[ফজলে রাব্বি লেখক ও অনুবাদক। তাঁর জন্ম পুরান ঢাকার সাতরওজা এলাকায় নানাবাড়িতে ১৯৩৪ সালে ৪ জুলাই। তাঁর পৈত্রিক নিবাস বাশবাড়িয়া গ্রাম, মুকসেদপুর থানা, গোপালগঞ্জ জেলা। পিতা মরহুম আবু আহমদ আবদুল আলী ছিলেন পুলিশ অফিসার, সফল মঞ্চ-অভিনেতা ও বাংলাদেশে প্রথম যুগে নির্মিত ‘আকাশ ও মাটি’ সিনেমার একজন অভিনেতা। মাতা মরহুমা সৈয়দা সুলতানা বানু তাঁর আত্মজীবনী ‘পঁচাশী ও হযরত শাহ আলী বোগদাদী’ গ্রন্থ রচনা করে সুখ্যাতি অর্জন করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ সমাপ্তির পর ফজলে রাব্বি ১৯৬১ সালে বাংলা একাডেমিতে সহ-প্রকাশনাধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন এবং দীর্ঘ কাল প্রকাশনা-বিক্রয়-মুদ্রণ বিভাগের পরিচালক হিসেবে কর্মরত থেকে বাংলা একডেমীর সহস্রাধিক গ্রন্থের প্রকাশনার দায়িত্ব পালন করেন। বাংলা একাডেমির ছাপাখানা তাঁরই উদ্যোগে ও তত্ত্বাবধানে স্থাপিত হয়। ছাপাখানা স্থাপনকালে লব্ধ তথ্য ও অভিজ্ঞতাকে অবলম্বন করে বাংলা ভাষায় প্রথম ‘ছাপাখানার ইতিকথা’ গ্রন্থ রচনা করেন। ১৯৭৯ সালে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক নিযুক্ত হয়ে নানাবিধ গ্রন্থ উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেন। তারই ফলশ্রুতিতে ২০০৩ সালে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের গ্রন্থ ও গ্রন্থাগার’ যে বইয়ে বাংলাদেশের গ্রন্থ, গ্রন্থাগারের ইতিহাস ও বর্তমান চিত্র ফুটে উঠেছে। তিনি বেশ কয়েকটি জাপানি, ইন্দোনেশীয় ও আফ্রিকান উপন্যাস অনুবাদ করে প্রকাশ করেছেন। তিনি দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বেসরকারি গণগ্রন্থাগার ‘সুধীজন পাঠাগার’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক। তাঁরই উদ্যোগে আত্মীয়-স্বজনদের সহযোগিতায় পৈতৃক গ্রাম বাশবাড়িয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘আহমদ স্মৃতি পাঠাগার’।
জনাব ফজলে রাব্বি বাল্যকাল হতেই একজন গ্রন্থ প্রেমিক এবং সমগ্র জীবন প্রকাশক, বিক্রেতা, মুদ্রণ বিশেষজ্ঞ, গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠাতা, গ্রন্থাগার-বান্ধব, লেখক ও অনুবাদক হিসেবে গ্রন্থের সেবায় নিয়োজিত আছেন।
কর্মসূত্রে, কখনো প্রশিক্ষণ উপলক্ষ্যে, কখনো বিশেষজ্ঞ হিসেবে, গ্রন্থ-উন্নয়ন বিষয়ক সভা-সেমিনা ও বিশ্ব গ্রন্থমেলা উপলক্ষে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন।
উল্লেখযোগ্য বই : ছাপাখানার ইতিকথা, সৈয়দ আলী আহসান, বৃক্ষই জীবন, বাংলাদেশের গ্রন্থ ও গ্রন্থাগার, বরণীয় মানুষ ও স্মরণীয় বই, স্মৃতিতে বাংলা একাডেমি, গ্রন্থকেন্দ্রের দিনগুলি এবং অনুবাদ গ্রন্থ : ভয় : মুখতার লুবিস; জাকার্তায় গোধূলী : মোখতার লুবিস; আমার কথা : মাইকেল জ্যাকসন; মাকিওকারা চারবোন : জুনিচিরো তানিজাকি; কোকোরো: সোসেকি নাতসুমে; স্বজন : সিমিজাকি তোসোন; থিংস ফল এপার্ট : চিনুয়া আচেবে।
নতুন এক মাত্রার পক্ষ থেকে এই প্রবীণ সাহিত্যিক ও গ্রন্থাগার বিশেষজ্ঞের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন
নির্বাহী সম্পাদক ড. ফজলুল হক তুহিন ও সহকারী সম্পাদক শাহাদাৎ সরকার।]
আপনার শৈশব কৈশোর কিভাবে কেটেছে?
