তিনি মুরাদাবাদ গিয়ে মাদ্রাসায়ে এমদাদিয়াতে ভর্তি হন এবং সেখানে দুই বছর লেখাপড়া করেন। আবদুল মান্নান তালিব কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। এইচএসচি পাস করেন ঢাকা বোর্ড থেকে ১৯৬৬ সালে। সাবেক পশ্চিম পাকিস্তানে থাকাকালীন সময়ে তিনি উর্দুতে এম.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি বাংলা এবং উর্দুতে এমন দক্ষতা অর্জন করেছিলেন যে, ভাষান্তরে তার সমকক্ষ মানুষ খুব কমই নজরে পড়ে।
তাঁর কর্মময় জীবন শুরু হয় মূলত সাংবাদিকতার মাধ্যমে। দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাসিকসহ বহু পত্রিকার সম্পাদনার সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন। রচনা করেছেন মৌলিক গ্রন্থ, গবেষণা গ্রন্থ। বই সম্পাদনাও করেছেন প্রচুর। অনুবাদকর্মেও রয়েছে তার বিরাট ভূমিকা। ১৯৮৭ সাল থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি বাংলা সাহিত্য পরিষদের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। পাশাপাশি ১৯৯৯ থেকে ইসলামিক ‘ল’ রিসার্চ সেন্টার এন্ড লিগ্যাল এইড বাংলাদেশ এর ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। আবদুল মান্নান তালিব সম্পাদক হিসাবে অনন্য। এই মহান সাহিত্যিক ২২ সেপ্টেম্বর ২০১১ সালে ছিয়াত্তর বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন।
তিনি ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ ইসলামিক স্কুল, দুবাই সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। ২০০০ সালে কিশোর কণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার এবং ২০১০ সালে বাংলা সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার লাভ করেন।
তার প্রবন্ধের সংখ্যা তিনশ’ এর বেশি। মৌলিক রচনা, অনুবাদ ও সম্পাদনা সব মিলিয়ে তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৭৬টি। অনেক মূল্যবান গ্রন্থ অপ্রকাশিত রয়েছে। তাঁর রচিত কয়েকটি মৌলিক গ্রন্থ নিম্নরূপ : ‘অবরুদ্ধ জীবনের কথা’, ‘মুসলমানের প্রথম কাজ’, ‘বাংলাদেশে ইসলাম’, ‘ইসলামী সাহিত্য’, ‘ইসলামী সাহিত্য : মূল্যবোধ ও উপাদান’, ‘ইমাম ইবনে তাইমিয়ার সংগ্রামী জীবন’, ‘সাহিত্য সংস্কৃতি ভাষা : ঐতিহ্যিক প্রেক্ষাপট’, ‘ইসলামী জীবন ও চিন্তার পুনর্গঠন’, ‘সত্যের তরবারি ঝলসায়’, ‘আধুনিক যুগের চ্যালেঞ্জ ও ইসলাম’।
নি¤েœাক্ত প্রবন্ধটি তাঁর রচিত ‘সাহিত্য সংস্কৃতি ভাষা : ঐতিহ্যিক প্রেক্ষাপট’ নামক গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।]
ভাষা চিরকাল জাতির আপন সম্পদ। জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাবধারা তার যাবতীয় মূল্যবান সম্পদ এমন কি তার নিত্যদিনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আবেগ-অনুভূতি সবকিছু ভাষার ভা-ারে সঞ্চিত থাকে। কোনোটা মূল্যবান। কোনোটা কম মূল্যবান। কোনটা বেশী মূল্যবান। কোনোটা মূল্যহীন। তবুও তা ভাষার সম্পদ। ভাষার ভা-ারটি এভাবেই সমৃদ্ধ।
আজ যে ভূ-খ-ে আমাদের বাস, সেটিই সেই প্রাচীনকাল থেকে বাংলার আসল অবয়বকে ধারণ করে আছে। বাংলার প্রাচীন ভূ-ভাগ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি জাতীয়তা সবকিছুই এই ভূখন্ডের আপন। প্রাচীন বাংলা বলতে এই গাঙ্গেয় বদ্বীপকেই বুঝায়। গঙ্গা ব্রহ্মপুত্রের পলি বিছানো বিস্তীর্ণ সমতল এলাকাই প্রাচীন বাংলা। এর পূর্বের ও পূর্ব-দক্ষিণের ছিটেফোঁটা পাহাড়ী এলাকা এ দেশটির প্রাচীনত্বের সাক্ষ্য দিচ্ছে। আর বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদে যে ভাষারীতির নমুনা পাওয়া গেছে তাও গড়ে উঠেছিল এই বাংলাদেশেরই মাটিতে। কাজেই ভাষা ও ভূ-ভাগ উভয় দিক দিয়েই আমরা আসলত্বের অধিকারী। এক্ষত্রে ভূখন্ডের দিক দিয়ে যেমন আমরা স্বাধীন রাষ্ট্রিক মর্যাদার অধিকারী হয়েছি তেমনি ভাষার দিক দিয়েও আমাদের গড়ে তুলতে হবে ঐতিহ্যিক স্বাতন্ত্র।
