আবদুল হক (১৯১৮-১৯৯৭) বাংলাদেশের প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক এবং লেখক ছিলেন। তিনি ১৯১৮ চাপাইনবাবগঞ্জ জেলার উদয়নগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৩৬ সালে কানসাট হাই ইংলিশ স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৩৯-এ করটিয়ার সাদত কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আই.এ. পাস করেন। রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে ১৯৪৪ সালে ইংরেজিতে স্নাতক এবং ১৯৪৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাস করেন।
আবদুল হক ১৯৪৫ সালে ডেইলি আজাদ এর উপ-সম্পাদক হিসাবে যোগদান করেন। পরে তিনি সাওগাত-এ কাজ করেছিলেন। তিনি ১৯৪৭ সালে ঢাকার আঞ্চলিক তথ্য অফিসে কর্মী লেখক হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন। পরে ভারত বিভাগের পরে তিনি বাংলা উন্নয়ন বোর্ডে সহকারী প্রকাশনা অফিসার হিসাবে কাজ করেছিলেন। পরে তাকে পদোন্নতি অফিসার পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। তাঁকে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম উত্তরসাধক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
তার উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থসমূহ : ক্রান্তিকাল, সাহিত্য ঐতিহ্য মূল্যবোধ, বাঙালী জাতীয়তাবাদ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ, সাহিত্য ও স্বাধীনতা, ভাষা আন্দোলন : আদি পর্ব প্রভৃতি।
১৯৬৪ সালে তিনি দাউদ পুরস্কারে ভূষিত হন। পেশাগত জীবনে তিনি ১৯৬৫ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত বাংলা উন্নয়ন বোর্ড ও বাংলা একাডেমীতে দায়িত্বরত ছিলেন। তিনি ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।
তিনি বেশ কয়েকটি নাটক রচনা করেছিলেন। তার প্রবন্ধগুলি জার্নালে প্রকাশিত হত এবং বইগুলিতে প্রকাশিত হত। ১৯৮১ সালে তিনি বাংলা একাডেমি থেকে পরিচালক হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৮৮ সালে তিনি আবুল হাসনাত সাহিত্য পুরস্কার এবং ১৯৯০ সালে হিলালী স্মৃতি স্বর্ণপদক লাভ করেন। তিনি ১৯৯৭ সালে ইন্তিকাল করেন। – শাহাদাৎ সরকার
বহু-আলোচিত বৈষম্য-নীতি সত্ত্বেও এদেশে সমৃদ্ধির সম্প্রসারণ যে ঘটছে তা স্বীকার্য। সর্বজনীনভাবে ঘটছে তা নয়-কেননা ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে তা সম্ভব নয়; ব্যাপকভাবে ঘটছে তাও নয়-কেননা নিয়োজিত সম্পদের পরিমাণ অপ্রতুল। কিন্তু সম্পদের সম্প্রসারণ ঘটছে এবং তার লক্ষণ নানা ক্ষেত্রে দৃশ্যমান। নতুন নতুন শিল্পকারখানা, সৌধশ্রেণী ও সিনেমাগৃহ পল্লী ও শহরাঞ্চলের চেহারা দ্রুত বদলে দিচ্ছে, প্রাইভেট কার ও সুসজ্জিত বিপণীর সংখ্যা বাড়ছে, এবং সুবেশ পুরুষ ও সুবেশা সালাংকারা নারী সর্বত্র দৃষ্টিগোচর।
