কোন কোন মানুষ জন্মায়, জন্মের সীমানা যাদের ধরে রাখতে পারে না। অথচ তাদের সবাইকে ক্ষণজন্মাও বলা যাবে না। এ রকম অদ্ভুত প্রকৃতির শিশু অনেক জন্মগ্রহণ করে জগতে, জন্মের বন্ধন ছিন্ন করার জন্য যাদের রয়েছে এক স্বাভাবিক আকুতি।… শেখ মুহাম্মদ সুলতান সে সৌভাগ্যের বলে ভাগ্যবান, আবার সে দুর্ভাগ্যের অভিশাপে অভিশপ্ত।
(বাংলার চিত্র ঐতিহ্য : সুলতানের সাধনা- আহমদ ছফা, রচনাবলী -১, পৃ: ১৭০)
নড়াইলের মাসিমদিয়া গ্রামের দরিদ্র কৃষক ও রাজমিস্ত্রি শেখ মেছের আলীর ছেলে শেখ মুহাম্মদ সুলতান (১০ আগস্ট ১৯২৩- ১০ অক্টোবর ১৯৯৪) ওরফে লাল মিয়া শৈশবে বাল্যশিক্ষক কৃষ্ণনাথের জীয়নকাঠির ছোঁয়ায় শিল্পকলার স্বপ্নময় জগতে প্রবেশ করে যে আপন আলো নির্মাণ করেছেন- তা বাংলাদেশের চিত্রকলার ধারাবাহিক যাত্রায় ভিন্ন ও অনন্য। বিশ্বশিল্পকলায় যিনি প্রথম বাঙালি চিত্রী হিসেবে পাবলো পিকাসোর সাথে চিত্রপ্রর্দশনীতে অংশ নিয়েছিলেন। সাথে আরো ছিলেন- সালভার দালি, জন ব্লাক, পল ক্লী, জন মার্টিন, যা অনুষ্ঠিত হয়েছিল হ্যামস্টিড, লন্ডন, যুক্তরাজ্যে ১৯৫৬ সালে। যদিও তার প্রিয় শিল্পী পিকাসো ছিলো না, প্রিয় ছিলেন ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পী সেজান ও ভিনসেট ভেনগগ।
১০ বছর বয়সে যখন তিনি ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র, স্কুল পরির্দশক ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর পেন্সিল স্কেচ এঁকে শিল্পী হিসেবে সবার দৃষ্টি কাড়েন। জমিদার ধীরেন্দ্র নাথ রায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় ও বিশিষ্ট শিল্পসমালোচক শাহেদ সোহরাওয়ারদীর প্রত্যক্ষ প্রভাবে কলকাতা আর্ট কলেজে ছয় বছরের কোর্সে ভর্তি হয়েও যিনি তিন বছরেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ত্যাগ করেন, তাতে স্পষ্ট হয়ে যায় তার বহেমিয়ান জীবনের চারিত্র। পায়ে হেঁটে যিনি উপমহাদেশের প্রায় ছোট বড় শহর ঘুরে বেড়িয়েছিলেন জীবনের পাঠ নিতে।
সুলতানের জবানিতে শুনুন তা :
১৯৫৩তে, আর্ট কলেজ থেকে পালিয়ে আমি ঘুরতে থাকলাম। সারা ভারতের সমস্ত স্টেশনে আমি পায়ে হেঁটে হেঁটে ঘুরেছি।
আমিনুল : পায়ে হেঁটে?
