আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে। কিন্তু দিন-ক্ষণ-তারিখ-সময়, প্রায় সব মনে আছে। কারণ বেড়াতে যাওয়ার আগে যেমন প্রস্তুতি নেই তেমনি সংরক্ষণ করি বাস-ট্রেনের টিকিট, স্যুভেনির, ট্র্যাভেল গাইড, ফোক টেল্সের বই। তাই মুখ খুললে বা কলম ধরলে স্মৃতিরা সব ভিড় করে বের হয়ে আসার জন্য।
শিরোনামে বন্ধু উল্লেখ করেছি কিন্তু নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমা থেকে যখন বিশ কিলোমিটার দূরের খনোমা নামের পাহাড়ি গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হই তখন না চিনতাম গ্রাম না চিনতাম সেখানকার কাউকে। অথচ দিনশেষে যখন ফিরে আসি তখন বিষাদ-আনন্দে এই প্রতীতি হয় যে, ‘এখানে আর কখনো আসা হবে না কিন্তু আমাদের সব সময় মনে থাকবে যে বিশাল পৃথিবীর এই দূর প্রান্তে আমাদের একঘর স্বজন রয়েছে।’
সেই স্বজনের নাম দোজু খোটে। ফেসবুকের কল্যাণে অতি সম্প্রতি তাকে খুঁজে পেলাম। নাগাল্যান্ডের পর্যটন বিভাগের ওয়েবসাইটে চারজন টুর অপারেটরের ঠিকানা পেয়ে ইমেল করলে তাৎক্ষণিকভাবে ডিমাপুর থেকে খনোমা গ্রামের একটি মেয়ে জানাল সে দোজু খোটেকে চেনে, তার ফোন নাম্বারও জানিয়ে দেয়। দোজু খোটে জানায় সে এখন নাগাল্যান্ডের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। প্রথম দেখার সময়ে সে ছিল সদ্য বিবাহিত। এখন তার চার সন্তান। কোহিমা শহরে দোতালা বাড়ি করেছে। পরিবার এবং বাড়ির ছবি পাঠিয়ে সাদর আমন্ত্রণ জানায় নাগাল্যান্ডে, গেলে তার বাড়িতেই থাকতে হবে।
দুই.
নাগাল্যান্ডের রাজধানী খনোমা সত্যিকার অর্থেই বিদেশ বিভুঁই হলেও প্রথম দিন সন্ধ্যায় আমাদের হোটেলের কাছেই দুজন বাঙালি পেয়ে যাই। একটা বড় ভবনের নিচে কাপড়ের দোকানির গায়ে পাঞ্জাবি এবং মুখে দাড়ি দেখে পরিচয় জিজ্ঞেস করে জানাতে পারি তার নাম নুরুল্লাহ মিঞা, বাড়ি চট্টগ্রাম। এখানে আছেন অনেক দিন। তিনিই জানালেন সামনে মূল রাস্তার সামান্য নিচের রাস্তায় আফতাব উদ্দিনের রেস্টুরেন্ট, তার বাড়ি নোয়াখালী। সে থাকে কিচেনে, কাউন্টারে বসিয়েছে এক নাগা মেয়েকে। আফতাব উদ্দিনের রেস্টুরেন্টেই খাওয়া-দাওয়া সেরেছি।
নুরুল্লাহ মিঞাই ট্যাক্সি ঠিক করে দেন সকালে। এন এল ওয়াই-৩৫১, ড্রাইভারের নাম দিলীপ থাপা। নেপালি, সঙ্গে রয়েছে তার দেশ থেকে নতুন আসা ছোটভাই। তাকেও সঙ্গে নিল। এমবাসেডর ট্যাক্সিতে একটু চাপাচাপি করে বসা গেল।
যখন বেরুলাম তখন আকাশ পরিষ্কার, ঝকঝকে রোদ, রাস্তায় লোকজন। কোহিমা শহরটি কত সুন্দর আর কত উঁচুতে তা বোঝা গেল রওনা হয়ে। শহরটি পাহাড়ের উপর। তাও এক পাহাড়ে নয়, কাছাকাছি দু’তিনটি পাহাড়, পাহাড় চূড়া ও পাহাড়ের ঢালে কোহিমা শহর। শহরে এক চক্কর দিয়ে থাপার ট্যাক্সি নিচে নামা শুরু করল। রাস্তা পাকা কিন্তু ততো ভালো নয়। ঘুরে ঘুরে খাড়া নিচে নামছে। কোথাও বা পাশের পাহাড় থেকে পানি নামছে রাস্তার উপর দিয়ে। পিছল রাস্তায় গাড়ির চাকা সামান্য স্লিপ কাটলেই ট্যাক্সি গড়িয়ে পড়বে কয়েক শ’ কিংবা হাজার ফুট নিচের খাদে। জঙ্গলের মধ্যে পড়ে থাকতে হবে কতদিন কে জানে। কিন্তু এই ভয় বেশিক্ষণ আটকে রাখে না। মৃদু হাওয়ার দোলায় অর্কিড ও ফার্নের চোখজুড়ানো ঘন সবুজ রঙ, কলকল করে নামা পথের পাশে ছোট ছোট ঝরনাধারা, আকাশ ফুঁড়ে ওঠা দূরের পাহাড়, মেঘের সঙ্গে মিশে চারপাশটা এমন শান্ত যে মনে হয় ঘুম ভাঙেনি প্রকৃতির। এমন দৃশ্য দেখেই হয়তো কবি গেয়েছিলেন ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই।’