এখানে গড়ে তোলার কথা এজন্য বলছি যে, এ স্বাতন্ত্র্যের অধিকারী আমরা এখনো হতে পারিনি। চর্যা যুগের পর হাজারো বছরের মধ্যে এ দেশের ধর্ম ও সমাজ জীবনে ওলট-পালট হয়ে গেছে। বৌদ্ধ, জৈন ও বৈদিক হিন্দু অধ্যুসিত বাংলায় তওহীদবাদী ধর্ম ইসলাম ব্যাপক প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর চিন্তায়, ভাবধারায়, আচারে-ব্যবহারে চালচলনে বিরাট পরিবর্তন এসেছে। লেবাস, পোশাক, খাদ্য থেকে শুরু করে জীবনের কোন ক্ষেত্রে এই পরিবর্তনের হাওয়া বয়নি তা বলা মুশকিল। হাজার বার শ’ বছর থেকে এ পরিবর্তন সমাজ ক্ষেত্রে এমনভাবে জেকে বসেছে যে বাংলার সমাজের সামগ্রিক কাঠামোয় এখন আর পৌত্তলিক বা মুশরিকী উপাদানের প্রাধান্য নেই। তওহীদী ভাবধারা ও তওহীদী ঐতিহ্য সেখানে সর্বক্ষেত্রে প্রসারিত। আর এর সামগ্রিক, ব্যাপক ও সুস্পষ্টতর প্রকাশের প্রধানতম মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ভাষায় এর প্রকাশ ঘটেছে।
এ প্রকাশটাকে বিকল করার ও জাতীয় অংগনে একে প্রভাবহীন করে রাখার জন্য বাংলাভাষার লেখ্য রীতিতে এর ছাড়পত্র আটকে রাখার কোনো মানে নেই। আজকে আটকে রাখলেও চিরকাল আটকে রাখা যাবে না। একদিন তার অধিকার তাকে দিতে হবে। মূলত ভাষা সমৃদ্ধ হয় তার শব্দ সম্ভারে। বিদেশ থেকে ও বিদেশী ভাষা থেকে শব্দ গ্রহণ করায় যদি আমাদের কোনো বাধা না থেকে থাকে বরং এক্ষেত্রে যদি আমরা সংগত গর্ববোধ করে থাকি যে, যে কোনো ভাষার শব্দ ধারণ করার মতো ক্ষমতা বাংলা ভাষার আছে, তাহলে আমাদের শ্যামল, সবুজ ক্ষেত্রে নিজেদের ঘরের কোণে অতি যতেœ ও আদরে যেসব শব্দ লালিত হয়েছে, যার মধ্যে আমাদের ঐতিহ্যিক চেতনা প্রাণাবেগে স্পন্দিত হচ্ছে, সেগুলোকে ভাষার অঙ্গন থেকে দূরে রাখার যৌক্তিকতা কোথায়?
বাংলা ভাষার ঐতিহ্যিক স্বাতন্ত্র্য শুধু তার শব্দ সম্ভারে নেই, তার প্রকাশ রীতিতেও রয়েছে। তওহীদবাদ সমাজ জীবনে যে প্রভাব বিস্তার করেছে, তার ফলে ভাষায় একটি শব্দের স্থলে আরেকটি শব্দের উদ্ভব হয়েছে। যেমন ধরা যাক, হালাল ও হারামের কোনো সুস্পষ্ট সীমারেখা ছিল না। হয়তো কিছু কাজ ভালো ছিল, কিছু কাজ খারাপ ছিল, কিছু খাদ্য খাবার অনুমতি ছিল, কিছু খাদ্য খাবার অনুমতি ছিল না। এ জন্য কিছু শব্দের ব্যবহারও এখানে ছিল। কিন্তু ইসলাম এসে যেভাবে এর সীমারেখা চিহ্নিত করে দিয়েছে, যেভাবে এর চেহারা সুস্পষ্ট করে দিয়ে একে দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল করে দিয়েছে, তাতে ‘হালাল’ ও ‘হারাম’ শব্দ দুটির ব্যবহার ছাড়া এ বিষয়টা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। শব্দগুলোর সাথে সাথে তাদের অন্তরনিহিত ভাবটি যে রীতিতে প্রকাশ করা হয় তার মধ্যেও পরিবর্তন এসেছে। মুসলমানদের চলন ও প্রকাশভঙ্গী সম্পর্কে আল্লাহ নিজেই কুরআনে বরেছেন : ওয়া ইযা র্মারু বিল্ লাগবী র্মারু কিরামা-মুসলমানরা যখন কোনো অশালীন কাজ ও কথার কাছ দিয়ে যায় তখন তারা ভদ্রতা ও রুচিশীলতার পরিচয় দেয়। মুসলমানরা কখনো ফাহেশ কথা মুখ দিয়ে বের করে না। তাদের প্রকাশ রীতি বড়ই শালীন। একজন অমুসলমান একটা কথা যে কোনো ভাবেই ব্যক্ত করে দিতে পারে। তার শ্রোতা বিষয়টা যেভাবে বুঝতে সক্ষম, বৈধ-অবৈধ, শালীন-অশালীন যে কোনো রীতিতে সে কথাটা তার সামনে প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু একজন মুসলমান তা করতে পারে না। তার প্রকাশভংগী হবে শালীন-রুচিশীল। বাংলাদেশের মুসলমানদের প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে বাংলা ভাষার কথ্য রীতিতে মুসলমানদের এ স্বাতন্ত্রও স্থান লাভ করেছে। কাজেই বাংলা ভাষার লেখ্য রীতিতে মুসলিম জনজীবনের শব্দের সাথে সাথে মনের ভাব প্রকাশের ও শব্দ ব্যবহারের বিশেষ ভংগীও স্থান লাভ করতে হবে।
