনাট্যদ্বয়ে বিধৃত সমাজ একেবারেই গ্রামীণ অবহেলিত এবং শাসক কর্তৃক নির্যাতিত সমাজ- যা নাট্যকার যেমনটি অনুসন্ধান করে পেয়েছেন, যেমনটি বাস্তবসম্মতভাবে ধারণ করতে পেরেছেন, তেমনটি অঙ্কন করার চেষ্টা করেছেন।
নিলক্ষা আকাশ নীল, হাজার হাজার তারা ঐ নীলে অগণিত আর
নিচে গ্রাম, গঞ্জ, হাট, জনপদ, লোকালয় আছে ঊনসত্তর হাজার।
ধবলদুধের মতো জ্যোৎসনা তার ঢালিতেছে চাঁদ- পূর্ণিমার।
নষ্ট ক্ষেত, নষ্ট মাঠ, নদী নষ্ট, বীজ নষ্ট বড় নষ্ট যখন জগৎ সংসার
তখন হঠাৎ কেন দেখা দেয় নিলক্ষার নীলে তীব্র শিষ
দিয়ে এত বড় চাঁদ?
নিসর্গের এমন চমৎকার বর্ণনার মাধ্যমেই শুরু হয়েছে ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ কাব্যনাট্যের অভিযাত্রা। এর পরতে পরতে ফুটে উঠেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। কখনো আকাশ, কখনো নদী, কখনো বৃক্ষ অথবা কখনো পাহাড়, পর্বত কিংবা শস্যভরা মাঠের বর্ণনা সুনিপুণভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এই কাব্যনাট্যে। এখানে নিসর্গের সাথে লোকজীবনের সম্পর্ক নিবিড়ভাবে অঙ্কিত হয়েছে। যেমন-
হামার তিস্তার পানি রক্তে রাঙি যায়,
নিরলক্ষার নীল দিয়া চান হাঁটি যায়।
হামার সন্তান কান্দে খা-খা আঙিনায়।
পুন্নিমার চান, তার কিবা আসি যায়?
পুন্নিমার চান নয়, অনাহারী মানুষেরা চায়
ধানের সুঘ্রাণে য্যান বুক ভরি যায়
পুন্নিমার মতো হয় সন্তানের মুখ রোশনাই।
ইয়ার অধিক মুঁই কিছু চাঁও নাই।
যুগে যুগে সুবিধাবঞ্চিত সাধারণ মানুষ, যারা অল্পেই তুষ্ট অথচ পায় না কিছুই, তারা জীবিকার জন্য, অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য সংগ্রাম করে বুকের রক্ত দিয়েছে। ক্ষুধার্ত এসব মানুষের কাছে চাঁদনী রাতের সৌন্দর্য ম্লান হয়ে পড়ে। তারা অনাহারী জীবন থেকে মুক্তি চায়। দু’বেলা দু’মুঠো ভাতÑ এই প্রত্যাশাও যেন তাদের কাছে অধিক কিছু। আবার নিসর্গের সাথে জীবনের চমৎকার উপমা টেনেছেন নাট্যকার; যেখানে জীবনের সঙ্গে নিসর্গ মিশে একাকার হয়েছে।
এ দ্যাশে হামার বাড়ি উত্তরে না আছে হিমালয়
উয়ার মতন খাড়া হয়া য্যান মানুষেরা হয়।
এ দ্যাশে হামার বাড়ি দক্ষিণেতে বঙ্গোপসাগর
উয়ার মতন গর্জি ওঠে য্যান মানুষের স্বর।
এ দ্যাশে হামার বাড়ি পূর্বদিকে ব্রহ্মপুত্র আছে,
উয়ার মতন ফির মানুষের রক্ত য্যা নাচে।
এ দ্যাশে হামার বাড়ি পশ্চিমেতে পাহাড়িয়া মাটি,
উয়ার মতন শক্ত হয় য্যান মানুষের ঘাঁটি।
শোষকশ্রেণী দ্বারা নির্যাতিত মানবেতর জীবনযাপন করে এমন মানুষ অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে প্রতিবাদ স্পৃহা খুঁজে ফেরে। তারা প্রকৃতির মতই অবিচল, শক্ত, দুরন্ত ও তেজোদীপ্ত হতে চায়। এই নিসর্গের সঙ্গে মানুষের অবিচ্ছিন্ন সম্পর্কের কারণেই নিসর্গের পরিবর্তনের ছাপ এসে পড়ে মানুষের জীবনযাত্রাতেও।
যায়
বদলি যায়
দিন বদলি যায়
কাল বদলি যায়
ঐ চান বদলি যায়
ঐ ম্যাঘ বদলি যায়
তিস্তার ধারা বদলি যায়
ঘাসের ওপর দিয়া মানুষের হাঁটিবার চিহ্ন বদলি যায়।
সময়ের প্রেক্ষিতে সবকিছু বদলে যায়। চাঁদ, তারা, মেঘ, আকাশ, বৃক্ষ, নদী-কোনোকিছুই এই পরিবর্তনের বাইরে নয়। নিসর্গ বলতে সবসময় যে তা মনোমুগ্ধকর হবেÑ এমন নয়। আলো-আঁধার নিয়েই যেমন জগৎ সংসার, ক্ষুদ্র-বৃহৎ নিয়েই যেমন বিশ্বব্রহ্মান্ড, তেমনি সুন্দর-কুৎসিত নিয়েই সামগ্রিক নিসর্গচিত্র। এ কাব্যনাট্যে সুন্দর নৈসর্গিক পরিবেশের পাশাপাশি নিসর্গের কদাকার দিকটিও নাট্যকার শৈল্পিক সুষমায় অঙ্কন করেছেন।
… গ্রীষ্মের ভ্যাপনা এ নরকে।
শ্বাস টানি গোক্ষুরের বিষাক্ত বাতাসে,
সহ্য করি মশার দংশন,
চতুর্দিকে ওড়ে নীল মাছি,
অবিরাম ষড়যন্ত্র।