আমার জন্ম ঢাকা শহরে নানা বাড়িতে। আমাদের পৈতৃক বাড়ি হচ্ছে গোপালগঞ্জ। তখন ফরিদপুর বলতাম, এখন গোপালগঞ্জ বলি। সেখানে আমাদের কেউ যায় নাই। কিন্তু কেউ বাড়ি জিজ্ঞেস করলেই বলতাম ফরিদপুর। বাবা চাকরি করতেন খুলনা জেলায়। তখনকার দিনে বড় দারগা ওই থানার। তখনকার দিনে থানার বড় দরগা মানে তিনিই সর্বেসর্বা। ব্রিটিশ আমলে মেনলি খুলনা জেলায় কলারোয়া, সাতক্ষীরা, রামপাল এসব জায়গায় আমার শৈশব কেটেছে। স্কুলে ভর্তি হইছি সাতক্ষীরায় প্রথম। ১৯৪১ সালে ক্লাস ওয়ান এ ভর্তি হয়েছি। সেখানে পড়েছি তিন বছর। সেখানে আমার সিনিয়র ছিলেন বিখ্যাত শিশু চিকিৎসক ডা. এম আর খান। উনি আমাদেরকে স্কুলে পড়তেন। উনি অষ্টম শ্রেণিতে পড়তেন আমি ফোরে পড়তাম। উনি খুব ভালো ফুটবল খেলতেন। একবার হাত ভেঙে গেল উনার। ফুটবল খেলতে গিয়ে পড়ে গিয়ে। এই সাতক্ষীরায় ছিলাম ৩ বছর পরে চলে গেলাম বাগেরহাট। বাবার তো বদলি চাকরি। ১৯৪৫, ১৯৪৬, ১৯৪৭ খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়। এটা নিয়ে লেখা লিখছি বাগেরহাট সম্পর্কে। ১০ গম্বুজ মসজিদ, ৬০ গম্বুজ মসজিদে নামাজ পড়া, অনেক লেখা আছে আমার। তারপর স্বাধীন পাকিস্তান হলো। একটা ফ্রেন্ড ছিলো এখনও বেঁচে আছে আল্লাহর রহমতে। সে চট্টগ্রামে থাকে। বাগেরহাটে তাদের বাড়ি ছিলো। তার বাবা স্কুলের হেড মাস্টার ছিলেন। স্বাধীন পাকিস্তান হওয়ার আগে আমরা ছাত্ররা মিছিল করতাম ‘লড়কে লেঙ্গা পাকিস্তান’। তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। ১৯৪৭ বাবা বদলি হয়ে গেলেন কুষ্টিয়ায়। মানে এই জেলা থেকে একেবারে আরেক জেলায়। খুলনায় থাকাকালে যাহোক ঘুরেফিরে বন্ধুদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে। কিন্তু কুষ্টিয়া নতুন জেলা। ১৯৪৮-এ নদীয়া ভেঙে নতুন জেলা হয়েছে। এর আগে নদীয়া ছিলো জেলা শহর আর কুষ্টিয়া ছিলো মহকুমা। দেশ স্বাধীন হলে নদীয়ার অর্ধেক পশ্চিমবঙ্গে চলে গেল আর অর্ধেক নিয়ে কুষ্টিয়া জেলা হলো। কুষ্টিয়ায় যে বাড়িটি বাবা বরাদ্দ পেলেন তা ছিলো জঙ্গলে ঘেরা। সেখানে অনেক গাছ ছিলো। বিভিন্ন রকম ফল হতো। এগুলো ছিলো হিন্দু বাড়ি। পাকিস্তান হলে অনেক হিন্দু পরিবার ভারতে চলে যায়। তাদের রেখে যাওয়া বাড়ি সরকার নিয়ে নেয়। এবং সরকারি কর্মকর্তাদের বরাদ্দ দেয়। পশ্চিমবঙ্গ থেকেও অনেক মুসলমান চলে আসতে বাধ্য হয়। এসময় নতুন