দৃশ্যত এই আর্থিক সমৃদ্ধি আমাদের সংস্কৃতি-জীবনেরও সম্ভাবনা বৃদ্ধি করেছে। নানা শ্রেণীর কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে এবং সর্বত্রই ছাত্র-ছাত্রীদের অভূতপূর্ব ভিড়। দৈনিক ও সাময়িক পত্র-পত্রিকার সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। রেডিও এখন শিক্ষিত জীবনের অঙ্গে পরিণত, এমনকি সুদূর পল্লী-অঞ্চলেও জনপ্রিয়; সিনেমা-গৃহগুলি জনাকীর্ণ, এবং নৃত্য-সঙ্গীত নাট্যানুষ্ঠান সর্বত্র সাগ্রহে পরিপোষিত। পুস্তক-প্রকাশনা ও পাঠক-সংখ্যা ক্রম-সম্প্রসারণমান। চিত্র-প্রদর্শনী ও সাহিত্য-সভার সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য।
কিন্তু শিক্ষা ও সংস্কৃতি-রুচির এই দৃষ্টিগ্রাহ্য সম্প্রসারণ যতটা পরিমাণগত ব্যাপার ততটা উৎকর্ষের ব্যাপার নয়, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নয়। শিক্ষাক্ষেত্রেই বোধ হয় এটা সবচাইতে স্পষ্ট।
বর্তমানে সকল প্রকার শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের অভূতপূর্ব ভিড়; কিন্তু আমরা জানি, শিক্ষার মান বৃদ্ধি পায়নি, হ্রাস পেয়েছে। আমাদেরই সমাজে শিক্ষার সুযোগ যখন ছিল সংকীর্ণ তখন অনেক প্রতিভা ও মনীষা শিক্ষালয়গুলি থেকে বেরিয়ে এসেছেন; জনসমাজে তাঁরা স্মরণীয় ও বরণীয় হয়েছেন; কিন্তু তেমন মনীষা ও প্রতিভার আবির্ভাব এখন একান্ত দুর্লভ। এবং সহজাত প্রতিভা ও অধ্যবসায় যেটুকু সম্ভাবনা নিয়ে আসতে পারতো, কূটকৌশলীদের গোপন সঙ্কেতে পরিচালিত ছাত্র-রাজনীতির আবর্তে তাও নিমজ্জমান।
সঙ্গীত-জলসা, সাহিত্য-সভা ও চিত্রপ্রদর্শনী, সিনেমা, নাটক ও নৃত্যানুষ্ঠান ইত্যাদির ক্রমবর্ধমান চাহিদা সংস্কৃতি-রুচির প্রসারের লক্ষণ, কিন্তু সংস্কৃতি-রুচির প্রসার এবং সংস্কৃতির উন্নতি এক কথা নয়। এই সংস্কৃতি-রুচির প্রসারকে প্রধানত প্রমোদপ্রিয়তার প্রসার বলাই সঙ্গত, এবং প্রমোদপ্রিয়তা সব সময় সংস্কৃতি-প্রিয়তা নয়। যে-সব অনুষ্ঠানে বুদ্ধি-বৃত্তির প্রয়োগ-সমস্যা অথবা প্রগাঢ় অনুভূতির প্রশ্ন নেই, আছে সহজ আনন্দ, সে-সব অনুষ্ঠানই সাধারণত জনপ্রিয়। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত-জলসা, চিন্তামূলক সাহিত্য-সভা ইত্যাদির ন্যায় অনুষ্ঠান তাই দুর্লভ ব্যাপার। অন্যদিকে সিনেমার জনপ্রিয়তা ক্রমবর্ধমান।
সিনেমার আকর্ষণ কিন্তু সহজ আনন্দই শুধু নয়। সিনেমা জগতে সেইসব ফিল্মেরই জনপ্রিয়তা বেশি যে-সব ফিল্মে যৌন-নৈতিকতা শিথিল, নগ্নতাবাদের প্রচার সুস্পষ্ট এবং আদিম প্রবৃত্তিগুলির উত্তেজনা সহজলভ্য। এ ব্যাপারে অন্যান্য দেশের তুলনায় এই ভূভাগের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই, একটা বহুল-প্রচারিত ধর্মীয় আদর্শবাদ সত্ত্বেও। কিন্তু এক্ষেত্রে এ প্রদেশে আরেকটা অপ্রত্যাশিত সংকট ঘনীভূত। সেটি হচ্ছে, বাংলা ফিল্মের ব্যর্থতা এবং উর্দু ফিল্ম কর্তৃক তার স্থান দখল। নিজের ভাষার ফিল্ম বর্জন করে অন্য ভাষার ফিল্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব : এমন ব্যাপার অন্য দেশে সুদুর্লভ। এর অনেক কারণ থাকতে পারে : শিল্প হিসাবে বাংলা ফিল্মের অনুৎকর্ষ; কাহিনীর অনুৎকর্ষ; বিকৃত অবাস্তব জীবনচিত্র ও যৌনতাবাহুল্যের প্রতি আকর্ষণ, সামাজিক ও ঐতিহ্যগত কারণে যা বাংলা ফিল্ম অপেক্ষা উর্দু ফিল্মে সহজ-পরিবেশনীয় এবং সহজলভ্য। প্রতিযোগিতার যদি কোনো অর্থ থাকে তবে এই সর্বশেষ লক্ষণটি বাংলা ফিল্মেও কালক্রমে সংক্রামিত হবে। উর্দু ফিল্মের অপেক্ষাকৃত জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ কোনটি তা বলা কঠিন, কিন্তু প্রধান কারণ যাই হোক, এটা সাংস্কৃতিক অবক্ষয়েরই লক্ষণ।
