বিলকিস : হুদহুদ যে চিঠি ফেলে গেছে সে বিষয়ে আমি আপনাদের অবকাশ দিচ্ছি-আপনারা ভাবুন। কয়েক দিন হয়ে গেল। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় এখনই।
সেনাপ্রধান : সম্রাজ্ঞী আমি প্রথমেই মতামত দিয়েছি। এখনও তার উপরেই আছি।
বিলকিস : কী? যুদ্ধ?
সেনাপ্রধান : মহামান্য সম্রাজ্ঞী, অবশ্যই আমরা অত্যন্ত শক্তিধর। আমাদের দক্ষ সেনাবাহিনী বর্তমান। তাহলে আমরা কেন রাজা সুলায়মানের বশ্যতা স্বীকার করব?
বিলকিস : সেনাবাহিনীর লোকজনের মতামত সর্বদা এমনই হয়। মন্ত্রীবৃন্দ আপনাদের মতামত বলুন।
১ম মন্ত্রী : সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্ণ অধিকার সম্রাজ্ঞীরই।
বিলকিস : এ কথা ইতোঃপূর্বে অনেকবার বলেছেন। যখনই গুরুতর বিষয় আসে তখনই চাতুর্যের সাথে সিদ্ধান্তের দায়ভার চাপিয়ে দেন আমার উপর। কিন্তু, আবশ্যক ছিল এমন সঙ্কট মুহূর্তে মতামত প্রদান করে আমাকে সহযোগিতা করা। অন্তত আপনাদের সকলের ঘাড়ের উপর মাথা তো রয়েছে। আপনারাও আমার সাথে ভাবতে পারেন। কী করা যায় তা চিন্তা করতে পারেন।
১ম মন্ত্রী : কিন্তু, সম্রাজ্ঞী আপনি জানেন আপনার এমন এক মন আছে যা অন্ধকারকে আলোকিত করতে পারে। আপনার এমন অনুভূতি ও বুদ্ধিমত্তা রয়েছে যা সর্বদা আপনাকে সঙ্কট মুহূর্তে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করে থাকে। আমাদের সাবা রাজ্যের এই যে, উন্নতি, উৎকর্ষ তা রানি বিলকিসের অনুগ্রহ, প্রত্যাশা, অনুভূতি ও পরিকল্পনা ছাড়া কখনই সম্ভব ছিল না।
বিলকিস : কিন্তু, আজকে আমি আপনাদের বিজ্ঞ মতামত জানতে চাই।
১ম মন্ত্রী : সম্রাজ্ঞী, এখানে অবস্থা বহুমুখী। এখন আমাদের চিন্তার নীরবতা কাম্য।
বিলকিস : আমি আপনাদের প্রথম থেকেই বলছি- যুদ্ধের পরিণতি ভয়াবহ। আর রাজা সুলায়মান অত্যন্ত শক্তিশালী এবং দাপুটে রাজা। সে যদি যুদ্ধে বিজয়ী হয় তাহলে সে আমাদের রাজ্যে প্রবেশ করবে। রাজ্যকে ধ্বংস করবে, রাজ্যে লুটপাট চালাবে, রাজ্যের সুধীজনদের লাঞ্ছিত করবে। কিন্তু, আমার সেনাপ্রধান শুরু থেকেই যুদ্ধের জন্য জিদ ধরে বসে আছে। আপনারা তা শুনেছেন। তার শক্তির ব্যাপারে সে আস্থাশীল, শত্রুর উপর বিজয়ের ব্যাপারে আশাবাদী।
সেনাপ্রধান : জি সম্রাজ্ঞী, ঠিক তাই। তাহলে আর সেনাবাহিনীর দরকার কী? যদি প্রয়োজনের সময় সীমালঙ্ঘনকারী শত্রুর প্রতিহত করা না যায় তবে সেনাবাহিনী থেকে প্রয়োজন কী?
বিলকিস : সেনাসামর্থ্য ও শক্তি সবসময় তাৎক্ষণিক প্রদর্শনের জন্য নয়। সন্ধিতেই শান্তি। শান্তি অপেক্ষা কল্যাণকর আর কিছু হতে পারে না। বিশেষত কোনো শক্তিশালী শত্রুসেনা যদি আক্রমণ করে তখন এটি খুবই প্রয়োজনীয়।
১ম মন্ত্রী : সম্রাজ্ঞী, এটি যদি হয় বিজ্ঞ মতামত, তাহলে আর মতামতের প্রয়োজন কী?
