(‘মেদান’ অনলাইন পোর্টালে ক্যালিগ্রাফার খালিদ পাবলো কাসাদোর এ লেখাটি ছাপা হয়েছিল। গুরুত্ব বিবেচনায় লেখাটি ভাষান্তর করে প্রকাশ করা হলো। মূলত এটি একটি মনোলগ বলা যায়। অ্যারিস্টটল যেমন বলেছিলেন, ‘ধৈর্য তেতো, কিন্তু এর ফল মিষ্টি।’ ক্যালিগ্রাফি এমন একটি শৃঙ্খলা যার জন্য অনুশীলন ও ধৈর্য উভয়ই প্রয়োজন। খালিদ যখন ক্যালিগ্রাফি করেন সে সময় তিনি দুর্দান্ত ধৈর্যের পরিচয় দেন।
পাবলো খালিদ কাসাদো স্পেনের একজন মাস্টার ক্যালিগ্রাফার। তিনি তুরস্ক ও স্পেনের বেশ কয়েকজন মাস্টারের সাথে অধ্যয়ন করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে, মাস্টার ক্যালিগ্রাফার নুরিয়া গার্সিয়া ম্যাসিপ, তুর্কি মাস্টার হাসান চালাবি ও ফেরহাত কারলু। ১৯৮২ সালে স্পেনের মাদ্রিদে পাবলো কাসাদোর জন্ম।
২০০৮ এই শিল্পের অনুশীলনের মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে তার এর প্রতি গভীর আগ্রহ জন্মে। তিনি শিগগিরই একজন প্রকৃত মাস্টারের কাছ থেকে আরো নির্দেশ পাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করছিলেন, যিনি তাকে এই প্রাচীন জ্ঞান দান করতে পারেন। সেই সময়েই তিনি স্পেনের বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার নুরিয়া গার্সিয়ার সাথে দেখা করেন। এই বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার পরে তার পরামর্শদাতা ও মাস্টার হয়েছিলেন।
কাসাদো ২০১৪ সালে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অবস্থিত ইসলামি শিল্প, ইতিহাস ও সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র (IRCICA) থেকে সুলুস ও নাসখ উভয় শিল্পরীতিতে ডিপ্লোমা করেছেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে ক্লাস নেন। বর্তমানে তিনি নিয়মিত ইস্তাম্বুল ভ্রমণ করছেন। সেখানে অনেকটা সময় কাটাচ্ছেন। এর কারণ, যাতে তার মাস্টারদের সাথে যোগাযোগ না হারিয়ে যায়। তাছাড়া তার কাজ শেখা ও পরিমার্জিত করার মহান উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে এতে।)
ক্যালিগ্রাফির রাস্তায় আপনি যাত্রা শুরু করেছেন। এ পথে কখন আপনি ক্যারিয়ার শেষ করবেন তা, আপনি জানেনই না। ইসলামী ক্যালিগ্রাফি শিক্ষার ব্যাপ্তি জীবনব্যাপী। মনে রাখতে হবে-এটি এমন এক যাত্রা যা শুধু লিখনকলা রপ্ততেই সীমাবদ্ধ নয়। লিখনকলার পাশাপাশি শিখতে হয় মানবিক অভিজ্ঞতার বিষয়-আশয়। যেমন-নম্রতা, ধৈর্য, সুশৃঙ্খলা বা বিনয় শিক্ষার পাঠ নিতে হয়।
অক্ষরের আকৃতির সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হওয়ার পর প্রথমে ক্যালিগ্রাফি করা শুরু করি। মনে মনে ভাবলাম এতে কোন সন্দেহ নেই যে, একটি অলৌকিক, একটি পবিত্র জ্ঞান, প্রতিটি স্ট্রোকে ও প্রতিটি অক্ষরের পিছনে একটি অন্তর্নিহিত বার্তা লুকিয়ে আছে। আজ অবধি, আমি উপলব্ধি করি যে এটি একটি সহজ সত্য যার মধ্যে একটি রহস্য লুকিয়ে আছে। যেটাতে আপনার নিজের আত্মার সাথে সংযোগ স্থাপন করে। যখন আপনি