সুলতান : পায়ে হেঁটে… সিমলা, মুশৌরী, শ্রীনগর, নর্থ ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট গ্রাহাম…
আমি তো নবাব ফরিদ খানের মেহমান ছিলাম। তিন মাস ঘুরতে ঘুরতে গিয়েছিলাম সেখানে। দাক্ষিণাত্যে গিয়েছি, মধ্য ভারতে গিয়েছি… (বাংলাদেশের চিত্রকলা ও চিত্রকর : আমিনুর রহমান, পৃ: ৪১)
হ্যাঁ, শিল্পী এস এম সুলতানের প্রথম চিত্রপ্রর্দশনী হয়েছিলো ১৯৪৬ সালে সিমলায়। ’৪৭-এর ভারত-পাকিস্তান ভাগের পর তিনি চলে আসেন তৎকালীন পূর্ব পাস্তিানে। আবার করাচি, ফার্সি স্কুলে দু’বছর আর্ট টিচার। খ্যাতিমান শিল্পী চুকতাই ও শাকের আলীর সাথে পরিচয় ও আন্তর্জাতিক যাত্রা। নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন, শিকাগো, বোস্টন ও লন্ডনে চিত্রপ্রদর্শনী। ১৯৫৩ সালে আবার নড়াইলে ফিরে আসা। শিশু স্বর্গসহ শিশুদের জন্য তার স্বপ্নময় পৃথিবী নির্মাণের প্রচেষ্টা। বিশাল নৌকায় ঘুরে ঘুরে শিশুদের ছবি আঁকা শেখানো এবং শিশুদের জন্য বহু প্রতিষ্ঠান গড়া। শিশুর চোখে তিনি পৃথিবী দেখতে চেয়েছিলেন। বলতেন … আমি তো বাচ্চাদের শিল্পী। এই স্বপ্নময় জগতে কেটে যায় তার অনেক সময়।
বাংলাদেশের চিত্রকলার মূলধারায় তিনি অনেক দিন প্রাসঙ্গিক ছিলেন না। শিল্পাচার্য জয়নুল অবেদীনের সাথে মানসিক দূরত্বে ’৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকাকেন্দ্রিক চিত্রধারার সাথে অনালোচিত ছিলেন। ১৯৭৬ সালে, বিশেষ করে জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক ও সাহিত্যিক আহমদ ছফার প্রচেষ্টায় ঢাকার শিল্পকলা একাডেমিতে একক চিত্রপ্রদর্শনীর পর আলোচনার পাদপ্রদীপে আসেন। বিশেষ করে বিশিষ্ট চিন্তক মহাত্মা আহমদ ছফা তিমির থেকে বের করে আনেন সুলতানের চিত্রকলা। লিখেন চমৎকার বর্ণাঢ্য চিত্রসমালোচনা- বাংলার চিত্র ঐতিহ্য : সুলতানের সাধনা (১৯৮০)।
সুলতানের শিল্পসাধনা সম্পর্কে লেখক আহমদ ছফা বলেন : ‘সুলতানকে বাংলার প্রকৃতিতে, বাংলার ইতিহাসে এবং বাংলার মানুষের শ্রম, ঘাম, সংঘাতের ভেতর সৌন্দর্যকে আবিষ্কার করার জন্য পাড়ি দিতে হযেছে দুস্তর পথ, পেরিয়ে আসতে হয়েছে সাধনা ও নিরীক্ষার অনেকগুলো পর্যায়। তার ব্যক্তিজীবন এবং শিল্পীজীবনের সমান্তরাল যে অগ্রগতি তাও কম বিস্ময়কর নয়।” (বাংলার চিত্র ঐতিহ্য : সুলতানের সাধনা- আহমদ ছফা, র ব -১, পৃ: ১৫১)
