নোবেলের পর বিশ্বে মর্যাদাবান সাহিত্য পুরস্কার হিসেবে খ্যাত বুকার। বুকার পুরস্কার-২০২২ এর জন্য শর্টলিস্টে থাকা পাঁচটি বইকে হারিয়ে জিতে নিয়েছেন শ্রীলঙ্কার কথাশিল্পী শেহান করুনাতিলাকা। অর্থনৈতিকভাবে বিধ্বস্ত দেশ শ্রীলঙ্কার একজন ঔপন্যাসিককে কেন বেছে নিলেন বিচারকম-লী সেটি একটি প্রশ্ন বটে। দুই আমেরিকান এক ব্রিটিশসহ অন্য দুটো দেশের মিলিয়ে ছিলেন পাঁচজন শক্ত প্রতিযোগী। বিচারক প্যানেলে ছিলেন এক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত একাডেমিক-ব্রডকাস্টার শাহিদা বারি। তিনি শর্টলিস্ট প্রকাশিত হওয়ার পর বলেছিলেন, ‘আমি জানি না কিভাবে আমরা এই দুর্দান্ত ফাইনাল সিক্স থেকে একটি বিজয়ী বই বাছাই করব।’ বোঝাই যাচ্ছে কমিটিকে তুল্যমূল্য যাচাই করতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। কমিটির প্রধান ছিলেন লেখিকা-ইতিহাসবিদ নেইল ম্যাক গ্রেগর। সদস্য হিসেবে ছিলেন ইতিহাসবিদ হেলেন ক্যাস্টর, ঔপন্যাসিক এম জন হ্যারিসন ও কবি-ঔপন্যাসিক অ্যালেইন মাবাংকু। ২০২২ সালের বুকার পুরস্কারটি অতিপ্রাকৃতিক কাহিনী নিয়ে লেখা বিদ্রুপাত্মক উপন্যাস ‘দ্য সেভেন মুনস অব মালি আলমেদা’র জন্য দেয়া হয় কথাশিল্পী শেহান করুনাতিলাকাকে।
শেহানের আগে ১৯৯২ সালে আরেক শ্রীলঙ্কান লেখক মাইকেল ওনদাতজে ‘দ্য ইংলিশ প্যাশেন্ট’-এর জন্য এ পুরস্কার জিতেছিলেন। দীর্ঘ ব্যবধানে সেখানে আবার যোগ হলো দেশটির নাম। সমালোচকরা বলেছেন ‘দ্য সেভেন মুন অব মালি আলমেদা’ বইটি অংশত মার্ডার মিস্ট্রি বা খুন রহস্য, আংশিক রাজনৈতিক ব্যঙ্গ এবং আংশিক প্রেমের গল্প। এর লেখক সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাগুলো স্মরণ করেছেন যা এটি লিখতে অনুপ্রাণিত করেছিল এবং তার সম্পাদক তাকে আরো ভালো করার জন্য তাগিদ দিয়েছিলেন। ভূতের গল্প বা অতিপ্রাকৃত কাহিনী লিখে আগেও একজন লেখক এ পুরস্কার পেয়েছেন। তাই এটিকে খাটো করে দেখাও ঠিক হবে না বলে একদল সমালোচকের মত।
এই বছর বুকার পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রকাশিত হয় ৬ সেপ্টেম্বর। দীর্ঘ তালিকার ১৩টি বই থেকে বাছাই করে বিচারকেরা ৬টি বই নির্বাচন করেন। নির্বাচিত বইগুলো হলো : নোভায়োলেট বুলাওয়াওর ‘গ্লোরি’, ক্লেয়ার কিগানের ‘স্মল থিংকস লাইক দিজ’, পার্সিভাল এভারেটের ‘দ্য ট্রিজ’, শেহান কারুনাতিলাকার ‘দ্য সেভেন মুনস অব মালি আলমেদা’, এলিজাবেথ স্ট্রাউটের ‘ওহ উইলিয়াম’ এবং অ্যালান গার্নারের ‘ট্রিয়্যাকেল ওয়াকার’। সংক্ষিপ্ত তালিকার এই ছয় লেখকের মধ্যে লিঙ্গসমতা বিদ্যমান তিনজন নারী ও তিনজন পুরুষ। এ ছাড়া বুকারের সংক্ষিপ্ত তালিকার ইতিহাসে এবার যুক্ত হয়েছে সবচেয়ে বয়স্ক লেখকের নাম অ্যালান গার্নার। এ বছর অক্টোবরে তিনি ৮৮ বছরে পা রাখেন। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে প্রথম ব্রিটিশ ভারতীয় হিসাবে ১৯৮১ সালে সালমান রুশদি তাঁর মিডনাইট চিলড্রেন উপন্যাসের জন্য বুকার পুরস্কার পান। তারপর দীর্ঘ অপেক্ষার পর প্রথম ভারতীয় নাগরিক হিসাবে ১৯৯৭ সালে অরুন্ধতী রায় তাঁর ‘দ্য গড অফ স্মল থিংকস’ উপন্যাসের জন্য বুকার পান। এরপর একে একে ২০০৬ সালে কিরণ দেসাই তাঁর ‘দ্য ইনহেরিটেন্স অব লস’ উপন্যাস, ২০০৮ সালে অরবিন্দ আদিগা তাঁর ‘দ্য হোয়াইট টাইগার’ উপন্যাসের জন্য বুকার পুরস্কার পান। আবার দীর্ঘ বিরতির পর প্রথম শ্রীলঙ্কার নাগরিক হিসাবে শেহাম করুনাতিলাকা তাঁর ‘দ্য সেভেন মুনস অব মালি আলমেদা’ উপন্যাসের জন্য এবার বুকার পুরস্কার লাভ করেন।
উপন্যাসের ঘটনার সূচনা ১৯৯০ সালের কলম্বোতে। এক মহাজাগতিক ভিসা অফিসে মৃত অবস্থায় জেগে উঠেছেন মালি আলমেদা। বেঁচে থাকতে তিনি ছিলেন যুদ্ধদিনের আলোকচিত্রী ও জুয়াড়ি। তার টুকরো টুকরো লাশ শান্ত বেইরা হ্রদে ডুবে যাচ্ছে এবং কে তাকে হত্যা করেছে সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। যে দেশে ডেথ স্কোয়াড, আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী এবং ভাড়াকরা গু-াদের দ্বারা স্কোর নিষ্পত্তি করা হয়, সন্দেহভাজনদের তালিকা হতাশাজনকভাবে দীর্ঘ, কারণ গুচ্ছ রাউন্ডে ক্ষোভের সাথে ভূত এবং ভূত প্রমাণ করতে পারে। কিন্তু পরকালেও মালির জন্য সময় ফুরিয়ে আসছে। তিনি যে পুরুষ এবং মহিলাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন তার সাথে যোগাযোগ করতে এবং শ্রীলঙ্কাকে দোলা দেবে এমন ফটোতে তাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য তার সাতটি চাঁদ রয়েছে। সেগুলো ব্যবহার করে তিনি তার প্রিয় মানুষগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন এবং নিজের ফেলে আসা ছবিগুলোর কাছে যেতে চান। স্বজন ও বন্ধুদের তার কাছে থাকা যুদ্ধের নৃশংসতা তুলে ধরা ছবিগুলোর হদিস দিতে মাত্র এক সপ্তাহ সময় আছে। কারণ, মালি মনে করেন, ছবিগুলো একদিন শ্রীলঙ্কাকে কাঁপিয়ে দেবে। কেন্দ্রীয় চরিত্র মৃত একজন আলোকচিত্রী। যুদ্ধের ভয়াবহতা আর হতাহতের সংখ্যা নিয়ে যখন বিতর্ক চলছিল, সে সময় এক আলোকচিত্রীকে ঘিরে এগিয়ে চলে উপন্যাসের কাহিনী।