লোকজীবন-এ নিসর্গ অনেক সময় অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। গ্রীষ্মের ভ্যাপসা গরমে যখন নিম্নশ্রেণির মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত, তখন এর সঙ্গে যুক্ত হয় মশার কামড়, মাছির উৎপাত, সাপের ছোবল প্রভৃতি। এই নিসর্গ লৌকিক মানুষের জীবনে কদাচিৎ বীভৎসতার প্রতিচ্ছবি হয়েও ফুটে ওঠে। যেমনÑ
সর্বাঙ্গে নামিয়া সূর্য অগ্নি ঢালি যায়,
ঝটাত শকুন পড়ি মাংস খুলি খায়…
মুখ দিয়া রক্ত উঠি বলদ পড়িয়া আছে মানুষ নোয়ায়।
বাংলার কৃষকের দুর্ভোগের কাহিনী একবিংশ শতকের বিজ্ঞানের যুগে কিংবদন্তির মত শোনালেও তা তারার মত ধ্র“ব সত্য। চিরদিন তারা শোষকশ্রেণী দ্বারা সর্বস্বান্ত হয়ে অতিকষ্টে কালাতিপাত করেছে। এমনকি হালের বদলের সঙ্গে কাঁধে জোয়াল নেয়ার মত নির্মম ঘটনাও তাদের জীবনে কদাচিৎ ঘটে থাকে। হয়ত এ কাজ করতে গিয়ে অনেক কৃষকের মৃত্যুও ঘটেছে। হয়ত সেই মৃতদেহ থেকে শকুন খুবলে মাংস ছিঁড়েও খেয়েছে। নিসর্গের এমন চিত্র যেমন নির্মম, তেমনি বীভৎস। এই বীভৎসতা আরো তীব্রভাবে ফুটে উঠেছে নিম্নোক্ত সংলাপেÑ
স্থির দৃষ্টি দূর নিলক্ষায়,
শকুন ঝাপটি ওঠে দুরন্ত পাখায়,
বড় স্থির বলদ পাড়িয়া আছে, মানুষ নোয়ায়।
উঠিল চিৎকার করি, একবার, নূরল তখন,
তখন নূরলদীন, শুনিল তখন,
তখন সে শুনিবার পায়,
নিজেরও গলার স্বর বদলিয়া গেছে তার গরুর হাম্বায়।
তখন, তখন তার অন্তরে নামিয়া সূর্য অগ্নি ঢালি যায়।
ঝাটাৎ শকুন পড়ি মাংস খুলি খায়।
সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ যখন মানুষের দ্বারাই নির্যাতিত-নিপীড়িত হয়ে পশুর মতো জীবনযাপন করে, তখন মানুষ্যজন্মের মাহাত্ম্য সেখানে বাতুলতা মাত্র। এমন জন্ম তখন আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। মানুষের উপমায় বৃক্ষের দৃষ্টান্ত টানতে গিয়ে নাট্যকার বৃক্ষকে সুস্থির এবং বীররূপে উপস্থাপন করেছেন।
আওয়া না করি, বাহে, ফুঁড়িয়া জমিন
যদি বা বৃক্ষের ন্যায় খাড়া হন, অজানা অচিন,
ধড়ফড়ি উঠিয়াই তবে হয় এমন মানুষ,
নিলক্ষারে নীল বৃক্ষ করি দিল গুম
অকস্মাতে।
বৃক্ষ যেমন নীরবে, নিভৃতে মাটির বুকে চিরে হঠাৎ বেরিয়ে আসে, বড় হয়; এক সময় নীল আকাশের মাঝে নিজের, অস্তিত্বকে বিকশিত করে। মানুষকে তেমনই ধৈর্য-সহ্যের মধ্য দিয়েই বড় হতে হয়। যা করার তা দ্রুত ও চুপি চুপি করতে হয়। তবেই জয় নিশ্চিত হয়। বৃক্ষের বর্ণনায় নাট্যকার একজন সাংসারিক মানুষের চিত্র অঙ্কন করতে গিয়ে বলেছেনÑ ‘উদাম বৃক্ষ যে হও, তোমার ডালেতে ঘিরি নাই স্বন্নলতা।’
নারী কিংবা পুরুষ এককভাবে কখনোই পূর্ণাঙ্গতা পায় না। উভয়ের যৌথ প্রচেষ্টায়, মিলনেই গড়ে ওঠে দাম্পত্যের ভিত্তি, বেজে ওঠে জীবনের কনসার্ট। উদাম বৃক্ষের চেয়ে যে বৃক্ষে স্বর্ণলতা শোভিত, সে বৃক্ষই তো সুন্দর ও নান্দনিক হয়ে ওঠে। এ কাব্যনাট্যে নাট্যকার পার্থিব সৌন্দর্যের সাথে আকাশের চাঁদের সৌন্দর্য যুক্ত হয়ে রাতের আকাশকে যে ঐশ্বর্য দান করে, তা চাঁদনী রাতের বর্ণনায় চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
বুড়া বুড়ি কয়, বাহে, ভরা পুন্নিমায়
নিশীথের বেড়া ভাংগি যায়,
কত কি উঠিয়া আসে বিরাম পাথারে,
কত কি নামিয়া আসে নদীর কিনারে,
রাতের আকাশে উদীয়মান পূর্ণিমার চাঁদ অকৃপণভাবে আলো ছড়ায়। সে আলোয় উদ্ভাসিত হয় বাংলার নিসর্গ। মাঠ, প্রান্তর কিংবা নদীর তীর হয়ে ওঠে স্বপ্নিল, মধুময়। চাঁদনী রাতের এই সৌন্দর্য আরো প্রাচুর্যময় ভাবে বিকশিত হয়েছে নিচের সংলাপে-
… আজ এই প্রশস্ত প্রান্তরে;
যখন স্মৃতির দুধ জ্যোৎস্নার সাথে ঝরে পড়ে,
তখন কে থামে ঘুমে? কে থাকে ভেতরে?