সুলতানের ৫০ পরর্বতী চিত্রগুলো নিয়ে বিশিষ্ট চিত্রসমালোচক শরীফ আতিউজ্জামান সূচিবদ্ধ করেছেন এভাবে : তার ক্যান্ভাস জুড়ে শুধু বাংলাদেশ- বাংলার কৃষকসমাজ, উৎপাদনের সাথে যারা সম্পৃক্ত, জল ও মাটির সাথে যাদের সম্পর্ক নিবিড়। তাঁর বিশাল ক্যানভাসগুলো ধারণ করে আছে গ্রামের বিস্তীর্ণ সবুজ ফসলের মাঠ, জমিতে মই দেয়া, লাঙ্গল-গরুতে গাঁতায় চাষ, ধান তোলা, ধান মাড়াই, ধান ঝাড়া, ধান ভানা, গোলায় ধান উঠানো, পাট কাটা, পাট বাচা, পাট ধোয়ার কাজে ব্যস্ত কৃষাণ-কৃষাণী, নদীর ঘাটে নরতা, জল ভরা, কাপড় ধোয়া, শাপলা তোলা, দুধ দোহানো, মাছ কাটার কাজে নিয়োজিত কৃষকরমণী, খাল বিল নদীতে মাছশিকারে ব্যস্ত জেলে সম্প্রদায়, ঢাল সড়কি লাঠি দিয়ে চরদখলে উদ্যত মারমুখী কৃষক, আছে ঋতুভিত্তিক গ্রামীণ পরিবেশ’। (দশ পথিকৃৎ চিত্রশিল্পী, পৃ: ৮৪)
এ ছাড়া কিছু ব্যতিক্রম চিত্রও আছে : বস্তিবাসী জীবন, জলোচ্ছ্বাসের পর, বেদেনীদের ঘরে ফেরা, গণহত্যার কিছু নিরীক্ষাধর্মী বিমূর্ত চিত্রকলা। হ্যাঁ, শিল্পী এস এম সুলতান- তেল ও জল রঙেই মূলত কাজ করলেও কিছু পেন্সিল ও কালির স্কেচও আছে।
বাংলাদেশের চিত্রকলার মূলধারায় শিল্পী এস এম সুলতানের ছবিগুলো আপাত প্রাসঙ্গিক হয়ে আসে না; তার ছবির মূল থিম গ্রামীণ জনগোষ্ঠী হলেও তার ছবির ফিগারগুলো ব্যতিক্রম। ফিগারগুলো দানবীয় অঙ্গসৌষ্ঠবময়। তিনি রিয়েলেস্টিক ধারার শিল্পী হলেও তার ছবির কৃৃষকেরা বাংলার আবহমান কৃষকের মতো নয়। দানবীয় গাঠনিক অবয়বের তো নয়ই। তাহলে সুলতানের ছবির মানুষেরা কারা?- যারা বিশাল দেহী, সুঠাম পেশি, প্রচন্ড প্রতাপময়।
মূলত শিল্পী সুলতান ইচ্ছাকৃতভাবে বাস্তবকে ঠেলে কল্পনাকে সামনে আনতে চেয়েছেন। তার মাঝে এক ধরনের রোমান্টিক আদর্শবাদ প্রাণিত হয়েছিলো। তাই তাকে সম্পূর্ণভাবে বাস্তববাদী শিল্পীও বলা যায় না। এ প্রসঙ্গে আমরা শিল্পতাত্ত্বিক হারবার্ট রিডের Realistic Painter সম্পর্কে ব্যাখ্যাটি স্মৃতিতে রাখতে পারি :
The realistic mood needs no explanation; it is, in the plastic art , the effort to represent the world exactly as it is present in our senses, without omission, without falsity of any kind. (The Meaning of Art, page : 160)
আমাদের সাদা চোখে মানুষের যে ফিগারগুলো দেখি, বা ইতিহাস ও সাহিত্যে বাঙালির যে চিরন্তন ফিগারটা পাই, সে চিত্রের সাথে সুলতানের ফিগারগুলো মেলে না। উপমহাদেশের চিত্ররীতিতে নারী-পুরুষের যে আকৃতি সুলতানের সাথে কেনো মেলে না? এটা ছবির দর্শক মাত্রই প্রশ্ন। নারী নিয়ে আমাদের চিত্রকলায় যে আদল আছে তা হলো : চিকন ঠোঁট, খাড়া নাক, নীল তিল কুল, পদ্ম পাতা কিংবা মৃগ- খঞ্জনার চোখ। বক্ষযুগল ঘট বা দাড়িম্ব ফলের মতো। কিন্তু সুলতানের ছবিতে আমরা তা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত দেখি। তার নারীরা স্ফীত ও মেদসর্বস্ব। নারীরা বিশাল দেহীও। মস্তক ও নিতম্বে কিছুটা ভারতীয় সাদৃশ্য। শাস্ত্রে¿ যেভাবে পুরুষের চিত্র আঁকা হয়েছে :
