[সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি আবদুল হাই শিকদার। এ ছাড়াও তিনি একাধারে নজরুল গবেষক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক ও সাহিত্যের অধ্যাপক। সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রায় সকল অঙ্গনে তার রয়েছে সরব পদচারণা। মানবতা, স্বাধীনতা, জাতীয়তাবাদী চেতনার ধারক এই কবির মুখে সবসময় ধ্বনিত হয়েছে প্রেম, প্রকৃতি, বিশ্বমানবতা, শোষণমুক্ত সমাজ ও বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের কথা। এ জন্য ১৯৯৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বরে কবি সন্ত্রাসী হামলার শিকার হলেও মানবমুক্তির স্বপ্ন, মুক্তচিন্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে তিনি আছেন আপসহীন। তার লেখনীতে বাংলাদেশের জাতিসত্তা ও বিশ্বমানবতার কথা প্রকাশ পাওয়ায় কবি আবদুল হাই শিকদারকে ‘জাতিসত্তার কবি’ও বলা হয়ে থাকে। জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য অনুসন্ধানেও গণমাধ্যমে তিনি পালন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত তার শিকড় সন্ধানী ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘কথামালা’ তাঁকে এনে দেয় ব্যাপক জনপ্রিয়তা।
কবি আবদুল হাই শিকদার ১৯৫৭ সালের ১ জানুয়ারিতে কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলার দুধকুমার নদীর তীরে দক্ষিণ ছাট গোপালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ওয়াজেদ আলী এবং মা হালিমা খাতুন। তার পিতা ছিলেন একজন কৃষিবিদ। তার পিতা-মাতা দু’জনই ছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর আসাম জীবনের ছাত্র।
আবদুল হাই শিকদার প্রথম জীবনের লেখাপড়া শেষ করেন গ্রামের স্কুল, ভুরুঙ্গামারী হাইস্কুল, রংপুরের কারমাইকেল কলেজে। তারপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধীনে ১৯৭৯ সালে বাংলায় স্নাতক (সম্মান) সম্পন্ন করেন। দীর্ঘ বিরতির পর শান্ত মরিয়ম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০৬ সালে বাংলা সাহিত্যে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেন।
কবি আবদুল হাই শিকদার সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন এবং বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় কাজ করেন। তিনি সরকারি ও সাংগঠনিক কার্যক্রমেও যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, জাসাস কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সচিব, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গুরত্বপূর্ণ কর্মকা-ের সাথে তিনি যুক্ত। তিনি বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের আজীবন সদস্য, উপদেষ্টা, সহ-সভাপতি, সভাপতি ও সদস্যসচিব হিসেবে যুক্ত আছেন। তিনি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি, শত নাগরিক জাতীয় কমিটি, বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ, জাতীয় নজরুল সমাজ, মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম ইত্যাদি সংগঠনের অন্যতম সংগঠক। তিনি বাংলা একাডেমির একজন ফেলো। তিনি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ছিলেন। দৈনিক আমার দেশ-এর সিনিয়র সহকারী সম্পাদক ও ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ (টঙউঅ) এর সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। নাগরিক সমাজের জাতীয় সংগঠন ‘শত নাগরিক’ জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়াও তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইওট)-এ অধ্যাপনা করছেন।
কবি আবদুল হাই শিকদার পড়াশোনা সম্পন্ন করার পরপরই পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা বেছে নেন। তিনি ছাত্র অবস্থাতেই ১৯৭৭ সালে ‘শাব্দিক সাহিত্যপত্র’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। তিনি বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট এবং জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে যুক্ত ছিলেন। সুদীর্ঘ ৪৪ বছরের সাংবাদিকতার পরিক্রমায় প্রতিবেদক, সহকারী সম্পাদক, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সবই যুক্ত হয়েছে তার নামের সাথে। সাপ্তাহিক সচিত্র স্বদেশ দিয়ে ১৯৮১ সালে তার পেশাগত সাংবাদিকতার জীবন শুরু। পর্যায়ক্রমে মাসিক এখন (৮৬-৮৭), দৈনিক মিল্লাত (১৯৮৭-১৯৯৪), সাপ্তাহিক বিচিত্রা (১৯৯৪-১৯৯৭), দৈনিক ইনকিলাব (১৯৯৭-২০০৪), পত্রিকার সাথে যুক্ত হন। ২০০৪-২০০৫ তিনি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার ফিচার বিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। ২০০৭ সাল থেকে তিনি দৈনিক আমার দেশ- এর সিনিয়র সহকারী সম্পাদক এর দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ২০১৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং দুই টার্মে টানা চার বছর (২০১৩-১০১৬) সফলতার সাথে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য, গবেষণা, সম্পাদনা ইত্যাদি সাহিত্যের সব শাখাতেই আবদুল হাই শিকদার রেখেছেন তার অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর। এ ছাড়াও তিনি নজরুলবিষয়ক গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন, কাব্যগ্রন্থ সম্পাদনের সাথেও তিনি যুক্ত। এ যাবৎ তার প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা প্রায় ১২০টি। তাঁর সৃজনশীলতা এখনো চলমান। এ ছাড়া তিনি এক ডজন তথ্যচিত্রের নির্মাতা।
১ জানুয়ারি কবির ৬৭তম জন্মদিন উপলক্ষে নতুন এক মাত্রার পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক ড. ফজলুল হক তুহিন ও সহকারী সম্পাদক শাহাদাৎ সরকার।]
আপনার কাব্যযাত্রার সূচনা-বিন্দু কোনটি? কিভাবে? কবিতা কিভাবে আপনাকে পেলো?