ক্যালিগ্রাফির একটি অংশ পর্যবেক্ষণ করেন, এমনকি আপনি এতে কী লেখা আছে তা বুঝতে না পারলেও। তবে একটি সুপ্ত সংযোগ রয়ে গেছে, আর সেটা হচ্ছে যখন ক্যালিগ্রাফির একটি অংশ দেখেন তখন। সেটা নিছক বোঝার বাইরে। আর অদৃশ্য সেই সংযোগটি আমাকে ক্যালিগ্রাফি অনুশীলন শুরু করতে প্রণোদনা জোগায়। আমি নিজেই এটি তৈরি করছি, আমি কী তৈরি করছি সে সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই, তবে এই শিল্পের জাদুতে মুগ্ধ হয়েছি।
নুরিয়া গার্সিয়া ও সনদপ্রদান অনুষ্ঠান
ক্যালিগ্রাফির সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল নুরিয়া গার্সিয়া মেসিপের সাথে দেখা হওয়ার কয়েক মাস পরে। মেসিপ আমার ভবিষ্যতের পরামর্শদাতা, শিক্ষক আর যিনি আমার জীবনে সবচেয়ে বড় পেশাগত পরিবর্তনের সূচনা করেছিলেন। যখন আমি তার সাথে দেখা করি, ততদিনে তিনি একজন বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার হয়ে গেছেন। তিনি আমাকে ইস্তাম্বুলে নিয়ে গিয়েছিলেন আর তার নিজের শিক্ষকদের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তাই আমি তার ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তুর্কি ক্যালিগ্রাফি মাস্টারদের সাথে পড়াশোনা শুরু করি। পাঁচ বছর প্রশিক্ষণের পর, আমি মাস্টার ক্যালিগ্রাফার হাসান চালাবি, ফেরহাত কারলু ও নুরিয়া গার্সিয়া স্বাক্ষরিত আমার ‘ইজাজাহ’ বা ক্যালিগ্রাফি সনদ পাই।
উসমানীয় সাম্রাজ্যের দীর্ঘমেয়াদি রাজধানী ইস্তাম্বুল একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ও শৈল্পিকসমৃদ্ধ শহর। এটি এমন একটি জায়গা যেখানে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ক্যালিগ্রাফির ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। ইস্তাম্বুলে আপনি সহজেই খুঁজে পেতে পারেন সারা বিশ্বের মানুষদের, যারা এই বিশেষ শহরে আসছেন মাস্টারদের কাছ থেকে শিখতে।
ক্যালিগ্রাফি শিক্ষার উদ্ভব হয়েছিল জাজিরাতুল আরব বা আরব উপদ্বীপে আর দ্রুত তা বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয়। ক্যালিগ্রাফির ঐতিহ্যের প্রধান ধারা সিরিয়া, ইরাক, পারস্য ও পরে আনাতোলিয়া এবং উসমানীয় সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। ইসলামের সূচনাকাল থেকেই শিক্ষাটি মাস্টার থেকে ছাত্রের কাছে চলে এসেছে, যা জ্ঞানের শৃঙ্খলা বা সিলসিলা তৈরি করেছে।
ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলী ইবন আবু তালিব, মুসলমানদের দ্বারা প্রথম প্রধান ক্যালিগ্রাফার হিসাবে বিবেচিত হন। তাই সেখান থেকে ধারাবাহিকতা বা হস্তান্তরের সিলসিলা শুরু হয়, যা বহুশতাব্দী পেরিয়ে আজকের পর্যায়ে নথিভুক্ত হয়েছে। এটি না উল্লেখ করলেও হয়, আপনি যখন উসমানীয় স্কুল অফ ক্যালিগ্রাফির একজন শিষ্য হয়েছেন, তখন আপনি জ্ঞানের ট্রান্সমিশন বা হস্তান্তরের শৃঙ্খলে যুক্ত হয়েছেন। এর মানে হলো আপনি আপনার জ্ঞান সেই মাস্টারদের কাছ থেকে পাচ্ছেন যারা একসময় পুরনো মাস্টারদের ছাত্র ছিলেন। যারা আজ অবধি ঐতিহ্যগত শিক্ষার পদ্ধতি ও প্রথম ক্যালিগ্রাফারদের দ্বারা ব্যবহৃত একই শিল্প উপকরণ ব্যবহার করেন।