যেতে যেতে চোখে পড়ল পাহাড়ের ঢালে জঙ্গল সাফ করে করা হয়েছে ধান চাষ। সমতল ভূমি নয় বলে করা হয় ‘জুম’ নয়তো ‘ধাপ-চাষ।’ পাহাড়ি ঢালকে ধাপে ধাপে কেটে ছোট ছোট প্লটের সমতল ভূমি বানিয়ে সেখানে চাষ করা হয় নানাজাতের ধান। কয়েক বিঘা জমিতে নাকি বিশ রকমের ধান চাষ করা হয়।
লোকবসতি কম বলে বাড়িঘর খুবই কম চোখে পড়ে। রাস্তার পাশে অনেক জায়গায় দেখা গেল ছোট খোঁয়াড়, তার ভেতরে আটকানো শূূকর। জিজ্ঞেস করায় থাপা জানাল এগুলি গৃহপালিত। কাছেই জঙ্গলের ভেতর রয়েছে এই পশুর মালিকের বসতি।
বিশ কিলোমিটার দূরের রাস্তায় লোকজন খুবই কম চোখে পড়ল। বাহন বলতে একটি মাত্র বাস, দু’-তিনটি মোটরসাইকেল। রাস্তায় পাওয়া গেল গরু ও শূকরের রাখাল এবং জঙ্গল থেকে কাঠ ও কলাপাতা কেটে বান্ডিল বেঁধে আনা মেয়েদের। অনায়াসে ভারী বোঝা বইছে কপালের সঙ্গে ফিতে দিয়ে আটকিয়ে পিঠে চাপিয়ে। নাগা মেয়েরা শক্ত-সমর্থ, পরিশ্রমী এবং খুব সাহসী। নইলে দু’তিনজন মেয়ে পুরুষ সঙ্গী ছাড়া এই দূর পাহাড়ি জঙ্গলে কাঠ-পাতা কাটকে আসতে পারতো না।
পথে এক জায়গায় দেখি তিনটি তরুণীকে, বাঁশ কাটছে। সম্পূর্ণ উদোম গা। কালো কিন্তু কি নিটোল স্বাস্থ্য। মরহুম সিরাজ শিকদার বান্দরবানের মুরঙদের সঙ্গে থাকার সময় এমন মেয়েদের দেখেই হয়তো লিখেছিলেন:
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে চলে একটি মুরুঙ মেয়ে,
কি নিটোল স্বাস্থ্যবতী,
কবে তার কাঁধে শোভা পাবে, রাইফেল একখানি।
সঙ্গে ক্যামেরা থাকলে যা হয়। বুঝতে পেরে থাপা নিষেধ করল। বিপত্তির শঙ্কায় ক্যামেরা রেখে দেই। নিটোল স্বাস্থ্যবতী তিন নাগা রমণী পেছনে পড়ে থাকে। থাপার গাড়ি এগিয়ে চলে। বাড়ি-ঘর কিছু কিছু চোখে পড়তে থাকলো। পাহাড়ের ঢালে মাচাং ঘর। ঘন নীল আকাশের পটভূমিতে সবুজ পাহাড়ের বুকে ছোট ছোট ঘর দেখে মনে হয় যতেœ আঁকা নিপুণ কোনো শিল্পীর শিল্পকর্ম। পৃথিবীটা যে কত সুন্দর ঘর থেকে না বেরুলে তা বোঝাই যেত না।
ছোট একটা বেলি ব্রিজের উপর ভর দিয়ে ট্যাক্সি এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে লাফিয়ে পড়ে। নিচে ছোট নদী, সরু কিন্তু বেশ স্রোত। সামান্য চড়াই ভেঙে দুই পাহাড়ের মাঝে পাওয়া গেল জনপদ। রাস্তার পাশে জলাধার। বাঁশের পাইপে করে দূরে কোথাও থেকে পানি এসে জমছে। কাপড় কাচছে কয়েকজন নাগা তরুণী ও মহিলা। পাহাড়ি এলাকায় দুপুরের পরে প্রায়ই রোদ থাকে না। থাকলেও তার তেজ মরে যায়। তাই সব পাহাড়ি এলাকাতেই পানির কাজ সারা হয় সকালের দিকটাতে, শীতের মধ্যেও। আমরা প্রায় এসে পড়েছি। গ্রামের ঢোকার মুখে Welcome to Khonoma লেখা বড় তোরণ। গেটের সামনে ডানে বেশ বড় পাথরের স্মৃতিফলক। কাছে যেয়ে ফলকের লেখা পড়ে চমকে উঠি। লেখা :
Nagas are not Indians, their territory is not a part of the Indian Union. We shall uphold and defend this unique truth at all costs and always. Khrisanisa Seyietsu1st President Federal Goverment of Nagaland. 12th July 1956 to 18th February 1959.