সেই সঙ্গে এটি রুচির স্থূলীকরণেরও পরিচয়। এবং রুচির স্থূলীকরণ কেবল দর্শক-সমাজে সীমাবদ্ধ নয়, পাঠক-সমাজেও তা লক্ষণীয়। আমাদের সংস্কৃতি-জগতের একটা করুণ অভিজ্ঞতা এই যে, শুধু সেইসব গ্রন্থ ও সাময়িক পত্রিকাই জনপ্রিয় যেগুলি অপেক্ষাকৃত তরল রসের পরিবেশক, এবং উত্তেজক ও অশ্রদ্ধের ভাবাবেগের পরিপোষক। উদার মতবাদ, গভীর জীবন-জিজ্ঞাসা এবং সুক্ষ্ম মননশীলতার বাহনগুলি প্রায় অপাংক্তের। এরূপ প্রবণতা যে কোনো কালেই ছিল না তা নয়, তবে রুচির স্থূলীকরণের এই ব্যাপকতা বিশেষভাবে সাম্প্রতিক ঘটনা। সিনেমা-ব্যবসায়ী এবং গ্রন্থ ও পত্র-পত্রিকার প্রকাশকের এ বিষয়ে সচেতন, আর এই পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণেও তারা পূর্ণ উদ্যমশীল। এমনকি সজ্ঞানে রুচির স্থূলীকরণই অনেক সময় তাদের লক্ষ্য। এবং এই কারণেই সম্ভব হয়েছে শিল্প-সাহিত্যের অবিমিশ্র ব্যবসায়ীকরণ, যার উদ্দেশ্য শিল্প-সংস্কৃতির সেবা নয়, মুনাফা এবং দ্রুত মুনাফা। অবশ্য এইখানে একটা তর্ক সম্ভব : গাছে কাক বসার জন্যেই তাল পড়লো, অথবা পরিপক্ক হয়ে উঠেছিল বলেই তাল পড়লো। রুচির স্থূলীকরণও শিল্প-সাহিত্যের ব্যবসায়িকরণ, এর কোনটি কার্য এবং কোনটি কারণ সে প্রশ্ন এখানে বড় নয় এবং সে প্রশ্নের মীমাংসাও বোধ হয় সম্ভব নয়। মূলত যেটিই হেতু হোক, সূচনা-স্তরের পর এর একটি অন্যটিকে উদ্দীপিত করেছে, এবং এ দুইটি এখন আমাদের সমাজে বাস্তব সত্য।
তবে ভালো কাজও সম্প্রতি কিছু কিছু হচ্ছে। বিশ^বিদ্যালয় এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের উদ্যমে গবেষণা এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতিমূলক তৎপরতা প্রসারমাণ, এবং এইটি একটি সুলক্ষণ। এ ক্ষেত্রে মহৎ সাফল্য অবশ্য এখনো দৃষ্টিগোচর নয়, এবং মহৎ সাফল্য দুর্লভ ব্যাপার। কিন্তু একথার প্রবল প্রতিবাদ বোধ হয় সম্ভব নয় যে মৌলিক চিন্তার ক্ষেত্রে আমাদের সমাজ বহু বছর থেকে বিশেষ-কিছু সংযোজন করেনি, এবং অন্যের অনুসরণে অতীতের নতুন ভাষ্যের বেশি এগোয়নি। বস্তুত মৌলিক চিন্তার ক্ষেত্রে আমাদের সমাজ বহুদিন থেকে প্রায় স্তব্ধ। অন্য দেশের মৌলিক ও নতুন নতুন চিন্তা-ধারা স্ব-সমাজে সঞ্চারণের উদ্যমও বিশেষ উল্লেখযোগ্য নয়।