জেলার ম্যাজিস্টেট হয়ে আসেন সাহিত্যিক বরকতুল্লাহ। আমার মনে আছে আমরা রেল লাইনে যেতাম পাথর কুড়াতে। ঢুকুর ঢুকুর করে পাথর ঘষতাম আগুন জ¦লাবার জন্য। সেখানে এক বিহারি ছেলের সাথে পরিচয় হলে, সে আমাকে একটি বই পড়তে দিলো। সেই বিহারি ছেলেটি ভালো বাংলা জানতো। পরে তার সাথে আমার আর দেখা হয়নি। বইটা রয়ে গেলো। বিষয়টা দাগ কেটে রয়েছে এখনো আমার মনে।
আপনাদের সময়ে শিক্ষার পরিবেশ ও শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন ছিল?
আমার শিক্ষাজীবন ছিলো ভিন্ন রকমের। মনে আছে আমি ক্লাস টুতে ভর্তি হয়েছিলাম সাতক্ষীরায়। সেখানে একজন প-িত মশায় ছিলেন। তিনি পড়া দিতেন এবং বলতেন কালকে এটা পড়ে আসবা। তারপরে জিজ্ঞেস করতো। উত্তর ঠিক না হলে মাইর দিতো। তবে আমাকে মারতো না। আমি দারোগা সাহেবের ছেলে বলে কথা। কিন্তু বাড়িতে পড়া হোম টাস্ক দিয়ে দিতো। সেই টাস্কগুলো মুখস্থ করতে হতো। আর সেকালে টেক্সবুক কিনতে হতো। সেগুলো বেশি দাম ছিলো না। আমরা বছর শেষে অধীর আগ্রহে থাকতাম নতুন ক্লাসের নতুন বইয়ের জন্য। বাগরেহাটে ক্লাস ফাইভের বাংলা বইয়ের কথা মনে আছে। বেশ সুন্দর সুন্দর সাহিত্য গল্প ওর মধ্যে থাকতো আর কি। জাস্ট টেস্কবুক। সরকার করে না কে করে বলতে পারি না। তবে অনেক রকম টেস্কবুক থাকতো। স্কুল থেকে সিলেকশন করতো। এটা সরকার থেকে সিলেকশন করে দেওয়া হতো না। প্রাইমারী থেকে ক্লাস নাইন-টেন সব ক্লাসেই স্বাধীনভাবে বই সিলেকশন করতো। পরীক্ষা যার যার মতো সিলেবাসে নিতো। তখন একটাই পরীক্ষা হতো মেট্টিক। আর আমার বাবাদের সময় বলা হতো ইন্টার্স। যাকে প্রবেশিকা বলা হতো। আর তখন এলিভেন টুয়েলভ বলে কিছু ছিলো না। ছিলো ইন্টারমিডিয়েট। ইন্টার মিডিয়েট আমাদের সময়ে তিনটা ভাগ ছিলো সায়েন্স আর্টস কমার্স।
যাদের ক্ষমতা ছিলো তারা বাড়িতে একজন মাস্টার রাখতো। তবে সবাই মাস্টার রাখতে পারতো না। আমাদের বাসায় সন্ধ্যার পরে একজন টিচার আসতেন। তিনি হোমটাস্কগুলো করতে সাহায্য করতেন। আর সকাল বেলা মৌলভী সাহেব আসতেন কোরআন শরীফ পড়াতে। আমার মনে আছে স্কুলে যাবার আগে ‘হাতে তক্তি’ উপলক্ষে মিলাদ পড়ানো হতো। যাকে হাতেখড়ি বলে। আর তখন রূপার কলমে জাফরাত দিয়ে আলিফ, বে, তে ছে, লেখার প্রচলন ছিলো। এভাবেই আমার আরবি পড়ার শুরু হয়।
আপনার সময় বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন ছিলো?
