[নাগিব মাহফুজ: আরবি সাহিত্যে একমাত্র নোবেল বিজয়ী নাগিব মাহফুজ আরব জগতে শীর্ষস্থানীয় সাহিত্যিক। ১৯১১ সালে তিনি মিসরের রাজধানী কায়রোতে জন্মগ্রহণ করেন। সতেরো বছর বয়স থেকে তিনি লেখালেখি শুরু করেন। তিনি উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেছেন দর্শনশাস্ত্রে। ১৯৩৪ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৩৯ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘হিকমাহ খুফু (খুফুস উইজডম) প্রকাশিত হয়। তাঁর ‘কায়রো ট্রিলজি’ সাহিত্যিক হিসেবে তাঁকে বিশ্বখ্যাতি এনে দেয়। ১৯৮৮ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ২০০৬ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন।]
মুহতাশিমি জায়েদ
সামান্য ঘুম হয়েছে। এরপর ভারি চাদরের নিচে উষ্ণতায় ভরা আকাক্সক্ষার মুহূর্ত। জানালা দিয়ে আসা ম্লান আলো রুমের গাঢ় নিষিদ্ধ অন্ধকারকে প্রবলভাবে ভেদ করেছে। হে প্রভু, আমি তোমার আদেশেই নিদ্রা যাই এবং তোমার আদেশেই জাগ্রত হই! তুমিই সবকিছুর মালিক। ফজর নামাজের আজান আমার জন্য একটি নতুন দিন সূচনার ঘোষণা করে। নীরবতার গভীর থেকে ডাকা হয় তোমার নাম। হে প্রভু, আমাকে সাহায্য করো, যাতে আমি আমার উষ্ণ শয্যা থেকে নিজেকে ছিন্ন করতে এবং এই দীর্ঘ শীতের কনকনে শীতলতার মুখোমুখি হতে পারি! আমার প্রিয়জন অন্য বিছানায় গভীর নিদ্রায় ডুবে আছে। অন্ধকারে আস্তে পা ফেলবো যাতে সে জেগে না ওঠে। ওজুর পানি কী ঠাণ্ডা! কিন্তু তোমার অনুগ্রহ থেকে আমি উষ্ণতা আহরণ করেছি। নামাজ হচ্ছে মিলন এবং নির্বাণ। আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন, যারা তাঁর সঙ্গে মিলিত হতে ভালোবাসে। যেদিন আমি আল্লাহর নিকটতর হতে না পারি, সেদিন আমার জন্য অনুগ্রহের দিন নয়।
অবশেষে আমি উঠলাম, যারা ঘুমিয়ে আছে তাদের জাগানোর জন্য। বাড়ির ক্লান্ত মানুষগুলোর জন্য আমি অ্যালার্ম। আমার মতো বয়সীদের জন্য কোনো কাজ থাকা ভালো। বৃদ্ধ হলেও আল্লাহর রহমতে আমার স্বাস্থ্য এখনও ভালো। এখন আমি বাতি জ্বালিয়ে দরজায় টোকা দিয়ে ডাকতে পারি, ‘ফাওয়াজ,’ তার কণ্ঠে, “শুভ সকাল, আব্বা,” শুনতে না পাওয়া পর্যন্ত আমি ওর দরজায় টোকা দেই।
আমার রুমে ফিরে আমি বাতি জ্বালাই। আমার নাতি গভীর ঘুমে। ওর মুখ ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। ওকে টেনে তুলতে হবে। আমি ওর ওপর ঝুঁকে ফিস ফিস করে ডাকি, “এলওয়ান, ওঠো।” সে চোখ খুলে, হেসে হাই তুলে উচ্চারণ করে, “শুভ সকাল দাদাজি।” এরপর জীবন শুরু হয় বাথরুম ও ডাইনিং রুমের মধ্যে ছুটাছুটি করে। আমি বসে রেডিওতে কোরআন তিলাওয়াত শুনতে থাকি, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমার পুত্রবধূ হানা আমাকে নাশতা টেবিলে ডাকে। জীবনের উপভোগ্য বিষয়গুলোর মধ্যে একমাত্র খাদ্যই আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে রয়ে গেছে। আমাদের জীবনে বৈচিত্র্য অবশ্যই আল্লাহর অপার অনুগ্রহ। হে প্রভু, রোগব্যাধি ও দৈহিক অক্ষমতা থেকে আমাকে রক্ষা করো। কেউ আর কারও সেবা করার মতো অবস্থায় নেই এবং অসুস্থতায় চিকিৎসা করার মতো অর্থও অবশিষ্ট নেই। নাশতার জন্য আছে শিম ও ফালাফেল এবং এ দুটি বস্তু এখন সুয়েজ খালের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। ডিম, পনির, পাস্তরামি এবং জ্যাম খাওয়ার দিনগুলো অতীত হয়েছে। ওসব ছিল আনোয়ার সাদাত এর ‘ওপেন ডোর’ অর্থনৈতিক নীতির আগের কথা। বহু আগে থেকে জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী, সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। শুধু রুটি খেয়ে ফাওয়াজের ওজন বাড়ছে, হানার শরীরও মোটা হয়েছে, অকালে বুড়িয়ে যাচ্ছে। পঞ্চাশ বছর বয়সে তাকে ষাট বছরের মনে হয়।
ফাওয়াজ চেঁচিয়ে বলে, “এখন থেকে কোনো কোনো দিন আমাদের সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করতে হবে। অতএব, আমি আমার চাকরি ছেড়ে দেব।”
আমি অস্বস্তি বোধ করি। সে এবং তার স্ত্রী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। ওদের আয়, আমার পেনশন, এলওয়ানের বেতন মিলিয়ে কোনোমতে আমাদের প্রয়োজন মেটে। সে চাকরি ছেড়ে দিলে কিভাবে চলবে?