সাহিত্যক্ষেত্রে আরো একটি সংকট ঘনায়মান, অথবা ইতিমধ্যেই ঘনীভূত : সেটি হচ্ছে, সৃষ্টিমূলক প্রতিভার সংকট। সাহিত্যে নতুন নতুন প্রতিভার আবির্ভাব হচ্ছে এমন কথা আমরা আগের মতো আর বলছি না। সাহিত্যের নানা বিভাগে এক সময় যাঁরা অনেক প্রতিশ্রুতি নিয়ে আমাদের সামনে এসেছিলেন, তাঁরা বিভিন্ন কলেজে, বিশ^বিদ্যালয়ে, সংস্কৃতি-প্রতিষ্ঠানে, পত্র-পত্রিকায়, সরকারী-বেসরকারী অফিসে অথবা ফিল্মে হয়তো সুপ্রতিষ্ঠিত এবং আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যে সফল, কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্র থেকে তাঁদের অনেকেই অপসৃত, অথবা অপসৃত-প্রায়, অথবা সাহিত্যের মূল্যবোধে বিভ্রান্ত। চিত্রশিল্পেও নতুন নতুন প্রতিভার আবির্ভাব সম্প্রতি দুর্লভ।
এসবই ঘটছে সমৃদ্ধির সম্প্রসারণ সত্ত্বেও। সকল ক্ষেত্রে সর্বদাই প্রতিভার আবির্ভাব আশা করা সঙ্গত নয়, কেননা তা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রতিভার ও সংস্কৃতিমানের প্রায় সর্বব্যাপী অবনমনও সুলক্ষণ নয়। এই অবনমনের কারণ সমাজের নতুন সমৃদ্ধি এমন কথা বলা কিন্তু আমার উদ্দেশ্য নয়, কেননা এ যুগের অথবা অতীত যুগের অগ্রসর ও সমৃদ্ধ দেশগুলির অভিজ্ঞতায় তার সমর্থন পাওয়া যায় না। সে-সব দেশে সমৃদ্ধি, মনীষা ও উন্নত সংস্কৃতি-বিকাশ অনেক সময় পাশাপাশি ঘটতে দেখা গেছে। এদেশেও তাই ঘটবে এমন প্রত্যাশা আমাদের ছিল। কিন্তু সে প্রত্যাশাপূরণ আজ যেন সুদূরপরাহত।
এই সংকটের সঠিক কারণ নির্ণয় দুরূহ। কিন্তু নয়া সমৃদ্ধির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সামাজিক লক্ষণ সংকটের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে হয়। এর একটি হচ্ছে শিল্প-সাহিত্যের ব্যবসায়িকরণ ও আরেকটি রুচির স্থূলীকরণ, যার উল্লেখ ইতিপূর্বে করেছি। আরও দুটি লক্ষণ হচ্ছে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধনশীল মান। এই লক্ষণগুলি পরস্পর-বিচ্ছিন্ন এবং সমান্তরাল নয়, বরং একটি অন্যটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
এর মধ্যে একটি অত্যন্ত মৌলিক ব্যাপার হচ্ছে নতুন সমৃদ্ধির যুগে জীবনযাত্রার ক্রমোন্নতিশীল মান। স্বাধীনতার আমলে যে আর্থিক সমৃদ্ধি সম্প্রসারিত হচ্ছে তা সমাজের অনেকের জীবনে শুধু স্বাচ্ছন্দ্যই আনেনি, পূর্বযুগের তুলনায় জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নতও করেছে : খাদ্যে ও বস্ত্রে, বাসগৃহে ও আসবাবে, ছেলেমেয়েদের শিক্ষায়, ললিতকলা চর্চায়, বিবাহ-সম্পর্ক স্থাপনে ও নানাবিধ সামাজিকতায়, প্রমোদ-সন্ধ্যানে, সংবাদপত্র রেডিও ও অন্যান্য বহুবিধ উপকরণের চাহিদায়। এই মান কিন্তু কোনো স্থির ব্যাপার নয়, প্রতি বছরই এ উচ্চতর হচ্ছে : কিছুটা সম্প্রসারণশীল সমৃদ্ধির নিজস্ব তাগিদে, কিছুটা বিদেশীদের প্রভাবে এবং কিছুটা বিদেশ-ফেরতদের সাড়ন্বর উদাহরণে। মনোন্নয়ন সব সময়েই যে বস্তুগত তা নয়, অনেক সময় স্টাইলগত। এবং এই ক্রমোন্নতিশীল মান একটা সমস্যারও সৃষ্টি করেছে : এ শুধু ভাগ্যবান পরিবারগুলিতে সীমাবদ্ধ না থেকে মধ্যবিত্ত সমাজের ব্যাপকতর অংশে একটা নির্মম সর্বজনীন রূপ নিতে চাচ্ছে।