কে একা নিঃসঙ্গ বসে অশ্র“পাত করে?
প্রকৃতির রূপ-রঙ মানুষের মনকে আশ্চর্য রকমের প্রভাবিত করে, আন্দোলিত করে। চৈত্রের খাঁ খাঁ দুপুর যেমন মানুষের মনকে উদাস করে, নিঃসঙ্গ করে, তেমনি চাঁদনী রাতের স্বপ্নিল পরিবেশ যে কোন বিষাদগ্রস্ত মনকেও ঐশ্বর্য দান করে। তার মনে বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায়। হ্যাঁ, এমন ভরা পূর্ণিমায় নৈসর্গিক পরিবেশে সবকিছুর মাঝেও নারীর সান্নিধ্য না পেলে অপূর্ণতা যেন একটা থেকেই যায়। হয়ত সে জন্যই চরম সঙ্কট মুহূর্তেও নাট্যকার ইঙ্গিত করেছেন নারী সঙ্গমের।
পূর্ণিমায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
রমণীর সঙ্গসুধা পান করবেন?
চাঁদের আলোয় নিসর্গ যখন স্বর্গীয় মনে হয়, তখন সবকিছুর মাঝেও কী যেন একটা অভাব অনুভূত হয়। পুরুষমনে আকাক্সক্ষা জাগে নারীর সান্নিধ্য লাভের। নৈসর্গিক চিত্র অঙ্কনে নাট্যকার কখনো আশ্রয় নিয়েছেন নদীর ‘সমস্ত নদীর অশ্র“ অবশেষে ব্রহ্মপুত্রে মেশে।’ কখনো পাহাড়ের ‘পাহাড়ি ঢলের মতো নেমে এসে সমস্ত ভাষায়।’ কখনো পাখির ‘দ্যাখেন দ্যাখেন আরো কতক আছে উয়ার পরে, গাং টিটিরি পাখি যেমন তোমাক লক্ষ্য করে।’ কিংবা কখনো রাত্রির ঝোপ জঙ্গলের-
বাগানের যে পথে এলেন,
ও দিকটা বড় অন্ধকার। ঝোপঝাড়।
লোকে বলে, রংগপুর রাজধানী গোক্ষুর সাপের।
ভরাবর্ষায় উপচে পড়া পানিতে নদী যেমন আনন্দে নেচে ওঠে, বিশাল সে জলভান্ডার শুকিয়ে গেলে নদী যেন মরতে বসে। তার জলরাশি অশ্র“ হয়ে বয়ে চলে নতুন আশ্রয়ের অভিলাষে। আবার এই জলরাশি যখন পাহাড়ের ঢল হয়ে নেমে আসে, তখন তা আর অশ্র“ বলে মনে হয় না। বাংলার পাখিও বাংলার নিসর্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এই পাখিও কখনো কখনো হয়ে ওঠে কালের সাক্ষী। আবার সাপের উপদ্রবও বাংলাদেশে কিঞ্চিৎ নয়। এদেশের ঝোপ-জঙ্গলগুলো দিনের বেলাতেই অনেক সময় আঁধারে ছেয়ে থাকে, রাত্রির অন্ধকারে সে আঁধার আরো তীব্র হয়ে ওঠে।
এ কাব্যনাট্যে নিসর্গের সবচে শক্তিশালী চিত্র অঙ্কিত হয়েছে এর কেন্দ্রীয় চরিত্র নূরলদীনের প্রার্থনাময় দীর্ঘ সংলাপে-
দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ,
আমার নদীর পানি খলখল করি উঠিতেছে।
দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ,
আবার বাংলার বুকে জোয়ারের পলি পড়িতেছে।
দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ;
নবান্নের পিঠার সুঘ্রাণে দ্যাশ ভরি উঠিতেছে।
দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ,
হামার গাভীন গাই অবিরাম দুধ ঢালিতেছে।
… … … … …. ….
দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ,
শত শত শিমুলের ডালে লাল ফুল ধরিতেছে।
বাংলার নিসর্গ আজ সঙ্কটাপন্ন বটে, কিন্তু সারাকালই তা ছিল না। এক সময় এ দেশের গাছে গাছে ফুল ফুটতো, সে ফুল এখনো ফোটে কিন্তু আগের মতো আবেদন যেন সেখানে নেই। নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় এখনো পানিতে টইটম্বুর হয়। কিন্তু আগের মতো এগুলোর প্রবাহ তেমন বেগবান হয় না। বাংলার কৃষক, খেটে খাওয়া মানুষ এখনো স্বপ্ন দেখে- তাদের জমিনে আবার পানি পড়বে, ভালো ফসল ফলবে, ঘরে ঘরে নবান্ন উৎসব হবে। সে উৎসবে মুখরিত হবে বাংলার আকাশ, বাতাস, নদী, নক্ষত্র।
আঠারো শতকের শেষপর্যায়ের ঐতিহাসিক ঘটনা অবলম্বনে রচিত ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ কাব্যনাট্যে নাট্যকার একদিকে যেমন উপস্থাপন করেছেন নিসর্গ চিত্র, তেমনি পাশাপাশি অঙ্কন করেছেন লৌকিক মানুষের জীবনাচরণ। এখানে নাট্যকারের শৈল্পিক উপস্থাপনায় চিত্রিত হয়েছে লৌকিক মানুষ তথা কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি, কৃষক, শ্রমিক নানান পেশার মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আহার-নিদ্রা অর্থাৎ যাবতীয় জীবনব্যবস্থা। এইসব দরিদ্র জনগোষ্ঠী ইংরেজ ও দেশীয় জমিদারদের কাছে জিম্মি।
একদিন অবাক হয়া দেখিলোম, কোন তালে কখন হামাক
গুটি সমেত নিছেক খরিদ করি।
আর দেখিলোম, এই দেখিলোম, হামার গলায় দিয়া দড়ি,
একে সৃষ্টি হন আল্লার,
হামার সিনায় তোমরা চড়াও হয়া চড়ি বসি আছেন চমৎকার।
সমাজে যারা ক্ষমতাধর, শক্তিধর সবসময় নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে সমাজকে, সমাজের মানুষকে। অভাব অনটনে পড়ে মানুষ মুক্তির জন্য তাদের কাছে গেলে শোষকগোষ্ঠী তাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কৌশলে তাদেরকে নিঃস্ব করে। অথচ শোষকশ্রেণি তাদের প্রতি শোষণ করে বটে কিন্তু যে জমির খাজনা তারা আদায় করে, সে জমির মালিক তারা নয়।
একদিন লক্ষ্য করি দেখিলোম, খাজনা দেই তোমাক, কিন্তু জমিন,
এই জমিন তোমার নয়।
দেখিলাম, হুকুম দিবার আছেন তোমরা,
বিচারের ভার কাজীর হাতে হয়।
সেই কাজী তোমার কোনো বিচার করিবার নয়।
লৌকিক মানুষের দুর্দশা কখনো শেষ হয় না। নিজের জমিতে চাষাবাদ করেও খাজনা দিতে হয় জমিদারকে, ইংরেজকে। এই খাজনা দিতে বিলম্ব হলে তাদের ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। এই নির্যাতনের কোনো বিচার হয় না। কেননা যারা বিচারক, তারা কখনো শোষকদের সিদ্ধান্তের বাইরে যায় না। প্রায় দুইশত বছর ইংরেজ শাসক শোষণ করেছে এ দেশের এই সাধারণ মানুষদের। তারা এই শোষণ করতে হয়ত পারত না, যদি দেশীয় জমিদার, দেওয়ান তাদেরকে অকাতরে সাহায্য না করতো।
দেওয়ানগিরি চালায় দ্যাশে গোরা কোম্পানিতে।
চৌ-চালাকি চালায় গোরা সিনার পরে বসি।
দেবী সিংয়ে খাজনা তোলে গলায় দিয়া রশি,
গলায় দিয়া রশি হামার হুকুম জারি করে-
ধানের বদল নগদ টাকায় খাজনা দিবার তরে।
বুদ্ধিটা কি ঠাহর করি দ্যাখেন তবে ভাই,
ধান বেচিতে সেই মহাজন ছাড়া উপায় নাই।
ধান করিব, পাট করিব রক্ত ঝরা ঘামে,
ধান কিনিবে মহাজনে নিজের খুশি দামে,
ধান বেচিয়া খাজনা দিলোম, সন্তানে কি খায়?
ঋণ করিতে চাষী আবার সানকি ধরি যায়।
সানকি ধরি যায় রে চাষী মহাজনের ঘরে,
সানকি ধরি যায় রে চাষী জমিদারের ঘরে,
সানকি ধরি যায় রে চাষী কুঠিয়ালের ঘরে,
দুগনা দামে স্বীকার হয়া ধান কর্জ করে।
কর্জ কিসে শোধ করিবেন? কর্জ আবার হয়;
গরু দিলেন, জমি দিলেন, দিলেন সমুদয়।
সমদুয় যে লিখিয়া দিয়া ধান আনিলেন ঘরে,
হায় রে কপাল, পোড়া কপাল, তাতো না প্যাট ভরে।
দীন-হীন মানুষ খাজনা বকেয়ার দায়ে জমিদারের লোক দ্বারা নির্যাতিত নিগৃহীত হয়। খাজনা পরিশোধের জন্য বাধ্য হয় মহাজনের নিকট বাড়িঘর, ফসলের ক্ষেত, হালের বলদ, দুধের গাই বন্ধক রেখে টাকা নিতে। এই বন্ধকের টাকা তারা কোনদিনই শোধ করতে পারে না। মহাজন সস্তায় তাদের সর্বস্ব কিনে তাদেরকে পথে বসায়। সবকিছু হারিয়ে এইসব নিঃস্ব মানুষ পেটপুরে খাবার কখনোই পায় না। পায় না নিরাপদ কোনো বাসস্থান।
ঘর?- ঘর কোনটে আব্বাস মন্ডল?
