উৎসবের সঙ্গে সুন্দরের গভীর সম্পর্কে রয়েছে। সুন্দর কিছু দেখলেই মানুষ আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠেন। সুন্দরের সঙ্গে রঙ তুলি, বিশেষকরে রঙ তুলির সাহায্যে রাঙানো চিত্রের সম্পর্ক চিরন্তন। আমরা যখন ঈদের উৎসবের কথা বলি তখন রোজা এবং রোজার শেষে ঈদগাহের ঈদ জামাত এবং কোলাকুলিকে বুঝি। বুঝি নানা ধরনের খাবার আয়োজনকেও। আর এই উৎসবকে নিয়ে শিল্পী যখন রঙিন চিত্রের জন্ম দেন, তখন ঈদের সৌন্দর্যকে বুঝি। সমগ্র মুসলিম দুনিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসবের নাম ঈদের উৎসব। এ উৎসব একেক দেশে একেকভাবে পালিত হয়। অনেক দেশ আছে যে সকল দেশ প্রকৃত অর্থেই ঈদকে উৎসবে রূপান্তর করে। আমাদের দেশে না হলেও জাকার্তা এবং ম্যানিলীয় মহিলাদের বিশাল ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। কোথাও কোথাও নারী পুরুষ একত্রে ঈদ উৎসব পালন করেন। এসব দেশের ঈদের ছবি দেখলে স্পষ্ট হয়ে উঠে ঈদ উৎসব কতটা বিস্তৃত। বিশে^র বিভিন্ন দেশে ঈদ উপলক্ষে মেলারও আয়োজন করা হয়। নানা ধরনের খেলাধুলা এবং শিশুদের চিত্রাংকনের ব্যবস্থা করতে দেখা যায়। দিনব্যাপী চলে এসব অনুষ্ঠান। যার কারণে ঈদের পুরো আনন্দ তারা উপভোগ করতে সক্ষম হন।
অনেক দেশেই ঈদকার্ডের প্রচলন আছে। ঈদ উপলক্ষে নানা বিষয়কে অবলম্বন করে দৃষ্টিনন্দন ঈদকার্ড বানানো হয়। দোকানে দোকানে বিক্রি করা হয় এসকল ঈদকার্ড। ঈদের কার্ড কিনে, অনেকেই বন্ধুদেরকে ঈদের শুভেচ্ছা জানান। আমাদের দেশেও ঈদকার্ডের প্রচলন আছে। কোন কোন দেশে উটকে নানা সাজে সজ্জিত করে ঈদকার্ড তৈরি করা হয়। ঈদ উপলক্ষে ইন্দোনেশিয়ায় নানা বয়সের মেয়েরা বাহারি সাজে সজ্জিত হয়ে ঈদ উৎসবে যোগদান করেন। এসব সজ্জিত মেয়েরা বিভিন্ন ধরনের জীবজন্তুর চিত্র সংবলিত নানা রঙের অসংখ্য বেলুন আকাশে উড়িয়ে থাকেন। আমেরিকার লং আইল্যান্ডের বিশাল ময়দানে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। ম্যানিলা, চায়না, ফালুজা, গাজা স্ট্রিট, কায়রো এবং তিউনিসিয়াসহ অসংখ্য দেশে নানাভাবে ঈদকে উৎসব মুখর করে তোলা হয়।
মুঘল ইন্ডিয়ার কথা অনেকেরই জানা যে, তৎকালে ভারতে ঈদ এবং ঈদের অনুষ্ঠানকে সরকারীভাবে গুরুত্ব দেওয়া হতো। মুঘল ইন্ডিয়ায় ব্যাপকভাবে ইসলামী সংস্কৃতির চর্চা করা হতো, সে কথাও অনেকের জানা। এসকল সংস্কৃতি বিষয়ক চিত্র চর্চাও হতো, তাও অনেকের জানা। বলা যায় যে, মুঘল সাম্রাজ্যে যে সব অনুষ্ঠান হতো সেসব অনুষ্ঠানের আবার চিত্রাঙ্কনও করা হতো। এমনই একটি চিত্রে প্রথম মুঘল সম্রাট বাবরকে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে তার ফোর্টের সভাসদকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে দেখা যাচ্ছে। প্রায় সকল মুঘল সম্রাটকেই ঈদের নানা উৎসব পালন করতে দেখা গেছে। এসকল তথ্য ইতিহাসের পাতায় যেমন আছে তেমনি আছে শিল্পী অঙ্কিত চিত্রকর্মেও।
সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর শিল্প সংস্কৃতির প্রতি উদার হৃদয় মানুষ ছিলেন। তিনি তার ইংরেজ অফিসার টমাস মেটকাফেকে দিয়ে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করিয়েছেন। সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের এ সকল কর্মাকাণ্ডের কথা ইতিহাসের পাতায় স্পটাক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে। টমাস মেটকাফে ১৭৯৫ সালের ২ জানুয়ারি ৪৯, পোর্টল্যাণ্ড প্লেস, লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দিল্লি আসেন ১৮১৩ সালে। এই সময় থেকে তিনি ৪০ বছর দিল্লিতে অবস্থান করেন। স্যার টমাস মেটকাফে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সিভিল সার্ভেন্ট ছিলেন। সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের ফোর্টে কাজ করবার কারণে মেটকাফে সম্রাটের প্রিয়ভাজন হবার সুযোগ লাভ করেন। বাহাদুর শাহ জাফর স্যার টমাস মেটকাফে দিয়ে ভারতের শিল্পসংস্কৃতি উপর জরিপ করা এবং সেগুলোর উপর চিত্রাঙ্কন করার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ভারতের শিল্পীদের সহযোগিতায় মুসলিম আর্কিটেকচারের উপর গবেষণা ও চিত্রাঙ্কনের কাজ শুরু করেন। একে একে গুরুত্বপূর্ণ ইমারতগুলোর চিত্র অঙ্কন করেন। এরপর মুঘল আমলে ঈদকে কেন্দ্র করে যেসকল অনুষ্ঠান হতো সে সকল অনুষ্ঠানেরও চিত্র অঙ্কনে অসাধারণ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। এমনই একটি চিত্রের নাম ‘ঈদের শোভাযাত্রা’। এই চিত্রটির আকার ৩৯১৫১২৩০ পিক্সেল। ফাইল সাইজ- ১৪৭ এমবি, এমআইএমই টাইফ: ইমেজ/জেপেগ। চিত্রের মাধ্যম কালি, তুলি ও রঙ। চিত্রটি আঁকা হয়েছে কাগজে। ১২ ফোল্ডের দীর্ঘ এই স্ক্রল চিত্রে সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর তার ছেলে এবং আত্মীয়স্বজন উপস্থিত রয়েছেন। উপস্থিত রয়েছেন স্যার টমাস মেটকাফে ও অন্যান্য সভাসদ। এই ঈদ শোভাযাত্রার চিত্রের সর্বত্র সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করে তৎকালে ঈদের আনন্দের ভাগী হতেন দেশের সব শ্রেণির মানুষ। সম্রাট উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, সম্রাটের ছেলে ও আত্মীয়স্বজন সুসজ্জিত হাতির পৃষ্ঠে অবস্থান করছেন। ঘোড়ার পিঠেও রয়েছেন কেউ কেউ। যিনি সরাসরি এ চিত্র নির্মাণে উদ্যোগ নিয়েছেন সেই টমাস মেটকাফে অবস্থান করছেন সুসজ্জিত হাতির পিঠে। অসাধারণ এই ঐতিহাসিক চিত্রাঙ্গনে যেসকল শিল্পী মেটকাফেকে সহায়তা করেছেন তাদের মধ্যে দিল্লির চিত্রশিল্পী মাজহার আলী খানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শিল্পী অঙ্কিত এ চিত্র কাল্পনিক নয়। শোভাযাত্রার বাস্তব চিত্র অবলম্বনেই ঈদের এ চিত্র অঙ্কন করা হয়েছে। মুঘল সাম্রাজ্যের সম্রাট সভাসদ ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের এমনভাবে শোভাযাত্রার সর্বত্র ছড়িয়ে রাখা হয়েছে যাতে সাধারণ মানুষরা তাদের সান্বিধ্যলাভে আনন্দ অনুভব করেন। এটাই চিত্রের বিশেষত্ব।