অক্ষরের ক্লাসিক মডেল বা আকারগুলো কোনও পরিবর্তনের শিকার হয়নি, জ্ঞানটি উত্তীর্ণ হয়েছে- এটা নিশ্চিত করে। ক্যালিগ্রাফির ঐতিহ্য রক্ষার একটি অতিরিক্ত পদক্ষেপ হল ‘আচার অনুষ্ঠান’-এর সিলসিলা পালন করা।
ক্যালিগ্রাফি শিখন : একটি উপহার
উসমানীয় স্কুলে ক্যালিগ্রাফির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আচারটি শিক্ষার প্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত। এই বিদ্যালয়ে শিক্ষাদানকে সবসময় একটি উপহার হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে; আর যিনি প্রধান শিক্ষক তিনি এই উপহার এর জন্য চার্জ করতে পারবেন না।
আমরা জীবনে যে জিনিসগুলি বিনামূল্যে পাই তা হলো আমাদের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। আর সেটা যখন আমরা বিনামূল্যে পাই, তখন আমাদের বিনামূল্যে ফিরিয়ে দিতে হয়। এটি ক্যালিগ্রাফি শেখানোর উসমানীয়-তুর্কি পদ্ধতির সারাংশ। এটি একটি উপহার যা আপনি পেয়েছেন। ঐতিহ্য আমাদের বলে, আরেক জনকে উপহারটি ফেরত দিতে হবে।
সুতরাং, এটি অনুসরণ করে প্রতিটি একক ক্যালিগ্রাফার একজন শিক্ষক হয়ে ওঠেন, কারণ আপনি যা পান আপনি বিনিময় করেন। আর যখন আপনার অভিজ্ঞতা আছে, আপনাকে এটি উত্তীর্ণ করতে হবে।
শিক্ষা সবসময় ব্যক্তিগতভাবে করা হয়, তাই ছাত্র প্রতিটি গতি দেখতে পারে আর মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করতে পারে যে তার মাস্টারের হাত কিভাবে চলে। শিক্ষক কিভাবে কলম ধরেন, কিভাবে তিনি এটাকে ঘুরান, কোন সময়ে তিনি স্ট্রোক শুরু করেন, কোথায় তিনি বিরতি দেন আর কোথায় তিনি শেষ করেন এই সমস্ত বিষয় সেই শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের দিক।
মাস্টারের হাত
ক্যালিগ্রাফারের প্রতিটি ছাত্রকে এই কথাটি শেখানো হয়: ‘আপনার মাস্টারের হাত আপনার শেখার সমস্ত জ্ঞান রাখে।’
এই ঐতিহ্যে হাতের একটি নির্দিষ্ট প্রতীক আছে। একজন ক্যালিগ্রাফারের জন্য একটি সুস্থ হাত থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
উসমানীয় মাস্টার ক্যালিগ্রাফার আর তাদের ‘হাত’ সম্পর্কে কিছু আকর্ষণীয় গল্প রয়েছে, যেমন কাজাস্কার মুস্তাফা ইজ্জত এফেন্দির গল্প; যিনি একজন ক্যালিগ্রাফার ছাড়াও ইস্তাম্বুলের ইয়ুপ মসজিদের ইমাম ছিলেন। প্রতি শুক্রবার তিনি ওই মসজিদে বক্তৃতা দিতেন আর এতে তিনি দিনের বেলায় ক্যালিগ্রাফি করতে পারতেন না। তাই তার হাত যাতে অলস হয়ে না যায় তার জন্য; ক্যালিগ্রাফি অনুশীলন করার জন্য তার হাতে একটি নরম জিনিস রেখে দিতেন।
এরকম আরেকটি গল্প সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্যালিগ্রাফারদের একজন সামি এফেন্দি সম্পর্কে; যিনি রাস্তায় হাঁটার সময় তার শার্টের বোতামগুলির মধ্যে তার হাত রাখতেন, তার হাতকে আঘাত হওয়া থেকে রক্ষা করার প্রয়াসে।