আমি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ি নাই। তবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ছাত্রদের মধ্যে ইউনিয়ন ইলেকশন হতো। ইলেকশনের জন্য কর্তৃপক্ষ প্রার্থী সিলেকশন করে দিতো। যেটা এখন ভিপি ইলেকশন বলে। এবং এই ইলেকশন এক বছর পর পর হতো। আমি পড়েছি করাচি বিশ^বিদ্যালয়ে। তখন বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন সাহিত্যিক সৈয়দ আলী আহসান। তিনি আমাকে সেখানে নিয়ে যান। আর কয়েকজন গিয়েছিলেন সেসময়। সেখানে শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলাম মুস্তাফা নূরুল ইসলামকে। এখানে আমি বাংলা ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে ছাত্র ইউনিয়নের রিপ্রেজেন্ট করতাম। এসময় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে ছাত্র ইউনিয়নের গ্রোগ্রামে দাওয়াত দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। এবং তিনি রাজি হয়েছিলেন ও এসেছিলেন। আর সেময় শিক্ষকছাত্রদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক ছিলো। এখনকার শিক্ষকদের মতো রাজনৈতিক কর্মীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন না।
সেই সময়ের সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে বর্তমান সময়ে মিল অমিল কি দেখছেন?
ইংরেজরা ভালোও ছিলো খারাপও ছিলো। তারা শিক্ষাকে খুব লিমিটেড করে রেখেছিলো। আমরা তা বুঝতে পারি নি। আমরা লেখাপড়া করতেছি অবস্থা একটু ভালো। কিন্তু সাধারণ মানুষ যে করে না এতে আমাদের কোনো দুঃখ নাই। আমরা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত আছি। আমাদের হিন্দু বন্ধু বান্ধব বেশির ভাগ ছেলেই হিন্দু। মুসলমান বন্ধু মাত্র এক-দুজন। আমরা ফুটবল খেলতাম বাগেরহাটে। আমার মনে আছে ২টা হিন্দু ছেলে ১ একজন মুসলমান। তাদের নাম মনে আছে। একটার নাম জীবন আরেকটার নাম স্বদেশ আরেকটার নাম আলমগীর। এরপর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় খারাপ অবস্থা শুরু হলো। আমরা তখন সাতক্ষীরায়। জয়নুল আবেদিনের ছবিতে যেমন মানুস দেখেছো, তেমন মানুষ দেখতাম। কংকাল সার। লাইন ধরে সবাই একসাথে ভিক্ষা করতে যেতো। আমাদের প্রত্যেকের বাড়িতে পাত্রে চাল রাখা হতো। ভিক্ষুক আসলে ভিক্ষা দেওয়া হতো। এটা হতে হতে ভিক্ষার চাল দেওয়া বন্ধ হয়ে গেলো। তখন মানুষ খাবার চাইতো।
আমাদের বাড়িতে কয়কেটা মিলাদ হতো। বিশেষ করে রোজার মাসের শেষের দিকে ২৭ তারিখের দিকে, আরেকটা হতো মহররম মাসে এবং দাদির মৃত্যুবার্ষিকীর মিলাদ। এ কটা মিলাদ হতোই। আর আম্মাকে বলতাম পোলাও জরদা রান্না করতে মিলাদের জন্য।
বইয়ের প্রতি প্রেম ও গভীর বাসনা আপনার মধ্যে কিভাবে সৃষ্টি হল?