প্রস্তরফলক পড়ে চমকে উঠি, এযে দেখছি দেশের মধ্যে দেশ। এ ব্যাপারে কিছু জানা নেই। বিষয়টা জানতে হবে।
তিন.
রাস্তার পাশে একটা চায়ের দোকান পেয়ে থাপা গাড়ি থামায় সেখানে। মালিক পরিচালক মহিলা। দোকানে কয়েকজন লোকের মধ্যে একজনকে পাওয়া গেল যিনি গ্রামের ভাইস চেয়ারম্যান। পরিচয় দিতে প্রথমে অবাক হলেন তারপরে সন্দিগ্ধ চোখে তাকাতে থাকলেন ক্যামেরা ব্যাগের দিকে। থাপাই কথা শুরু করল। ভাইস চেয়ারম্যান ভদ্রলোক কথা না বাড়িয়ে খবর দিয়ে কাছের স্কুল থেকে আনালেন প্রিন্সিপাল সাহেবকে। সুঠাম দেহের তরুণ। সরকারি আপগ্রেডেড এম.ই স্কুলের প্রধান নাম, দোজো খোটে। দু’চার কথাতেই বোঝা গেল মানুষটি সরল ও ভালো। তিনিও প্রথমেই সবিস্ময়ে জানতে চাইলেন রাজধানী থেকে দূরে এই অজপাড়াগাঁয়ে আসার কারণ কী। জানালাম, কোনো অঞ্চলের মানুষকে জানতে চাইলে যেতে হবে গ্রামে। আর এ গ্রামটিতে আসার বিশেষ কারণ হচ্ছে বীরপ্রসাবিনী এই গ্রামের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। এ কথাতে খুশি হয়ে তিনি জানালেন অন্যদেরকে। উপস্থিত গ্রামবাসীর মুখের হাসি দেখে বুঝলাম তারা আমাদেরকে খুশি মনে গ্রহণ করেছেন।
আমাদের নিয়ে বসানো হলো গ্রাম পঞ্চায়ায়েতের মিটিং হয় যেখানে। বসার ব্যবস্থা বেশ মজার। পাথর কেটে বানানো আসন। অর্ধ বৃত্তাকারে তিন সারি, সামনে বসেন গ্রামপ্রধান ও সহপ্রধান।
প্রিন্সিপাল সাহেব শিক্ষিত, বলতেও পারেন ভালো। প্রথমে জানালেন নাগাদের আদি ইতিহাস সম্পর্কে।
পণ্ডিত ব্যক্তিদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে নাগাদের আদিনিবাস, এমনকি ‘নাগা’ শব্দটি নিয়েও। একদল শব্দতত্ত্ববিদের মতে নাগা শব্দটি এসেছে বার্মিজ ভাষায় যার অর্থ কান ছিদ্র করা মানুষ। নাগাদের ভেতর কান ছিদ্র করা খুবই প্রচলিত একটি প্রথা। এমনকি কান ছিন্দ্র করা একটি সামাজিক উৎসবও। আট থেকে বারো বছরে বয়সের মধ্যে ছেলেদের কান ফোঁড়ানো হয়। শুভদিন দেখে এক সঙ্গে একদল ছেলের কানের লতিতে বাঁশের সূক্ষ্ম শলাকা দিয়ে ছিদ্র করে কোনো দক্ষ যোদ্ধা বা শিকারি। তার আগে একটি বড় পুরুষ শূকর বধ করেন গ্রামপ্রধান। শূকরের মাংস প্রতিবেশীদের মাঝে বিলি করা হয়। কান ফোঁড়ানোর পরে সেই ছেলেটি অধিকার পায় সামাজিক নাচের আসরে যোগ দেয়ার।
অন্যমতে নাগা শব্দটি এসেছে কথ্য অহমিয়া ভাষা ‘নোগা’ থেকে। নোগা মানে ন্যাঙটা বা উলঙ্গ। আসামের ইতিহাস ‘আসামবুরুঞ্জী’ বা অহমিয়া সাহিত্যে নোগা শব্দের বহুল ব্যবহার দেখা যায়। বন-জঙ্গলে উলঙ্গ আদিম মানুষকে বোঝাতে ব্যবহার করা হয় নোগা শব্দ। নাগারাও আগে উলঙ্গ থাকতো। এখনো নাকি দূর প্রত্যন্ত এলাকায় উলঙ্গ থাকে কিছু নাগ। এ কথাটা আমরা সহজেই বিশ্বাস করলাম কারণ আজ আসার পথে দেখেছি অর্ধ-উলঙ্গ নাগা তরুণীদেরকে।
কালক্রমে ‘নোগা’ থেকে রূাপান্তরিত ‘নাগা’ শব্দটি বার্মা, মনিপুর, আসাম ও পৃথক রাজ্য নাগাল্যান্ডের এক বৃহৎ ও পৃথক উপজাতি গোষ্ঠীর পরিচয় হয়ে দাঁড়ায়। নাগাল্যান্ডের ষোলটি উপজাতির অধিবাসীরা মেনে নিয়েছে এই শব্দ।