কিবা সুমেরু চূড়া – যেন শালদ্রুম
ফোঁড়া শশীমুখ পঙ্কজ নয়ন।
সুলতানের পুরুষেরা তেমন নয়। তার ছবির পুরুষেরা দেবতা নয় মূলত মানুষ। সর্বোপরি কৃষক। দেবতার মতো রূপবান নয়। তার ছবির এমন রোমান্টিক প্রবণতা দূর বাস্তবের আদর্শায়ন। এ সম্পর্কে শিল্পীর ভাষ্যই প্রণিধানযোগ্য :
শুধু ফোটোগ্রাফির উপস্থাপনা ছবি আঁকার উদ্দেশ্য হতে পারে না। আমার কৃষকের অতিকায়তা সব বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। সমালোচকরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে একে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পেয়েছেন। কেউ একে বিকৃতি বলেছেন, কেউ আবার আমার অ্যানাটমি জ্ঞানের অভাব হিসেবেও দেখেছেন, কিন্তু এখানেই আমার ছবির দর্শন। আমি রেনেসাঁ মাস্টারদের অনুকরণে তাদের দেবসৌষ্ঠব এঁকেছি মানুষকে দেখাতে যে কৃষকদের এরূপ হওয়া উচিত। তাদের কৃশকায় হওয়ার পেছনে নিয়তি বা ভাগ্য নয়, শোষণের দীর্ঘ ইতিহাস জড়িত। আমার ছবিতে একটি প্রতিবাদী ‘মেসেজ’ আছে। আমার আশা, সব ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে একদিন ওরা জয়ী হবেই। ওরা ওদের স্বাস্থ্য ফিরে পাবে। (ভিডিও সাক্ষাৎকার : বিশিষ্ট চিত্রসমালোচক শরীফ আতিউজ্জামান)
তবে বিশেষভাবে মনে রাখা উচিত- ১৯৪৬ সালে শিল্পী যখন বাবার মৃত্যুর পর নড়াইলে ফিরে আসেন তখন শিল্পী খাকসার আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। কৃষক বিদ্রোহের সাথে যুক্ত হন। আন্ডার গ্রাউন্ড পার্টির সাথে যুক্ত হয়ে গভীর রাতে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে কৃষকদের সমাজ পরিবর্তনের জন্য প্রাণিত করতে চেষ্টা চালান। হয়তো সে কারণে- কৃষকদের জীবন পরিবর্তনের কথা, কল্পিত আদর্শ চিত্রগুলো, কাম্যগুলো তার ছবির সৌষ্ঠব্য হয়ে উঠে আসতে থাকে বিভিন্ন ফিগারে, চিত্রে, স্কেচে।
এস এম সুলতান পুরোপুরি ইম্প্রেশনিস্ট ধারার শিল্পী ছিলেন না, ছিলেন অনেকটা প্রকাশবাদী ধারার শিল্পী। আবেগ যেখানে মুখ্য, যেখানে পারিপার্শ্বিক জগৎ ও অবস্থা কিছুটা অতিরঞ্জনে উপস্থাপিত, যা উদ্ভট নয় বরং উদ্ভাবিত। শিল্পতাত্ত্বিক হারবার্ট রিট প্রসঙ্গটিকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন :
it expresses the emotions of artist at any cost the cost being usually an exaggeration or distortion of natural appearances which borders on grotesque.