ঈদে শোভাযাত্রার এই বিশাল ঐতিহাসিক চিত্রটি ছাপা রয়েছে ‘দ্য গোল্ডেন কাম’ নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থে। গ্রন্থটি লিখেছেন স্যার টমাস মেটকাফের মেয়ে এমিলি। এমিলির জন্ম ১৯৩০ সালে। বাবার সাথে থেকে ব্রিটিশ ভারতের সব কিছু দেখেছেন এবং নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেছেন। তার সেই জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকেই মুঘল ভারতের সব বিষয়ে অভিমত ব্যক্ত করেছেন এই গ্রন্থে। গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন এম. এম. কে-ই। আমেরিকার নিউইয়র্কের প্রাট ইনস্টিটিউটে আমি যখন ফুলব্রাইট স্কলার্শিপ নিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করি ১৯৮৫-১৯৮৭ তখন ইনস্টিউিট সংলগ্ন ফুটপাথের দোকান থেকে এই গ্রন্থটি ক্রয় করেছিলাম মাত্র এক ডলারে। আমেরিকা সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে সপ্তাহে একদিন প্রাট ইনস্টিটিউটের চার পাশের রাস্তার ফুটপাথে নানা ধরনের সামগ্রীর দোকান বসত। সেই ফুটপাথের একটি দোকান থেকে মূল্যবান এ গ্রন্থটি ক্রয় করি ১৯৮৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২১ তারিখে। এই গ্রন্থে ঈদের শোভাযাত্রার যে ছবি ছাপা আছে তার দৈর্ঘ্য ১০০ সে.মি. এবং প্রস্থ ২১ সে.মি.। উল্লেখ্য যে, এখানে পুরো শোভাযাত্রার ছবিকে সমান দুইভাগ করে উপর নিচে ছাপা রয়েছে। অর্থাৎ সমগ্র শোভযাত্রার চিত্রের ২০০ সে.মি.। গ্রন্থে চিত্রটিকে ৬ কোল্ডে ভাঁজ করে সংযুক্ত করা হলো। প্রকৃত চিত্রের আকার গ্রন্থে ছাপা চিত্রের বহুগুন বেশি। ‘দ্য গোল্ডেন কাম’ নামক এই গ্রন্থটির আকৃতি ৯৮ ইঞ্চি। স্যার টমাস মেটকাফের কন্যা এমিলি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে এই গ্রন্থটি লিখেছেন। স্যার টমাস মেটকাফে এবং তার সুযোগ্য কন্যা এমিলি। মুঘল ইন্ডিয়া ও মুঘল ইন্ডিয়ার ইসলামি সংস্কৃতিকে কতটা ভালবেসেছিলেন তার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত গোল্ডেন কাম নামক গুরুত্বপূর্ণ এই গ্রন্থটি। ২১০ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থের প্রতিটি পাতায় রয়েছে ইসলামি সংস্কৃতির নিদর্শনগুলো। গ্রন্থের বিভিন্ন অংশে টমাস মেটকাফের মেয়ে এমিলি ঈদ সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন। তারাবিহ এবং ঈদের জামাতের শৃঙ্খলা তাকে অভিভূত করেছে। ঈদের পবিত্রতায় তিনি মুগ্ধ হয়েছেন। কোরবানি ঈদের ত্যাগ এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের বিষয়টি তাকে অনুপ্রাণিত করেছে। তিনি যেমন ঈদ দেখেছেন তেমনি দেখেছেন ঈদের শোভাযাত্রাও। ফলে তার পক্ষে যথাযথভাবে সবকিছু তুলে ধরা সম্ভব হয়েছ।