পণ্ডিতদের মতে নাগাদের আদি নিবাস ছিল চীনের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে। সেখান থেকে তারা দেশান্তরী হয়ে নিবাস বাঁধে বার্মায়। পরে এগিয়ে আসে পূর্ব দিকে। নাগাদের ব্যবহৃত অলঙ্কার, বৃহদাকার ঢাক ও বাদ্যযন্ত্র দেখে অনেক পণ্ডিতদের ধারণা নাগারা সম্ভবত ইন্দোনেশিয়ার জাভা ও সুমাত্রা দ্বীপাঞ্চল থেকে দেশান্তরী হয়ে এদেশে এসেছে। পৃথিবীর মানুষের শ্রেণিবিভাগ অনুসারে নাগারা তিব্বত-বর্মী গোষ্ঠীর অন্তর্গত।
খনোমা গ্রামটি বড় হলেও বাড়ির সংখ্যা মাত্র পাঁচশো। লোকসংখ্যা তিন হাজার। গ্রামের মানুষের প্রধান পেশা কৃষি। ইদানীং শিক্ষিত লোকেরা চাকরি এবং ব্যবসা পেশায়ও যোগ দিচ্ছে। প্রিন্সিপাল সাহেবের কাছ থেকে জানা গেল মজার খবর। প্রতিটি গ্রামে ‘খেল’ বা দুই অংশে বিভক্ত থাকে। প্রতিটি গ্রামে থাকে একটি করে ভিলেজ কাউন্সিল। এই ভিলেজ কাউন্সিল পুরো গ্রামটিকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে থাকে। নাগাদের গ্রামের জমি ব্যক্তি মালিকানা নয়, জমির মালিক ওই গ্রামের জাতি বা গোত্রের। প্রতি বৎসর গোত্রপ্রধান ঠিক করে দেন জমি কিভাবে চাষ করা হবে এবং কারা করবে। সেই অনুসারে গ্রামের পরিবারদের মধ্যে জমি ও কাজ ভাগ করে দেওয়া হয়। এর ভেতরে কোনো হিংসা, ঈর্ষা, প্রতিবাদ বা শত্রুতার অবকাশ নেই। ভিলেজ কাউন্সিল কাজের দায়িত্ব বণ্টন করে পুরো গ্রামের মানুষের চাহিদা ও প্রয়োজন মেটায়। গ্রামের মানুষের দায়িত্ব গ্রামের সব মানুষের। এই জন্য নাগারা যেমন পরিবারের প্রতি অনুগত তেমনি অনুগত ভিলেজ কাউন্সিলের প্রতিও। গ্রামের সব ছেলেরা বাস করে একত্রে। হোস্টেলের মতো বড় ঘরে। তাদের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় ‘মোরাঙ’ নামের যুব ক্লাবে। নাগা যুবকের জন্য তার গ্রামই হচ্ছে পৃথিবী। এখানেই তাকে শিখতে হয় শিকার ও যুদ্ধের কলাকৌশল, গোত্রের নিয়মনীতি। ভিলেজ কাউন্সিল তার পেশা পছন্দ করে দেয়। নাগা যুবক গ্রাম থেকেই পছন্দ করে নেয় বিয়ের কনে।
নাগাদের বাড়িঘরও মজার। বাঁশের বা কাঠের খুঁটির উপর মাচাঙ ঘর। ঘরের চাল টিনের। কিন্তু মজবুত। সামনের দিকটা যুদ্ধ ও শিকারে পাওয়া পশুর মুণ্ডুর স্মারক চিহ্ন দিয়ে সাজানো। দু’ধরনের ঘর হয়। দলবদ্ধ বাসের জন্য চল্লিশ বা পঞ্চাশ ফুটের লম্বা ঘর। নয়তো সপরিবারে বসবাসের জন্য দুই অংশে বিভক্ত বাড়ি। প্রথম বা সামনের অংশ হচ্ছে, গৃহপালিত পশু যথা গরু, শূকর বা মুরগি রাখার জন্য। দ্বিতীয় অংশে বাস করে বাড়ির মানুষ। শয়ন ও রান্না একই ঘর, মেহমান এলে সেও বাস করে সেই ঘরে। চুল্লিতে আগুন জ্বলতে থাকে দিন-রাত।
নতুন শিশু জন্ম নিলে ঘনিষ্ঠজন ছাড়া কেউ সে বাড়িতে যেতে পারে না। ছেলে জন্ম নিলে ছ’দিনে, মেয়ে হলে পঞ্চম দিনে নবজাতকের নামকরণ উৎসব পালন করা হয়। কেউ মারা গেলে তাকে গোর দেয়া হয়। মৃতের আত্মার স্মরণে ভোজ দেয়ার প্রথা চালু আছে। নাগারা খুব গণতান্ত্রিক। একটি গোত্রের মধ্যে কোনো শ্রেণীভেদ নেই, উঁচু-নিচু নেই। নাগারা খুব আমুদে ও উৎসবপ্রিয়। বিচিত্র অলঙ্কার, উজ্জ্বল ও রঙিন পোশাক পরা নাগাদের নৃত্য উৎসব নাকি দেখার মতো। ইদানীং হর্নবিল উৎসব দেখতে আসে দেশ-বিদেশের বহু পর্যটক।
চার.