আমরা এর বাস্তবতা গ্রিক ভাস্কর্যেও দেখি। গ্রিক ভাস্কর্যেও বাস্তবের সম্পূর্ণ প্রতিফলন হয় না। মিলোসের আফ্রোদিতিকে আমরা যেভাবে দেখি তা বাস্তবে দৃশ্যের মতো নয়। চোখের ভ্রু, মুখ, বক্ষযুগল বাস্তবের মতো নয়, পুনর্নির্মিত।
শিল্পী এস এম সুলতান মূলত ইউরোপীয় রেনেসাঁর শিল্পীদের মতো ভিশনারি। এক সময়ের সচ্ছল কৃষক যখন সামন্তবাদী সমাজে এসে কৃশকায় হয়ে গেলো, শোষিত হতে হতে সমাজের নি¤বর্গে পৌঁছে গেলো, তাকে উদ্দীপ্ত করতে, তার হারানো স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারেই শিল্পকে প্রণোদনাময় উদ্ভাস হিসেবে দেখেছেন তিনি। উজ্জীবন, স্বপ্ন ও সম্ভাবনার আশাকে তার শিল্পে আশ্রয় দিয়েছেন, লালিত করেছেন বিশাল ক্যানভাসে। এ বিশালতায় বাংলার এ বিশাল কৃষিজীবী সমাজকে প্রতিনিধিত্ব করতে।
বিশিষ্ট শিল্প তাত্ত্বিক-সমালোচক ও কবি সৈয়দ আলী আহসান শিল্পী এস এম সুলতানের চিত্র নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন :
তার লক্ষ্য হচ্ছে আমাদের গ্রামের সমাজজীবনকে উপস্থিত করা। অত্যন্ত বলিষ্ঠদেহী কৃষককুল অথবা কৃষকরমণী, কৃষিকর্মে নিযুক্ত প্রাণী, উর্বরা ভূমি, এবং বলিষ্ঠ ধানের মঞ্জরি সব কিছু একাকার করে তিনি একটি সজীবতার উত্তরণ খুঁজেছেন। তার বক্তব্য হচ্ছে, এ সজীবতা হচ্ছে আমাদের কাম্য সুতরাং তিনি কাম্যের প্রসাদকে আমাদের সামনে উপস্থিত করেছেন। অবশ্য এখানে মনে রাখতে হবে বাস্তব দৃশ্য আমাদের গ্রামাঞ্চলে এ সজীবতাকে উদঘাটন করে না। বিপুল আয়তনের ক্যানভাস ব্যবহারের ক্ষেত্রে এস এম সুলতান যথেষ্ট সাহস দেখিয়েছেন। এ সমস্ত চিত্রের মধ্যে সমাজব্যবস্থার মুখ্য কোনো সমালোচনা নেই, একটি কাম্য আস্থার উদ্ঘাটন আছে। (বাংলাদেশের শিল্পকলা : শিল্পবোধ ও শিল্পচৈতন্য : পৃষ্ঠা ১৭১)
শিল্পী এস এম সুলতান ছবির ফিগারগুলো দানবীয় অঙ্গসৌষ্ঠ বলে কোনো কোনো শিল্পসমালোচক তাকে নিয়ে তাচ্ছিল্য করেন- ‘সুলতান অ্যানাটমি জানে না’। তাদের কাছে ফিগারই মুখ্য, শিল্প নয়। মনে রাখা দরকার শুধু জ্যামিতিক নিয়মে বাস্তবতার অনুকরণের ছবি আদর্শ ছবি নয়, তা হয়ে যায় ফটোগ্রাফি। শিল্পগুরু শ্রী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলি’তে বলেছেন :