নির্মম-কেননা সামর্থ্য থাকুক বা না থাকুক জীবনযাত্রার একটা নিম্নতম মানে উপনীত হওয়া এবং সে মান রক্ষা করা এই সমাজের পরিবারগুলি নিছক সামাজিক চাপে পড়ে অবশ্যকর্তব্য জ্ঞান করছে : জীবনযাত্রার উপকরণে ও পদ্ধতিতে যেন অন্তত একটা নিম্নতম মানের পরিচয় পাওয়া যা, কোনো কিছু যেন বাদ না পড়ে, নইলে মধ্যবিত্ত জীবনযাত্রা অসম্ভব হয়ে পড়বে, নেমে যেতে হবে নিম্ন-মধ্যবিত্ত সমাজে, এবং তারপর বৃন্তচ্যুত হয়ে নিম্নতর সমাজে। সমাজের মানুষেরা সচেতন যে বাড়ীঘর ও আসবাব, পোশাক-পরিচ্ছন্ন, পারিবারিক শিক্ষা, নানাবিধ সামাজিকতা, বিবাহ-সম্পর্ক ইত্যাদি কতকগুলি দৃষ্টিগ্রাহ্য ব্যাপার দিয়ে তীক্ষèচক্ষু সমাজ বিচার করে কার কেমন পয়সা আছে, অথবা কোন পরিবার কতটা “ভদ্র”, অথবা “কালচার্ড”। এইসবের দু’একটি ব্যাপারে কমতি হলেই প্রমাণ হয় যে “পয়সা নেই”, এবং “পয়সা নেই”-এর মতো সামাজিক সম্মানহানির ব্যাপার বোধ হয় আর কিছু নেই।
নতুন এবং ক্রম-সম্প্রসারণশীল সমৃদ্ধির প্রেক্ষিতে মধ্যবিত্ত মানুষদের এই দায়িত্ব বাড়ছে-অথবা বাড়ছে বলে তারা মনে করছে-কিন্তু অর্থোপার্জনের অসম সুযোগ ও অর্থের অসম বন্টন, মুদ্রাস্ফীতি এবং সেই সঙ্গে ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের দরূন এই দায়িত্ব অধিকাংশের পক্ষেই অগ্নিপরীক্ষার মতো দুঃসহ এবং “পয়সা নেই”-এর বিভীষিকায় কন্টকিত।
জীবনযাত্রার এই ক্রমবর্ধনশীল মানের তাড়না থেকে লেখক-সম্প্রদায় মুক্ত নন, কেননা তাঁরা প্রধানত এই মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়েরই মানুষ। এই তাড়না আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনকে কিভাবে প্রভাবিত করছে তা বোঝা যাবে যদি মনে রাখি যে এই তাড়নার পাশাপাশি রয়েছে দুটি সামাজিক সত্য : রুচির স্থূলীকরণ এবং শিল্প-সাহিত্যের ব্যবসায়িকরণ। আমরা জানি, সিনেমা-শিল্পের অবিচল দৃষ্টি বক্স-অফিসের প্রতি, এবং বক্স-অফিসের নিশ্চিত পন্থা জীবনের আর্দ্র আবেগবহুল বিকৃত চিত্র ও যৌন-নৈতিকতার শিথিলতা। যেসব সাময়িকপত্র বহুল প্রচারিত অথবা বহুল প্রচারিত হওয়ার আকাক্সক্ষী, সেগুলিরও অবলম্বন তাই; পুস্তক-প্রকাশক প্রতিষ্ঠানগুলিও প্রাকৃতরুচি সমাজের একই রকম চাহিদা সম্পর্কে সচেতন, এবং সে চাহিদা পূরণে যত্নশীল। জীবনযাত্রার মান রক্ষার তাগিদে এই চাহিদা সম্পর্কে উদাসীন থাকা লেখকদের পক্ষে সুকঠিন। বহু শক্তিমান খ্যাতিমান লেখকই তাই শিল্প-সৃষ্টির আনন্দকে ত্যাগ করে সিনেমা-উপযোগিতার দিকে লক্ষ্য রেখে গল্প-উপন্যাস লিখেছেন সিনেমা-পত্রিকায়-বাংলাদেশে শুধু নয়, পশ্চিমবঙ্গেও। উত্তম সৃষ্টি এবং মৌলিক সৃষ্টি যদি দ্রুত ও প্রচুর মুনাফা অর্জনে সমর্থ না হয় তবে প্রকাশক তা নেবে কেন, এবং প্রকাশক না নিলে লেখকই বা তা লিখবেন কেন? গবেষণা ও মননমূলক রচনার ব্যাপারে যদি লেখক দেখেন যে তিন দিন খেটে যে অর্থাগম হবে তিন মাস খেটেও হবে তাই, তবে তিনি তিন দিনের বেশী পরিশ্রমের উৎসাহ পাবেন কোথা থেকে, এবং ঐ রচনাটির জন্যে দশবিশ টাকার বই-পত্রিকা কিনতে এবং আট-দশটা লাইব্রেরীতে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে পড়াশোনা করতে যাবেন কেন? পড়াশোনারর আনন্দ, গবেষণার আনন্দ, সৃষ্টির আনন্দ তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক; কিন্তু