এরপর প্রিন্সিপাল সাহেব নিয়ে গেলেন তার বাড়িতে, কাছেই। কাঠের ড্রইংরুমে। বাহুল্যহীন আসবাব কিন্তু পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন ঘর। কিন্তু ঘর মানে গ্রামের ঢোকার আগে পেরুতে হয় পাথুরে তোরণ। নানারকম চিহ্ন ও মূূর্তি আঁকা বিরাট কাঠের পাল্লা। প্রিন্সিপাল সাহেব ইংরেজিতে সাবলীলভাবে কথা বললেও তার হাসিখুশি স্ত্রী মাতৃভাষা ছাড়া অন্যকিছু জানেন না। তবে হাসিমুখে হাতে তুলে দিলেন সিদ্ধ ডিম, বিস্কুট ও চানাচুর। ইশরায় অনুরোধ করলেন সবটুকু শেষ করতে। শেষে নিয়ে এলেন ধোঁয়া ওঠা বড় কাপের চা।
আসার আগেই বই পড়ে অনেকটা জেনে নিয়েছি নাগাল্যান্ডের ইতিহাস, বাকিটা জানলাম প্রিন্সিপাল সাহেবের কাছ থেকে।
এই রাজ্যের আয়তন ১৬৪৮৮ বর্গ কিলোমিটার বা ৬৩৬৬ বর্গ মাইল। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুসারে লোকসংখ্যা ১২,১৫,৫৭৩ জন। অর্থাৎ প্রতি বর্গকিলোমিটারে মাত্র ৭৩ জন। আমাদের দেশের তুলনায় শুধু সংখ্যাতেই কম নয় বসতির দিকে থেকেও কত হালকা। রাজ্যের জেলার সংখ্যা সাত। কোহিমা, মোকচুঙ, মন, ফেক, তিয়েংশাং, ওখা ও জুনেবেটা। শহরের সংখ্যা চার, মোট গ্রাম ৮৬০।
১৮৮০ সালের দিকে ইংরেজরা কোহিমা দখল করে। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীন ও বিভক্ত হলে এই এলাকা ভারতের অন্তর্গত হয়। প্রথমে কোহিমা ও মোকচুঙ দু’টি মহকুমা নিয়ে ‘নাগা হিল্স’ নামে পৃথক রাজ্য গঠন করা হয়। ১৯৫৭ সালে আসামের ‘নাগা হিল্স এবং নেফার তিয়েংশাং এলাকা নিয়ে গড়া হয় ‘নাগাল্যান্ড’ নামের পৃথক রাজ্য। তবে এটি অধীনে থাকে ভারতের রাষ্ট্রপতির। ১৯৬৩ সালের ১ ডিসেম্বর ভারতের ১৬ নম্বর রাজ্যের মর্যাদা পায় নাগাল্যান্ড।
এক সময়ে নাগারা ছিল হিংস্র ও অত্যাচারী। তারা থাকতো উলঙ্গ বা নাঙ্গা। তা থেকে তাদের পরিচয় হয় নাগা বলে। এখন আর আগের মতো নরমুন্ড শিকার করে না। নাঙ্গা বা ন্যাংটাও থাকে না। ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করা আধুনিক পোশাক পরা গিটার বাজিয়ে ইংরেজি গান গাওয়া নাগারা এখন এক দ্রুত উন্নতিশীল জাতি। শুধু পালা-পার্বণে পরে ঐতিহ্যবাহী পোশাক।
বারো লাখ লোকের এই রাজ্যে রয়েছে ১৬টি উপজাতি- আও, অঙ্গামি, সেমা, লোথা, রেঙ্গমা, ইমচুঙ্কার, খিয়ামুঙ্কার, জেলিয়াঙ, কুকি ও পচারী। প্রায় সব উপজাতিরই আবার আছে নিজস্ব ভাষা।
প্রিন্সিপাল সাহেবই সঙ্গে নিয়ে চললেন পাহাড়ের চূড়ায়। পাথরের খাড়া সিঁড়ি ভেঙে দম নিয়ে নিয়ে কমপক্ষে পাঁচতলা দালানের সমান উঁচু পাহাড় চূড়ায় উঠে পাওয়া গেল স্মৃতিস্তম্ভ। পাথরের ছোট বেদির উপর তিন ফুট উঁচু পাথরের একটি পিলারের পাদদেশে ইংরেজিতে লেখা চার জনের নাম। উপরে উঠতে সবাই হাঁফিয়ে গিয়েছি। পাথরের উপর বসে রোদে পিঠ ঠেকিয়ে শুনলাম পুরনো দিনের গৌরবগাথা।
ব্যবসা করতে আসা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজরা পলাশীর যুদ্ধে জিতে বণিকের দণ্ডকে শাসকের দণ্ডে পরিণত করে তারা। ক্রমে ক্রমো শাসন এলাকা সম্প্রসারিত করতে থাকে। নৌযুদ্ধে বার্মাকে পরাজিত করে বার্মারাজার সঙ্গে ২৪ শে ফেব্রুয়ারি ১৮২৬ তারিখে সম্পাদিত ইয়ান্দবু সন্ধির সূত্র ধরে ইংরেজরা আসাম, কাছার, জয়ন্তিয়া, মনিপুর তাদের অধিকারে আনে। এরপরে তারা হাত বাড়ায় নাগাদের দিকে।