কবিতা কিভাবে আমাকে পেলো এই কথাটা বলাতো খুব মুশকিল। পাখিকে যদি জিজ্ঞাসা করেন তুমি গান কিভাবে পেলে? বাতাসকে যদি জিজ্ঞাসা করেন তুমি দক্ষিণ দিকে কেন যাও? এসব তাদের পক্ষে কি বলা সম্ভব? তেমনি কবিতা কিভাবে আমার মধ্যে এসেছে তা বলা যায় না। তবে শৈশব থেকেই আমি প্রকৃতির ভাষা বুঝতে পারতাম। আমার মনে হতো, আমি গাছের ব্যথা বুঝি। পাখির ভাষা বুঝি। এবং মানুষের সাথে মিশতে গিয়ে মানুষের অন্তরকে স্পর্শ করতে পারি বলে মনে হয়েছে। এই রকম একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই কবি হয়ে উঠি বলেই মনে হয়। তবে ছোটবেলায় আমি তেমন কোলাহলপ্রিয় ছিলাম না। ছাত্র হিসাবে ভালো ছাত্র ছিলাম। বই নিয়ে সময় কাটাতাম। আমার নির্জনতার একটা জগৎ তৈরি হয়ে গিয়েছিলো বলা চলে। আর এই নির্জনতাই মূলত আমাকে কবি হয়ে উঠতে সাহায্য করে।
সূচনাটা কি তাহলে শৈশবে….
শৈশব থেকেই লেখালেখির প্রতি আমার মধ্যে একধরনের দুর্বলতা ছিলো। আর লেখালেখির আনুষ্ঠানিক শুরু স্কুল জীবনে। আমাদের ক্লাস টিচার ছিলেন সৈয়দ উদ্দীন মন্ডল স্যার। তিনি বাংলা পড়াতেন। তিনি একবার ক্লাসে বললেন যে কালকে একটা ছড়া লিখে নিয়ে আসবি। তো পরের দিন আমি আব্বার সহযোগিতা নিয়ে একটা ছড়া লিখে নিয়ে গেলাম। আমাদের ক্লাসে তখন তিন সেকশনে প্রায় ১০০ জনের মতো ছাত্র ছিলো। তো ক্লাসে একমাত্র আমিই পরের দিন হাত তুললাম। স্যার অবাক হয়ে বললেন, তুই লিখছস এইডা? আমি বললাম, হ্যাঁ স্যার। বলিস কী! বলে খুশি ও অভিভূত হয়ে আমাকে বুকে টেনে নিলেন। এটা একটা ব্যাপার। আর মওলানা ভাসানীর দুই সন্তানের একটা প্রভাব আছে আমার ওপর। একজন আনু ফুফু। মানে মওলানা ভাসানীর মেয়ে আনোয়ারা খানম ভাসানী। আমি ছোটবেলা থেকে আনু ফুফুর নেওটা ছিলাম। আনু ফুফু অনেক রূপকথার গল্প শোনাতেন। আমাদের আমবাগানে ঘুরে ঘুরে বা ঘুমানোর সময় গল্প শোনাতেন। আর যখন একটু বড় হলাম, তখন মওলানা ভাসানীর কনিষ্ঠপুত্র আবুবকর খান ভাসানী, তিনি একদিন জানতে পারলেন আমি লেখালেখি করি। তিনি আমার খাতা নিয়ে বলছেন তুই লিখেছিস? আমি বললাম, হ্যাঁ। তো আবুবকর চাচা একদিন ভুরুঙ্গমারী বাজারে নিয়ে গেলেন ‘বার্তাবহ’ পত্রিকার অফিসে। এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন জয়নাল আবেদীন ভান্ডারী। সেই সময় এই পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন অধ্যাপক আবু তালিব, বাঙাল আবু সাঈদ (তার জনপ্রিয় উপন্যাস ছিলো ‘রিফিউজির মেয়ে’, ‘টেডিবয়’, ‘টেডিগার্ল’ ইত্যাদি) মোফাখখারুল ইসলামের মতো লেখকরা। তো বার্তাবহের আয়োজনে মাসে একটা সাহিত্য আসর হতো। সেখানে একদিন গল্প পড়লে, জয়নাল আবেদন ভান্ডারী খুব প্রশংসা করলেন। এবং আমার গল্পের জন্য সবাইকে হাততালি দিতে বললেন। এই হাততালি আমার জীবন পাল্টে দিয়েছিলো।
প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কিভাবে সম্পন্ন হলো?