“এটা হয়তো অল্প সময়ের জন্য,” আমি কণ্ঠে আশাবাদ এনে বলি।
“আমি তোমার হয়ে কিছু কাজ করবো। তাছাড়া তোমার বিভাগীয় প্রধানের সঙ্গে কথা বলবো,” হানা বলে।
“এর মানে হচ্ছে, আমাকে ভোর থেকে মাঝরাত পর্যন্ত কাজ করতে হবে,” ফাওয়াজ রেগে সাড়া দেয়।
আমরা সবসময় চেয়েছি খাওয়ার সময় আমরা কোনো আলোচনা না করতে চেষ্টা করবো। কিন্তু কিভাবে?
এলওয়ান বলে ওঠে, “আমার প্রফেসরের বাবা অবসর সময়ে ট্যাক্সি চালিয়ে বেশ ভালো আয় করেন।”
“তিনিই কি ট্যাক্সিটির মালিক?” ওর বাবা জানতে চায়।
“আমার তাই মনে হয়।”
“কিন্তু আমি কী করে একটি ট্যাক্সি কিনবো? তোমার প্রফেসরের বাবা কি ধনী অথবা তিনি কি ঘুষ খান?”
সবাই যার যার কাজে চলে যাওয়ার পর বরাবরের মতো ছোট্ট ফ্ল্যাটে আমি একা কাটাই। প্রভু, সময়ের পরিবর্তন থেকে ওদের সকলকে রক্ষা করো। আমাকে তোমার নিরাপত্তা দান করো। আমি বেডরুম, লিভিং রুম গোছাই এবং রেডিও এবং টেলিভিশনে তিলাওয়াত, গান এবং খবর শুনি। ফ্ল্যাটে যদি চারটি রুম থাকতো, তাহলে এলওয়ান একটিতে থাকতে পারতো। সকল প্রশংসা আল্লাহর, আমি তাঁর কর্তৃত্বের ওপর প্রশ্ন তুলতে পারি না।
যে বছর দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে যায়, তখন একদিন বিখ্যাত ধর্মীয় নেতা আবু আল-আব্বাস আল-মুরসি কায়রোর এক বেকারির সামনে ভিড় দেখতে পান এবং তার মন তাদের কাছে চলে যায়। তিনি ভাবেন, যদি তাঁর কাছে কিছু খুচরা মুদ্রা থাকতো, তাহলে তিনি লোকগুলোকে সাহায্য করতে পারতেন। তিনি পকেট ভারি অনুভব করেন, পকেটে হাত দিয়ে কয়েকটি মুদ্রা পান এবং বেকারি মালিককে রুটির দাম দেন, যে রুটি তিনি লোকগুলোর মধ্যে বিতরণ করবেন। তিনি চলে যাওয়ার পর বেকারি মালিক দেখেন মুদ্রাগুলো নকল। লোকটিকে ধরতে পারার পূর্ব পর্যন্ত বেকারি মালিক সাহায্যের জন্য চিৎকার করেন। লোকটি উপলব্ধি করেন মানুষগুলোর জন্য তার করুণার অনুভূতি আসলে মানুষের কাছে আল্লাহর উপায়ের ক্ষেত্রে তার পক্ষ থেকে এক ধরনের আপত্তি। অনুতপ্ত হয়ে তিনি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং শুধু এর পরই বেকারির মালিক বুঝতে পারেন যে মুদ্রাগুলো আদৌ নকল নয় এবং লোকটি আসলেই আল্লাহর খাঁটি বান্দা। যারা পৃথিবীকে পরিহার করে তাদেরকেই পবিত্রতা দান করা হয়। আমার বয়স প্রায় আশি বছর, কিন্তু পৃথিবীকে বর্জন করতে অক্ষম। আমি পৃথিবীকে ভালোবাসি।
আমি কোরআন ও হাদিসে আগ্রহী, ঠিক যেভাবে আমি ‘ওপেন ডোর পলিসি,’ তেল, জিরা ও লেবুর রস মিশ্রিত শিম খেতে আগ্রহী। আমি কখন আল্লাহর ক্ষমাশীলতায় ধন্য হবো, যাতে আমি দূর থেকে আলো দেখতে সক্ষম হই এবং সুইচ স্পর্শ না করেই বাতি জ্বালাতে পারি। আমার একজন মাত্র ভালো বন্ধু আছেন এবং আমাদের মধ্যে ঘুরে ফিরে বার্ধক্যের কথাই আসে। শেষবার আমি পড়েছি, তা এক বছর আগে। আমার ঘুম হয় সামান্য, কিন্তু আমি মৃত্যু নিয়ে ভীত নই। মৃত্যু যখন আসবে, আমি স্বাগত জানাবো।
