সমসাময়িক আরবি কাব্যসাহিত্যের প্রাণপুরুষ ফিলিস্তিনী কবি মাহমুদ দারবিশ ছিলেন কবি, তাত্ত্বিক এবং সংগ্রামী এক পুুরুষ। মাত্র ২০ বছর বয়সে যিনি ফিলিস্তিনিদের নিকট জাতীয় কবির মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছিলেন। আধুনিক আরবি সাহিত্যের ‘আশ-শির আল জাদিদ’ নামক কাব্য আন্দোলনটির অন্যতম মুখপাত্রও ছিলেন তিনি। তাঁর যাবতীয় রচনার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল স্বদেশ আর প্রতিবাদ-প্রতিরোধ।
দারবিশের বয়স যখন সাত বছর তখনই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যায়নবাদী ইসরাইল রাষ্ট্র। ১৯৪৮ সালের এক রাত্রে ইসরাইলি সৈন্যরা হানা দেয় আল-বিরওয়া গ্রামে। দারবিশের পরিবার জঙ্গলের ভিতর দিয়ে কোনক্রমে পালিয়ে আশ্রয় নেন পার্শ্ববর্তী দামুন গ্রামে, পরবর্তীতে লেবাননে। বছরখানিক পর তারা ফিরে দেখেন, ইসরাইলি বাহিনী তাদের প্রিয় জনপদ ‘আল-বিরওয়া’ ধ্বংস করে সেখানে গড়ে তুলেছে নতুন ইহুদি বসতি। ইয়েমেন এবং মরক্কো থেকে নিয়ে আসা ইহুদিদের পুনর্বাসিত করে সেখানে নতুন গ্রামের জন্ম দেয়া হয়েছে। এবার তারা নিজ দেশেই শরণার্থী হলেন। কেননা তারা যখন জীবন বাঁচাতে লেবাননে আশ্রয় নেন তখন ইসরাইল আদমশুমারি করে। ফলে দারবিশের পরিবারসহ অসংখ্য ফিলিস্তিনি পরিবারকে ইসরাইলে চিহ্নিত করা হয় অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে।
স্কুলজীবন থেকেই তার সুপ্তপ্রতিভার সন্ধান পাওয়া যায়। কবিতার প্রতি তার ঝোঁক অল্প বয়স থেকেই। ১৯৫৩ সালের একটি ঘটনা। ১২ বছর বয়সী দারবিশ ইসরাইলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত স্কুলের একটি অনুষ্ঠানে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন। কবিতাটির বিষয়বস্তু ছিল এক ইহুদি বালকের প্রতি এক আরব বালকের করুণ আবেদন। ‘ওয়া ইয়া লিমুরারাতিল মুফারিকা’ নামক সেই কবিতায় দারবিশ বলেন:
হে বন্ধু!
তুমি তোমার খেয়াল খুশিমত দিনের বেলায় খেলতে পার
তুমি তোমার খেলনা বানাতে পার।
কিন্তু আমি পারি না,
তোমার যা কিছু আছে, আমার তার কিছুই নেই
তোমার বাড়ি আছে, আমার নেই।
আমি উদ্বাস্তু……. ।
আমরা কেন একসাথে খেলতেও পারব না?
দারবিশ সেই কিশোর বয়স থেকেই একের পর এক রচনা করে গেছেন অসাধারণ সব-সাহিত্য, দ্রোহাত্মক প্রতিবাদী কবিতা। অধিকাংশ আরব কবির বেলায় যেটা দেখা যায় ষাট বছর বয়সের মধ্যেই তাদের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিগুলোর রচনা শেষ হয়ে যায়। এরপর বলতে গেলে নতুনত্ব আর তেমন থাকে না। দারবিশ ছিলেন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তাঁর পূর্ববর্তীটার চেয়ে পরবর্তী রচনায় থাকত আরও চমৎকারিত্ব। প্রতিটিতেই থাকত নতুনত্ব। মূলত কবিতা লিখলেও অসাধারণ সুন্দর গদ্যও রচনা করেছেন। আরবিতেই লিখতেন তিনি। তবে ইংরেজি, ফরাসি এবং হিব্রু ভাষাতেও ভালো দখল ছিল তাঁর। প্রায় ২৫টি ভাষায় তাঁর রচনা অনূদিত হয়েছে। ইংরেজি ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে প্রায় কুড়িটির মতো গ্রন্থ। ফ্রান্সে বরাবরই বেস্ট সেলারের তালিকায় থাকত তাঁর গ্রন্থ। এ পর্যন্ত তাঁর প্রায় ৩০টি কাব্য এবং ৮টির মতো গদ্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে
ষাটের দশক থেকে কাব্যচর্চায় নিয়মিত এই কবি ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিলেন ফিলিস্তিনি জনগণের কণ্ঠস্বর। তাঁর কবিতা ধারণ করেছে রাষ্ট্রবিহীন ভূখ-ের অজস্র মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা আর বেদনাকে। তাদের ‘জাতীয় কবি’র মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি। কবিতার মাধ্যমে তিনি ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদের চেতনা বপন করে গেছেন। আধুনিক আরবি কবিতায় প্রতিরোধ প্রতিবাদের এক নতুন কাব্যধারা ও শৈলীর জন্মদাতা তিনি। তাঁর কবিতা পাঠের আসরগুলোতে সবশ্রেণীর মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ অবাক করার মতো ছিল। ফিলিস্তিনের জাতীয় আবেগ, আশা-আকাক্সক্ষা, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার সমস্ত অনুভূতি মূর্ত হয়ে উঠেছিল তাঁর লিরিকধর্মী কবিতায়। আমৃত্যু মাতৃভূমির জন্য সংগ্রামরত এই কবি সর্বত্র নিজেকে নির্বাসিত মনে করতেন। আত্মপরিচয়ের সঙ্কটে ভুগতেন। সেই যন্ত্রণাদগ্ধ হৃদয়ের কথা নানাভাবে উঠে এসেছে তাঁর লেখনীতে। দারবিশ তাই অজস্র নির্যাতিত মানুষের কণ্ঠস্বর। তাঁর কবিতা আশাবাদ আর ভ্রাতৃপ্রেমে উজ্জীবিত অথচ প্রতিবাদমূলক। কিন্তু সেটা ক্রোধোন্মত্ত নয়। এটি গতিশীল এবং প্রগাঢ়ভাবে স্বদেশপ্রেমী। তাঁর সে স্বদেশ প্রীতিতে উৎকটতা নেই, নেই কোন বাহুল্যও। তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী সুরের সঙ্গে আশাবাদ একই লয়ে বাঁধা। এ বিদ্রোহ চেতনা আসলে আশাবাদের যৌক্তিক বিস্তার। কবিখ্যাতি ছিল তাঁর কিংবদন্তির মতো। দারবিশ বলেছেন:
মানুষকে আমি ঘৃণা করি না
কিন্তু ক্ষুধার্ত হলে
জবর দখলকারীর মাংসই হবে আমার খাবার
সাবধান!
সাবধান!
আমার ক্ষুধা থেকে
আমার রাগ থেকে
বিষয়বস্তু এবং প্রকাশ ভঙ্গিতে দারবিশের কবিতা সহজ, স্বচ্ছ। ভাষাশৈলী এবং বিষয়ের দিক থেকে দারবিশের কবিতা এমন একটা নির্দেশনা দেয় যেখানে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দারবিশের কবিতার ভাষা সহজ-সরল, সাবলীল যা বুঝতে পারে আম জনতা, উদ্দীপ্ত করে সাধারণ মুক্তি সংগ্রামীদের। আরবি ভাষায় দারবিশ নিজের জন্য এমন একটি স্থান প্রতিষ্ঠা করেছেন যার ফলে একটি নতুন ধারারই সৃষ্টি হয়েছে। তিনি কবিতায় যেসব প্রতীক, রূপক ব্যবহার করেছেন সবকিছুতেই ব্যতিক্রমী ধারা এবং নতুনত্ব বিদ্যমান। তাঁর রচনাশৈলীটাই স্বতন্ত্র। নান্দনিকতায় উত্তীর্ণ। ভাষাকে শ্রুতিমধুর করার বিশেষ মেধা ছিল তাঁর মধ্যে। তাঁর কবিতায় প্রতীক, উপমা, উৎপ্রেক্ষা খুব সতর্কতার সাথে বেছে নেয়া হয়েছে। একইসাথে সেগুলো সম্পূর্ণ নতুন বিষয়কে সামনে এনেছে। তাঁর কবিতার বাক-প্রতিমা, চিত্রকল্প, উপমা এবং সর্বোপরি সরল অথচ প্রতিবাদী এক ভাষা যা অতুলনীয় বলে বিবেচিত হয়েছে।
দারবিশ ঐতিহ্যবাহী আরবি শোককবিতা নিয়ে এক ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে সফল হয়েছেন। এর ফলে আরবি মারছিয়া বা শোককবিতা তো বটেই, আধুনিক কবিতার ধারাকেও ভিন্ন মাত্রায় উন্নীত করেছেন। বলা বাহুল্য, বিশ্বসাহিত্যের শোককবিতার প্রচলিত ধারায় দারবিশ নতুনমাত্রা যোগ করেছিলেন। তাঁর এ ধরনের একটি শোকগাথা হলো তিবাকযা বিখ্যাত ফিলিস্তিনি সাহিত্যিক অ্যাডওয়ার্ড সাঈদের মৃত্যর পর রচিত। যেখানে সমকালীন রাজনৈতিক প্রসঙ্গকে কবিতার বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত করে মার্সিয়া কাব্যকে বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের দিক থেকে অভিনব ও অনন্য করে তুলেছেন। কবির ভাষায়:
আমি বলি : আর আমি যদি আপনার আগে মরি?