কোহিমা দখল করে ১৯৭৮ সালের নভেম্বর মাসে। এর আগের বছর ইংরেজরা মেজোমা গ্রাম দখল করে পুরো গ্রামটি পুড়িয়ে দেয়। খনোমা এবং মেজোমা এ দু’টি গ্রাম ছিল সমৃদ্ধ এবং শক্তিশালী। গ্রাম দু’টি থেকে প্রায়ই নাগাদের দল যেয়ে অতর্কিতে আক্রমণ করতো পার্শ্ববর্তী ইংরেজ অধিকৃত এলাকায়। দু’বছরে তারা লুট করে ছয়টি গ্রাম এবং হত্যা করে ৩৮৪ জনকে। যারা ছিল হয় ইংরেজ, নয়তো ইংরেজ অধিকৃত এলাকার বাসিন্দা। অবশ্য এই সময়ে অন্য ১৬টি নাগা গ্রাম ইংরেজদের বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। কারণ আগ্রাসী ইংরেজদের সঙ্গে এসেছে মিশনারিরা। তারা চার্চ খুলে অশিক্ষিত আদিবাসীদের মধ্যে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের সঙ্গে সেবা এবং শিক্ষা দেওয়ার কাজ শুরু করে উন্নত জীবনের স্বাদ-সুবিধা দেখাতে শুরু করেছে।
পুরো আটাত্তর সালটা গেল শান্ত। নাগাদেরকে মনে হলো সুস্থির ও অনুগত। কিন্তু পরের বছরের জুন মাসে খনোমা গ্রামকে মনে হলো অশান্ত। বলতে গেলে তখন পর্যন্ত খনোমা গ্রামই নিয়ন্ত্রণ করতো কোহিমাকে। অসুবিধা দূর করার জন্য ইংরেজরা খনোমা গ্রামবাসীর উপর জরিমানা বা ট্যাক্স ধার্য করলো। জুলাই মাসে শান্ত মনে ট্যাক্স শোধ করলো গ্রামাবাসী। ইংরেজরা ভাবলো গণ্ডগোল মিটে গেছে। অবস্থা অনুকূল। শান্ত পরিবেশ ভেবে ইংরেজদের রাজনৈতিক প্রতিনিধি জি. এইচ. ডামান্ট অন্য শান্ত নাগা এলাকায় যাওয়ার আগে একবার খনোমা গ্রাম ঘুরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলো। ১৮৭৯ সালের ১৩ অক্টোবর ২১ জন সিপাই ৬৫ জন কনস্টেবল নিয়ে ডামান্ট যাত্রা শুরু করে খনোমা গ্রামের উদ্দেশ্যে। অনেকেই তাকে খনোমা যেতে নিষেধ করেছিল। তার দোভাষী নাকি পায়ের কাছে নত হয়ে বারবার বাধা দিয়েছিল। কিন্তু সাহসী ইংরেজ নিবৃত্ত হয়নি। সে ভেবেছিল খনোমা গ্রাম শান্ত। গ্রামবাসীরা অনুগত। গত মাসের জরিমানা দিয়েছে বিনা আপত্তিতে। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ডামান্ট পৌঁছে খনোমা গ্রামের কাছে। চড়াই ভেঙে উঠে আসে গ্রামের প্রবেশে-তোড়নের সামনে। কাঠের বন্ধ পাল্লার সামনে দাঁড়াতেই বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসা গুলিতে নিহত হয় ডামান্ট। খনোমা গ্রামবাসী তীর বেগে নেমে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে ইংরেজ বাহিনীর উপর। পুরো বাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। মারা যায় ৩৫ জন, গুরুতরভাবে আহত হয় ১৯ জন।