বাদশাহ ফুয়াদ যখন আমাদের স্কুল উদ্বোধন করতে আসেন তখন শিক্ষকদের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেয়ার জন্য আমাকে ডাকা হয়েছিল। কী ঐশ্বর্যময় একটি দিন ছিল! ছাত্ররা যখন শ্লোগান দিয়েছে, “বাদশাহ ফুয়াদ জিন্দাবাদ, সা’দ জগলুল জিন্দাবাদ!” সেই আনন্দধ্বনি, সেই সঙ্গীত পরিবর্তিত হয়েছে। জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি লাগামহীন হয়ে গেছে। জানালা দিয়ে আমি নীল নদ ও গাছের সারি দেখতে পাই। নীল স্ট্রিটে অবস্থিত আমাদের বাড়িটি সবচেয়ে পুরোনো ও সবচেয়ে ছোট: আধুনিক ভবন সারির মাঝখানে খর্বাকৃতির। আমাদের দুর্দশাও অভিন্ন। দারিদ্র্য সীমাহীন, কত প্রিয়জন মারা গেছেন। বর্ষণের সম্ভাবনা নিয়ে আকাশে যখন মেঘ ঘনীভূত হওয়ার দিনগুলোতে আমরা কানাতের উদ্যানে চলে যেতাম। পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে একত্রে উপাদেয় খাবার ও পানীয় উপভোগ করতাম, রেকর্ড প্লেয়ারে বাজতো পুরোনো দিনের গান। সেই দিনগুলো এখন কঙ্কাল। আমার বিয়ের রাতে তারা সবাই আমার পেছনে সার বেঁধে দাঁড়িয়েছিল, ওই রাতেই আমি প্রথমবারের মতো ফাতেমার নেকাব তুলেছিলাম। শেষবার তোমার কবর জিয়ারতের পর পাঁচ বছর কেটে গেছে।
এলওয়ান ফাওয়াজ মুহতাশিমি
নতুন একটি দিনের সূচনা হয়েছে। যদি পুরোনো কোনোকিছু ভালো না হতে পারে, তাহলে নতুন করে মন্দ কিছু না হোক। একেবারে না থাকার চেয়ে কোনো কিছু থাকা ভালো। মৃত্যু স্বয়ং এক নতুনত্ব। হাঁটা স্বাস্থ্যের জন্য উত্তম এবং মিতব্যয়িতার উপায়। কিন্তু হাঁটতে পা ক্লান্ত হয়, জুতায় পা কাটে। সহ্য করো এবং ধৈর্য ধারণ করো। হে আমার প্রিয়, আগুন ও নিষ্ঠুরতার এই দিনগুলোতে শুধু তুমি ছাড়া কোনো বাতাস হৃদয়কে শীতল করতে পারে না। তা সত্ত্বেও এইসব রাজসিক বৃক্ষ এবং সর্বোপরি নীল নদের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। ওপরের দিকে তাকিয়ে সাদা মেঘ এবং বৃক্ষগুলোর অগ্রভাগ দেখো, তাহলে তুমি মাটির এবড়ো-থেবড়ো ওপরিভাগ ভুলে যাবে। একদিন কোনো নিরীহ শয়তানের সঙ্গে তোমার দেখা হবে এবং তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে। আমি সকল শক্তিসম্পন্ন মন, চারিত্রিক মহত্ত্ব এবং গভীর ভাবনার কাছে মাথা নত করি।
এই পুরোনো বাড়িতে আমি বাস করেছি, যেটি এখন উঁচু উঁচু অট্টালিকার মাঝে হারিয়ে গেছে বাড়িটি, যেন বিত্তবানদের মাঝখানে একজন অনুপ্রবেশকারী। এখানে আমার শৈশব, কৈশোর ও প্রাপ্তবয়স্ক যৌবন কেটেছে। বেড়ে চলা দুর্নীতির মাঝেও প্রেম টিকে থাকা উচিত। ভাঙাচোরা ফুটপাত জুড়ে বিমান হামলার সময় আশ্রয় গ্রহণের নিশানা এখনও বিদ্যমান। আবর্জনার স্তূপ আড়াল করে রেখেছে প্রেমিক-প্রেমিকাকে। সকাল বেলায় যাত্রীতে পূর্ণ বাসের ভাঙা কাচের ভেতর দিয়ে মুখগুলো দেখে কারাগারে দর্শনার্থীদের জন্য লোহার গ্রিলের সামনে ভিড় করে থাকা বন্দীদের মতো দেখায়। পথচারীতে ব্রিজটি পূর্ণ। সাইকেল চালকরা বিন স্যান্ডউইচে কামড় দিতে দিতে প্যাডেলে পায়ের চাপ দিচ্ছে।
আমার দাদা বললেন, “তোমার প্রতিটি সমস্যার সঙ্গে স্বস্তিও আসে।” প্রিয় দাদা, কতদিন পর্যন্ত এসব কথা মুখস্থ করবো এবং অন্যদের বলবো? সে আমার ভালো বন্ধু এবং আমি একজন এতিম। তারা যখন সামান্য উপায়ে জীবিকা নির্বাহের জন্য সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে ছোটাছুটি করে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত টানা কাজের মধ্যে নিজেদের হারিয়ে ফেলেছে, তখন আমি আমার মা-বাবাকে হারিয়েছি। আমাদের হঠাৎ দেখা হয়, তাও খুব স্বল্প সময়ের জন্য।
“অলস দর্শন ফলানোর সময় নেই। তোমরা কী দেখতে পাও না যে আমরা ঘুমানোর সময় পর্যন্ত পাই না?”