জীবনের কঠিন বাস্তবের প্রতিও তিনি অন্ধ নন। জীবনের কঠিন বাস্তব চতুর্দিক থেকে তাঁর চেতনাকে আঘাত দিচ্ছে, জীবনযাত্রার ঊর্ধ্বশ^াস মিছিলের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই ঊর্ধ্বশ^াস জীবনে যে-পরিমাণ পরিশ্রম তাঁর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের, অথবা মান অক্ষুণœ রাখার অথবা শুধু জীবনযাত্রার সহায়ক হবে তা তিনি অবশ্যই করবেন; কিন্তু যে-পরিমাণ পরিশ্রম তা করবে না, বরং তার জীবনযাত্রার মানকে আরও নামিয়ে দেবে, সে পরিমাণ পরিশ্রম-অপরিহার্য হলেও, প্রিয় হলেও, সে পরিমাণ পরিশ্রম করতে তিনি জৈবিক নিয়মেই সঙ্কুচিত হবেন। কেননা তিনি সচেতন যে রুচির স্থূলীকরণ ও শিল্প-সাহিত্যের ব্যবসায়িকরণের যুগে তাঁর এই শ্রম ও সাধনার মূল্য সমাজ বুঝবে না। অতএব তিনি অগ্রসর হবেন, হতে বাধ্য হবেন, এবং হতে বাধ্য হচ্ছেন সেই পথে যেপথে তাঁর জীবনযাত্রার সামাজিক রূপটা অক্ষুণœ থাকে এবং জৈবিক চাহিদাগুলির পূরণ হবে। এর একটা পথ তাঁর রচনার স্থূলীকরণ যা তিনি করছেন। আরেকটা পথ নির্বিচার অনুবাদ। স্বাধীনতার আমলে এ প্রদেশে অনুবাদ-সাহিত্যের অভূতপূর্ব প্রসার তাই অনিবার্যভাবেই ঘটেছে।
অনুবাদ একটা বাঞ্ছনীয় সাহিত্যকর্ম, কেননা অনুবাদও সাহিত্যের একটা শাখা। উত্তম অনুবাদ-সাহিত্য পাঠক-সমাজের রুচির সম্প্রসারণে ও মৌলিক সাহিত্যের রূপ-বৈচিত্র্য সাধনে সহায়তা করে। কিন্তু এ দেশে সাম্প্রতিককালে যে-সব অনুবাদ হয়েছে তার বেশীর ভাগই বৈদেশিক ও বিজাতীয় রাজনৈতিক স্বার্থের আনুকূল্যে এবং এই কর্মে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিরাও অংশ নিয়েছেন। যে পরিমাণে অংশ নিয়েছেন, এবং এই কাজে যে পরিমাণে তাঁরা তাঁদের উদ্যম ও সময় নিয়োজিত করেছেন, সেই পরিমাণে আমারে মৌলিক সাহিত্যের অগ্রগতি স্তম্ভিত হয়ে থেকেছে। কিন্তু এ হল সামাজিক বাধ্যতার প্রশ্ন-যার কিছুটা প্রকৃত এবং কিছুটা হয়তো কাল্পনিক। কিন্তু এ ছাড়া আরও একটি প্রশ্ন আছে-বিবেকের প্রশ্ন, মূল্যবোধের প্রশ্ন। এই বিবেক এবং এই মূল্যবোধের প্রশ্ন অবশ্য বিচ্ছিন্নভাবে শুধু লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী-সমাজের প্রশ্নই নয়, সমগ্র সমাজের প্রশ্ন, এবং সমগ্র সমাজের প্রেক্ষিতেই প্রশ্নটির বিচার কর্তব্য।
নয়া সমৃদ্ধির যুগে আমাদের সমাজের একটা নগ্ন লক্ষণ হচ্ছে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। বিশেষভাবে সমৃদ্ধির সম্প্রসারণ উপলক্ষেই তা লক্ষণীয়। সমাজের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ সুযোগ পেলেই শোভনতা, নৈতিকতা, মানবিকতা ইত্যাদি সদগুণকে অসংকোচে পদদলিত করে যে-কোনো পদ্ধতিতে বিত্তশালী হওয়ার আকাক্সক্ষী। এই মনোবৃত্তি সমাজে যে কখনো ছিল না তা নয়, তবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আমলে এর প্রসার এবং স্বাধীনতার আমলে নতুন নতুন সুযোগের অন্ধকার গলিপথে এর বিশেষ ব্যাপকতালাভ। এর মধ্যে আছে মুনাফাবৃত্তি, কালোবাজারী, চোরাচালান, উৎকোচ এবং অন্যান্য