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাতো আসলে কাউকে কবি বানাতে পারে না। অ্যাকাডেমিক শিক্ষার রাস্তাটা আলাদা। যেমন রবীন্দ্রনাথ কোন বিশ^বিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেছিলেন? কোনো বিশ^বিদ্যালয় থেকেই না। কাজী নজরুল ইসলাম কোন বিশ^বিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা করেছেন? আল মাহমুদ কোন বিশ^বিদ্যালয় থেকে পাস করা? তবুও কবিতা লিখে মাত করে দিয়েছেন। আসলে অ্যাকাডেমিক শিক্ষাটা একটা কাঠামো দাঁড় করায়। এটার দরকার আছে। একদম নাই এটা বলবো না। যেমন মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানরা বা আবু হেনা মোস্তফা কামাল কি কবি না? তারা তো উচ্চ শিক্ষিত। তাদের গ্রামারটা ঠিক আছে। গ্রামার এবং কাঠামো। আঙ্গিকটা তাদের খুবই সুন্দর। কিন্তু যে জায়গায় পৌঁছলে একজন কবি হবেন, বড় হবেন, ছোট হবেন, সে জায়গায় তো আল মাহমুদের বাড়ি। সে জায়গায় তো নজরুল, রবীন্দ্রনাথের বাড়ি।
কবিতা ও সাংবাদিকতা সমানভাবে করেছেন। পারস্পরিক সম্পর্ক ও প্রভাব বিষয়ে বলুন।
আমি জগন্নাথ থেকে পড়াশোনা শেষ করার আগেই ঢুকে গেলাম সাংবাদিকতায়। তখন তো মাত্র চারটি পত্রিকা। তো আমরা চার বন্ধু, কালিরঞ্জন বর্মন, রহমান মোখলেস, সুব্রত চৌধুরী আর আমি। আমরা কবিতা লিখি আর পত্রিকাগুলোতে লেখা দিয়ে দিয়ে বেড়াই। কিন্তু কেউ ছাপে না। ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ হয়ে কত যে কর্মকা- করেছি। এর মধ্যে ফারুক মাহমুদের ছোটকাগজ বলে একটা পত্রিকা টিএসসিতে ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে প্রতি বছর কবিতা পাঠের আয়োজন করতো। ভোর পর্যন্ত কবিতা পাঠ চলতো। সেখান থেকে কবিতা পাঠ শেষে যেতাম শহীদ মিনারে। শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে চলে আসতাম বাংলা একাডেমিতে। বাংলা একাডেমিতে ৮টার সময় শুরু হয়ে যেতে কবিতা পাঠের আসর। তো সেই সময় বাংলা একাডেমি ও টিএসসিতে আমরা একঝাঁক কবি এক সঙ্গে আবির্ভূত হয়েছিলাম। তাদের মধ্যে এখন যারা উল্লেখযোগ্য যেমন : আসাদ মান্নান এসেছিলেন চিটাগাং থেকে, আরেকজন মোহন রায়হান এসেছিলেন সিরাজগঞ্জ থেকে। আর আমরা চারবন্ধু এসেছিলাম রংপুর থেকে। তারা দুইজন খুব উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। তো আমার বন্ধুরা বললো, তুই তোর ‘নতুন ইশতেহার’ কবিতাটা পড়। মাত করে ফেল। তো এমন চিৎকার করে কবিতা পড়েছিলাম যে সবাই বুঝেছিল পাগল আরেকটা পাওয়া গেছে। তো কবিতা ছাপানোর জন্যই মূলত আমার সাংবাদিকতায় আসা। আরেকটা কারণ হলো ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাথে মানুষকে পরিচয় করে দেওয়া। যেমন কারমাইকেলে পড়ার সময় একবার আমরা পায়রাবন্দ গেলাম। তো সেখানে দেখলাম একজন ফকির ভিক্ষা করছে। তো সেই ফকিরের সাথে কথা বললে, তিনি বলেন, ‘আমি বেগম রোকেয়ার বংশধর।’ আমি খুব অবাক হলাম। বেগম রোকেয়া জমিদার বংশের ছিলেন। আর তার বংশধর ভিক্ষা করেন। ফিরে এসে আমি এই ভিক্ষুককে নিয়ে একটা রিপোর্ট করলাম। আমি তখনো সাংবাদিকতায় প্রবেশ করিনি। তবে এই রিপোর্টে ওই ভিক্ষুকের কিছুটা উপকারও হয়েছিল। তখন মনে হলো বাহ্! সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে তো মানুষের উপকার করা যায়। এটা আমার মাথার মধ্যে ঢুকেছিলো। আরেকটা হলো ঝাড়বিশিলা। ঝাড়বিশিলা পীরগঞ্জের একটা গ্রাম। সেখানে বড়দরগা বলে একটা জায়গা আছে। সেটা শহীদ ইসমাইল গাজীর মাজার। তো ঝাড়বিশিলা রিমোট এরিয়া। সেই জায়গায় সপ্তদশ শতকের কবি হেয়াত মামুদের বাড়ি। তিনি জঙ্গনামা কাব্য লিখেছেন। তাকে নিয়ে মযহারুল ইসলাম গবেষণা করেছেন। তো আমি সেখানে থেকে ফিরে এসে একটা রিপোর্ট করলাম ‘কবিতীর্থ ঝাড়বিশিলা’। আমি খেয়াল করলাম এই ধরনের বিষয়গুলো হাইলাইট করা হয় না। যেমন শহীদ ইসমাইল গাজী। তিনি সেকান্দার শাহ’র সেনাপতি ছিলেন। তিনি একটা অসমযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। তিনি বিরাট সোলজার ছিলেন। তার কবর এখন বড়পীরের দরগা হয়ে গেছে। তার এই বীরত্ব আমাকে টাচ্ করেছিলো। তো রংপুর থেকে একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হতো ‘সাপ্তাহিক মহাকাল’। সেখানে একটা রিপোর্ট করলাম। এরপর শেখ ফজলল করিমের কাকিনা গেলাম। সেই জায়গা নিয়ে একটা রিপোর্ট করলাম। মহাকালে দিলেই ছাপে। ওই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন গোলাম মোস্তফা বাটুল। তিনি বলেন, আরে তুমি তো দারুণ দারুণ কাজ করতেছো। তো এইভাবেই সাংবাদিকতার প্রতি ঝোঁক তৈরি হয়।
‘আশি লক্ষ ভোরে’র প্রসবকাহিনী?