অনুরূপভাবে, তুর্কি ভাষায় একটি বাগধারা রয়েছে যা প্রায়শই ক্যালিগ্রাফারদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়। যখন কেউ একটি সুন্দর কাজ তৈরি করে, তখন তারা বলবে ‘এলেরিন সাগলিক’, যার অর্থ- ‘আল্লাহ তোমার হাত রক্ষা করুন।’
মাস্টারকে দেখান
আরেকটি আচার বা ঐতিহ্য যা ক্যালিগ্রাফি চেনা-শোনাগুলিতে ক্রমাগত পুনরাবৃত্তি হয় তা হলো- প্রত্যেক ক্যালিগ্রাফার সংশোধন ও পরামর্শ পাওয়ার জন্য, মাস্টারকে কাজ দেখানোর জন্য সপ্তাহে অন্তত একদিন তার কাছে যান।
আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে শিক্ষা সবসময় বিনামূল্যে করা হয়; তাই আপনার শিক্ষককে অর্থ প্রদান করার একমাত্র উপায় হলো এই শিল্পে নিজেকে প্রয়োগ করা সর্বোত্তম উপায়ে, যা আপনি করতে পারেন এবং তার সাথে দেখা করা আর তাকে আপনার কাজ দেখানো বন্ধ না করা।
মাস্টারের সাথে দেখা করা শুধুমাত্র একজন নবিস ক্যালিগ্রাফারের দায়িত্ব নয়, এ দায়িত্ব সকল ক্যালিগ্রাফারের পালন করা উচিত। ক্যালিগ্রাফার তিনি ইতোমধ্যে একজন বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার কিনা তা বিবেচ্য নয়, বরং তার মাস্টারের সাথে দেখা করা উচিত
মাস্টার ক্যালিগ্রাফারের সিগনেচার
মাস্টারের সাথে সাক্ষাৎই ঐতিহ্যগতভাবে একজন ক্যালিগ্রাফি মাস্টারকে সম্মান করার একমাত্র উপায় নয়। আমরা ক্যালিগ্রাফির ছাত্ররা, আমাদের মাস্টারদের সম্মান করি। একটি সূত্রের মাধ্যমে আমরা একটি ক্যালিগ্রাফি টুকরায় স্বাক্ষর করতে পছন্দ করি। এটি সমস্ত ক্যালিগ্রাফারদের জন্য একইভাবে প্রযোজ্য। একটি কাজ শেষ হলে ছোট একটি কলম দিয়ে একই কাগজে ক্যালিগ্রাফার লেখেন :
[এটি] নগণ্যের দ্বারা লেখা (বিনয়সূচক বাক্য), এরপর থাকে ক্যালিগ্রাফারের নাম (একজন ছাত্র ক্যালিগ্রাফার) এরপর থাকবে তার মাস্টারের নাম, পরে থাকবে দোয়াসূচক বাক্য (আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন ও তার প্রতি সন্তুষ্ট হোন।)।
এই সূত্রটি এসেছে সপ্তদশ শতাব্দীর উসমানীয় ক্যালিগ্রাফার হাফিজ ওসমানের কাছ থেকে। হাফিজ যখন একজন ছাত্র ছিলেন, ততক্ষণে তিনি একজন প্রতিভাধর শিল্পীতে পরিণত হয়েছেন। আর তিনি অনুপম হাতের লেখায় পুরো কুরআনের একটি অনুলিপি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। একদিন তার মনিব এই কোরআনটি নিয়েছিলেন আর হাফিজকে তার সাথে সেই সময়ের উসমানীয় সুলতানের সাথে দেখা করতে বলেছিলেন; যাতে করে সুলতান হাফিজের কাজের সৌন্দর্য দেখতে পান। কুরআনের কপি দেখে সুলতান মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি হাফিজের কাছে জানতে চাইলেন, এই সুন্দর শিল্পকর্মটির ক্যালিগ্রাফার কে? উত্তরে, হাফিজ বলেছিলেন: ‘এটি মাস্টার মুস্তাফার নগণ্য ছাত্রের দ্বারা লিখিত। আইয়ুবি।’ অন্য কথায়, হাফিজ যেভাবে শুধু তার মাস্টারের নাম উচ্চারণ করেন তাকে সম্মান ও সম্মান দেখানোর জন্য, ঠিক সেভাবে আমরা ক্যালিগ্রাফির ছাত্ররা আজও তার ঐতিহ্য অনুসরণ করি।