আজি হতে তোমার হামার ঘর-মাঠ, ঘাট, গহীন জঙ্গল।
মানুষের বেঁচে থাকার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক প্রয়োজন বাসস্থান। ইট-পাথরের তৈরি বিশাল অট্টালিকা তো পরের কথা, সামান্য মাথা গোঁজার ঠাঁইও অনেক সময় নিম্নস্তরের সাধারণ মানুষের ভাগ্যে জোটে না। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষায় তারা যাযাবরের জীবন কাটায়। তারা বেশি কিছু প্রত্যাশা করে না। নিতান্ত জীবিকার জন্য চায় দু’বেলা দু’মুঠো খাবার, মাথা গোঁজার জন্য বাসস্থান, পরিধানের জন্য চায় বস্ত্র।
জংগ জিতি মোর পতিধন আসিল হে বাড়ি।
সেই খুশিতে পিন্ধিনু হয় আগুন পাটের শাড়ি।
আগুনপাটের শাড়ি কবে দিবেন আনিয়া?
আশপড়শীর বাড়ি যামো গুমর করিয়া-
ওকি গুমমর কি গুমমার করিয়া-
‘এখান আগুন পাটের শাড়ি। আর কিছু নয়।’
বাংলার মসলিনের যে শাড়ি একসময় ছিল জগদ্বিখ্যাত, তা তৈরি করতো এ দেশের খেটে-খাওয়া মানুষ। নিজেদের জন্য এই শাড়ি তারা কল্পনাই করতে পারতো না। এমনকি তাদের সাধ্যের মধ্যে যে আগুনপাটের শাড়ি তারা প্রত্যাশা করে, সেটিও অভাবের তাড়নায় পায় না। দীনহীন ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে পরিধানের জন্য মাত্র একটি শাড়ি প্রত্যাশাও যেন অধিক কিছু। নূরলদীনের কণ্ঠে তাই ঝঙ্কৃত হয়Ñ
আগুন, আগুন।
আগুন শাড়িতে নয়, প্যাটোতে প্যাটোতে।
আগুন, আগুন জ্বলে, এই ঠাঁই, হামার প্যাটোতে,
কিষাণের সন্তানের প্যাটের ভিতরে।
আর ঐ আগুনপাটের শাড়ি বোনো যাঁই,
উদাম, উদাম তাঁই,
এক সুতা বস্ত্র নাই কঙ্কাল গতরে।
আগুনপাটের শাড়ি কাড়ি নেয় কোম্পানির কুঠিতে,
আগুনপাটের শাড়ি জ্বলি ওঠে তাঁতির প্যাটোতে।
আগুনপাটের শাড়ি দাউ দাউ করি জ্বলে সারা বাংলাদেশে।
নূরলদীনের আলোচ্য সংলাপে বাংলার অভুক্ত, অনাহারী মানুষের বেদনার চিত্র ফুটে উঠেছে। কৃষক ফসল ফলায়, জেলে মাছ ধরে, তাঁতি শাড়ি বোনে-সবাই সবার সাধ্য মত কাজ করে, তবুও ক্ষুধার আগুন তাদের পেট থেকে কখনো যায় না। বাংলার লোকজীবনে এই হাহাকার যেন নিত্যনৈমিত্তিক। অহর্নিশি তাদের এই অভাব-অনটনের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে টিকে থাকতে হয়। এর সঙ্গে আরো রয়েছে মশা, মাছি, বিভিন্ন রোগ-প্রকৃতির যন্ত্রণা।
মশা, মাছি, জ্বর কিংবা আমাশয় নয়,
… অদূর যে ভবিষ্যতে, সেদিন সেদিন
ভূতলে অতুল স্বর্গ বলে মনে হবে আমাদের,
লোকজীবনের দুঃখ কষ্টের কোন শেষ নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণ, দু’বেলা দু’মুঠো খাবার, মাথা গোঁজার ঠাঁই, এগুলোই যেন তাদের কাছে এক কল্পিত স্বর্গ বলে মনে হয়। তারা এমন জরাজীর্ণ অবস্থা থেকে মুক্তি চায়, প্রয়োজনে সন্ন্যাসী হতেও তারা প্রস্তুত।
এবার সন্ন্যাসী হবো,
ফকির যে হবো।
জন্মের সময়ে বস্ত্র অঙ্গে ছিল না যে,
মুঁই সেই সাজে
এ হেন সংসার ছাড়ি মককাতে হে যাবো,
এ হেন সংসার ছাড়ি কৈলাসেতে যাবো,
এহেন সংসার ছাড়ি আজমীরেতে যাই,