দুঃসংবাদ সেদিনই কোহিমায় ইংরেজদের কাছে পৌঁছে যায়। তারা ২১ অক্টোবর অবরোধ করে খনোমা গ্রাম। অতি অল্প সময়ের মধ্যে এই অঞ্চলে ইংরেজদের তিনজন অফিসার নিহত হয়েছে। তারা ভাবলো বিদ্রোহী নাগাদের শায়েস্তা করার জন্য এই উপযুক্ত সময়। সিলেট ও আসামে অবস্থিত লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের সৈন্য, প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ এবং দুটি ফিন্ড কামানসহ খনোমা গ্রাম আক্রমণ করা হয় ১৯৭৯ সালের ২২ নভেম্বর। গ্রামের বীর নাগারা রুখে দাঁড়ায়। মেজর কক, লেফটেন্যান্ট ফোবর্স, একজন নেটিভ সুবেদার মেজরসহ ইংরেজপক্ষে নিহত বা গুরুতরভাবে আহত হয় ৪৪ জন।
অসম যুদ্ধ দীর্ঘদিন চালিয়ে যাওয়া যাবে না বুঝে রাতের আঁধারে নাগা গ্রামবাসীরা পশ্চাৎপসরণ করে। তারা কাছাকাছি পাহাড়ে আশ্রয় নিয়ে প্রতিশোধমূলক আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকে সুযোগ-সুবিধামতো। ইংরেজরা পরিত্যক্ত খনোমা গ্রাম এবং তাদের ধাপচাষের জমি বাজেয়াপ্ত করে অন্য সম্প্রদায়ের নাগাদের মধ্যে বন্দোবস্ত দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কেউই খনোমা গ্রামের জমি নিতে এগিয়ে আসে না। ইংরেজরা নমনীয় নীতি গ্রহণ করে। প্রায় দু’বছর পরে শর্তাধীনে খনোমা গ্রামবাসী আত্মসমর্পণ করে। গ্রামবাসীদের উপর রাজস্ব ধার্য করা হয় বছরে বাড়ি প্রতি এক টাকা ও একমণ চাল।
প্রবেশ তোড়নের কাছে Federal Goverment of Nagaland প্রস্থর ফলকের কথা জিজ্ঞেস করলে জানালেন, নাগারা দুর্ধর্ষ এবং স্বাধীনতাকামী। ১৮৮০ সালে শর্তাধীনে ইংরজেদের বশ্যতা স্বীকার করলেও কোন লিখিত চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি তারা। মিশনারিদের সংস্পর্শে এসে নাগারা শিক্ষিত হতে থাকে, তাদের মধ্যে জাতীয় জাগরণও দেখা যায়। নাগাদের নিয়ে গড়া হয়নাগা জাতীয় পরিষদ এবং Federal Goverment of Nagaland (FGN)।
১৫ই আগস্ট ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। ভারত সরকার সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। নাগারাও অস্ত্র তুলে নেয়। কৌশল হিসাবে ভারত সরকার নাগাল্যান্ডে পুতুল সরকার গঠন করে। ১৯৬৩ সালের ১লা ডিসেম্বর নাগাল্যান্ডকে ভারতের ১৬ নম্বর রাজ্য হিসাবে ঘোঘণা করা হয়। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অব্যাহতই থাকে। সম্প্রতি এর অবসান হয়েছে। বিগত ২৭শে ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সালে শান্তিপূর্ণভাবে বিধানসভার নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। নাগারা তাদের অতীত দিনের স্মৃতিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। তাই ফেডারেল সরকারের স্মৃতিফলক সযতনে রক্ষা করছে প্রবেশ তোড়নের পাশে।
পাহাড়ে অনেক উঁচুতে ইংরেজরা খনোমা বিজয় এবং জি এইচ ডামান্ট ও যুদ্ধে নিহত তাদের সৈন্যদের স্মরণে তৈরি করে স্মারকস্তম্ভ। এ যায়গাটা অনেক উঁচুতে, এখানে দাঁড়ালে চারদিকে অনেক দূর দেখা যায়। কাছে ও দূরে শুধুই পাহাড়। পাহাড়চূড়ার নিচে মেঘ ও কুয়াশা। অনেক নিচে সরু ফিতের মত নদী, দেখা যায় কি যায় না। কোথাও কোন শব্দ নেই। আমাদের কাছাকাছি মেঘ, মনে হয় আমরা মেঘের মাঝেই রয়েছি। চারদিকে চেনা ব্যস্ত পৃথিবী উধাও। নাগাল্যান্ডের সবচেয়ে উঁচু পর্বতচূড়া সরামতি (১২,৫৫২ ফুট) এখান থেকে অনেক দূরে। কিন্তু আমাদের মনে হয় আমরা সরামতিরই কাছাকাছি রয়েছি।