তিনি বললেন; গালিলি পাহাড়ে গিয়ে আমার শোক প্রকাশ করবে
আর লিখে রাখব, ‘নন্দনতত্ত্বের কাছে পৌঁছানই
স্থিরতা অর্জন’ আর এখন ভুলে যেওনা
আমি যদি আপনার আগে মরি, এ আমার এক অসম্ভব ইচ্ছে!
১৯৮৮ সালে ফিলিস্তিনে স্বাধীনতা ঘোষণার পর তিনি এমন কিছু বিপ্লবী কবিতা রচনা করেন যা তাঁর অমর সৃষ্টি বলে গণ্য করা হয়। এগুলো প্রতিটি আরবের চেতনায় গেঁথে যায়। দারবিশের কবিতায় ব্যাপকভাবে উঠে এসেছে নিজ দেশে তাঁর পরবাসী তথা উদ্বাস্তু হয়ে বাস করার বেদনা। তার ধ্যানমগ্নতা আবর্তিত হয়েছে আরবদের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর অতীতকে ঘিরে। বেশির ভাগ কবিতাতেই ফুটে উঠেছে দখলকৃত এলাকার মানুষের প্রতি ভালোবাসা, তাদের জন্য উদ্বেগ। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাঁর লেখনীতে অরাজনৈতিক বক্তব্য প্রাধান্য পেলেও তা একেবারে রাজনীতিবর্জিত ছিল না। তাই, রক্ত, জখম, পাথর, আয়না এ ধরনের শব্দগুলো আর চিত্রকল্প বারবার ফিরে এসেছে তাঁর রচনায়। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছেন বারবার আর রচনা করে গেছেন একের পর এক চমৎকার দ্রোহাত্মক প্রতিবাদী-প্রতিরোধী কবিতা। তীব্র নারীপ্রেমও তাঁর কবিতায় তাই রূপান্তরিত হয়ে গেছে স্বদেশপ্রেমে। দারবিশের কবিতার শব্দমালার বিপরীতে হায়েনার রক্তচক্ষু ব্যর্থ, পরাস্ত হয়েছে।
‘প্রতিরোধের কবি’ হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেলেও তাঁর কবিতার একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে প্রেম ও মৃত্যুচিন্তা। ১৯৯৯ সালে ছারিরুল গারবিয়্যাহ নামক প্রেমের কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করে সকলকে চমকিয়ে দিয়েছিলেন। বিদ্রোহের কবিতার পাশাপাশি দারবিশের প্রেম এবং মৃত্যু বিষয়ক কবিতাগুলোও অসাধারণ। মা এবং প্রেমিকা “রীতা”কে কেন্দ্র করে তাঁর বেশ কিছু মিথাশ্রয়ী কবিতা রয়েছে। দারবিশের “মা” শীর্ষক একটি কবিতা গান হিসেবে আরব বিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয়। জেলে বন্দী অবস্থায় সিগারেটের প্যাকেটে এ কবিতাটি রচনা করেন তিনি। বন্দী পুত্রের মায়ের হাতে বানানো রুটি আর কফির কথা ভেবে নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার অতি বাস্তব এবং সূক্ষ্ম চিত্র ফুটে উঠেছে এ কবিতাটিতে। কবির ভাষায়:
আমি আমার মায়ের বানানো রুটির জন্য ব্যাকুল
আমি ব্যাকুল মায়ের বানানো কফির জন্য
আমি ব্যাকুল আমার মায়ের স্পর্শের জন্য
দুুধের দিনগুলো থেকে শুরু করে সব দিন।
দারবিশের মত খুব কমসংখ্যক কবিই পেরেছেন নিজ জাতির কণ্ঠস্বর হতে। তিনি সব সময় মানবতার জয়গানই গেয়েছেন। মাহমুদ দারবিশকে মনে করা হয় সমকালীন আরব বিশ্বের কবিদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানীয় ও গুরুত্বপূর্ণ কবি। আরবি কবিতার সৌন্দর্যকে নতুন ভাবে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছেন মাহমুদ দারবিশ। মধ্যপ্রাচ্যের জটিলতায় ঘুরপাক খাওয়া ফিলিস্তিনিদের দুঃখ দুর্দশার চিত্র আঁকতে গিয়ে কবিতায় তিনি নিয়ে এসেছেন সমগ্র বিশ্বের সংগ্রামী মানুষের ছবি। কবিতার মাধ্যমে মানবতার মুক্তির জন্য তাঁর আর্জি দেশকালের গ-ি পেরিয়ে হয়ে উঠেছিল সার্বজনীন, বিশ্বজনীন।