এ হেন সংসার ছাড়ি বৃন্দাবনে যাই।
চারদিকে রোগ-শোক, দুঃখ-দুর্দশায় অতিষ্ঠ মানুষ বাঁচার জন্য শেষ পর্যন্ত সন্ন্যাসী হতে চায়, যেতে হয় দেশ-দেশান্তরে বহুদূরে। তবুও তারা বাঁচতে চায়। কিন্তু তাদের পরিত্রাণ হয় না। সকল দুর্দশা মাথায় নিয়েই তাদের বেঁচে থাকতে হয়।
তীর্থে যাবো, তারো মাশুল শুনিয়া দেওয়া চাই।
ডাইনে দিবেন, বাঁয়ে দিবেন, দিবেন কাছাড়িকে,
মহাজনের ঘরে দিবেন, দিবেন কোম্পানিতে।
দরপত্তনিদার, গাঁতিদার, জমিদার আর গোরা
এক হাতোতে আদায় করে, আরেক হাতে কোড়া।
ঘরের নারী নেয় কাড়িয়া, জ্বালেয়া দেয় ঘর,
নীল বুনিয়া দেয় রে গোরা হামার সিনার পর।
বিষের বিষে সর্পবিষে গোক্ষুরারই ন্যায়,
হামার দেহে হামার লহু নীল করিয়া দ্যায়।
ইংরেজ-জমিদার দেশবাসীর ওপর নানাভাবে নির্যাতন করেছে। যে কোন উছিলায় লোকজনের কাছ থেকে খাজনা আদায়, কৃষকের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদেরকে নীলচাষে বাধ্য করা, ঠুনকো কারণে তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া এবং তাদের মা-বোন-স্ত্রীর সতীত্ব হরণ অত্যাচারী পিশাচদের ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ক্রিয়াকলাপ। তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়, লাশ হয়ে ফিরে আসতে হয়। তবুও বুকে প্রত্যয় নিয়ে দীনহীন মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায় তাদের প্রতিনিধি চরিত্র নূরলদীন।
মুক্তি দিবে নূরলদীন
রক্ষা দিবে নূরলদীন।
তারায় হামার নবাব হামার নবাব নূরলদীন।
জয় নবাব নূরলদীন।
সারাদেশ যখন ইংরেজ-জমিদারের নির্যাতনের শিকার, তখন নূরলদীনকে প্রতিবাদী হতে দেখে বাংলার সর্বস্তরের মানুষ আশায় বুক বাঁধতে শুরু করে। যুগযন্ত্রণার ঘোরতর অমানিশায়ও মুক্তির যেন ক্ষীণ আলো দেখতে পায় তারা। নূরলদীন মানবেতর জীবনযাপন কর এসব সহায়হীন মানুষের অধিকার আদায়ে জীবনপণ লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নূরলদীন।
এই যুদ্ধে মরোঁ যদি, কেনো দুঃখ নাই।
হামার মরণ হয়, জীবনের মরণ যে নাই।
প্রকৃত বীর মৃত্যুভয়ে কখনো ভিতু নয়। অকুতোভয় নূরলদীন জানে ইংরেজ-জমিদারদের সমূলে বিনাশ করতে না পারলে যুগ যুগ ধরে তাদের মতই তার উত্তরসূরিদের শোষণ-নির্যাতনের শিকার হতে হবে। তাই পরবর্তী প্রজন্মের অনাগত ভবিষ্যৎ যেন সুন্দর হয়, তারা যেন স্বাধীন জীবন-যাপন করতে পারে, সেজন্য নূরলদীন নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন শত্র“দের প্রতিহত করতে। লোকজীবনের দুঃখ-কষ্টের মর্মন্তুদ ঘনীভূত হয়ে ফুটে উঠেছে নূরলদীনের দীর্ঘ সংলাপে-
হঠাৎ নূরলদীন দেখিবার পায়,
দেখিয়া তাজ্জব তাঁই হয়া যায়, দেখিবার পায়,
বাপ তার নিজ কান্ধে জোয়াল তুলিল,
জোয়ালে সে অতি ধীরে নিজেকে জুতিল।
বলিল নূরলদীন, বেচইন, ‘এ কি হয়? কোনঠে বলদ?
‘বাপ, আজি হতে নাঙলের নূতন বলদ।’
আবার নূরলদীন কান্দিয়া শুধায়,
‘বাপজান, তুমি ক্যানে? বলদ কোন ঠায়?’
