বন্দে আলী মিয়াকে (জন্ম : ১৭ জানু. ১৯০৬-মৃত্যু : ২৭ জুন ১৯৭৯) আমরা সবাই কবি ও শিশুসাহিত্যিক হিসেবেই চিনি। কিন্তু আমরা তাকে চিত্রকর বা চিত্রশিল্পী হিসেবে কতটুকু চিনি? চিত্রশিল্প বা চারুকলার জগতে তিনি যে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনেরও আগে হাতেখড়ি নিয়েছিলেন তার খবর ক’জন জানি? তিনি শখ করে ছবি আঁকার জগতে প্রবেশ করলেও কৈশোরেই ছবি এঁকে দিয়ে, ছবি আঁকা শিখিয়ে পয়সা উপার্জনও করতেন। কবির পারিবারিক সূত্রে পাওয়া এসব অজানা তথ্য এখন উদ্ঘাটিত হচ্ছে। তার আঁকা প্রায় একশত ছবি এখনো সংরক্ষিত আছে তার পরিবারের উত্তরাধিকারগণের কাছে। যেগুলোর মধ্যে কিছু ছবি অযত্ন অবহেলায় নষ্ট হয়েছে, কিছু ছবি তার বইয়ের প্রচ্ছদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে; কিছু ছবি এখনো উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করছে তার শিল্পী প্রতিভার।
বন্দে আলী মিয়া ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে পাবনার রাধানগর মজুমদার একাডেমি থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কোলকাতায় যান এবং সেখান থেকে চিত্রশিল্পী হবার বাসনায় ‘ইন্ডিয়ান আর্ট একাডেমি’-তে ভর্তি হন। এখান থেকে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে চিত্রবিদ্যায় উত্তীর্ণ হন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, জয়নুল আবেদীন কোলকাতায় আর্ট স্কুলে ভর্তি হন ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু বন্দে আলী মিয়া জয়নুল আবেদীনের চেয়ে প্রায় ১০ বছর পূর্বে ‘ইন্ডিয়ান আর্ট একাডেমিতে’ ভর্তি হন এবং মুসলমান ছাত্রের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম ছবি আঁকার জগতে প্রবেশ করেন। বন্দে আলী মিয়া ছবি আঁকার জগতে একমাত্র মুসলিম ছাত্র হিসেবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে বিরল দৃষ্টাস্ত স্থাপন করেন।
জানা যায় বন্দে আলী মিয়ার প্রথম কবিতা প্রকাশ হওয়ার পূর্বেই ছবি আঁকায় পটু ছিলেন। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে নাটোরের “বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি” নামক সাপ্তাহিক পত্রিকায় তার প্রথম কবিতা ‘ছিন্নপত্র’ প্রকাশিত হয়। কিন্তু তার পূর্বেই তিনি আঁকিয়ে হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কেননা তার আগে থেকেই সুরেশ নামক এক বন্ধুর বোনকে তিনি ছবি আঁকা শিখাতেন। তিনি তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘জীবনের দিনগুলি’তে তার প্রথম কবিতা ‘ছিন্নপত্র’ ছাপা হওয়া প্রসঙ্গে বলেছেন, “এইটুকু পড়তেই মনে পড়ে গেল পুরনো দিনের একটি কথা। সুরেশের দিদি আমার কাছে ছবি আঁকা শিখতো। আজ এতদিন পরে সেদিনের কথা মনে হলে হাসি পায়। কী-ই বা আমি আঁকতে জানতাম। তাই আবার একজনকে শিখাতাম। তবু গুরু হওয়ার শখ সেদিন ছিল। গম্ভীর হয়ে ছাত্রীকে নানা উপদেশ দিতাম।” তার ছবি আঁকা ও সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ ও হাতেখড়ি প্রসঙ্গে ঐ গ্রন্থে আরো বলেছেন, “আজ বিশেষ করে একজনের কথা বারবার মনে পড়ে। তিনি আমার মধ্যম মাতুল মরহুম আব্বাস আলী সাহেব। শৈশবে চিত্রশিল্প ও সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ তার আনুকূল্যেই আমার মনে অঙ্কুরিত হয়েছিল। তিনি কবিতা ও গল্প লিখতে পারতেন… তিনি মাঝে মাঝে ছবিও আঁকতেন। সেগুলো দেখে অতি শৈশবে আমি কালি হাতে নিয়ে ছবিতে রঙের স্পর্শ বুলিয়েছি। সুতরাং সাহিত্যে ও চিত্রশিল্পে তিনি আমার ওস্তাদ ছিলেন।”