সুবিদিতসুবর্ণ পদ্ধতি। আমাদের সমাজের স্বাভাবিক নৈতিকতা ও ধর্মবোধের জন্যে এসব আগে ঘৃণিত হতো। এখনও হয়, তবে অতোটা নয়, এসবই গা-সওয়া হয়ে গেছে এবং যেন অবাঞ্ছিত কিন্তু অনিবার্য স্বাভাবিকতা বলে স্বীকৃত হয়েছে। এমনকি এই সুবর্ণ-পদ্ধতিগুলি বর্তমানে যেন আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গে পরিণত, কেননা জীবনযাত্রার পদ্ধতিও সংস্কৃতির অঙ্গ বলে গণ্য। এবং এই সুবর্ণপদ্ধতি অবলম্বনই বুদ্ধিমানের লক্ষণ, এবং নৈতিকতা বোকামি, এই এখন বিবেচিত। উল্লিখিত সুবর্ণ-পদ্ধতিতে কোনো ব্যক্তি যদি সফলকাম হয় এবং দৃশ্যত স্বচ্ছন্দ জীবনযাপন করতে পারে তবে সমাজে সে অপাংক্তের হয় না, বরং প্রশংসিত হয়। নিন্দিত হয় কেবল তখনই, যখন সে ব্যর্থ হয়। তার বিপরীত প্রকৃতির কোনো ব্যক্তি যদি নৈতিকতাও সততার জন্যই আর্থিক দৈন্যে পীড়িত হয় তবে কারো কারো কাছে সে প্রশংসা হয়তো পায়, কিন্তু সামাজিকভাবে সে অপাংক্তেয় ও উপেক্ষণীয়ই থেকে যায় এবং মূর্খ বলে বিবেচিত হয়। বস্তুত বর্তমানে আমাদের সমাজের অনুচ্চারিত নির্দেশ এই; “যদি সমাজে সম্মান পেতে চাও, তবে যেমন করে পারো পয়সাওয়ালা হও। আমরা অবিশ্যি খোলাখুলি বলি না যে তুমি মুনাফাখোরী কর, কালোবাজারী কর, চোরাচালান কর অথবা ঘুষ খাও। তুমি তো জানোই যে আমাদের আইন আছে। তুমি একটু অসতর্ক হলেই আইনের রশিতে আমরা তোমাকে পেঁচিয়ে মরাব। কিন্তু এই-সমস্ত ফাঁড়া কাটিয়ে তুমি যদি কোনো প্রকারে পয়সাওয়ালা হতে পারো, যদি দেখি যে তুমি ওস্তাদ লোক, তাহলে তোমার জন্য আমাদের সালাম নির্ধারিত রইল।”
বস্তুত একথা অস্বীকার করা কঠিন যে সাম্প্রতিক কালে আমাদের সমাজে প্রায় সর্বজনীনভাবে রুচিহীন বিত্তপূজা কায়েম হয়েছে। এ রকম ব্যাপার যে আর কোনো যুগে ছিল না তা নয়; যে-কোনো উপায়ে পুঞ্জীভূত হয়ে থাকুক, বিত্তের জৌলস চিরকালই মানুষকে মুগ্ধ করেছে। বহু সংস্কৃতিবান ভূম্যধিকারী-পরিবারের পূর্ব-পুরুষ দস্যুবৃত্তি করত এমন কাহিনী দুর্লভ নয়। কিন্তু গুণী ব্যক্তির প্রতিও সমাজ ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট হতো। একমাত্র বিত্তের মানদণ্ডেই সমাজের প্রশংসা ও শ্রদ্ধা নিবেদিত হতো না। এবং নৈতিক অর্থে “অধর্ম” ও অধার্মিকের প্রতি ঘৃণা বর্ষণ করতেও সমাজ সংকুচিত হতো না। কিন্তু সফল নীতিহীনতাই এখন প্রশংসিত।
এই কলুষিত মূল্যবোধ আমাদের লেখক-সমাজে কিছুমাত্র সংক্রামিত হয়নি এমন কথা কি আমরা জোর করে বলতে পারি? যে-কোনো উপায়ে বিত্তবান হওয়ার আকাক্সক্ষা, এবং এই আকাক্সক্ষার প্রেরণায় নীতি ও নৈতিকতা বিসর্জন, আদর্শ-বদল, ব্যক্তিস্বার্থে পরস্পরের পৃষ্ঠপোষণ এবং সাহিত্যের ভান, অর্থাৎ যে-কোনো উপায়ে নিজের জন্যে যতোটা পারা যায় গুছিয়ে নেওয়া, এইসব ব্যাপার, দুঃখের বিষয়, আমাদের সাহিত্য-সমাজে একবারে দুর্লভ নয়। এবং এই সমাজেই, একজন লেখকের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জৌলুস যতোটা মূল্যবান বিবেচিত, একনিষ্ঠ লেখক-ব্যক্তিত্ব ততোটা নয়।