কলম ও তার শেভিং
ক্যালিগ্রাফি লিখতে আমরা যে কলম ব্যবহার করি তা বাঁশের একটি সাধারণ টুকরো বলে মনে হতে পারে, তবে মুসলিম ক্যালিগ্রাফারদের জন্য এটির একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। আর সেসবের বেশ কয়েকটি আচার-অনুষ্ঠান কলমের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
ইসলামী সাহিত্যে, আমরা দেখতে পাই যে আল্লাহ সর্বপ্রথম যে জিনিসটি সৃষ্টি করেছিলেন তা হলো কলম, আর এর দায়িত্ব ছিল একজনের জীবনে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনা রেকর্ড করা। একইভাবে, আমরা দেখতে পাই যে কোরানে পুরো একটি অধ্যায় ‘সূরা কলম’। ষাটতম অধ্যায়ের নাম কলম থেকে নেওয়া হয়েছে।
আমাদের আরও মনে রাখা উচিত যে ক্যালিগ্রাফার প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে সময় ব্যয় করেন। আর তার হাতে জীবনব্যাপী হাতে থাকে কলম। কলমটি ক্যালিগ্রাফারের হাতে দীর্ঘ সময় ধরে থাকে। আর এটি একটি অবলম্বন বা মাধ্যম যা দিয়ে কাগজে কিছু ধারণা ও অনুভূতি প্রকাশ করতে ব্যবহৃত হয়। সুতরাং কলম হচ্ছে একজন ক্যালিগ্রাফারের জন্য সবচেয়ে পবিত্র হাতিয়ার।
ক্যালিগ্রাফির ছাত্রদের দ্বারা সম্মানিত একটি আচার হলো, প্রতিবার আপনার কলম কাটা ও তীক্ষè করার সময় আপনি যে সমস্ত শেভিং পান তা রাখা। কারণ এগুলো সরাসরি আয়াত বা হাদিসের সাথে সম্পৃক্ত। আমরা কলমের মুণ্ডন বা শেভিং জমা করে রাখি; আমরা পবিত্র পাঠ্য লেখার জন্য যে টুল ব্যবহার করি তার একটি অংশ ট্র্যাশে ফেলতে চাই না, আর সেগুলো আবর্জনার সাথে মিশিয়ে দিতে চাই না।
ঐতিহ্য বলে, যেদিন থেকে সে ক্যালিগ্রাফি শেখা শুরু করবে, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ক্যালিগ্রাফারকে তার সমস্ত শেভিং রাখতে হবে। আর যখন একজন ক্যালিগ্রাফারের মৃত্যু হয়, তখন তার পরিবার শেভিংগুলি সংগ্রহ করে আর সেগুলিকে ফুটন্ত তপ্তপানিতে ফেলে দেন যা তারা ক্যালিগ্রাফারের মৃতদেহ ধোয়ার জন্য ব্যবহার করবে (মুসলিম ঐতিহ্য অনুসারে, পরিবার মৃত ব্যক্তির সৎকারের ব্যবস্থা করে।) অন্য কথায়, ক্যালিগ্রাফার যখন এই জগৎ থেকে তার বস্তুগত রূপ নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়, তখন তার কলমের মুণ্ডনও অদৃশ্য হয়ে যায়।
পানি ও কালি
আমরা কালি মেশানোর জন্য যে পানি ব্যবহার করি তার সাথেও একই রকম কিছু ঘটে। উসমানীয় খেলাফতের সময় ক্যালিগ্রাফাররা তাদের নিজস্ব কালি তৈরি করতে শুধুমাত্র বৃষ্টির পানি ব্যবহার করতেন। তাদের ভাষ্য- বৃষ্টি হল ‘রহমাতুল্লাহ’, যার অর্থ ‘আল্লাহর রহমত।’ এই কারণেই, ক্যালিগ্রাফাররা তারা এটিকে ব্যবহারযোগ্য সবচেয়ে বিশুদ্ধ পানি হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন।
আজকাল বৃষ্টির পানির পাশাপাশি, কলের পানির ব্যবহার এড়াতে আমরা গোলাপ পানি বা পাতিত পানি ব্যবহার করি। কারণ আমরা নিশ্চিত নই যে এই পানি যে পাইপগুলির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তা সম্পূর্ণ পরিষ্কার কিনা; আমরা এমন কিছু দিয়ে লিখতে চাই না, যা আমাদের জন্য পবিত্রতার অর্থের বদলে নোংরা বা বিশুদ্ধ নাও হতে পারে।