আশি লক্ষ ভোরের প্রসব কাহিনী। আমি তো অনেকদিন থেকে কবিতা লিখতাম। তবে আশি লক্ষ ভোর বই আকারে বাজারে আসে ১৯৮৭-৮৮ সালের দিকে। এই মুহূর্তে সঠিক সাল মনে নেই। তবে ৮০ সাল থেকে সিরিয়াস কবিতা চর্চার সময় ধরি তাহলে বেশ দীর্ঘ সময়। এর মধ্যে আমার দুই তিনটা কবিতা কবিদের মুখে মুখে চলে গিয়েছিল। তার একটা ছিল ‘সন্ধ্যার ছাদ’, ‘সিরাজউদৌলা’। ফলে তখন সবার চোখ পড়লো আমার ওপর। যেমন মুহাম্মদ নূরুল হুদা বললেন, ‘বুদ্ধিজীবীদের ওপর একটা সংকলন বের হবে বাংলা একাডেমি থেকে। আপনি একটা লেখা দেন শিকদার।’ ফরুক মাহমুদকে একটা ধন্যবাদ দেই যে, সে সময় তিনি বছরের সেরা কবিতা নিয়ে সংকলন বের করতেন। এই সংকলনগুলোতে অনিবার্যভাবে যে কবিগণ থাকতেন, তার মধ্যে আমি একজন। তবে এরা যে আমার রাজনৈতিক মিত্র তা না। আর তখন এত রাজনৈতিক বিভাজন প্রকট হয়নি। তো এইরকম অবস্থায় আইয়ুব হোসেনের সাথে আমার দেখা। আইয়ুব হোসেন হলেন আমার প্রিয় বন্ধু। আমরা দুইজন পরে যোথ বই করেছি : ‘যুগল বন্দি ভূগোলময়’। আইয়ুব একদিন আমাকে বলল, ‘আপনার একটা বই করা দরকার। ফরহাদ ভাই বলেছে।’ ফরহাদ ভাই মানে ফরহাদ মজহার। একদিন আইয়ুব হোসেন আমাকে ফরহাদ মজহারের কাছে নিয়ে গেলেন। তো আমি গিয়ে তো আশ্চর্য! দেখি ফরহাদ ভাই, কমরেড মতিন (ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন)-কে আমার ‘সন্ধ্যার ছাদ’ কবিতাটি পড়ে শোনাচ্ছেন। আইয়ুবও চমকে গেছে। তো পরিচয় করিয়ে দিলেন আইয়ুব। তখন মতিন ভাই বললেন, ‘আপনার কবিতা শুনছিলাম। খুব সুন্দর কবিতা।’ আর ফরহাদ ভাই বললেন, আপনাকে আইয়ুব বোধ হয় বলেছে। তো আপনার একটা স্ক্রিপ্ট দেন। ফরহাদ ভাইয়ের তখন প্রতিপক্ষ নামে একটা প্রকাশনা সংস্থা ছিলো। আমার স্ক্রিপ্ট দিতে তাও তিন চার বছর লেগেছে অলসতার কারণে। এইরকম অবস্থায় ফরহাদ ভাইয়ের তত্ত্বাবধান ও অর্থে, আইয়ুবের উৎসাহ ও ব্যবস্থাপনায় সেতাউর রহমানের প্রেস থেকে আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আশি লক্ষ ভোর’ বের হলো।
আর নাম নিয়ে পড়লাম সংকটে। একুশ-বাইশটা নাম লিখলাম। নাম কোনোটা পছন্দ হয় না। তো অনেকগুলো নাম লিখে নিয়ে গেলাম রেজোয়ান সিদ্দিকীর টেবিলে। তখন তিনি দৈনিক বাংলায় বসতেন। তার পাশের রুমে বসতেন আহসান হাবীব। অন্য রুমে বসতেন ‘জুলেখার মন’ খ্যাত কবি মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ। অন্য পাশে বসতেন কবি মাফরুহা চৌধুরী। আর ছিলেন আর্টিস্ট সৈয়দ লুৎফুল হক ও অলোকেশ ঘোষ। তো ওখানে বসে সবাইকে বললাম, ভাই, এই হলো আমার পা-ুলিপি। এখন নাম সিলেক্ট করেন। তো সবাই মিলে কণ্ঠভোটে ‘আশি লক্ষ ভোর’ পাস হয়ে গেলো। আর সৈয়দ লুৎফুল হককে তখনই কভার করতে দেওয়া হলো। তার আঁকা প্রচ্ছদে বইটি বের হলে মান্নান ভাই (আবদুল মান্নান সৈয়দ) খুব প্রশংসা করলেন।
‘আশি লক্ষ ভোর’-এরপর ক্রমাগত ‘আগুন আমার ভাই’, ‘রেলিঙ ধরা নদী’ থেকে ‘মানব বিজয় কাব্য’ নতুন বাঁক, আবার বড় ধরনের বাঁক ‘এই বধ্যভূমি একদিন স্বদেশ’ ছিল? আত্মমূল্যায়ন কী?