আমাদের শৈশবে টেলিভিশন ছিলো না। মাঝে সাঝে সিনেমা দেখতে পেতাম। বিনোদন বলতে একমাত্র বই-ই ছিলো। বাবা প্রথম বই কিনে ধিলেন হাসিখুশি। আর ইংরেজি একটা ছড়ার বই। আমি যখন ক্লাস ওয়ানে, সেসময় দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ চলছিলো। যুদ্ধের সময় আমরা কিছুদিন কোলকাতায় ছিলাম। সালাউদ্দিন ভাই একদিন আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে গেছেন কলেজ স্ট্রিটে। সেই সিনটা আমার এখনো মনে আছে। আমাদের ৩টি বই কিনে দিলেন। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বুড়োঅ্যাংলা আর আরেকটা এমেলির গোয়েন্দাকাহিনী। এই প্রথম গল্পের বই পেলাম হাতে। আমরা ছোটবেলায় বই চেঞ্জ করতাম বন্ধু বান্ধবের সাথে। বড় হলে পরে কিরিটি রায়, মন সিরিজ ইত্যাদি বই পড়তাম। একেবারে পাগল ছিলাম। এভাবেই বইয়ের প্রেমে পড়ে গেলাম। আর তখন মফস্বলে পাবলিক লাইব্রেরি ছিলো। সেখানে দেখতাম বই নেওয়ার জন্য দাঁড়ায় আছে, খুব ভীড় হতো। সবাই হিন্দু। মুসলামদের বই দেওয়া হতো না। তবে বাবা বড় দারগা হওয়ায় বই আনতেন। বাবা নিজেও বই পড়তেন, আম্মা বই পড়তেন। আম্মা দুপুরবেলা খাওয়র পরে সোয়ার সময় বিষাদসিন্ধু, আনোয়ারা পড়তেন। আমরা শুনতাম। শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যেতাম। এভাবেই পারিবারিক ভাবে মূলত বইয়ের প্রতি আমার অনুরাগ তৈরি হয়।
বাংলা একাডেমিতে বই প্রকাশনায় আপনার অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
১৯৬১ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত যখন আমি একাডেমিতে। শুধু ১৯৭৮, ১৯৭৯ এ এক বছর আমি দুটো দায়িত্ব পালন করি। বাংলা একাডেমি ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে। প্রকাশন বিভাগে দায়িত্ব একটু বেশিই ছিলো। প্রত্যেক ৩ মাসে একটা রিপোর্ট রাখতে হতো। সেই রিপোর্টটা লিখতো কিন্তু প্রকাশনা বিভাগরই হেডকে। সেটা সেক্রেটারি লিখতো না। আর বাংলা একাডেমি থেকে ‘বাংলা একাডেমি ত্রৈমাসিক’ পত্রিকা প্রকাশিত হতো। সেটার কাজও সম্পাদনা করতেন প্রকাশনা বিভাগের পরিচালক। তবে সম্পাদক থাকতেন একাডেমির পরিচালক। এখন যেটা মহাপরিচালক। এই পত্রিকার পিছনেও একটা প্রতিবেদন থাকতো বাংলা একাডেমির কার্যক্রম নিয়ে। সেটাও প্রকাশনা বিভাগের পরিচালক লিখতেন। জন্য একটা প্রতিবেদন থাকতো। সেই প্রতিবেদনে থাকতো বাংলা একাডেমি গত তিনমাসে কি কি কাজ করেছে এবং কি কি বই প্রকাশিত হচ্ছে।
বাংলা একাডেমির প্রকাশনা ও গ্রন্থ উন্নয়নের ক্রমধারা কিভাবে হলো?