আমরা যে কালি ব্যবহার করি সেই কালি-আরবি গাম ও পানি দিয়ে তৈরি। অতীতে ক্যালিগ্রাফাররা মসজিদগুলোকে আলোকিত করা তেলের বাতি থেকে কালি সংগ্রহ করতেন, আর তাদের নিজস্ব কালি তৈরি করতে ব্যবহার করতেন। বিখ্যাত উসমানীয় স্থপতি মিমার সিনান, যিনি সিনান দ্য আর্কিটেক্ট নামেও পরিচিত। উদাহরণস্বরূপ নির্মাণের পর্যায়ে ইস্তাম্বুলের সুলেমানি মসজিদের উপরে একটি ছোট কক্ষ নির্মাণের জন্য তার শিষ্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রদীপ থেকে সমস্ত কালি এই ঘরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যেখানে বছরে একবার ক্যালিগ্রাফাররা গিয়ে দেওয়াল ও ছাদে লেগে থাকা কালির আঁচড় দিতেন; তারা তাদের কালি তৈরিতে এই কালি ব্যবহার করতেন।
ক্যালিগ্রাফাররা এই কালি ব্যবহার করে কুরআনের কপি লিখতেন। তারা পরবর্তীতে এই কপিগুলো মসজিদে দাতব্য হিসেবে দেন। অন্য কথায়, মসজিদে যে জিনিসের উৎপত্তি হয়েছিল ঝুলকালি হিসেবে, তা পরে সুন্দর হাতে লেখা কোরআনের আকারে একই জায়গায় ফিরে আসে আর সেখানে দীর্ঘকাল থাকে।
মাজার পরিদর্শন ও ক্যালিগ্রাফি
ক্যালিগ্রাফাররা ঐতিহ্যগতভাবে আরেকটি আচার পালন করেন তা হচ্ছে অতীতের মহান ক্যালিগ্রাফি মাস্টারদের সমাধি পরিদর্শন। এই পরিদর্শনে মাস্টারদের রুহের জন্য দোয়া করার পাশাপাশি, ক্যালিগ্রাফাররা দাফন করা ব্যক্তির হাতের স্তরে একটি কলম দাফন করতেন আর কিছু সময়ের জন্য সেখানে রেখে দিতেন। পরবর্তীতে, তারা সমাধিতে ফিরে আসতেন আর তাদের ক্যালিগ্রাফির কাজে ব্যবহার করার জন্য কলমটি তুলে নিতেন। এটা বিশ্বাস করা হয় যে এই কলমে কিছু ‘বারাকা‘ (ক্যালিগ্রাফারের কাছ থেকে আশীর্বাদ বা ইতিবাচক শক্তি) গ্রহণ করবে আর এটি ক্যালিগ্রাফারের কাজকে সহজ করবে ও হাতের লেখাকে সুন্দর করবে।
ঐতিহ্য আর শিল্পের বেঁচে থাকা
এই আচারগুলো সমস্ত ক্যালিগ্রাফারের জন্য বাধ্যতামূলক নয় বা ক্যালিগ্রাফির সাথে জড়িত প্রত্যেকের দ্বারা এগুলো পালন করা হয় না। যাইহোক, এই ঐতিহ্যগুলোর অংশবিশেষ প্রশংসনীয়, পাশাপাশি অন্য কারণও রয়েছে। ক্যালিগ্রাফারদের প্রজন্ম এই শিল্পের সারমর্মকে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন আর আমরা যখন ক্যালিগ্রাফি সম্পর্কে কথা বলি তখন এইগুলি আমাদের মনে রাখতে হবে।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে গেলে, এটা খুবই সত্য যে এই সমস্ত ঐতিহ্যগত দিকগুলি আমাকে মুগ্ধ করেছিল আর আমাকে এই শিল্পের প্রেমে পড়িয়েছিল। দীর্ঘ অনুশীলন ও সৃজনশীল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আপনি একটি ক্যালিগ্রাফি পিস বা ক্যালিফারি টুকরো রচনা করে নিজেকে প্রকাশ করতে পারেন।