আমার কোনো বোন যদি তাদের স্বামীদের সঙ্গে ঝগড়া করে, তখন শুধু আমাকেই পাঠানো হতে ঝগড়া মেটানোর চেষ্টা করতে। আজকাল কেউ আর সহায়তার জন্য কাউকে পায় না। আমাদের সকলকে লড়তে হবে এবং শেষ পর্যন্ত এটা তোমার আর তোমার ভাগ্যের ব্যাপার! এখানে আবার সেই সরকারি খাতের খাদ্যজাত পণ্য প্রস্তুতকারী কোম্পানি, ফটকে বড় করে লেখা, “এখানে প্রবেশ করুন, কিন্তু কোনো আশা করবেন না।” এবং অবশেষে আমার অফিস ‘জনসংযোগ ও অনুবাদ’ বিভাগে বসে থাকতে দেখি আমার প্রেমিকাকে। আমাকে দেখে সে প্রেমপূর্ণ দৃষ্টিতে হাসে।
“তুমি যদি আর কয়েকটা মিনিট অপেক্ষা করতে, তাহলে আমরা একত্রে আসতে পারতাম,” তিরস্কারের সুরে আমি বলি।
“তোমাকে বিরক্ত না করার কারণ ছিল। আমাকে ব্রাজিলিয়ান কফি স্টোর ক্যাফেতে নাশতা করতে হয়েছে,” উৎফুল্লভাবে সে উত্তর দেয়।
আমার দাদাকে ধন্যবাদ যে আমরা একই কোম্পানিতে এবং একই বিভাগে কাজ করতে সক্ষম হয়েছি। আমার কী আসলে অফিসারদের একজনকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত, যিনি একসময় দাদার ছাত্রদের একজন ছিলেন? যারা সাধারণত তাদের পূর্বসূরিদের অবদান মনে রাখতে অভ্যস্ত নয়, তারাও আমার দাদার কাছে তাদের ঋণ স্বীকার করেন। আমাদের বিভাগে অনেক নারী কর্মী আছেন। কাগজের স্তূপ অফিস জুড়ে, কিন্তু সেদিকে আমাদের মনোযোগ নেই। আমি একটু সময় কাজ করি, এরপর আড়চোখে রান্দাকে দেখি। আমি স্বপ্ন দেখি, স্মৃতিচারণ করি। যখন আমরা শিশু ছিলাম তখন একসাথে খেলতাম। আমরা একই বয়সের। কিন্তু মা বলতেন সে আমার চেয়ে বড়, কিন্তু এর কোনো প্রমাণ তার কাছে ছিল না। কৈশোর আসে, আমাদের মাঝে লাজুকতা ও সন্দেহ স্থান করে নেয়। আমার বিবেক আমাকে খোঁচা দেয়, আমার সকল আনন্দ নষ্ট করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভালোবাসা এগিয়ে যায়। মাধ্যমিক স্কুলে সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামার সময়, দুপুরে ক্লাসের বিরতির সময় আমরা কথা বলি। একদিন আমার ভালোবাসার সব কথা লিখে তার হাতে গুঁজে দেই। উত্তরে সে আমাকে ‘দুই প্রজন্মের আনুগত্য’ (দ্য লয়্যালিটি অফ টু জেনারেশনস) নামে একটি উপন্যাস উপহার দেয়। আমরা যখন একই বছর মাধ্যমিক স্কুলের পরীক্ষায় পাস করি তখন দাদাকে বলি যে আমি আমাদের প্রতিবেশী রান্দা সুলায়মানকে বিয়ে করতে চাই।
দাদা আমাকে বলেন যে তার সময়ে কেউ পুরোপুরি নিজের ওপর নির্ভরশীল না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে করার কথা বলতে পারতো না। কিন্তু তিনি আমাকে প্রতিশ্রুতি দেন যে বিষয়টি নিয়ে তিনি আমার বাবা ও মায়ের সঙ্গে কথা বলবেন। মা বলেন যে সুলায়মান মুবারকের পরিবার আমাদের নিজেদের আত্মীয়-স্বজনের চেয়েও বেশি ঘনিষ্ঠ এবং রান্দাকে তিনি তার আপন কন্যার মতো দেখেন। বাবা বলেন, “কিন্তু সে তোমার চেয়ে বয়সে বড় না হলেও তোমার সমবয়সী।”