মুঘল কোর্টের স্যার টমাস মেটকাফের কন্যা এমিলির পুরো নাম এমিলি এনি থিওফিলা মেটকাফে। এমিলি গোল্ডেন কাম নামক গ্রন্থের এক স্থানে লিখেছেন শহর বন্দর নগর সিংহাসন ক্ষমতা সব কিছুই ফুলের মতো যা প্রতিদিনই মরে যায় এবং পাপড়িগুলো ঝড়ে যায়। আর এসব দৃশ্য শিল্পীরা তাদের ফর্মের মাধ্যমে ক্যানভাসে ধরে রাখেন। লেখিকা এমিলির এ বক্তব্য যে কতটা বাস্তব এবং সত্য তা তার গ্রন্থের চিত্রগুলোই প্রমাণ করছে। আজ ক্ষমতাধর সংস্কৃতিমনা মুঘল শাসকরা নেই কিন্তু তারা যে কর্মকাণ্ড করেছেন বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করেছেন। সেসব কর্মকাণ্ড এসব উৎসবের স্মৃতি শিল্পীর অঙ্কিত চিত্রে স্পষ্ট হয়ে আছে।
মুঘল আমলে দিল্লিতে যেমন ঈদের শোভাযাত্রার আয়োজন করা হতো নওয়াবদের তত্ত্বাবধানে ঢাকাতেও ঈদের শোভাযাত্রার আয়োজন করা হতো। এসকল শোভাযাত্রার শিল্পী অঙ্কিত চিত্র আজও ঢাকার জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এচিত্রও সে সময়কার স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দেয়। আনন্দধারা এবং ধর্মীয় অনুভূতির তরঙ্গমালা সৃষ্টিকারী ঐশ^রিক এবং সাম্যের বাণী প্রচারকারী এবং সব মানুষের হৃদয়ে শান্তির বাণী বহনকারী এসব ঈদের শোভাযাত্রার চিত্রাবলী মুসলমানদের ঈমানী শক্তি ও সামাজিক শান্তি শৃঙ্খলার প্রতীক।
সংস্কৃতিমনা মুঘল সম্রাটদের তত্ত্বাবধানে ঈদের উৎসব পালনের আয়োজন করা; সর্বস্তরের মানুষদের নিয়ে ঈদের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করা এবং এসব উৎসব ও শোভাযাত্রার চিত্র শিল্পীদের দিয়ে অঙ্কিত করা হলেও নিজ উদ্যোগে শিল্পীদের কাউকে এসকল বিষয়ের চিত্র অঙ্কন করতে দেখা যায় না। বাংলাদেশেও এর নজির নেই বললেই চলে। তবে তৎকালীন ঢাকার চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক খাঁজা শফিক আহমেদ ঈদকে নিয়ে একটি চিত্র এঁকেছিলেন। তার চিত্রের নাম ঈদুল ফিতর। এক মাস রোজা রাখার পর মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে যে ঈদের আনন্দের জোয়ার বয়ে যায় সেই আনন্দঘন কিংবা উৎসবমুখর পরিবেশই এ চিত্রের বিষয়। গ্রামীণ পরিবেশে খোলা ময়দানে ঈদগাহের দিকে ধাবমান অগণিত ধর্মপ্রাণ মানুষ এই চিত্রের মূল বিষয়। গ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে সুন্দর পোশাক পরে আগত মানুষ নামাজের উদ্দেশ্যে কাতারবন্দি হচ্ছেন ঈদের মাঠে। সুশৃঙ্খলভাবে বসে অপেক্ষা করছেন নামাজের উদ্দেশ্যে। আগত মুসল্লীদের কাউকে কোলাকুলি করতেও দেখা যাচ্ছে। সুন্দর পবিত্র পরিবেশ। সুপরিকল্পিভাবে অঙ্কিত এ সকল চিত্র নান্দনিক রসে সমৃদ্ধ চিত্র ধর্মপ্রাণ মানুষের ঈমান আকিদা ও ঈমানী দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এসকল চিত্র দর্শনে যুগের পর যুগ মানুষ ধর্মের প্রতি, ধর্মপালনের প্রতি এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির প্রতি অনুপ্রাণিত হবেন। উৎসবের মাধ্যমেও যে মানুষকে ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করা যায় তার গভীর তাৎপর্যপূর্ণ বাণীও এ সকল চিত্র ভবিষৎ প্রজন্মের কাছে প্রচার করে যাবে এবং ঈদ ও ঈদের শোভাযাত্রার আয়োজনের গুরুত্বের কথা তুলে ধরবে।