পাশ্চাত্য সভ্যতার আওতাধীনে আমাদের ভাষা ও সাহিত্য ক্ষেত্রে যে রেনেসাঁ এসেছে তা যদি আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য, ভাষা ও সাহিত্যের ঐতিহ্যের বিকৃতি ঘটনায় তাহলে তাকে আমরা আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের রেনেসাঁ নামে আখ্যায়িত করি কেমন করে? আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের রেনেসাঁর সূচনা করতে হবে আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের ঐতিহ্যিক স্বাতন্ত্র্যকে বজায় রেখে বরং তার ভিত্তিতে।
আমাদের স্বাধীন দেশে বাংলা রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। তওহীদবাদের প্রভাবে আমাদের এ ভাষার একটা স্বতন্ত্র কাঠামো গড়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের বাইরে যেসব দেশে বাংলা ভাষার প্রচলন আছে হয়তো বিগত শতকে ও চলতি শতকের গোড়ার দিকে সেখানে বাংলা ভাষার উন্নয়ন হয়েছে। বেশী। কিন্তু সেই উন্নয়নকারে তওহীদবাদের প্রভাব কাটিয়ে ওঠার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে তাদের এই অবিমৃষ্যকারিতার চিহ্ন বর্তমান বাংলা ভাষার সব ক্ষেত্রেই জ¦লজ¦ল করেছে। একে ভাষার উপর এক রকম ধর্ষণ আখ্যা দেয়া যেতে পারে। এটা ছিল বাংলা ভাষাটাকে বিশেষ একদল লোকের ভাষায় পরিণত করার অপচেষ্টা। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে একটা ক্ষুদ্রতর গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থের আয়েশ করার চেষ্টা করেছিল।
কিন্তু আমাদের স্বাধীন দেশে বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থের আয়েশের কোনো স্থান নেই। এখানে বাংলা ভাষাকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাসায় পরিণত করতে হবে। এ ভাষা যদি তওহীদবাদী জনতার ভাসায় পরিণত না হয় তাহলে ভাষার ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র অর্জিত হলো কোথায়? উপমহাদেশের বুক চিরে বাংলাদেশের যদি একটি স্বাধীন ও স্বাতন্ত্র্য রাষ্ট্র হিসাবে বেঁচে থাকার যৌক্তিকতা থেকে থাকে তাহলে বাংলাদেশের বাংলা ভাষা তার ঐতিহ্যিক স্বাতন্ত্র নিয়ে টিকে থাকার অধিকার পাবে না কেন?
একটা কথা এখানে সুস্পষ্ট হয়ে যাওয়া ভাল। বাংলা ভাষার বিগত সোয়া শ’ বছরের উন্নয়নের ভিত্তি রাখা হয়েছে সংস্কৃতের ওপর। আর এ সংস্কৃতের স্থান ভারতের বাংলা ভাষায় থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু বাংলাদেশের বাংলা ভাষায় এর স্থান কোথায়? বাংলাদেশের লোকেরা নিজেদের মাতৃভাষায় দক্ষতা অর্জনের জন্য কি সংস্কৃত শিখবে? কারণ সংস্কৃত জানা ছাড়া এ বাংলা ভাষায় দক্ষতার দাবী কেউ করতে পারে না। এ অবস্থায় আমাদের বাংলা ভাষা আজকের মত চিরকাল ভারতের বাংলা ভাষার দ্বারস্থ হয়ে থাকবে। তাহলে ভাষার ক্ষেত্রে কি আমরা বলতে পারবো, আমরা স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছি? এ দেশের জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশ যে তওহীদবাদী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক তারই ভিত্তিতে এ দেশের বাংলা ভাষার চেহারা ও অবয়ব সুস্পষ্ট রূপ নিলেই আমরা বাংলা ভাষাকে এ দেশে সত্যিকার মর্যদায় প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি বলে দাবী করতে পারবো।