আমাদের বিয়ের কথা পাকা হয়। তখনকার দিনে স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হতো। কিন্তু যখন থেকে আমরা কাজ করতে শুরু করলাম তখন বেশ কিছু নতুন সমস্যা সামনে এলো। তিন বছর পর আমাদের বয়স ছাব্বিশ বছরে পড়লো। আমি তখন প্রেমে পাগল ছিলাম, কিন্তু দায়িত্বের বোঝায় এখন ক্লান্ত ও অসহায় হয়ে পড়েছি। আমরা এখন আর শুধু কথা বলার জন্য দেখা করি না, বরং আর্থিকভাবে নিজেদের সমর্থন করা, ফ্ল্যাট, ফার্নিচার, একত্রে জীবনযাপনের বোঝা নিয়ে সীমাহীন আলোচনা করি। আমরা কোনো সমাধানে পৌঁছতে পারি না। আমাদের শুধু প্রেম ও দৃঢ়তা রয়েছে। আমাদের বাগদান হয়েছে নাসেরের যুগে এবং এখন আমরা ‘ওপেন ডোর পলিসি’র বাস্তবতা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আমরা এক উন্মাদনাপূর্ণ পৃথিবীর ঘূর্ণিপাকের মধ্যে ডুবে গেছি। আমরা অন্য কোনো স্থানে চলে যাওয়ার যোগ্যও নই। দর্শন বা ইতিহাসে পড়–য়াদের কোনো চাহিদা নেই। আমাদের কর্মচ্যুত হতে হলো। কত বেকার লোক! কিভাবে আমরা এমন এক অবস্থায় নিক্ষিপ্ত হলাম, যেখান থেকে ফেরার পথ নেই? আমি দায়িত্ব ও সন্দেহের বোঝায় পিষ্ট, রান্দা এখনও সুন্দরী ও কাক্সিক্ষত। আমি তার পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছি।
আমি তার বাবা-মা’র ক্রুদ্ধ দৃষ্টি খেয়াল করি। আমার পেছনে কী বলা হচ্ছে তা যেন আমি শুনতে পাই। আমার স্বপ্ন ভেসে যেতে থাকে। কিন্তু দুর্নীতির কথা কে বলবে? আলিয়া সামিহ এবং মাহমুদ আল-মাহরুকি যা বলেন তা বিরক্তিকর। কোন্ কথাটি সঠিক? ১৯৬৭ সালের জুন মাসে আমার প্রিয় নেতার পতনের পর আমি সবকিছু নিয়ে সন্দেহ পোষণ করছি কেন? লোকজন অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল বিত্তের মালিক হওয়ার জাদুকরী তত্ত্ব কোথায় পায়? দুর্নীতি ছাড়া কি এত সম্পদ লাভ সম্ভব? আমি যে এতটা নীতিবান চেষ্টা করছি তার রহস্য কী? এর একটি মাত্র কারণ আমি রান্দাকে বিয়ে করার সামর্থ্য অর্জন করতে চাই।
আমাকে ও রান্দাকে বলা হয়েছে বিভাগীয় প্রধান আনোয়ার আলমের সঙ্গে দেখা করতে। যেহেতু আমরা একসাথে অনুবাদ বিভাগে কাজ করি, সেজন্য দু’জনকে একসাথেই ডাকা হয়েছে। তিনি অমায়িক ব্যক্তি, তবে নিজেকে প্রদর্শন করতে ভালোবাসেন। দীর্ঘ, শীর্ণ, কালো রঙের অন্তর্ভেদী দৃষ্টিসম্পন্ন লোকটির বয়স পঞ্চাশ হতে চলেছে, কিন্তু এখনও বিয়ে করেননি।
আনোয়ার আলম তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললেন, “স্বাগতম বর ও কনে।” তিনি দ্রুততার সঙ্গে আমাদের কাজ দেখার পাশাপাশি মন্তব্য করছিলেন। আমাদের বিয়ে কবে সম্পন্ন হচ্ছে তাও জানতে চাইলেন। এটিকে আমি ধরে নিলাম কর্মচারীদের ব্যক্তিগত জীবনে প্রবেশ করার ব্যাপারে তার নীতি হিসেবে। তাঁর চোখের চাউনিতে স্বস্তি বোধ করছিলাম না। আমি বললাম, “এখন পর্যন্ত আমরা আমাদের সমস্যার কোনো সমাধান খুঁজে পাইনি।”
“সমাধান ছাড়া কোনো সমস্যা নেই,” তিনি বিরক্তিকর ভঙ্গিতে হেসে বললেন। “অসহায় লোকজন কী বলে, তা আমাকে বলবেন না। সমাধানের জন্য কারও মুখাপেক্ষী হবেন না।”
টেবিলে ফিরে এসে আমার বারবার মনে হচ্ছিল যে রান্দার সামনে আমাকে সম্পূর্ণ এক অসহায় মানুষে পরিণত করতে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে কথাগুলো বলেছেন। অফিস ছাড়ার পূর্ব পর্যন্ত তার কথা আমাকে পীড়া দিচ্ছিল। আমরা একসাথে নীল স্ট্রিটে আসার পর আমি রান্দাকে বললাম, “লোকটির কথা আমার ¯œায়ুতে বসে গেছে। তিনি নিজেকে খুব স্মার্ট মনে করেন। তোমার কি মনে হয় যে আমরা এখনও যে সমস্যার মধ্যে পড়িনি, সেই সমস্যার সমাধান রয়েছে?”