বিলকিস : (প্রসন্ন হাসি হাসে। বন্দি রাজা মুনিরের দিকে তাকায়।) (কোনো অনুসারীর প্রবেশ। সে রানি বিলকিসের কানে কানে কিছু বলবে।)
বিলকিস : তাড়াতাড়ি যাও! তাদেরকে নিয়ে এসো। (সবার দিকে রানি বিলকিস তাকাবে) আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো। আমি তোমাদের হতে একটি বিষয় গোপন করেছিলাম। আমি যেদিন সুলায়মানের পত্র পেয়েছি, তখনই আমি আমার পক্ষ থেকে কিছু উপহার সামগ্রীসহ দূত প্রেরণ করেছি। যাতে তারা আমার কাছে প্রকৃত অবস্থার বিবরণ দিতে পারে। এখন সেই দূতগণ ফেরত এসেছে। তারা কী নিয়ে এলো তা মনোযোগ দিয়ে শোনো।
[দূতরা ভেতরে প্রবেশ করে। বয়োজৈষ্ঠজন সবার সামনে। সে রানির দিকে এগিয়ে যায়। সালাম জানায় ও সুলায়মানের উপহার তার কাছে পেশ করে।]
দূত : সম্রাজ্ঞী!
বিলকিস : কী এটি?
দূত : সম্রাজ্ঞী, উপহার সামগ্রী। রাজা সুলায়মান এগুলো পাঠিয়েছেন। আর বলেছেন- তোমাদের এ উপহারসামগ্রী আমার কোনো প্রয়োজন নেই। এর কোনো প্রভাবও আমার কাছে নেই। তোমরা বিলকিস ও তার জাতির নিকট ফেরত যাও। শিগগির আমরা বিশাল সৈন্য বাহিনীসহ তোমাদের রাজ্যে আসব, ইতঃপূর্বে এমন বাহিনী তোমরা কখনও দেখোনি। যদি তোমাদের রানি আমার কাছে না আসে এবং নিজেকে আমার কাছে আত্মসমর্পণ না করে।
দূত বলতেই থাকে : সে সাম্রাজ্যে সোনা-রূপা পাথরের মতো, আর ধান-চাল ধুলা-বালির মতো সহজ প্রাপ্য। রাজা সুলায়মানের আছে এক হাজার চার শত গাড়ি, বারো হাজার অশ্বারোহী, চার হাজার প্রশিক্ষিত অশ্ব বাহিনী।
বিলকিস : (সভাসদকে) শুনলেন তো! (দূতকে বাইরে যেতে নির্দেশ করবে।)
সেনাপ্রধান : প্রত্যুত্তর এমনই হবে।
বিলকিস : আমি আপনার জবাব জানি। রাজনীতিকবৃন্দ আপনাদের কাছে নতুন কিছু আছে কি?
১ম মন্ত্রী : রাজা সুলায়মান আসলে কী চান?
বিলকিস : সেই প্রথম মুহূর্ত থেকেই এই একই প্রশ্ন আমার মনেও। আপনারাও যদি প্রথম থেকে এমন চিন্তা করতেন। এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করতেন।
সেনাপ্রধান : এ প্রশ্নের এত কী গুরুত্ব? সব কিছু প্রকাশ্য। শক্তিমান রাজারা অন্য রাষ্ট্রকে দুর্বল বানাতে চায়। তাকে তার করদ রাজ্য বানাতে চায়।
বিলকিস : বিষয়টি আমরা অন্যভাবে ভাবছি না কেন? এমনও তো হতে পারে বিত্তশালী রাজা সাবার রানির সততায় প্রলুব্ধ হয়ে তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
১ম মন্ত্রী : সম্রাজ্ঞী সত্যিই তাই। সত্যিই এরই নাম রাজনীতি। স্থান-কাল-পাত্রভেদে পরিস্থিতির আলোকে বিবেচনা করতে পারাটাই রাজনীতি।
বিলকিস : আপনারা যদি আমার মতামত জানতে চান। শুনুন, আমি আপনাদের বলছি- সত্যিই তার মহান আমন্ত্রণে তার সাথে মর্যাদাপূর্ণ সাক্ষাতে কোনো সমস্যা নেই। এ মুহূর্তে রাজা সুলায়মানের রাজত্ব পরিদর্শনে যাওয়ার থেকে প্রিয়তর কিছু নেই। তার সাথে সাক্ষাৎ করে তার বিস্ময়কর ও বিরল বিষয়াদি অনুধাবন করার চেয়ে বেশি আগ্রহ আর কিছুতে নেই। দীর্ঘ দিনের প্রত্যাশা পূরণের যে সুযোগ আমাকে দিয়েছেন তার জন্য অবশ্যই তিনি প্রশংসার দাবদিার।
(বিলকিস সভা ভঙ্গের ইঙ্গিত করবে।) (রানি বিলকিস ও বন্দি রাজা ব্যতীত সবাই বাইরে যাবে।)
বিলকিস : (বন্দি রাজার দিকে তাকিয়ে।) উহ! মুনজির তুমি সব দেখলে না?