বন্দে আলী মিয়া অল্প বয়সে যেমন ছবি আঁকা শিখেছিলেন তেমনি অল্প সময়ের মধ্যেই ছবি আকার পারদর্শিতা লাভ করেছিলেন কেননা কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের পূর্বেই তিনি চিত্রাঙ্কন দ্বারা পয়সা উপার্জন করতে থাকেন। এ প্রসঙ্গে তিনি ‘জীবনের দিনগুলি’ গ্রন্থে বলেছেন- ১৩৩৩ সালের অগ্রহায়ণ মাসে বিবাহ করেছিলাম (তখন কবির কোন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি)। চিত্রাঙ্কনের দ্বারা আয় হতে লাগল। মির্জাপুর স্ট্রিটে আর এল দত্তের ব্লক তৈরির দোকান ছিল। সেই স্থানে নিয়মিত ডিজাইনার হিসাবে কাজ শুরু করলাম। অবসর সময়ে বাইরের ছবিও আঁকতাম। পুস্তক ব্যবসায়ী ভট্টাচার্য অ্যান্ড সন্সের লাইব্রেরি ছিল কলেজ রোডে।… “খোকাখুকুর গল্প ও কবিতার” ছবি আঁকাবার জন্য তার নিকট প্রস্তাব দিতেই তিনি সানন্দে রাজি হলেন এবং কয়েকটি গ্রন্থের ছবি এক দেবার তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা করলেন। তার নিজের ‘চাঁদমামা’ নামক একখানি বহির কভার ডিজাইন করে দেবার জন্য শিল্পী যতীন্দ্র কুমার সেনের নিকটে তিনি যেতে উদ্যত হয়েছিলেন। সেই ডিজাইন আঁকবার ভার আমার উপরেই দিলেন। যথাসময়ে ছবি এঁকে দিলাম। তিনি খুশি হলেন এবং উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিলেন।
সাহিত্য চর্চা এবং সেই সাথে ছবি আঁকা এমন ধরনের প্রতিভা বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি নেই। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছবি আঁকতেন। কিন্তু মুসলমান কবিদের মধ্যে সম্ভবত বন্দে আলী মিয়াই একমাত্র কবি যিনি একই সাথে কবিতা লিখতেন ও ছবি আঁকতেন এবং সে ছবির অধিকাংশ তার গ্রন্থের প্রচ্ছদে ব্যবহার করেছেন। তার প্রথমগ্রন্থ ‘চোরজামাই’ (১৯২৭) থেকে শুরু করে প্রায় পঞ্চাশ-ষাটটি গ্রন্থে তার নিজের অঙ্কিত ছবি প্রচ্ছদ পটে ব্যবহার করেছেন।
বন্দে আলী মিয়া শেখ হাবিবুর রহমানের ‘পরীর কাহিনী’ আবুল ফাত্তাহ কোরেশীর ‘সালেহা’ গ্রন্থসহ আরো অনেক লেখকের গ্রন্থের প্রচ্ছদের ছবি এঁকেছেন। এছাড়া তৎকালীন ‘মানসী ও মর্মবাণী’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘গল্পলহরী’, ‘পঞ্চমুখ’, ‘সচিত্র শিশির’ প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় তার অঙ্কিত চিত্র প্রকাশিত হয়েছে এবং প্রশংসা পেয়েছে। মৌলানা আকরম খাঁর অনুরোধে ‘মাসিক মোহাম্মাদী’-তে একজন মুসলিম নারীর মোনাজাতের ছবি প্রচ্ছদে প্রকাশিত হলে ছবিটি সুধীমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং সমাদৃত হয়। আজও কোলকাতার বেলুর মাঠে তার অঙ্কিত রাধা-কৃষ্ণের ‘যুগল-মিলন’ ছবিটি শোভা পাচ্ছে। তার চিত্র সম্পর্কে সে সময়ে কথাশিল্পী প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় উচ্চ ধারণা পোষণ করেছিলেন।
বন্দে আলী মিয়া জীবদ্দশায় ছবি এঁকে খ্যাতি অর্জন করলেও চিত্রশিল্পী হিসেবে বাংলাদেশে তিনি এখনো অপরিচিত। তার অঙ্কিত প্রায় একশত ছবি উত্তরাধিকারগণের সংগ্রহে রয়েছে; যেগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলে বাংলাদেশের চিত্রশিল্পজগতের এক অনন্য সম্ভাবনার দ্বার খুলে যেতে পারে।