যখন মুহম্মদ এনামুল হক পরিচালক ছিলেন তখন কভার হতো সাদামাটা। শুধু টাইপ করে লেখা থাকতো। আমরা পরে শিল্পী কামরুল হাসানকে বই পত্রিকার কভার করে দিতে বলি। একটা কভার করে নিয়ে আবার এক বছর পরে আরেকটা প্রচ্ছদ করে নিতাম। এই দুইটা দায়িত্ব প্রকাশন বিভাগের প্রধানের উপর ছিলো। প্রথম ৩ বছর আমি সহকারী ছিলাম। হাসান জামাল সাহেব প্রকাশনা বিভাগের অধ্যক্ষ ছিলেন। সেই সময় বলা হতো প্রকাশনা অধ্যক্ষ, পরে সেটা পরিচালক বলা শুরু হয়।
একাডেমি থেকে প্রকাশিত বইয়ে প্রকাশক হিসাবে বিভাগের পরিচালকের নাম লেখা থাকতো। তো এখানে কাজ করতে গিয়ে কিছু অভিজ্ঞতা তো হয়েছে। সেগুলো আমার স্মরণীয় মানুষ বরণীয় মানুষ বইয়ে লেখা আছে। যেমন : মুনসুর উদ্দিন সাহবের কোন বই ছাপার কাজ চলছে। উনি ছেড়া কাগজের মধ্যে লিখে এনে বলছেন এটা যোগ কর। এনামুল হক সাহেবের অভিধান উনাকে ফাইনাল স্ক্রিপ্ট দিতাম যে প্রিন্ট অর্ডার দেন। তিনি নতুন করে প্রুফ দিতেন। যতবার দেয় ততবার প্রুফ দেন। একই শব্দ দেখা গেলো যে কয়েকবার কাটলেন। একবার কেটে ঠিক করে দিলো। দেখা গেলো পরেরবার আবার সেই শব্দ কেটে দিলেন। ফলে তাকে একবার বললাম, যে আপনারা মেইনস্ক্রিপ্ট কাটবেন। কিন্তু ফাইনাল প্রুফে কাটলে কিভাবে বই ছাপবো। আপনি তো পরিবর্তন করছেন। এই কারণে অভিধানের প্রথম অংশ ছাপতেই তিন বছর গেলে গেলো। তো এই সমস্যা দেখে এনামুল হক সাহেব বললেন, আমি আর দেখবো না। অন্য কাউকে দেন। পরে শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী নামে এক হিন্দু ভদ্রলোককে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এবং অভিধানটি প্রকাশিত হয়।
প্রকাশনা ও গ্রন্থ উন্নয়নের ক্রমধারা যদি বলেন, কিভাবে প্রকাশনার উন্নয়ন ঘটলো।
তখন তো কম্পিউটার ছিলো না। হাতের লেখায় মেইনস্ক্রিপ্ট ধরতো। হাতের লেখা টাইপরাইটারে কম্পোজ করে পা-ুলিপি তৈরি করা হতো। আর হ্যাঁ, আমরা প্রথম কভারে সুন্দর করার কনসেপশনটা গ্রহণ করি। যে বইয়ের কভার সুন্দর করে ছাপাতে হবে এটা শুরু । আগে কভার ছাপানো হতো সরকারী গেজেটের মতো। সাদা পাতায় কালো অক্ষরের লেখা। যেমন : আমরা দৌলত উজির বাহরাম খাঁ, লাইলী মজনু টাইপ দিয়ে ছাপা হয়েছিলো এনামুল হক সাহেবের সময়। কিন্তু আমরা শিল্পীকে ব্যবহার করতে শুরু করলাম। তখন কামরুল হাসান, রশিদ চৌধুরী, কাইয়ুম চৌধুরী-এরা তখন বাচ্চাদের বইয়ের ভেতরে ছবি আঁকা শুরু করলো। আর হ্যাঁ এর আগে ঢাকার বইয়ে ছবি এটা কোন প্রকাশনীর ছিলো না। এমন কি তখন কোন প্রকাশনায় ছিলো না। বই ছাপা হতো কোলকাতায়।