আত্মমূল্যায়ন কী! আমার মনে হয় আহা! আমি যা দিতে পারতাম তা তো দেয়া হয়নি। আমার অলসতা আমার প্রতিপক্ষ। আমার এই যে জীবিকার ধান্দা, পেটের ধান্দায় জীবনের অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে গেছে। বলা চলে জীবনের বেশির ভাগ সময় চলে গেছে এই ভাতের ধান্দায়। ভাতের তালাসে। এর মধ্যে একটা বিয়ে করে ফেললাম। বিয়ে করে আরেক বিপদে পড়লাম। ফলে নানা শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে গেছি। চারদিকে নানা টানাটানি। এর মধ্য থেকেও ফোয়ারার মতো যে নিজের আত্মাকে জাগিয়ে রাখতে পেরেছিলাম, সেটার জন্য আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা তাদের প্রতি, যারা নানাভাবে আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন। তারা আমার প্রতি তাদের আস্থা হারায়নি। কিন্তু আমি মনে করি যে হাজার হাজার বছরের কতো মানুষের কতো অব্যক্ত কথা-ব্যথা-বেদনা-দাহ, তারা ব্যাকুলভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আবার যখন দেখি সমাজের মধ্যে হাজার অসঙ্গতি, হাজার পেইন, কত কষ্ট, কত দাহ। এই জায়গাগুলো আরো গভীরভাবে আমার টাচ্ করা উচিত ছিলো। আমি তো মানুষের কবি। নার্সিসাস না। আমি সমাজের পার্ট। আমার সামাজিক দায়িত্ব আছে। আমার একটা সোস্যাল কমিটমেন্ট আছে, অঙ্গীকার আছে। তো ভাতের ধান্দায় বা জীবিকার তাগিদে নেড়ি কুকুরদের মতো হন্যে হয়ে ঘুরতে না হলে, আমি যা পারতাম দিতে চেয়েছিলাম তা হয়তো সফলভাবে দিতে পারতাম। কিন্তু এখন আমি ভীষণ অতৃপ্ত। কারণ, আমার মনে হয় আহা! এখন থেকে একশ বছর পরে আমার কবিতা কেউ পড়বে তো? পাঁচ বা এক হাজার বছর পরে মানুষ আমাকে মনে রাখবে তো? এই কয়টা লেখার জন্য আমাকে কি কেউ স্মরণ করবে? এগুলো ভেবে ভেবে কষ্ট পাই। আমি যদি আরো ভালো করে সময় দিতে পারতাম। আরো মনোযোগ দিয়ে লিখে যেতে পারতাম। যদি সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে শুধু কবিতা নিয়ে থাকতাম। তাহলে হয়তো আমি যেরকমভাবে চেয়েছিলাম সেরকমভাবে পারতাম। এক ধরনের অতৃপ্তি, এক ধরনের ক্ষুধা, আরও ভালো কবিতা লেখার পিপাসা থেকেই গেলো।
একদিকে প্রেম-প্রকৃতি, অন্যদিকে মানবতা-স¦াধীনতা-জাতীয়তা, সমাজ ও রাজনীতিমনস্কতা, আবার ইতিহাস-ঐতিহ্য চেতনা ও আধিপত্যবাদ বিরোধী গণসাহিত্যের প্রেরণা- কোথায় পেলেন?
আমি প্রকৃতি থেকে পেয়েছি। মানুষ থেকে পেয়েছি। সমাজ থেকে পেয়েছি। আমার অধ্যয়ন থেকে পেয়েছি।
নজরুল-ভাসানী-মাও এদের প্রভাব আছে কিনা?
নিশ্চয় আছে, নিশ্চয়। মানুষমুখিনতা এইটা তো মওলানা ভাসানীর বিরাট একটা ট্রেনিং। এটা কাজে লেগেছে আমার। আর ভাসানীর ট্রেনিং থেকে যখন গেলাম সিরাজ শিকদারের সাম্যবাদ বা কম্যুনিস্ট সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য, এই যে গেছিলাম কি কারণে? ব্যক্তিগত কোন উচ্চাভিলাষ ছিলো না আমাদের মধ্যে। আমরা চেয়েছিলাম এমন একটা সমাজ, আমার আশি লক্ষ ভোরে উৎসর্গপত্রটা পড়বেন। ‘আর যদি দেখি মানুষ না খেয়ে মরছে, আর যদি শুনি মানুষ মানুষকে শোষণ করছে, তাহলে পৃথিবীকে ধিক্কার।’ উৎসর্গপত্রেই তো আমি অংকিত করে দিয়েছি ‘হু আই এম’। মানুষ, মানুষ এবং মানুষ। মানুষের অজ¯্র কলরব, অজ¯্র অশ্রু, অজ¯্র ঘাম, অজ¯্র সংগ্রাম, অজ¯্র স্যাক্রিফাইজ। এগুলো আমার মধ্যে কাজ করেছে। আমি সেই মানুষের সঙ্গে কিভাবে গাদ্দারি করবো। সেই মানুষের কাজ থেকে কিভাবে চোখ ফিরিয়ে নেব। আমি তো মানুষ সম্পৃক্ত একজন মানুষ। লালন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ফররুখ তাদের আসল আরাধ্য কী? মানুষ। চন্ডিদাস সেই চতুর্দশ শতাব্দীতে বলে গেছেন : ‘শুনহে মানুষ ভাই, সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই।’ মানুষ, মানবিক প্রেম, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, প্রকৃতি, জীবন, সমাজ, প্রাণিজগৎ, বৃক্ষরাজি সমস্ত কিছুই আমাকে নানাভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। তারাই হয়তো আমাকে রসদগুলো সরবরাহ করেছে।
‘হাফিজ, এই যে আমার দরখাস্ত’ নতুন এক বাঁক, সর্বশেষ বাঁক ‘ইশক আবাদ’ এর সজীব প্রাণজ প্রকাশ-নিজের মন্তব্য কী?