(রানির ১ম পরিচারিকা শাহবাহ এগিয়ে আসবে। তার পেছনে সাজগোজের জিনিসপত্র নিয়ে অন্যান্য পরিচারিকারাও আসবে।)
শাহবা : (রানির চুলে বিলি কাটতে কাটতে) রানি মা! সত্যিই আপনি খুব কষ্ট করছেন।
বিলকিস : শাহবা, তুমি সত্যিই বলেছ। কিন্তু, আমি কী করব? তারা আমার এ বিয়ষে আমাকে সম্মান করে, আমাকে কষ্ট দেয়। মুনজির তুমি কী বলো- এখন আমার কী করা উচিত?
মুনজির : আপনার নিজস্ব বিষয়ে আপনি আমার মতামত প্রত্যাশা করেন কেন?
বিলকিস : আমি যা করছি- তা কি তোমাকে সামান্যতম বিস্মিত করছে না?
মুনজির : আমার অবাক লাগছে- আপনি অবিরত প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন। আর তা আমার দুই চোখকে দীপ্তিমান করছে।
বিলকিস : (ফিসফিস করে) আমি চেষ্টা করছি?
মুনজির : প্রতিক্ষণই আমাকে তা দেখানোর কোনোই প্রয়োজন নেই। আমি অস্বীকার করি না যে, আপনি অত্যন্ত বুদ্ধিমতী এবং বিচক্ষণ। আমি এও স্বীকার করি যে, আপনি মহান রানি।
(বিলকিস শাহবাহ ব্যতীত সব পরিচারিকাকে বাহির যেতে বলে। সবাই বেরিয়ে যায়। আয়না দেখতে থাকে।)
বিলকিস : (চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে গলার উপরাংশে নাড়তে নাড়তে।) মহান রানি! এখানে এর বাইরে আর কিছুই নেই? মুনজির তুমি কী মনে করো? এই যে আমার গলার চেইন, চুলের অলঙ্কার।
মুনজির : ?
বিলকিস : এই সুরভিত সুগন্ধি আমা হতে সুবাসিত, বিচ্ছুরিত। বলো! এভাবে চুপ করে আছো কেন?
মুনজির : আপনি কি এ বিষয়েও আমার মতামত চান?
বিলকিস : কেন নয়?
মুনজির : এসব বিষয়ে কি আমি আমার স্বাধীন মতামত দিতে পারব?
বিলকিস : তুমি আমাকে যা দেখছ সে ব্যাপারে বলতেই পারো- তুমি তা পছন্দ করো অথবা পছন্দ করো না।
মুনজির : (নড়েচড়ে ) মহান সম্রাজ্ঞী! আপনি কি আমাকে অনুমতি দিলেন?
বিলকিস : না। বরং তুমি থাকো। তুমি জানো এখানে থাকাতে তিনি কখনই আমার ক্ষতি করবেন না।
মুনজির : আপনার পাশে সার্বক্ষণিক থাকাতে কোনো সমস্যা মনে করছেন? আমি আপনার বিচারকার্যের সাক্ষী থাকছি, আপনার ফরমান প্রত্যক্ষ করছি, রাজনীতির প্রজ্ঞা লক্ষ করছি, এমনকি আপনার সাজগোজও দেখছি।
বিলকিস : তাতে ক্ষতি কী? তুমি কি আমার বিশ্বস্ত সারমেয় নয়?
মুনজির : এ আপনার অধিকার যে আপনি আমাকে সারমেয় সম্মোধন করবেন। কিন্তু, আপনি জানলেন কি করে যে আমি বিশ্বস্ত?