জীবন ও মৃত্যুর মধ্যকার এক ঝঞ্ঝাময় পরিভ্রমণ এবং কল্পনার বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে নিরীক্ষাপ্রবণ বর্ণনাভঙ্গির সমন্বয়ের জন্য তাঁকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে বলে বিচারকেরা জানিয়েছেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত শ্রীলঙ্কার প্রেক্ষাপটে লেখা তাঁর এ উপন্যাসে এক মৃত আলোকচিত্রীর গল্প বলা হয়েছে, মৃত্যুর পর যে নিজের হত্যাকারীকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। ওই আলোকচিত্রী তাঁর এক বন্ধুকে বলেন, নিজের জীবদ্দশায় তোলা এসব ছবি তিনি প্রকাশ করতে চান। কারণ, এ ছবি প্রকাশ পেলেই যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষ জানতে ও বুঝতে পারবেন। শেহান করুণাতিলাকার এটি দ্বিতীয় উপন্যাস। প্রথম উপন্যাস চায়নাম্যান প্রকাশিত হয়েছিল ২০১০ সালে। এ বইয়ের জন্য সে বছর তিনি ‘কমনওয়েলথ বুক প্রাইজ’ পেয়েছিলেন।
শেহান করুণাতিলাকার জন্ম ১৯৭৫ সালে শ্রীলঙ্কার গালেতে। গালে শ্রীলঙ্কার অন্যতম প্রধান শহর। কলম্বো থেকে ১১৯ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বাংশে এ শহরের অবস্থান। ষোড়শ শতকে পর্তুগিজরা এখানে আসে। চতুর্দশ শতকে বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা এ শহরটি পরিভ্রমণ করেন এবং তিনি এতে ‘কালি’ নামে উল্লেখ করেছিলেন। শেহান রাজধানী কলম্বোতে বড় হয়েছেন। তিনি এস থমাস প্রিপারেটরি স্কুল, কোলু-পিটিয়া, শ্রীলঙ্কা, ওয়াংগানুই কলেজিয়েট স্কুল এবং ম্যাসি ইউনিভার্সিটি, পালমারস্টন নর্থ (যেখানে তিনি ইংরেজি সাহিত্যের পাশাপাশি ব্যবসায় প্রশাসন অধ্যয়ন করেন) থেকে শিক্ষা লাভ করেন। তিনি নিউজিল্যান্ডের মাসেই বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়াশোনা করেন। বসবাস ও কর্মস্থল হিসেবে বেছে নেন লন্ডন, আমস্টারডাম ও সিঙ্গাপুরকে। তিনি ম্যাকক্যান, আইরিস এবং বিবিডিওতে বিজ্ঞাপনে কাজ করেছিলেন এবং দ্য গার্ডিয়ান, নিউজউইক, রোলিং স্টোন, জিকিউ, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, কন্ডে নাস্ট, উইজডেন, দ্য ক্রিকেটার ও ইকোনমিক টাইমসের জন্য ফিচার লিখেছেন। তিনি শ্রীলঙ্কার রক ব্যান্ড ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্কয়ার ও পাওয়ারকাট সার্কাস এবং ব্রাস মাঙ্কি ব্যান্ডের সাথেও ছিলেন। শ্রীলঙ্কার লেখক শেহান করুণাতিলাকা বুকার পুরস্কার জয়ী তাঁর ব্যঙ্গাত্মক অতিপ্রাকৃত উপন্যাস ‘দ্য সেভেন মুনস অব মালি আলমেদা’ এর জন্য লন্ডনে এক অনুষ্ঠানে রানি কনসর্ট ক্যামিলার কাছ থেকে ট্রফি গ্রহণ করেন। এ ছাড়া তিনি ৫০ হাজার পাউন্ড পুরস্কার পান। পুরস্কার পেয়ে সম্মানিত ও গর্বিত বলে মন্তব্য করেন শেহান। সংক্ষিপ্ত তালিকায় থাকা মনোনীত বাকি পাঁচ লেখককেও দেয়া হয় আড়াই হাজার পাউন্ড করে।