গনেশ মূর্তিটিতে আমাদের ঘরের ও পরের ছেলের অ্যানাটমি যেমন করে ভাঙা হয়েছে তেমন আর কিছুতে না। হাতি ও মানুষের সমস্তখানি রূপ ও রেখার সামঞ্জস্যের মধ্য দিয়ে একটি নতুন অ্যান্টমি এলো, কাজেই সেটা আমাদের চক্ষে পীড়া দিচ্ছে না, কেননা একটা ঘটনা নয়, রচনা। (শিল্প ও দেহতত্ত্ব-পৃ: ৯৩)
১৯৯১ সালের এক সাক্ষাৎকারে শিল্পী এ এম সুলতান তার নতুন ধরনের চিত্রভাবনা, শিল্পভাবনা সম্পর্কে বলেন :
মাছ গেছে, ধান গেছে, সুর গেছে সব হারিয়ে গেছে। সুজলা সুফলা কথাটি তো শেষ হয়ে গেলো। ¯্রােতস্বিনী নদীমাতৃক কথাটাই ফুরিয়ে গেলো, কি করে জাতি বাঁচবে? আমি প্রতিবাদ করি, আমি মুখে বললে বলবে যে দেশের শত্রু। সে জন্য কথা বলি না। আমি ঐ ছবিতে দেখায় দেখো, তুমি প্রশ্ন করো কৃষক মোটা হয়েছে কেন? … কৃষককে আমি মাসকুলার করেছি কেন? কেননা ওদের নিঃশেষ করে দিয়েছে। আল্লামা ইকবালের একটি সুন্দর উর্দু কবিতা আছে-
ওঠো মেরি দুনিয়াকি…
গনিবোকোগাদো
কৃষককে ভালোবাসি আমি এ জন্য যে, ওরা কাজ নিয়ে থাকে। মাটির ধর্মী, মাটির সঙ্গে ওরা সম্পৃক্ত, আর ওরা আমাদের ফসল দেয়। আমাদের অন্ন জোগান দেয়। ওরা দুঃখী হলে আমরা দুঃখী হয়ে যাই। কৃষককে ভালো রাখতে গিয়েই তো ছবির ধারা বদলে গেলো আমার। ছবির স্টাইল বদলে গেলো। আমি আর বিদেশী কায়দায় ছবি আঁকছি না।’ (বাংলাদেশের চিত্রকলা ও চিত্রকর : আমিনুর রহমান, পৃ: ৪৩)
শিল্পী এস এম সুলতান এভাবে হয়ে ওঠেন অন্য এক মাত্রার অন্য রকম। বাঙালির একান্ত নিজস্ব ঘরানার শিল্পী। সাহিত্যিক আহমদ ছফা এ জন্য শিল্পী এস এম সুলতানকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে লিখেছেন :
সুলতানের কৃষকেরা জীবনসাধনায় নিমগ্ন। তারা মাটিকে চাষ করে ফসল ফলায় না। পেশির শক্তি দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গম করে প্রকৃতিকে ফলে-ফসলে সুন্দরী সন্তানবতী হতে বাধ্য করে। এইখানে জীবনের সংগ্রাম এবং সাধনা, আকাক্সক্ষা এবং স্বপ্ন, আজ এবং আগামীকাল একটি বিন্দুতে এসে মিশে গিয়েছে। সুলতানের কৃষকেরা নেহাত মাটির করুণা কাঙাল নয়। রামচন্দ্র যেমন অহল্যা পাষাণীকে স্পর্শ করে মানবী রূপ দান করেছিলেন, তেমনি তার মেহনতি মানুষদের পরশ লাগা মাত্রই ভেতর থেকে মাটির প্রাণ সুন্দর মধুর স্বপ্নে ভাপিয়ে উঠতে থাকে। এ মানুষগুলো পাখা থাকলে দেবদূতের মতো আকাশের অভিমুখে উড়াল দিতে পারতো। কিন্তু একটি বিশেষ ব্রতে, একটি বিশেষ অঙ্গীকারে আবদ্ধ বলেই তারা মাটির দিকে ঝুঁকে পড়ে আছে। সে অঙ্গীকারটি, সে ব্রতটি মাটিকে গর্ভবতী ও ফসলশালিনী করা। মাথার উপরে স্বর্গলোকের যা কিছু প্রতিশ্রুতি, যা কিছু প্রেরণা তার সবটুকু- আকাশে নীল থেকে, রামধনু বর্ণের সুষমা থেকে ছেঁকে এনে মাটির ভেতরে চারিয়ে দিয়ে যাচ্ছে এই মানুষ-মানুষীর দল। (বাংলার চিত্র ঐতিহ্য : সুলতানের সাধনা- আহমদ ছফা, র ব-১, পৃ: ১৬৫)