বিলকিস : আমি তোমাকে অবিশ্বাসের কারণ দেখিনি।
মুনজির : অবিশ্বাস করার মতো কোনো কারণ এখনও ঘটেনি।
বিলকিস : (আয়না থেকে মাথা উঠাবে। মুনজিরের দিকে তাকিয়ে) কী অবাক! অবাক তো! তুমি তোমার অপছন্দনীয়তা গোপন করার বিষয়ে কোনো আক্ষেপ তোমার নেই।
মুনজির : সে আমার একক স্বাধীনতা। আপনি কি আমাকে এর চেয়েও বেশি চাপাতে চান?
বিলকিস : তোমার স্বাধীনতা? মুনজির তুমি যে বন্দি তাও কি তোমাকে নিবৃত্ত করবে না? তুমি কি এখনও ভালোবাসার বন্ধনে আছ? তুমি কি দুর্গ বন্দি? তুমি সর্বদা আমার সাথেই থাকবে। আমার প্রাসাদেই তোমার জীবন যাপন। প্রাসাদের খাবারই তোমার খাবার। আমার বাগানে তোমার বিচরণ। আমার কাজকর্ম অবসর তোমার গোচরে। আমার সামনেই কাটে তোমার সময়ের পুরোটুকু। নিশ্চয়ই তুমি সহজ-সরল, কিংবা চতুর কোনো লোক নয়। যেহেতু তুমি বন্দি। তোমার সৌভাগ্য যে, তুমি সব সময়ই একজন সুন্দরী রমণীর পাশে কাটাও।
মুনজির : আপনার সৌন্দর্য আমাকে বন্দি করেনি। আমাকে বন্দি করেছে আপনার সৈন্য বাহিনী।
বিলকিস : কোনো পুরুষের নিকট হতে এমন কথা শোনা যেকোনো নারীর জন্যই কষ্টের। তবে আমি মহান রানি আর তুমি সামান্য এক পুরুষ। তুমি যাচ্ছেতাই বলতে পারো। তোমার কোনো কথাই আমাকে রক্তাক্ত করবে না। কোনো কষ্টও দিবে না।
মুনজির : আমি কি জিজ্ঞাসা করতে পারি আমার পক্ষ হতে এমন কথা শোনার পরও কেন আপনি আমাকে সারাক্ষণ আপনার পাশে রাখেন।
বিলকিস : তুমি কি চাও যে আমি তোমাকে ছেড়ে দিই এবং তোমার দায়-দায়িত্ব জেলারকে দিয়ে দিই। অথচ তুমিও রাজা, রাজাদের একজন। মুনজির কখনও তা হবে না। আমার সৈন্য বাহিনী তোমার পরিবার ও রাজ্য ধ্বংস করেছে তা ঠিক। এটিই যুদ্ধের নিয়ম। তবে তোমার সম্মান রয়েছে তা সংরক্ষণ এবং তোমার মর্যাদা রয়েছে তার যথাযথ মূল্যায়ন হওয়া উচিত। কাজেই সবসময় আমি তোমাকে আমার নজরে রাখতে চাই। যাতে আমি প্রশান্তি পাই। আমি তোমার জন্য এমন জীবন নিশ্চিত করতে চাই যেমন জীবন আমি পছন্দ করি।
মুনজির : এমন ঔদার্যের জন্য আপনার প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা। আমি বিশ্বাস করি আপনি এ কাজটি করবেন। কারণ আমার সান্নিধ্যে আপনি প্রসন্ন বোধ করেন এবং আমার সাহচর্যে আপনি প্রফুল্ল থাকেন।
বিলকিস : তোমার পরিমিতি বোধ ও বুদ্ধিমত্তায় আমিও একমত। তবে হ্যাঁ আমি কখনই নিজেকে প্রবোধ দিতে পারব না যে তোমার সান্নিধ্য বিদ্বেষপূর্ণ এবং তোমার নৈকট্য বন্দিত্ব।
মুনজির : মহান রানি! আপনার শুকনো কথা ও শুষ্ক অনুভূতিতে আমি দুঃখিত। রানি! আমি ক্ষমাপ্রার্থী। এখন পরিচ্ছন্ন মুক্ত হাওয়ার খুবই প্রয়োজন বোধ করছি। যদি আপনি বাইরে যাবার সদয় অনুমতি প্রদান করতেন। অল্প সময়ের জন্য হলেও।
(অনুমতির অপেক্ষা না করেই মুনজির বাইরে যাবে।)
বিলকিস : (হাই তুলবে। পরিচারিকার দিকে তাকাবে।) শাহবা দেখেছ?