রান্দা হেসে বললো, “আল্লাহর ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস রয়েছে, তবুও আমরা বিশ্বাস করতে থাকি যে সবকিছু চিরদিন একভাবে থাকবে।”
আমি দ্বিধাগ্রস্তের মতো বললাম, “কিন্তু সময় দ্রুত অতিক্রান্ত হচ্ছে।”
“হয়তো, কিন্তু প্রেম স্থির!” সে হেসে উত্তর দিল।
রান্দা সুলায়মান মুবারক
আমি অ্যাপার্টমেন্টের সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলাম, আর সে তার ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে নিশ্চিত হতে চাইছিল যে আমি নিরাপদে দরজা পর্যন্ত পৌঁছেছি। নিজের ভাবনায় মগ্ন থেকে উদ্বিগ্নভাবে আমার দিকে চুম্বন ছুঁড়ে বিদায় জানালো। আনোয়ার আলমের কথায় তার বিরক্ত হওয়ার কারণ আছে। তাছাড়া সে সবসময় চিন্তার মধ্যে ডুবে থাকে। আমি তার অবস্থা বুঝতে পারি, কিন্তু সে কি আমাকে বিশ্বাস করে না? দুঃশ্চিন্তা করার আর কোনো সুযোগ নেই। অ্যাপার্টমেন্টে মুলুখিয়া স্যুপের সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে, এবং এতে আমার ক্ষুধার তীব্রতা বৃদ্ধি করেছে।
বাবা কি সোফার ওপরই ঘুমিয়ে পড়েছেন? না, আমাকে দেখে তিনি হাসলেন। মা জানালেন, খাবার রেডি। আমি মুলুখিয়া স্যুপ পছন্দ করি, ক্ষুধার কথা তেমন ভাবি না। মা প্রায়ই বলেন, “কেউ যখন হালকা-পাতলা থাকে, সে রোগ-ব্যাধির সঙ্গে লড়তে পারে না।”
আমি উত্তর দেই, “মোটা হওয়া আরও বিপজ্জনক।” মা সবসময় মোটা ছিলেন এবং মোটা হওয়ার কারণে তাকে সোফায় বসে নামাজ পড়তে হয়। আমি খাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক। মা নিজেকে আর্থিকভাবে সচ্ছল মনে করেন, কারণ তাঁর মাসিক আয় পঁচিশ পাউন্ড। কাহিনিতুল্য দিনগুলোর কথা বলার অধিকার তাঁর আছে। কিন্তু এখন তাঁর আয়, বাবার পেনসন এবং আমার বেতন মিলিয়ে কী হয়!
খাওয়ার সময় বাবা তাঁর নকল দাঁত ব্যবহার করেন। তিনি ধীরে শুরু করেন, প্রচণ্ড ঠাণ্ডার ব্যাপারে অভিযোগ করেন। আমার তালাকপ্রাপ্তা বোন সানা আমার রুমে থাকে। সে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সেক্রেটারিয়েল কোর্স করছে, যাতে সে একটি কাজ জোগাড় করতে পারে। কারও ওপর বোঝা হতে চায় না সে। খেয়ে আমি বিছানায় শুয়ে আবারও ছুঁড়ে দেওয়া চুমুর কথা ভাবি। এটা আমি পছন্দ করি না। আমার কাছে অপমানজনক মনে হয়। সে যদি এমন করতে থাকে তাহলে আমি খোলাখুলি তাকে বলবো, যে যদি আসলেই চুম্বন অনুভব না করে এবং আমার প্রতি প্রেমের অনুভূতি ছাড়া অন্য চিন্তায় মগ্ন থাকে, তাহলে যাতে এভাবে আমাকে চুম্বন ছুঁড়ে না দেয়। প্রেম ছাড়া আমাদের আর কী আছে? আমি এমনভাবে তার খেয়াল করি, যেন আমি তার মা এবং সে বখাটে, ক্রদ্ধ সন্তান। আহা, সে যদি শুধু একজন ইঞ্জিনিয়ার হতো! তাহলে সে ‘ওপেন ডোর পলিসি’র শিকার না হয়ে হয়তো সামনের সারির কেউ হতে পারতো। সে ১৯৬৭ সালের জুন মাসের ঘটনা এবং পরাজিত বীরের নিরুদ্দেশ হওয়ার ঘটনারও শিকার। এখন সে দ্বিধাগ্রস্ত এবং নির্বিকার। কিন্তু এভাবে আর কতদিন চলবে? যারা তাকে অতিক্রম করে গেছে, তাদের প্রতি সে ক্ষুব্ধ এবং সে বিশ্বাস করে যে তার সঙ্গে অন্য যারা কাজ করে তাদের সবার চেয়ে সে বেশি যোগ্যতার অধিকারী। কেন? কখন থেকে সে নিজেকে এভাবে দেখতে শুরু করেছে?