নিল ম্যাকগ্রেগর, যিনি এ বছর পুরস্কারের বিচারকদের চেয়ারে বসেছিলেন। তিনি বলেছেন, উপন্যাসটি পাঠকদের জীবন এবং মৃত্যুর একটি রোলার-কোস্টার যাত্রা করাবে। যেখানে পাঠক তাদের বিস্ময়, আনন্দ, কোমলতা, ভালোবাসা এবং আনুগত্য খুঁজে পাবেন। করুণাতিলাকা পুরস্কারটি শ্রীলঙ্কার জনগণকে উৎসর্গ করেন। তার পুরস্কার বিজয়ী উপন্যাস চায়নাম্যান তাকে শ্রীলঙ্কার অন্যতম প্রধান লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার দশ বছর পর, শেহান করুণাতিলাকা বুকার পুরস্কার নিয়ে ফিরে এসেছেন। এবং একটি বিরক্তিকর গভীর সত্য যে ঞযব ঝবাবহ গড়ড়হং ড়ভ গধধষর অষসবরফধ’ ভৌতিক গল্পের ভিত্তি করে রচিত উপন্যাস।
করুনাতিলাকার ‘দ্য সেভেন মুনস অব মালি আলমেদা’-এর বিভিন্ন সংস্করণ বিভিন্ন শিরোনামে প্রকাশিত হয়। ২০১৫ সালে যখন প্রথম খসড়াটি গ্র্যাটিয়ান পুরস্কারের জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পায় তখন এটির শিরোনাম ছিল ‘ডেভিল ড্যান্স’। এটি ভারতীয় উপমহাদেশে পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া দ্বারা ২০২০ সালে ‘চ্যাট উইথ দ্য ডেড’ নামে প্রকাশিত হয়। বেশির ভাগ প্রকাশক শ্রীলঙ্কার রাজনীতিকে ‘গুপ্ত ও বিভ্রান্তিকর’ বলে মনে করেন এবং অনেকে মনে করেন ‘পৌরাণিক কাহিনী এবং বিশ্ব নির্মাণ পশ্চিমা পাঠকদের জন্য দুর্ভেদ্য ও কঠিন। এ কারণে তারা বইটি প্রকাশ করতে চায়নি। ব্রিটিশ প্রকাশনা সংস্থা শর্ট অব বুকস ‘পশ্চিমা পাঠকদের কাছে পরিচিত করার জন্য’ সম্পাদনা করার পরে উপন্যাসটি প্রকাশ করতে সম্মত হয়েছিল। করুনাতিলাকা বলেন, ‘আমি বলতে চাই এটি একই বই, কিন্তু এটি দুই বছরের করোনা কঠোরতা থেকে উপকৃত হয় এবং এটি অনেক বেশি অ্যাক্সেসযোগ্য। …আমি মনে করি শেষ নাটকটি হলো যে, ‘দ্য সেভেন মুনস অব মালি আলমেদা’ নামই চূড়ান্ত শিরোনাম হবে এবং পাঠকপ্রিয় হয়ে উঠবে। তার কথা সত্যি হয়েছে। এটি একটি ভূতের গল্প বলে মনে হবে, কেননা মৃত চরিত্র কথা বলছে। আর এই নাটকীয়তাই বইটির মূল রহস্য। ওয়ার ফটোগ্রাফার মালি আলমেদাকে অনুসরণ করে কাহিনী এগিয়ে যায়। লেখক ১৯৮৯ সালের ঘটনাবলির আলোকে বইটির কাহিনীবস্তু সেট করেছিলেন, কারণ এটি ছিল যখন ‘দ্য টাইগারস, দ্য আর্মি, দ্য ইন্ডিয়ান পিসকিপারস, দ্য জেভিপি টেরোরিস্টস ও স্টেট ডেথ স্কোয়াড সবাই একে অপরকে ব্যাপক হারে হত্যা করছিল। কারফিউ, বোমা, গুপ্তহত্যা, অপহরণ ও গণকবরের সময়টি লেখকের কাছে ‘ভূতের গল্প, গোয়েন্দা কাহিনী বা একটি স্পাই থ্রিলারের জন্য একটি নিখুঁত পরিবেশ বলে মনে হয়েছে। শেহান শিশু-কিশোরদের জন্যও কিছু বই লিখেছেন। ‘প্লিজ ডোন্ট পুট দ্যাট ইন ইওর মাউথ (২০১৯)-এ তার চিত্রকর ভাই ললিথ করুণাতিলাকার কাহিনী তুলে এনেছেন শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের পটভূমিতে তৈরি উপন্যাসে। উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন ওয়ার ফটোগ্রাফার। তার হত্যার রহস্য সমাধানের দায়িত্ব তিনি নেন।