শাহবা : এ তো কোনো জ্যান্ত পুরুষ নয়। যেন পাথরের তৈরি।
বিলকিস : সে জানলো কিভাবে যে, তার সান্নিধ্যে আমি প্রসন্ন হই, তার নৈকট্যে প্রফুল্ল হই? আমি তো তার সামনে কখনই দুর্বলতা প্রকাশ করিনি।
শাহবা : রানি মা! এমন হলে কত ভালো হতো যদি আপনি তার প্রতি আরো দুর্বলতা প্রকাশ করতেন।
বিলকিস : না সেটা আমার জন্য শোভন নয়।
শাহবা : সত্যিই তাই! কোন বিজয়ী নারীর জন্য এটি মানানসই নয়। তবে…..
বিলকিস : তবে..? তবে পরাজিত নারীর জন্য তা মানানসই?
শাহবা : আমি তা বলিনি রানি মা!
বিলকিস : শাহবা, বরং তাই-ই বলো। তুমি জানো- সেটিই বাস্তবতা। উহ! ইতঃপূর্বে আর কখনও এমনটি হয়নি।
শাহবা : আমি জানি।
বিলকিস : এই বন্দি যদি জানত তাকে বন্দি করে কিসের মালিক হওয়া যেত তবে সেই বিজয়ী হতে চাইত।
শাহবা : তার মনটা একটুও যদি নরম হতো!
বিলকিস : শাহবা, তুমি কি পাগল হয়েছ?
শাহবা : রানি মা! ভয় পাবেন না। আমার কাছ থেকে কেউ কিছুই জানতে পারবে না।
বিলকিস : আমি বেঁচে থাকতে কখনও মাথা নত করব না। এমন পুরুষ যে অন্তরের বেদনা শুনতে পায় না। আমি কখনও তার পদানত হতে পারি না।
শাহবা : কিন্তু, রানি মা! আপনি তো কষ্ট পাচ্ছেন।
বিলকিস : হ্যাঁ তা বটে। অনেক কষ্ট পাচ্ছি।
শাহবা : আমাদের অবশ্যই এর বিহিত করা উচিত।
বিলকিস : আমি মনে করি না- আমার এ রোগের কোনো প্রতিষেধক আছে।
শাহবা : প্রত্যাশা করা তো উচিত।
বিলকিস : আমি কোনো আশাই করি না। তার পাশে যে সময়টুকু আমি কাটিয়েছি তাতে সে বুঝেছে আমি কোন কথা অপছন্দ করি, তবুও তার থেকে পৃথক হওয়াটাই আমার কাছে শ্রেয়তর।
শাহবা : আপনি রাজা সুলায়মানের রাজ্য সফরে যাবার মনস্থ করেছেন- তো এখন আর কী করার আছে আপনার?
বিলকিস : উহ! সত্যিই তাই। আমি সে বিষয়েই ভাবছি।
শাহবা : আপনি কি এই বন্দিকেও সাথে নিবেন?
বিলকিস : তাকে ছাড়া তো আমি সফরের চিন্তাও করতে পারি না।
শাহবা : রাজা সুলায়মানকে আপনি তার সম্পর্কে কী বলবেন?
বিলকিস : আমি অত কিছু জানি না। বলব- আমার একজন অনুগত।
শাহবা : রাজা সুলায়মানকে ধোঁকা দেয়া অত সহজ হবে না। বলা হয়- তিনি জিন ও মানব উভয় সম্প্রদায়ের শাসক।
বিলকিস : প্রকৃত সত্য জানতে পারলে ক্ষতি কী?
শাহবা : আপনার হাতে এই পরাজিত রাজাকে নিয়ে তিনি কোনো চক্রান্ত করবেন বলে আশঙ্কা করেন না?
বিলকিস : না সে আশঙ্কা করি না। তবে এক মুহূর্তের জন্য সে দৃষ্টির অগোচরে গেলে টেনশন করব। সে এখন কোথায়?
শাহবা : কিছুক্ষণ পূর্বেই সে বলল যে, মুক্ত বাতাসের ঘ্রাণ নিতে সে বাগানে যেতে চায়?