এ অনন্য সাধারণ শিল্পী ও শিল্পীর সাধনাকে অনুভব করতে হলে মহাত্মা আহমদ ছফার আরো একটি মূল্যায়ন মনে রাখা জরুরি :
শেখ সুলতানের মধ্যে দ্য ভিঞ্চি, মিকেলেঞ্জেলো, রাফায়েল প্রমুখ শিল্পীর প্রকান্ড কল্পনা এবং কল্পনার বলিষ্ঠ ছাপ এত গভীর এবং অনপনেয় যে মনে হবে এ চিত্রসমূহ, কোনোরকমের মধ্যবর্তিতার বালাই ছাড়া, সরাসরি রেনেসাঁস যুগের চেতনার বলয় থেকে ছিটকে পড়ে এই উনিশ শ’ সাতাত্তর সালে বাংলাদেশের কৃষকসমাজে এসে নতুনভাবে জন্মগ্রহণ করেছে। এই ছবিগুলো আঁকার মত মানসিক স্থিতাবস্থা অর্জন করার জন্য শেখ সুলতানকে সব দিতে হয়েছে। পরিবারের মায়া, বংশধারার মধ্য দিয়ে নিজের অস্তিত্বকে প্রবাহিত করার স্বাভাবিক জৈবিক আকাক্সক্ষা ভেতর থেকে ছেঁটে দিয়ে, এই চিত্র সন্তান জন্ম দেয়ার একাগ্রপ্রায় কাপালিক সাধনায় নিযুক্ত থাকতে হয়েছে সারাজীবন। শেষ পর্যন্ত অসম্ভব সম্ভব হয়েছে। বাংলার শিল্পীর হাত দিয়ে বাংলার প্রকৃতি এবং বাংলার ইতিহাসের একেবারে ভেতর থেকে রেনেসাঁস যুগের ফুল ফুটেছে। সুলতানের সাধনা মিথ্যা হয়ে যেতো, যদি না বাংলার শিল্পীর সঙ্গে সহযোগিতা কনের একটি যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়ে ইতিহাসের জাগ্রত দেবতা আপন স্বরূপে সামনে এসে না দাঁড়াতেন।
এইখানে সুলতানের অনন্যতা। এইখানে বাংলার কোন শিল্পীর সঙ্গে ভারতবর্ষের কোন শিল্পীর সঙ্গে সুলতানের তুলনা চলে না। অবনীন্দ্রনাথ, যামিনী রায়, নন্দলাল, জয়নুল অবেদীন, আবদার রহমান চাঘতাই, নাদী, এ সকল দিকপাল শিল্পীর মধ্যে যতই পার্থক্য থাকুক, তবু সকলের মধ্যে অন্তর্নিহিত যোগসূত্র অবশ্যই রয়ে গেছে। হ্যাভেল ভারতীয় শিল্পদর্শনের যে সংজ্ঞাটি দিয়েছেন, কেউ তার আওতা ছাড়িয়ে যেতে পারেননি- একমাত্র সুলতান ছাড়া। (বাংলার চিত্র ঐতিহ্য : সুলতানের সাধনা- আহমদ ছফা, র ব -১, পৃ: ১৬৭)
শিল্পী এস এম সুলতানের কোনো পূর্বসরি ছিলো না, নেই কোনো উত্তরসূরিও। কিন্তু ট্র্যাজেডি হচ্ছে তার কর্মময়জীবন ও চিত্রগুলোর নিয়ে আলোচনার প্রয়াসও নেই আমাদের মাঝে।