একটি টুকরো তৈরি করা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া যেখানে চূড়ান্ত ফলাফলটি একটি স্থির নাট্য উপস্থাপনার মতো হওয়া উচিত। যেখানে প্রতিটি ছোট জিনিস যত্নসহকারে স্থাপন করা হয় আর আপনার রচনায় থাকা বাকি উপাদানগুলির সাথে তার সৌন্দর্য, ভারসাম্য ও প্রবাহ অনুসারে বেছে নেওয়া হয়। যেমন আমার শিক্ষক বলেছেন, ‘ক্যালিগ্রাফির একটি অংশ তৈরি করা একটি ভাস্কর্য তৈরি করার মতো।’ একটি চূড়ান্ত অংশ চোখের জন্য কবিতা হওয়া উচিত, একটি কাগজে লেখা সঙ্গীত হওয়া উচিত, চোখ ও আত্মার জন্য আনন্দ একটি অর্থই বহন করা উচিত।
আমার মতে, একটি শিল্প রচনায় কাজ করার সময় একজনকে প্রথমে যে জিনিসটি মনে রাখতে হবে তা হলো-এই বিশেষ কাজটি আশা করি এই পৃথিবীতে দীর্ঘকাল স্থায়ী হবে। তাই আমাদের সত্যিই সতর্ক থাকতে হবে যে আমরা কি এই পৃথিবী থেকে মুছে যেতে চাই? অন্যদের মত পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে যথেষ্ট ভালো কিছু তৈরি করা ক্যালিগ্রাফারের দায়িত্ব।
‘হাল’-এ পৌঁছানো
যখন আমরা একটি ক্যালিগ্রাফি টুকরায় তাকাই, সেখানে একটি সংলাপ ঘটে। এটি একটি অ-মৌখিক সংলাপ, অক্ষরের জ্যামিতি ও আমাদের নিজস্ব সেলুলার জ্যামিতির মধ্যে একটি যোগাযোগ। এটি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, কারণ প্রতিটি একক আর্টওয়ার্ক শুধুমাত্র সেই লোকেদের উপর প্রভাব ফেলবে যারা এটি পর্যবেক্ষণ করবে। তবে এর নির্দিষ্ট জ্যামিতিক বৈশিষ্ট্যগুলো যেখানে এই শিল্পকর্মটি প্রদর্শিত হবে সেই স্থানের পরিবেশকেও পরিবর্তন করবে? কোনোভাবে, এটি সেই অবস্থানের বায়ুমণ্ডলকে রূপান্তরিত করবে। (“হাল” একটি আধ্যাত্মিক অবস্থা যা হৃদয়কে অভিভূত করে। হাল বান্দার উপর আল্লাহর অসীম অনুগ্রহের উপহার আর দান হিসাবে এটি হৃদয়ে প্রবেশ করে। চেষ্টা, ইচ্ছা বা আগ্রহের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক অবস্থা লাভ করা যায় না। এটি অপ্রত্যাশিতভাবে আসে আর অপ্রত্যাশিতভাবে চলে যায়। আধ্যাত্মিকতায় মাকাম ও হাল অসংখ্য। নিখুঁত ব্যক্তিরা উভয়কে অতিক্রম করে।)
নুরিয়া গার্সিয়ার আমরা একটি কম্পোজিশন বা রচনা দেখতে পাই, যেখানে একটি বড় অক্ষর ‘হা’ দাঁড়িয়ে আছে। এমন লেখা সুফিরা তাদের ধ্যানের সেশনের সময় ‘হাল’-এ পৌঁছানোর জন্য ব্যবহার করেন, যা চেতনার একটি অবস্থা যা সাধারণ অবস্থার চেয়ে উচ্চ স্তরে বলে মনে করা হয় আর যা আপনাকে আপনার সত্তা, আপনার সারাংশ ও এর কাছাকাছি নিয়ে আসে। যার শেষ বিন্দু আল্লাহ।
সুতরাং, যদি আমরা শব্দগুলিকে মন্ত্র হিসাবে বুঝি, আমরা যখন সেগুলো উচ্চারণ করি তখন এগুলো আমাদের নিজেদের উপর খুব নির্দিষ্ট প্রভাব ফেলবে। আমরা কিভাবে তাদের উচ্চারণ করি তার উপর নির্ভর করে শব্দের শক্তি একক বা অন্য কোনোভাবে প্রভাব ফেলবে। আর লিখিত শব্দের শক্তি, এটি কিভাবে লেখা হয়েছে তার উপর নির্ভর করে বিভিন্ন প্রভাব ফেলবে।
আর ক্যালিগ্রাফাররা তাদের প্রতিটি একক স্ট্রোকে এটিই করার চেষ্টা করে। তারা নিজেদের কাছাকাছি যাওয়ার ও ভবিষ্যতের নান্দনিকতা আবিষ্কার করার চেষ্টা করে; যে গল্পটা প্রতিটি স্ট্রোকের পেছনে লুকিয়ে থাকে।