এখান থেকে রাজধানী কোহিমাও দেখা যায়। আমরা সমতল ভূমির লোক, সিলেটের টিলা দেখেই সাধ মিটাই পাহাড় দেখার আর এখনতো পাহারচূড়ায় চারপাশে মেঘ পাহাড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে। দেখা আর শেষ হয় না, দাঁড়িয়েই থাকি। সামনে ইংরেজদের খনোমা বিজয় যুদ্ধে নিহত সৈন্যদের স্মরণে তৈরি করে স্মারকস্তম্ভ। স্বাধীন দেশে স্থানীয়রা প্রায় কেউই এখানে আসে না। বাইরে থেকে আসা গাইড বইপড়া পর্যটকরা খনোমা গ্রামে এসে শ্রদ্ধা জানায় গ্রামবাসীদের তৈরি এই নিরাভরণ স্মারকস্তম্ভে। আমাদের সঙ্গে ফুল ছিল, আমরাও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে নিচে নেমে এলাম।
দরজার মুখে দাঁড়িয়েছিলেন প্রিন্সিপাল সাহেবের স্ত্রী মিসেস দোজো খোটে। জুটিবদ্ধ তাদের ছবি তুলতে চাইলে খুশি মনেই সম্মতি জানালেন। ভদ্রমহিলা চট করে পোশাক পাল্টালেন। মি. দোজো ছিলেন সাদা শার্ট নেভি ব্লু ফুলপ্যান্টে ইন করে। তেমনিভাবে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালে স্ত্রী আবার দৌড়ে ঘরে যে ভাঁজ করা লাল-কালো-সাদার ডোরাকাটা শাল এনে স্বামীর কাঁধে ঝুলিয়ে দিলেন। এই শাল নাগাদের কমন ড্রেস। ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে শাটার টিপতে দেরি করছি দেখে মিসেস দোজো স্বামীর বাহুতে খোঁচা দিয়ে ইশারায় জানতে চাইলেন কী হয়েছে। মি: দোজু আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, এনি থিং রং? বললাম, না, ভিউ ফাইন্ডারে আমি দেখছিলাম পৃথিবীর এক সুখী দম্পতিকে। মি: দোজো তা জানালে তার স্ত্রীর সারা মুখে যে হাসি খেলল তা দেখে বুঝতে একটুও অসুবিধা হয় না যে পৃথিবীর সব ভালো আর সুখী মানুষেরা এমনি হয়। ফিরে আসার সময় গ্রামবাসী সমবেতভাবে বিদায় জানাল করমর্দন, আলিঙ্গন ও হাত নেড়ে। শহর থেকে খনোমা আসার সময় আমরা কেউই ভাবতে পারিনি যে একটি অচেনা ও ভিনদেশী গ্রামকে, গ্রামের মানুষজনকে এত ভালো লাগবে। কিন্তু তখনও জানতাম না যে ভালো লাগার সঙ্গে অলক্ষ্যে জড়িয়ে থাকে কিছু বিষাদও। দেশে ফিরে আসার সময় সীমান্তের ভারতীয় কাস্টম্স ছবির সব নেগেটিভ রেখে দেয়। ছবি হারাবার কষ্টের চেয়ে বেশি কষ্ট পাই গ্রামাবাসীদের যে কথা দিয়ে এসেছিলাম দেশে ফিরে আমার তোলা সব ছবির কপি পাঠাবো তা আর হলো না। এখনো চোখের সামনে ভাসে ফিরে আসার দৃশ্যের কথা। বুনো ফার্ন ও অর্কিড, নাম না জানা অজস্র তরুলতা ও বৃক্ষে ছাওয়া পাহাড়ি পথ, ঝরনার পানি মাড়িয়ে দিলীপ থাপার ট্যাক্সি ঘুরে ঘুরে চড়াই ভাঙছে কোহিমার পথ, বিপরীত দিকের পাহাড় থেকে দেখা যাচ্ছে উঁচু পাহাড়ের ঢালে খনোমা গ্রামের বাড়ি-ঘর, যেন গ্রামের লোকেরা এখনো পাথরের তোড়নের কাছে দাঁড়িয়ে আমাদের বিদায় জানাচ্ছে।
আবার বিষাদের ভেতর আনন্দও লাগে এই ভেবে বিদায়ের শেষ সময়ে দোজো পরিবারকে যা বলেছি, তোমাদের দেশে আর কখনো হয়তো আসা হবে না কিন্তু আমাদের সব সময় মনে থাকবে বিশাল পৃথিবীর এই দূর দেশে আমাদের একঘর স্বজন রয়েছে।