বিলকিস : হ্যাঁ! পরিচ্ছন্ন মুক্ত হাওয়ার কথা বলছিল। কারণ আমার ব্যবহৃত সুগন্ধিতে তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল।
শাহবা : রানি মা আপনার জন্য আমার কষ্ট হয়। আমি আপনার জন্য কিছুই করতে পারছি না।
বিলকিস : জানালা দিয়ে তাকে দেখো। তাকে জিজ্ঞেস করো সফরের বিষয়ে মতামত জানাক।
[উঁচু জানালার দিকে শাহবা এগিয়ে যায়। বাগানের দিকে তাকায়। মুনজিরকে আসতে ইঙ্গিত করে।]
শাহবা : মুনজির আসছে।
বিলকিস : সে খুব বিরক্ত ও অসন্তুষ্ট। তাই নয় কি?
শাহবা : আমি এখান হতে তাকে দেখে কিছু বুঝতে পারছি না।
বিলকিস : কিন্তু, তাকে আমি না দেখেই বুঝতে পারি তার মনে ও মগজে কী ঘুরাঘুরি করছে?
শাহবা : সে তো এখানেই আছে! [মুনজির প্রবেশ করবে।]
মুনজির : হ্যাঁ! এখানেই তো।
বিলকিস : (শাহবাকে) শাহবা! তোমাকেও যেতে হবে। তুমি সফরের কথা ভুলে যেও না।
শাহবা : রানি মা! আমি আপনার সাথে ছায়ার মতো লেগে আছি। (শাহবা বেরিয়ে যায়)
মুনজির : কী এমন ঘটলো যে আপনি আমাকে ডেকে পাঠালেন?
বিলকিস : আগে বসো।
মুনজির : বসতে আমার কষ্ট হচ্ছে।
বিলকিস : এখানে বসো, এখানে। বিশ্বস্ত সারমেয় সর্বদা আমার পদানত থাকবে।
মুনজির : (রানির পায়ের কাছে বসবে।) বলুন এবার কী চান?
বিলকিস : তুমি সবখানেই আমার সাথে থাকবে।
মুনজির : আমার কি এর অন্যথা করার সুযোগ আছে?
বিলকিস : তুমি আমার সাথে রাজা সুলায়মানের দরবারে যাবে।
মুনজির : আমার শিকল আপনার হাতে। আপনি চাইলে আপনি যেকোনো স্থানে আমাকে যেতে বাধ্য করতে পারেন।
বিলকিস : তবে সেখানে আমি তোমাকে আমার বন্দি বলতে চাই না।
মুনজির : তবে কী বলতে চান?
বিলকিস : তোমাকে কোনো উচ্চ অভিধায় অভিহিত করতে চাই।
মুনজির : আপনার সারমেয়ের জন্য উচ্চ অভিধা?
বিলকিস : মুনজির, রসিকতা করো না। আমি কি তোমাকে বিশ্বস্ত পরামর্শদাতা বলতে পারি না?
মুনজির : কখনও না। বিশ্বস্ত সারমেয় হওয়াই আমার জন্য ভালো। আমি আপনার বিশ্বস্ত পরামর্শক হতে চাই না।
বিলকিস : তুমি চাইলে গাদ্দার পরামর্শক হতে পারো।
মুনজির : যে আমাকে তার আস্থা ও পরামর্শকের স্থান দেয় আমি তার সাথে গাদ্দারি করতে পারব না।
বিলকিস : তাহলে আমার কাছে এখন তোমার অবস্থান কী হবে তা বলো?
মুনজির : কিছুই না। নীরব দর্শক ও অপেক্ষমাণ বন্দি।
বিলকিস : তোমার আবার কিসের অপেক্ষা? মুক্তির না পালানোর? যাতে তুমি তোমার পরিবার ও দেশে ফিরে যেতে পারো। এরপর আমার বিরুদ্ধে তাদেরকে উসকে দিবে। সৈন্যদের একত্রিত করবে। আমার থেকে প্রতিশোধ নিবে। এই তো? এ তোমার নিতান্ত স্বপ্ন। ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার এক আশা মাত্র।
মুনজির : আসাই তো জীবনকে বাঁচিয়ে রাখে।
বিলকিস : মুনজির কখনও তা নয়। এখানে তার চেয়েও অনেক অসাধ্য স্বপ্ন ও অনুপম আশা রয়েছে। তুমি কি সেভাবে বাঁচতে চাও না?