‘বলদ তো নাই বাপ, বেচিয়া নগদে
রাজার খাজানা শোধ দিনু কোনোমতো।’
… … …
মাথার উপরে সূর্য অগ্নি ঢালি যায়,
একখান মরা গাছে স্তব্ধ মারি শকুন তাকায়।
নিচে, নাঙলের লোহার ফলায়
ধীরে ধীরে মাটি ফাড়ি যায়।
থর থর করি কাঁপে মুষ্টি তার, হাত থামি যায়,
… … …
জোয়াল কান্ধেতে বাপ অকস্মাতে পড়ি যায় জমির উপর।
ঘাড় ভাঙ্গি পড়িয়া সে যন্ত্রণায় ছটফট করে কিছুক্ষণ,
তারপর, হঠাৎ মস্তক তুলি, নিরলক্ষার পানে দৃষ্টি করিয়া স্থাপন,
বাপজান, বাপ মোর, ভাগাড়ে অন্তিমকালে পশুর মতন
ডাক ভাঙ্গি উঠিল হাম্বায়।
নৈসর্গিকচিত্র লোকজীবনে কখনো কখনো নির্মমভাবে ফুটে উঠতে দেখা যায়। সহায়হীন মানুষের নিদারুণ কষ্ট ছবি হয়ে ফ্রেমে ধরা দেয়। অত্যাচারী শাসকের নিষ্ঠুরতায় অগণিত কৃষক, শ্রমিক, জেলে, তাঁতি নানান স্তরের মানুষের জীবনে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ নেমে এসেছে। লাঙলের লোহার ফলায় মাটি যেমন ফেড়ে-চিরে যায়, তাদের নির্যাতনে এসব মানুষের বুকের পাঁজর তেমনি খণ্ডিত হয়, ঝলসিত হয়। কখনো কখনো নারকীয় যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। পূর্বপুরুষদের ওপর এইসব নির্যাতনের চিত্র পরবর্তী প্রজন্মকেও প্রভাবিত করে, বিষিয়ে তোলে।
নিশীথে নামিয়া আসি নিন সব নিমেষে ভুলায়।
স্মরণ, মরণ, দুঃখ কষ্ট যত আছে দুনিয়ায়
নিঁনি আসি মুছি নিয়া যায়
গোলাপের জলের তুলায়।
হামার না আছে নিঁন চোখের পাতায়।
হামার জগতে শব্দ শান্তি না পায়।
অতীতের কষ্ট মানুষ ভুলে থাকতে চায়, কিন্তু পারে না। ক্ষণে ক্ষণে তা মনের গোপন কোণে তুষের আগুনের মতো দগ্ধ করে, জ্বালা দেয়। নূরলদীন তার অতীত ভুলতে চেয়েছে, ভুলতে পারেনি, শান্তিতে থাকতে চেয়েছে, শান্তি পায়নি। অতীতে তার বাবা যেমন ইংরেজ ও জমিদার দ্বারা সর্বস্বান্ত হয়েছিল, তেমনি সে নিজেও তাদের দ্বারা নিঃস্ব হয়েছে।
একদিন টাকায় টাকা সুদ স্বীকার করি মহাজনের ঘরোতে গেইলোম,
কর্জ শোধ করিবার না পাই বলিয়া জমি লিখিয়া দিলোম,
ঘটি বাটি লাঙল বলদ মই বিক্রি করিলোম,
বাপ হয়া বিক্রি করিলোম ব্যাটা, স্বামী হয়া ইস্তিরি,
যুবতী কন্যা নিল কাড়ি,
জংগল পলেয়া গেইলোম, গোরস্তান শ্মশান হয়া গেইল
হামার বাপোদাদার বাড়ি,
হামার নিজের ভিটা, নিজের মাটি চলি গেইল শয়তানের দখলে।
লোকজীবনের মানসপটে একই চিত্র, একই ঘটনা বারবার ফিরে আসে। সে চিত্র বেদনার, সে ঘটনা কষ্টের, তিক্ততার। যুগ যুগ ধরেই তাদের জীবনে এমন ঘটনা অহরহ ঘটে থাকে। হয়ত শাসকের পরিবর্তন হয়, হয়ত শোষণের ধরন বদলে যায়, কিন্তু সাধারণ মানুষের ওপর শোষণ চলে চিরদিনই। আর চিরদিনই নূরলদীনের মত কেউ না কেউ এসে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের দুর্গ গড়ে তোলে।
একজোট হয়া সবে এক সাথে কন-
হামার দ্যাশে হামার অধিকার।
নূরলদীন চেয়েছে বাংলার মাটি থেকে ইংরেজদের উচ্ছেদ করতে, এদেশের মাটিতে তারা যে শিকড় গেড়েছে, তা উপড়ে ফেলতে। তার একার পক্ষে যেহেতু তা করা সম্ভব নয়, তাই সে নিপীড়িত-সর্বহারা মানুষদের ঐক্যবদ্ধ হতে আহ্বান জানিয়েছে। সুবিধাবঞ্চিত ও নির্যাতিত কৃষক, শ্রমিক, জেলে, তাঁতি সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ ইংরেজ ও জমিদার প্রতিহত করতে নূরলদীনের নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নূরলদীনকে তাদের নেতা বানায় তারা।
হামার নেতা নূরলদীন আর বা কিসে ডর?
নূরলনের হাতে হামার বাপোদাদার ঘর।
বাপোদাদার ঘর রে হামার সন্তানেরও ঘর।
জগতে লাঞ্ছিত, নিপীড়িত ও সর্বহারার সংখ্যাই বেশি। তাদের শক্তিও কিঞ্চিৎ নয়। কিন্তু তারা সংগঠিত নয় বলে পরাধীনতার জিঞ্জির থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। তাদেরকে সংগঠিত করতে, ঐক্যবদ্ধ হতে কেউ না কেউ এগিয়ে আসে। এগিয়ে আসে জাতির ত্রাণকর্তারূপে। নূরলদীন আমজনতার তেমনই এক কর্ণধার। চারিদিকে ‘নূরলদীন, নূরলদীন’ রব উঠে যায়। জনসাধারণ তাকে তাদের ‘নবাব’ বলে মেনে নেয়। কিন্তু নূরলদীন কখনো নবাব হতে চায়নি। সে চেয়েছে শোষণকারীদের সমূলে বিনশ করতে-
রাজ সিংহাসনে?