এটা আমার মনে হয়েছে হাফিজের কবিতার স্টাইলটা কি? হাফিজ যেটা বলতেছে সেটা কী? হাফিজ এবং শেখ সাদীর ব্যাপারে আমি একটা তুলনামূলক আলোচনা করি। হাফিজ চেয়েছিলেন মর্ত্যরে মানুষের প্রাণের যে হাহাকার, প্রাণের যে রোদন, সেগুলো অমরলোকে পৌঁছাতে চেয়েছিলেন। আর শেখ সাদি অমরলোক থেকে আলো এনে মানবজীবনকে আবাদ করতে চেয়েছিলেন। দু’জনার লক্ষ্য এক। কিন্তু পদ্ধতি আলাদা। দুইটা দুই রকমভাবে কাজ করেছে। হাফিজের মধ্যের ওই জিনিসটা সবসময় আমাকে টাচ করেছে-
তোমার পথে মোর চেয়ে কেউ সর্বহারা নাইকো, প্রিয়!
আমার চেয়ে তোমার কাছে নাই সখি, কেউ অনাত্মীয়।
তোমার বেণীর শৃঙ্খলে গো নিত্য আমি বন্দী কেন?
মোর চেয়ে কেউ হয়নি পাগলপিয়ে তোমার প্রেম-অমিয়॥
আমার ‘ইশক আবাদ’-এর মধ্যে আছে দেখবেন :
তোমার পথে আমার চেয়ে
গরিব আছে আর কে বলো,
সবাই পেলো তোমার প্রসাদ
আমাকে কও, একলা চলো!
হাফিজকে আমার বেসিক্যালি মনে হয়েছে কবিদের কবি। তিনি হলেন সারা পৃথিবীর মরমি আত্মার কবি। মরমি চেতনার কবি। আমার কাছে হাফিজ মানে বিশাল ব্যাপার। যদিও আমি হাফিজকে যেমন পড়েছি, তার চেয়ে বেশি পড়েছি জালালউদ্দীন রুমিকে। তো রুমি, হাফিজরা হলো কবিদের কবি। তাদের যে মরমিবাদ, অব্যাখ্যাত আধ্যাত্মবাদ, যা ব্যাখ্যা করা যায় না। যা বচনাতীত, বর্ণনাতীত। এই অবর্ণনীয় বিষয়গুলোকে তারা যেভাবে ধরেছে। আমার মধ্যে তারা ক্ষুধা তৈরি করেছেন। কিন্তু আমি যেটা করেছি ইশক আবাদের মধ্যে মরমিচেতনার সাথে সমকালীন জীবনকে তুলে ধরেছি। যেমন :
রবজায় একা মরেনি গিফারী
মরেছিল ইসলাম,
ফোরাতের তীরে হোসেনের খুনে
ফের জেগে উঠলাম।
বা
পুঁজির পাছায় মারে মার্কসের লাথি
লেনিন ও মাও সাথী,
আমার মোকামে আবুজর ধ্যানে
রুমী জে¦লেছেন বাতি।
এইখানে দেখবেন একটা সমন্বয় আছে। ইসলামের যে রেভ্যুলুশনারি সাইটটা তার সাথে সমকালীন পৃথিবীর রেভ্যুলুশনারিদের ঐক্যবদ্ধ করা, একমাত্রায় নিয়ে আসা, এর কারণটা কী? কারণটা হলো যে, দুই গ্রুপ দুই রকমভাবে একই জায়গায় যেতে চেয়েছেন। যেমন মাও সেতুঙের লংমার্চের কথা যদি পড়েন অশ্রুসিক্ত হবেন। সারাদিন পরিশ্রম করে আবার রাতে কবিতা পাঠের আসর বসত। সেখানে মাও সেতুঙ নিজে কবিতা পড়ছেন। তিনি এই ট্রেনিং কোথায় পেলেন? আমি খুঁজে দেখলাম চৌদ্দ-পনেরো শ’ বছর আগে আরবের মরুভূমিতে আরেক মানুষ, আরেক মহামানবের জন্ম হয়েছিলো। তিনি একটা যুদ্ধের আগে, একটা কর্মের আগে কবিদেরকে সংগঠিত করতেন। কবিদেরকে বলতেন, পড়। জিহ্বাকে তোমরা তরবারির মতো ব্যবহার কর। তুমি কবিতা লেখো। কবিতার জন্য এত উৎসাহ। এই মানুষগুলোর টার্গেট কি ছিলো আসলে? আমাদের রাসূলের যে টার্গেট, আমাদের আবুজর গিফারির যে টার্গেট, মার্কসের যে টার্গেট, মাও সেতুঙের যে টার্গেট, মওলানা ভাসানীর টার্গেট, আসলে কী একই টার্গেট না? বিভিন্ন মোড়কে বিভিন্ন ভাবে তারা কাজটা করেছেন। তারা প্রতিপক্ষ হিসাবে কাকে চিহ্নিত করেছেন ? তারা মানুষের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ মনে করেছেন পুঁজিবাদ। লুণ্ঠন ছাড়া পুঁজির বিকাশ ঘটে না, মাও সেতুঙ বলতেন। মাকর্সের কথা, মানুষের রক্ত পান না করলে পুঁজি বিকাশ লাভ করে না। আর এই পুঁজিবাদের আরেকটা বড় ফরম হলো সা¤্রাজ্যবাদ। সা¤্রাজ্যবাদ যখন বড় হয়ে ওঠে তখন তা রূপলাভ করে উপনিবেশবাদে। এই উপনিবেশকে টিকিয়ে রাখতে আধিপত্যবাদ জন্ম লাভ করে। এই সমস্ত জিনিসগুলোই হলো মানব বিরোধী। মানুষের অস্তিত্ব বিরোধী। এগুলো মোকাবেলা করার যে মন্ত্র, যে শিক্ষা তার কিছুটা আলো তো আমার ইশক আবাদের মধ্যে আছে। এর সঙ্গে আছে আধ্যাত্মবাদ। আমি বলি উইথআউট স্পিরিচুয়ালিজম লিটারেচার হতে পারে না।
সাংবাদিকতা ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে আপনার ব্যাপক ভূমিকা কতটা দেশ ও দশের স্বার্থে ও সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী?