এই আলোচনার বক্তব্য অবশ্য এই নয় মূল্যবোধ-বিরোধী অথবা সংস্কৃতি-বিরোধী প্রবণতা সমৃদ্ধিপূর্ব যুগে যুগে ছিল না। প্রত্যেক যুগেরই কোনো না কোনো প্রকৃতির মূল্যবোধ-ও-সংস্কৃতি-বিরোধী প্রবণতা থাকে; এ যুগে যেমন আছে, অতীতেও বহু শতাব্দী ধরে তেমনি ছিল, তবে তার প্রকৃতি ছিল অন্য রকম। এ আলোচনার উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদের যুগের প্রবণতাগুলি সম্পর্কে সচেতন হওয়া, কেননা সংকটের প্রকৃতি সম্পর্কে সচেতন হলে তার নিরসনের পন্থাও হয়তো আবিষ্কৃত হবে।
আমাদের সমাজে যে নীতিহীন রুচিহীন বিত্ত-পদ্ধতির প্রসার ঘটছে তার সুফল যে এই পদ্ধতির কৃতী ব্যক্তিরা আর তাদের বংশধরেরা পাবে না তা নয়; এমনকি সমাজও তাদের সমৃদ্ধির একাংশ পেতে পারে; কিন্তু পৃথিবীতে কোনো কাজ, কোনো মনোভঙ্গী এবং কোনো সমৃদ্ধি-দর্শনই ফল-বিরহিত নয়। সমাজে এই দর্শনই যদি প্রতিষ্ঠিত ও অনুস্বত হয় যে বিত্ত অর্জনের যে কোনো পদ্ধতিই বৈধ তবে এই পদ্ধতি-উদ্ভূত কোনো কৃতী পুরুষ, অথবা অন্তত সেই কৃতী পুরুষের বংশধর শেষ পর্যন্ত নিরাপদ থাকার আশা করতে পারে না। কেননা পৃথিবীর কোনো সমাজে প্রতিদ্বন্দীবিরহিত মানুষ সম্ভব নয়। এক ব্যক্তি বিক্তশালী হওয়ার কোনো মহাজনপন্থা প্রদর্শন করলে আর পাঁচজন অনতিবিলম্বেই তা অবলম্বন করে, এবং তার শিকার শুধু সাধারণ মানুষেরা নয়, কৃতী পুরুষেরাও হতে পারে; এবং হয়ে থাকে। মানুষের ইতিহাসে দেখা যায় কোনো সমাজে যদি পুরুষানুক্রমে রক্তের বদলে রক্তপাতের রীতি প্রচলিত থাকে, যদি থাকে স্ব-সমাজের নরমাংস ভক্ষণের রীতি এবং নরমুণ্ডু সংগ্রহের ঐতিহ্যগৌরব তবে সে সমাজের খুব কম সংখ্যক মানুষই নিরাপদ জীবনের আশা করতে পারে।
মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিক সততাকে চোখে ঠেরে যে সমৃদ্ধি, ব্যক্তি ও সমাজের জীবনে সেইটাই শেষ কথা নয়। তার রীতি ও পদ্ধতিগুলি সমাজের সকল স্তরে সঞ্চারিত হতে থাকে, এবং এমন একটা জটিল চক্রের সৃষ্টি করে যাতে বহু লোক জড়িয়ে পড়ে এবং আরো বহু লোকের জীবন বিচিত্র পথে প্রভাবিত হয়। নিয়ত ঘূর্ণ্যমান এই চক্র অন্ধভাবে মানুষকে নিষ্পেষিত করে-নিরীহ মানুষকেও-এবং সাধারণত নিরীহ মানুষকেই, তারপর সমগ্রভাবে সমাজকে। সংস্কৃতিগতভাবে এবং ঐতিহাসিকভাবে। বহু জাতি ও সমাজেরই অভিজ্ঞতা এই যে, এক নীতিহীনতা অন্য নীতিহীনতাকে উৎসাহিত করে, এবং এক লালসা মানুষকে অন্য লালসার দিকে আকর্ষণ করে। কোন্টি কারণ এবং কোন্টি কার্য এই কূটতর্কে না গিয়েও বলা যায়, অর্থনৈতিক নীতিহীনতা, রাজনৈতিক অন্তর্দ্বন্দ, রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা, যৌন-বিলাস, সাংস্কৃতিক অধোগতি এবং আরো অনেক দুর্লক্ষণ প্রায় এক সঙ্গে জড়িয়ে থাকে, এবং জাতি ও সমাজকে তার অন্তিম নিয়তির পানে টেনে নিয়ে যায়। এটা উদ্বেগেরই বিষয় যে স্বাধীনতার আমলে বাঙ্গালী মুসলিম সমাজ বহুকাল পরে সমৃদ্ধির কিছু সুযোগ পেলেও সেই সঙ্গে পৃথিবীর বহু অবলুপ্ত ও অবলুপ্তিমান জাতি ও সমাজের দুর্লক্ষণগুলির সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েছে।