জঙ্গলে আসিয়া ডেরা বান্ধিবার পরে
কিষাণের বাহিনী গড়িয়া,
সবার সম্মুখে মুঁই নিজ হাতে বন্দুক ধরিয়া
ফতেপুর, কাকিনায়, টেপায়, পাংশায়
এই কয়মাসের ভিতরে,
যত যুদ্ধ করিলোম তুচ্ছ করি নিজের জীবন,
করিলোম কিসের আশায়?
রাজসিংহাসন?
জীবন হাতোতে করি গভীর নিশীথে, কি কারণ?
কিসের লোভেতে
নায়ের গোমস্তাগণ বধ করিলোম-দাওয়ের কোপেতে?
নবাব নূরলদীন?
নূরলদীনের মনে ইংরেজ-জমিদারের প্রতি যে দ্রোহ, তা ঠুনকো কোন ঘটনার জন্য নয়, তাদেরকে সে বিনাশ করতে চায় ক্ষমতার জন্য নয়। তাদের অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে। সে যতগুলো যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, নেতৃত্ব দিয়েছে, নায়েব-গোমস্তা খুন করেছে, সেগুলোর প্রতিটির নেপথ্য কারণ-দেশকে শত্র“মুক্ত করা, স্বাধীন করা। সে হাতে অস্ত্র নিয়েছে সবার কল্যাণের জন্য; নিজের ক্ষমতা প্রসারের জন্য নয়। কিন্তু বঞ্চিতদের দল ঐক্যবদ্ধ হয়েছে জেনে ইংরেজ-জমিদার তাদের ওপর শাসন নির্যাতনের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। নূরলদীনকে ধরার নামে অত্যাচার চালায় নিরীহ মানুষের ওপর।
সে ঠাঁই দ্যাখোঁ জনমানুষের শতেক ঘর আছে?
ঘরগুলোতে আগুন দিলোম সটকি পড়ে পাছে।
আংগরা করি দিলোম তবু মানুষ মরে নাই।
পশ্চিমেতে আবার শোনে শিঙা ফুঁকায় কাঁই।
তলাশ তলাশ তলাশ
জ্যান্ত পারেন মড়ায় পারেন আনেন উয়ার লাশ।
কাঁই কইলে কাঁই কইলে পশ্চিমেতে আছে?
পশ্চিমেতে ফাঁসি দিলোম মানুষ ধরি গাছে।
চৌমাথাতে শতে শতে কিষাণ ঝুলি আছে।
শ্মশান করি দিলোম তবু আওয়াজ ক্যানে ভাসে?
দক্ষিণেতে আবার দ্যাখোঁ বাদ্য বাজায় কাই।
তলাশ তলাশ তলাশ
জ্যান্ত পারেন মড়ায় পারে আনেন উয়ার লাশ।
নূরলদীনে আহ্বানে সর্বহারা মানুষ যখন দলে দলে আন্দোলনে যোগ দেয়া শুরু করে, তখন ইংরেজ-জমিদারও গণমানুষের ওপর অত্যাচারের মাত্রা আরো বাড়িয়া দেয়। কামার, কুমার, তাঁতি, জেলে, কৃষক কেউ তাদের নির্যাতন থেকে বাদ যায় না। অনেকেই জমিদারের চাবুকের আঘাতে জর্জরিত, ক্ষত-বিক্ষত হয়ে রক্তাক্ত দেহে গাছে ঝুলে মৃত্যুর প্রহর গুনে। তাই ইংরেজ ও জমিদারের অত্যাচারে অতিষ্ঠ জনসাধারণ শেষ পর্যন্ত ক্রোধান্বিত হয়ে নূরলদীনের নিকট প্রতিশোধের জন্য আবেদন জানায়-
আর সেই অত্যাচার সহ্য না হয়।
আর এই অনাহার সহ্য না হয়।
আর এই অবিচার সহ্য না হয়।
নিষ্পেশিত, নিরীহ জনগণও শেষ পর্যন্ত আর স্থির থাকতে পারে না। দ্রুত ইংরেজ জমিদারের নরকতুল্য নির্যাতন বন্ধের জন্য বিক্ষোভ শুরু করে। নূরলদীন সর্বহারার দলকে লাঠি, সুরকি, পলো, যার যা আছে, তা-ই নিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদাত্ত আহ্বান জানায়।
‘… জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়?’
নূরলদীনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে লৌকিক মানুষের প্রতিবাদী চেতনা তীব্রভাবে ফুটে উঠেছে। তাদের এই চেতনা কখনো নিঃশেষিত হয় না, সঞ্চারিত হয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
এক এ নূরলদীন যদি চলি যায়,
হাজার নূরলদীন আসিবে বাংলায়।
এক এ নূরলদীন যদি মিশি যায়,
অযুত নূরলদীন য্যান আসি যায়
নিযুত নূরলদীন য্যান বাঁচি রয়।
পৃথিবীর হাজার হাজার বছরের ইতিহাসে অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর যেমন জন্ম হয়, শোষণ করে নিম্নস্তরের মানুষকে, তেমনি যুগে যুগে তাদেরকে প্রতিহত করার জন্য নূরলদীনের মত বিপ্লবীদেরও জন্ম হয়। এই নূরলদীন তখন আর ব্যক্তি নূরলদীন থাকে না, সে হয়ে ওঠে সর্বকালের সর্বযুগের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদী মানুষের প্রতিনিধি। হ