সেটা বিচারের ভার তো আমার পাঠকের হাতে। যারা আমাকে কাছ থেকে দেখেছেন তাদের হাতে। আমি যেদিন থেকে কাজ করা শুরু করেছি, সেদিন থেকে আমার জীবন, কর্ম, সময়, লেখালেখি সব তো মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছি। চে গুয়েভারার একটা ডায়ালগ আমি সব সময় মাথায় রাখি। ঙঁৎ বাবৎু ধপঃরড়হ রং ধ নধঃঃষব পৎু ধমধরহংঃ রসঢ়বৎরধষরংস-আমাদের প্রতিটি কাজ এক একটি যুদ্ধ ঘোষণা। সেই যুদ্ধ কার বিরুদ্ধে? মানুষবিরোধী, মানবতাবিরোধী সা¤্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে।
সারা পৃথিবীকে ল-ভ- করে বেড়াচ্ছে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ। আফগানিস্তানকে প্রস্তর যুগে পাঠিয়ে দিয়েছে। ইরাককে ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে। লিবিয়াকে রক্তাক্ত করে দিয়েছে। ফিলিস্তিনের মানুষ ৭০-৮০ বছর ধরে একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে আছে। কাশ্মীরে মানুষ মারা যাচ্ছে। মরোর জঙ্গলে আমার ভাইয়েরা কাতরাচ্ছে। পেরুতে আমাদের ভাইয়েরা কষ্টে আছে। নিকারাগুয়েতে আপনার মঙ্গলে জন্য কোনো না কোনো কৃষক অশ্রু ঝরাচ্ছে। সারা পৃথিবীর এই মানুষের জন্য কিছুই করার কি নাই আপনার? আপনি শুধুমাত্র একটা ‘ডগমা’ নিয়ে বসে থাকবেন। এই রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে যেতে হবে তো আমাদের। আমাদেরকে ছড়িয়ে পড়তে হবে। আপনার নিজস্বতা নিয়েই আপনি ছড়ান। মওলানা ভাসানী ধর্মীয় নেতা হওয়া সত্ত্বেও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রধান পুরুষ। তিনি দেওবন্দ থেকে পাস করা আলেম। অথচ বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রধান প্রতিভূ। ঠিক একই রকমভাবে দানিয়েল ওরতেগা নিকারাগুয়ের যিনি বিপ্লবের নায়ক। দানিয়েল ওরতেগার দক্ষিণ হস্তটা কে? দক্ষিণ হস্ত তো আরনেস্তু কারদেনাল। যিনি একজন পাদ্রি। কই কোন সমস্যা তো হয়নি। আপনার টার্গেট যদি থাকে মানবমুক্তি, আপনার টার্গেট যদি কোন বিশেষ দলের দাসত্ব করার আগ্রহ না থাকে, তাহলে তো আপনি ফ্রিলি নিজেকে উপস্থাপন করতে পারবেন। আমার জীবনটাকে ঠিক ওইভাবেই দেখেছি। আপনি বলতে পারেন হ্যাঁ, ‘আপনিতো এখন একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত’। ইয়েস, আমি মনে করেছি এইখানে থেকে আমি যদি আমার কণ্ঠকে রাইজ করতে পারি। আমার কণ্ঠস্বরকে তুলে ধরতে পারি। কিছু মানুষের তো মঙ্গল করা সম্ভব এখান থেকেও। আমি সমাজ বিপ্লবের পথে নাই বা গেলাম। কিন্তু সমাজ সংস্কারের কাজ তো করতে পারি।
আপনার নামের সাথে নজরুলচর্চা ওতপ্রোতভাবে মিশে গেছে। নজরুল গবেষণা, প্রামাণ্য চিত্র, সম্পাদনা, ভাষণসহ সামগ্রিক চর্চায় একজন উচ্চকণ্ঠ ও সক্রিয় কর্মী হিসেবে দেখা যায়- এই ব্যাপ্তি ও ধারাবাহিক সক্রিয়তার কারণ কী?