হতে পারে যে এটাই আমার কাজ, কিন্তু যে বিষয়টি নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন বোধ করি, তা হলো আমাদের প্রেম। আমি তাকে ভালোবাসি এবং ভালোবাসা কোনো যুক্তি মানে না। আমি আমার হৃদয় ও আত্মা দিয়ে তাকে চাই। কিভাবে? কখন? আমার বোন সানা প্রেম করে বিয়ে করেছিল, সে তার মাধ্যমিক স্কুলের সার্টিফিকেটে, একজন গৃহবধূ হিসেবে এবং একজন বিত্তবান তরুণ ভদ্রলোককে নিয়ে সুখী ছিল। কিন্তু এসবে কাজ হয়নি এবং প্রেম নিঃশেষ হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে যা ঘটে, অভিযোগের আঙুল ওঠে প্রতিপক্ষের দিকে। আমার বোন তুচ্ছ বিষয়েও আগ্নেয়গিরির মতো বিস্ফোরিত হয়। কে এসব সহ্য করতে পারে? সেজন্য আমি আমার খাদ্যাভ্যাসে সতর্ক থাকার মতোই চেষ্টা করি যাতে আমার মেজাজ খারাপ না হয়। সময়ের চাবুকের আঘাতের বিরুদ্ধে সৌন্দর্য কতক্ষণ প্রেমকে আটকে রাখতে পারবে?
আমার স্বপ্ন আমাকে ঘুমের জগতে নিয়ে গিয়েছিল। বিকেলে ঘুম ভাঙলে আমি জোহর ও আসর নামাজ একসাথে পড়লাম। এজন্য আমি মায়ের কাছে কৃতজ্ঞ, তিনি আমার ধর্মীয় শিক্ষক। বয়সের অনেক ব্যবধান এবং নাস্তিক হওয়া সত্ত্বেও বাবার সঙ্গে মা অত্যন্ত সুখী? তোমার কি মনে আছে যে যখন তুমি ছোট ছিলে তখন কিভাবে তোমার বাবাকে তিরস্কার করতে?
“বাবা, আপনি আমাদের সবার মতো রোজা রাখেন না কেন? আল্লাহকে কি আপনি ভয় করেন না?”
“স্বাস্থ্যগত কারণে, আমার প্রিয় কন্যা। এ ব্যাপারে অন্য কিছু ভেবো না।”
“নামাজের কথা কী বলবেন?”
“তুমি যখন বড় হবে তখন আমি তোমাকে এ সম্পর্কে বলবো।”
আমার প্রেমিকের সঙ্গে বিষয়গুলো এমন নয়। তার দাদা, বাবা ও মা নামাজ পড়েন ও রোজা রাখেন। আমার বাবার নাস্তিকতা আগের মতোই আছে। তিনি কোনো সন্দেহবাদী কথা বলেন না, কিন্তু তার আচরণেই নাস্তিকতা সুস্পষ্ট। তিনি যখন রেগে যান তখন ধর্মকে অভিশাপ দেন। তিনি হয়তো আমার কারণে অথবা আমার মায়ের কারণে কখনও আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন, কিন্তু সেটিও তার অন্তর থেকে আসে না। একেবারেই শূন্যগর্ভ উচ্চারণ। আমার প্রেমিকের অবস্থা কী? সে কি ধার্মিক? অধার্মিক? প্রতিশ্রুতিশীল? আলিয়া সামিহ? মাহমুদ আল-মাহরুকি? সে আমার প্রেমিক এবং সেটুকুই যথেষ্ট। বাদবাকি আমার ভাগ্যের ব্যাপার। সে সবসময় হারানো কিছু খুঁজে বেড়ায়। আমাদের সমস্যার কি কোনো সমাধান আছে?
আমরা একসাথে ড্রয়িং রুমে বসি। আমার বাবা তাঁর দুর্বল শরীর, তাঁর বয়সের সমস্যা ও তাঁর নাস্তিকতার পথ নিয়ে, মা তাঁর মেদ-বাহুল্য এবং অন্যদের ব্যাপারে উৎকণ্ঠা নিয়ে, সানা তার ভাগ্য ও বিচ্ছিন্নতার বেদনার অনুভূতির অসন্তুষ্টি নিয়ে এবং আমি আমার স্থায়ী সমস্যা নিয়ে। আমার বাগদানের এগারো বছর কেটে গেছে। এখনও কি আশা করার মতো কিছু অবশিষ্ট রয়েছে?