আসলে বাংলা একাডেমি প্রকাশক হওয়ার কথা না। বাংলা একাডেমির কাজ হলো বাংলা ভাষার উন্নতি করবে। সেভাবে তারা কাজ করবে। কিন্তু প্রকাশনী বিভাগে দায়িত্ব আমি থাকায় যত ভালো করা যায়। আমি প্রকাশনা বিভাবে কাজ করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু গবেষণা বিভাগের যে দায়িত্ব গবেষণা করানো। তা তারা কম গুরুত্ব দিতে লাগলো। বলা চলে তারা কাজে ফাঁকি দিতো। সেকারণে গবেষণা বিভাগে কাজের ক্রমধারা অনুযায়ী এগোয়নি। আগে নিয়ম ছিলো বাংলা একাডেমি থেকে বৃত্তি দেওয়া হবে। বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণার জন্য। পিএইচডি করার জন্য। প্রথমে বাংলা ছাত্ররাই এটা চাইতো। যেমন ওয়াকিল আহমেদ বা গোলাম সাকলায়েন সাহেব, তারা এই বৃত্তি নিয়ে বাংলা সাহিত্যের ওপর গবেষণা করেন। তবে একাডেমির উদ্দেশ্য ছিলো বাংলা ভাষার উন্নতি করা, সাহিত্যের না। এই বিষটি চেষ্টা করেন সৈয়দ আলী আহসান সাহেব। এবং তিনি বললেন, বই প্রকাশ করা বাংলা একাডেমির কাজ না। তাই প্রথম ইডিশন বাংলা একাডেমি করলেও। দ্বিতীয় ইডিশন বাইরের যেকোন প্রকাশনী করতে পারবে। এটা শুরু হলো আহমদ পাবলিশিং হাইজের মাধ্যমে। মহিউদ্দিন আহমদ সাহেব কয়েকটি বই প্রকাশ করলেন।
গ্রন্থ প্রকাশে বাংলা একাডেমি কি জাতীয় চেতনা ও মনন ধারণ করতে পেরেছে?
এটা শুরু হয়েছিলো। তবে সৈয়দ আলী আহসান সাহেব চলে যাওয়ার পর আর এগোয়নি।
এখন যে বইগুলো বের হচ্ছে সেগুলো কি জাতীয় মনন ধারণ করে না?
এখন যে বইগুলো বের হচ্ছে সেগুলো বিক্রি হয় কি না? তাতো জানিই না।
বাংলা একাডেমি ছেড়ে আপনার জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রে যোগ দেয়ার কারণ কি?
বাংলা একাডেমি থাকাকালীন আমি দুটো কাজ করলাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে জাপান থেকে রিকুয়েস্ট আসলো প্রকাশনা বিষয় প্রশিক্ষণের জন্য একজনকে পাঠানোর। আসাদুল হক সাহেব আমার নাম পাঠালেন। ওখান থেকে পাবলিকেশন বিষয় ট্রেনিং নিয়ে আসলাম। এবং দেখে আসলাম কিভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়। পরে দেশে ফিরে আমি তাদের চিঠি পাঠালাম। ১৯৭৬ সালে ঢাকায় টিএসসিতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলাম। পরের বছর ছিলো আন্তর্জাতিক শিশু বর্ষ। ইউনিসেফের একজন ফোন করে আমাকে বললো আপনারা বইমেলা করেন। আমরা পেট্্েরাল, গাড়ি ও ডাইভার দিবো। আপনেরা শুধু বই দিবেন আর একজন বিক্রিয় প্রতিনিধি দিবেন। তখন আমরা বিভিন্ন জায়গায় মেলা করলাম। এই কাজটা করে আমার বেশ ভালো লাগলো যে, শুধু বই প্রকাশ করলে হবে না। তা বিপণন করাটাও দরকার। আর এই কাজের সুযোগ গ্রন্থকেন্দ্রে ছিলো। আর যেহেতু আমি এক সঙ্গে ৭৮-৭৯ সালে একাডেমি ও গ্রন্থকেন্দ্রে কাজ করেছি। পরে গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালকের অফার এলে তাতে খুশি হয়। এবং গ্রন্থকেন্দ্রে যোগদান করি।
আপনার সময়ে জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র গ্রন্থ উন্নয়নে ও বিস্তারে নানামুখী তৎপরতা ও উদ্যোগ গ্রহণ করেছে- সে সম্পর্কে জানতে চাই।