কারণটার মধ্যে মানুষ। বাংলাদেশের সাহিত্য বা নজরুলের সমকালীন বিশ^সাহিত্য মাথায় রেখে বলছি, নজরুলের চাইতে মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে এমন কথা আর কে বলেছে? বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্য উচ্চারণ :
গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।
এই বিষয়টা কি অন্যদের থেকে নজরুলকে বিশিষ্ট করে তোলেনি! মানুষের কথা যদি বলতে চান, তাহলে নজরুলের চেয়ে মানুষ আর মানবতার কথা আর কে বেশি বলেছে। নজরুলের চাইতে বেশি করে আর কে শোষণ, বঞ্চনা, নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। নজরুলের চাইতে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কথা বলেছে আর একজন লোকের নাম বলেন। নজরুলের চাইতে বেশি করে নারী অধিকারের কথা বলেছে আর একজন কবি লেখকের নাম বলেন। নজরুলের চেয়ে নিজের জীবন, লেখা ও কর্ম একাকার করেছেন আর একজনের নাম বলেন। বুদ্ধদেব বসুর মতো নজরুলবিদ্বেষীও বলতে বাধ্য হয়েছেন, বহিমিয়ান জীবনে আমরা অনেক দেখেছি। প্রত্যেকেরই দুটো খাতা থাকে একটা বাহিরের আর একটা ভেতরের। আর নজরুল আমার জীবনে দেখা একমাত্র বহিমিয়ান যার কোন খাতাই ছিলো না। বাইরে-ভেতরে আলাদা কোনো খাতা ছিলো না। জাত বহিমিয়ান পৃথিবীতে একজনই জন্মাইছে মাত্র। সেটা হলো নজরুল। এই যে লোকটা। আমি যদি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে চাই, সমকালীন বিশ^মানবতার সাথে আত্মীয়তা করতে চাই, সা¤্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ, উপনিবেশবাদ, কলনিয়ালিজমের বিরুদ্ধে কথা বলতে চাই, আমি যদি স্বর্গ-মর্ত্য করতলে নিতে চাই, অস্ত্রটা কে? নজরুল। প্রেমের সঙ্গে প্রকৃতি, জীবনের সঙ্গে সংগ্রামের আত্মীয়তা, ধর্মের সঙ্গে বিপ্লবের আত্মীয়তা করে দেওয়া-এই যে অদ্ভুত কেমিক্যাল নজরুলের ভেতর ছিলো। আর যদি নজরুলের জন্ম না হতো তাহলে আমরা কি করে জানতে পারতাম যে ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে ভাষার মধ্যে থেকে অগ্নিগিরি উদগীরণ হতে পারে। ফোর্ট উইলিয়ামের যে কৃত্রিম ভাষা সংস্কার তার গালে চপেটাঘাত করে তাড়িয়েছেন নজরুল। এই সব কারণ মূলত নজরুল চর্চায় আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে।
কবিতার পাশাপাশি প্রবন্ধ সাহিত্যের বৈচিত্র্য যেমন রয়েছে, রয়েছে একটা নিজেস্ব ঢঙ যা প্রচলিত একাডেমি ফ্রেমের বাইরে এটা কিভাবে পেলেন?
কিছু কিছু জিনিস থাকে মানুষের স্বভাবজাত। আরেকটা বিষয় হলো একাডেমি মানুষের দক্ষতা তৈরি করতে পারে। তবে তাতে প্রাণ পাওয়া যায় না। গবেষণাকর্মের মধ্যে কোন লাইফ নেই, প্রাণ নাই। যেমন ধরেন: বাঙলা ভাষার প্রথম মুসলিম কবি বিষয়ে অনেক গবেষক মন্তব্য করেছেন, ইতিহাসের ফ্রেমে লিখেছেন। কিন্তু আমি যখন সোনারগাঁ নিয়ে ডকুমেন্ট তৈরি করি তখন এটা জোর দিয়ে প্রচার করি যে বাঙলা ভাষার প্রথম মুসলিম কবি শাহ মুহাম্মদ সগীর। রাষ্ট্রের অর্থে বাঙলা ভাষার প্রথম কাব্যগ্রন্থ কোনটি? এগুলো আমি উপস্থাপন করেছি। যদিও আবিষ্কার আমার না। আবিষ্কার ড. মুহম্মদ এনামুল হকের। কিন্তু এটাকে পপুলারাইজ করার কাজটা করেছি আমি। এই যে মানুষের কাছাকাছি যাওয়া আগ্রহ সেখান থেকেই মূলত একাডেমিক ফ্রেমের বাইরে গিয়ে প্রাণের সুরে কথা বলতে চেয়েছি আমার প্রবন্ধ গুলোতে।
আপনার আগামীর সাহিত্য পরিকল্পনা কী?
ওরে শাহাদাৎ, আমি সারাজীবন অপরিকল্পিত জীবন যাপন করেছি। ঢাকা শহরে আসলাম ক্যান? করলাম কী? কোন পরিকল্পনা ছিলো না। হতে চেয়েছিলাম সন্ন্যাসী, হয়েছি সংসারী। হতে চেয়েছিলাম সৈনিক, হয়েছি কেরানি। তো আমার কোন পরিকল্পনা নেই। যদি হয় হবে। না হলে নাই। তবে কিছু পরিকল্পনা যে একেবারে নেই এটা বলবো না। আগামীতে ‘লান্দে’ নিয়ে কাজ করবো। শায়েরী শের এই ধারার থেকে ‘ইশকা আবাদ’ করলাম। তেমনি আগামীতে ‘লান্দে’ নিয়ে কাজ করবো। এর আগে মানববিজয় কাব্য লেখেছি রুবাইয়ের আঙ্গিকে।