মুনজির : কোনো বিষয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা হলে তাতে আমি অবাক হই না।
বিলকিস : আমি নিজেকে অনেকবার প্রশ্ন করেছি- কোনো একদিনের জন্যও কি আমরা একমত হতে পারি না?
মুনজির : কিন্তু, কখনই আমি নিজেকে এমন প্রশ্ন করিনি।
বিলকিস : সেটি আমি জানি। সেটি দুর্ভাগ্য বটে।
মুনজির : যে প্রশ্নটি বারবার আমাকে নাড়া দিচ্ছে- আপনি সুলায়মানের কাছে সফরে আমাকে সঙ্গী করতে চান কেন?
বিলকিস : কারণ.. আমি…
মুনজির : কারণ আপনি আপনার দৃষ্টি থেকে দূরে রেখে আমার স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যাপারে আপনি প্রসন্ন হতে পারবেন না।
বিলকিস : মুনজির ঠিক তাই।
মুনজির : আমি তো আপনাকে বলেছি অন্যান্য বন্দিদের সাথে বদ্ধ কুটিরে আটকে রাখলে তাতেই আমার স্বাচ্ছন্দ্য? আমার এই আবেদনে কি আপনার সাড়া মিলবে?
বিলকিস : (হন্তদন্ত হয়ে, নিজেকে গোপন করার চেষ্টা করবে।) মুনজির, এমন আবেদন তুমি কেন করছ?
মুনজির : আমাকে যদি কোনো পছন্দের কথা বলা হয় তবে এটিই আমার পছন্দ।
বিলকিস : তোমাকে কোনো বদ্ধ সেলে রাখব এই তো?
মুনজির : কোনো এক ইউনিটে।
বিলকিস : (মাথা নিচু করবে, হাত দিয়ে চোখ ঢাকবে। যাতে নয়নাশ্রুর ফোঁটা দেখা না যায়।)
মুনজির : এটি কি আপনার কাছে কঠিন কোনো আবেদন?
বিলকিস : (মাথা উঠাবে) আমি ভেবেছিলাম তোমাকে বন্দি সেলের পরিবর্তে আমার প্রাসাদে রাখব। যাতে তোমাকে পালাবার পথ তৈরি করে দিতে পারি।
মুনজির : সত্যিই কি এ ভাবনা থেকে আপনি এমনটি করছেন?
বিলকিস : হ্যাঁ। তোমার জন্যই আমি এমন কৌশল এঁটেছিলাম। এবং মন্ত্রিপর্ষদ ও সৈন্যদের তুষ্টিকে যুক্তি হিসেবে সামনে এনেছিলাম। তোমাকে এখানে রাখব বলে। সেজন্যই তোমাকে সফরসঙ্গী করতে চেয়েছিলাম যাতে তোমার পালানোর সুযোগ হতে পারে।
মুনজির : হায় নির্বুদ্ধিতা! বিষয়টি পূর্বেই আমার বোঝা উচিত ছিল।
বিলকিস : এখন যা বললাম তা এত সময় তোমা হতে গোপন রেখেছিলাম। যাতে গোপন বিষয়ে তোমার ভাগীদার বানাতে পারো আমাকে এবং আমাকে জনরোষে না ফেলতে হয় তোমাকে।
মুনজির : আপনি আমাকে পালাবার সুযোগ করে দিবেন যাতে আমি সৈন্যদের একত্রিত করে আপনাকে হত্যার উদ্যোগ নিতে পারি?
বিলকিস : এ তোমার সর্বক্ষণের ইচ্ছা।
মুনজির : বিলকিস!
বিলকিস : (আভিজাত্যে কিংকর্তব্যবিমূঢ়, ন¤্রতার সাথে।) হ্যাঁ মুনজির।
মুনজির : আপনি আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছেন কেন?
বিলকিস : (নিজেকেই) প্রথমবার ঠিক এভাবেই তুমি আমাকে ডেকেছিলে।
মুনজির : আচ্ছা, আমি আপনার সফর সঙ্গী হবো।
বিলকিস : ঠিক আছে।
মুনজির : আপনি অনুমতি দিলে আমি সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছি তাহলে।
(আনন্দের সাথে মুনজির বের হবে।)
বিলকিস : হ্যাঁ। প্রস্তুতি নাও।
[বিলকিস হাতের তালুতে মাথা রাখবে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকবে।]
[ক্রমশ]