আমি গ্রন্থকেন্দ্র যোগদানের পর দেখলাম এখান থেকে একটা পত্রিকা বের হয় ‘বই’ নামে। তবে সেটা অনিয়মিত। ২-৩ মাস মিলে একটা সংখ্যা বের হতো। এই বিষয়টি দেখে আমি বললাম, এটা নিয়মিত করতে হবে। তারা বললো বাজেট কম। এই জন্য নিয়মিত বের করতে পারি না। আমি নিজে তখন উদ্যোগ নিলাম। এবং জুট করপোরেশনের তৎকালীন চেয়ারম্যানের সাথে কথা বললাম। তিনিও তেমন সাড়া দিলেন না। পরে অনেক চেষ্টা তদবির করে নিয়মিত করলাম। এর মধ্যে একদিন ভূইয়া ইকবাল এলেন আমার অফিসে এবং বললেন, আপনাদের বইগুলো আমাদের দিন আমরা আলোচনা লিখে পাবলিসিটির ব্যবস্থা করে দিবো। এবং তারা একটি সংগঠন করলো সাহিত্য সুহৃদ নামে। এভাবে বইয়ের প্রচার প্রচারণা তৈরি কাজ করেছি।
বর্তমানে বাংলাদেশের বইয়ের প্রকাশনা ও বিপণনে বিপুল সংকট বিরাজমান সে সম্পর্কে আপনার মতামত কি?
আমাদের দেশের প্রকাশনা শিল্প যথেষ্ট উন্নত হয়েছে; তবে বিপণন ব্যবস্থা খুব একটা ভালো না। এখানে যিনি প্রকাশক তিনিই বিক্রেতা। কিন্তু ইংল্যান্ডে প্রকাশক কখনো বই বিক্রয় করবে না। তারা শুধুমাত্র প্রকাশ করবে। বিপণনের জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তারা লাইব্রেরিগুলোতে বই বিক্রয়ের জন্য পাঠিয়ে থাকে। এবং সেখানে নির্ধারিত মূল্য বই বিক্রয় হয়। গায়ের দামের বেশি নিতে পারবে না। আবার কমিশনের সিস্টেমও নেই। কিন্তু আমাদের দেশে বিপণন ব্যবস্থা খুব ভালো মতো গড়ে উঠেনি। এখানে কিছু অনলাইন প্লাটফর্ম গড়ে উঠেছে। এটা কিছুটা আশার সঞ্চার করছে।
বিশেষভাবে মানসম্পন্ন বই প্রকাশ এবং শক্তিশালী বিপণন ব্যবস্থা কিভাবে গড়ে তোলা সম্ভব?
এবিষয়ে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র উদ্যোগ নিয়েছিলো তবে এখন তা আর নেই।
বর্তমান প্রজন্ম দিনকে দিন বই বিমুখ হয়ে পড়ছে- এর কারণ কি আপনি মনে করেন?
বইয়ের সম্পর্ক শিক্ষার সাথে। কিন্তু আমাদের দেশে যুক্ত করা হয়েছে সংস্কৃতির সাথে। অর্থাৎ বাংলা একাডেমি বা গ্রন্থকেন্দ্র হওয়া দরকার ছিলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন। অথচ এখানে তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সংস্কৃত মন্ত্রণালয়ের মধ্যে। এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার। বই হচ্ছে শিক্ষার জিনিস। অথচ তা জুড়ে দেওয়া হয়েছে সংস্কৃতির সাথে। এখানেই গলদ। খোদ কলকাতাতেও লাইব্রেরি বিষয়ক মন্ত্রণালয় রয়েছে। তারা সরকারী-বেসরকারী লাইব্রেরি ডেভপলের বিষয়ে কাজ করে। বিদেশে লাইব্রেরির বইপড়া কারিকুলামের অন্তর্ভুক্ত। সেখানে বই পড়তেই হবে। আবার বই পড়া শিখতেও হয়। অভ্যাস করতেও হয়। সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কিন্তু এখানে সে ব্যবস্থা নেই। এই বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব নিতে হবে।