“এভাবেই বিধবা না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে, তখনও তাকে বাগদত্তাই থাকতে হবে,” সানা তীক্ষè কণ্ঠে বলে।
“এ ব্যাপারে তোমার মাথা না ঘামালেও চলবে,” আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলি।
“রান্দা, ওকে সবসময় স্মরণ করিয়ে দেবে, তা না হলে সে ভুলে যাবে,” মা বলেন।
“আমরা সবসময় আমাদের চিন্তা নিয়ে কাটাই, অতএব ওকে মনে করিয়ে দেওয়ার কারণ নেই।” আমি তীক্ষè কণ্ঠে উত্তর দেই। “আমারও বয়স হয়েছে এবং আমি নিজের ইচ্ছায় সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি কোনো কিছু নিয়ে অনুশোচনা করি না।”
“নিজের ভালো বোঝার মতো যথেষ্ট বয়স রান্দার হয়েছে, সে নিজের খেয়াল রাখতে পারবে,” বিরক্তির সুরে বাবা বলেন।
মা অনুতাপ করে বলেন, “আমরা অনেক ভালো সুযোগ হারিয়েছি।”
আমি অহঙ্কারের সঙ্গে বলি, “আমি বাজারে বিক্রয় করার মতো কোনো দাসী নই।”
“আমি তোমার মা এবং ত্রুটিহীন। পুরোনো ধারায় আমার বিয়ে হয়েছে এবং টিকে আছে, সেজন্য আল্লাহর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ যে আমি একজন ভালো স্বামী পেয়েছি,” মা বলেন।
আমাকে আবারও বলতে হয়, “মা, দেখুন, প্রতিটি যুগের আলাদা একটি ধরন থাকে, কিন্তু সকল সময়ের চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক এক সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি।”
“এমন একটি সময় ছিল যখন মানুষ কুকুর, গাধা, এমনকি নিজের সন্তানদের খেয়ে ফেলতো,” বাবা হেসে বলেন। “এরপর মানুষ একজন আরেকজনকে খেতে শুরু করে।”
আমি তিরস্কারের কণ্ঠে বলি, “আমরা মানুষ খাওয়ার যুগ পার হয়ে এসেছি, ভালো কিছু আশা করতে পারি।”
প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বাবা আমাদের থামিয়ে দেন। তার প্রিয় টিভি সিরিজ শুরু হয়েছে। আমার ভাবনায় আমার প্রেমিক ফিরে আসে। আমি স্বপ্নভরা চোখের নারীতে রূপান্তরিত হই, যেন আমার মাঝে বিবাহিত জীবনে গভীর উপলব্ধি রয়েছে। আমি অশ্রু দমন করি। তাকে ছাড়া কি আমার জীবন সম্ভব? টিভি সিরিজের নায়কেরা আসলেই ভাগ্যবান। তারা তাদের যেকোনো সমস্যার সমাধান খুঁজে পায়।
মুহতাশিমি জায়েদ
আমি নিঃসঙ্গতার সময়ে আমি অপেক্ষা করি। আমার ক্ষীণ শরীরে ভালো করে আলখিল্লা জড়িয়ে নেই এবং আমার চুলশূন্য মাথায় টুপি ঠিক করি। আমি আমার গোঁফে তা দেই এবং আমার নিঃসঙ্গতার সময়ে আমি অপেক্ষা করি। আল্লাহ একজন মানুষকে যতটা দিতে পারেন তার চাইতে বেশি চাইতে বলেন না। দরজায় বেল বাজে, দরজা খুলে দিলে মোটাসোটা গড়নের উম্মে আলী প্রবেশ করে আমি কেমন আছি জানতে চান।
“আল্লাহর ইচ্ছায় আমি ভালো আছি, উম্মে আলী।”
“মনে হয়, এবার শীতকাল আমাদের ছেড়ে যাবে না।”
যার কাছে সময় মানেই অর্থ, তিনি তার ওভারকোট খুলে দরজার কাছে হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে ফাওয়াজ ও হানা’র রুমে যায়। আমি তাকে অনুসরণ করি, আমাকে তাই করতে বলা হয়েছে। একটি চেয়ারে বসে তার মেঝে ঝাড়– দেওয়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা এবং সবকিছু গুছিয়ে রাখা লক্ষ্য করি। মোটা হলেও মহিলা কর্মঠ এবং চটপটে। সে চুরি করতে পারে বলে সবাই সন্ত্রস্ত থাকে। অতীতের কোনো কারণে অযৌক্তিক সন্দেহ। উম্মে আলীর ঘণ্টাগুলো অর্থের মতো মূল্যবান। সে মৌমাছির মতো এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি যায়। আমাদের সকলের মিলিত আয়ের চেয়ে তার একার আয় অনেক বেশি। কিন্তু আমি তার সঙ্গে একা কাটানো উপভোগ করি। এটি সাপ্তাহিক একটি পরিবর্তন, যা আমাকে অতীত দিনের স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। তার সঙ্গে একা কাটাতে আমার দৈনিক কর্মসূচিতে বিঘœ ঘটে।
অতএব আমাকে সময় ভাগ করতে হয়েছে, পুরোনো ‘আমি’ মুখোমুখি হয় বর্তমান ‘আমি’র, কিন্তু দুটি ভিন্ন ভাষায় যোগসূত্র স্থাপনে ব্যর্থ হয়। পুরোনো চেতনা ফিরে এলে মুহূর্তের জন্য হৃদস্পন্দন থেমে যায়। উম্মে আলী যখন কার্পেট মেলার জন্য সামনের দিকে ঝুঁকে, তখন আমি কল্পনা করি যে আমি তাকে আলতোভাবে একটি চিমটি কেটেছি; এটি শুধু কল্পনা, কারণ আমি নিজের ওপর পুরো নিয়ন্ত্রণ রেখেছি। আমার ব্যাপারে তার কোনো ধরনের সন্দেহ নেই। কারণ শক্তি, সামর্থ্য ও একগুঁয়েমির দিক থেকে সে অনেকটা পুরুষের মতো। হে খোদা, আমরা ভুলে গেলে বা ভুল করলে তুমি ক্ষমা করো।
তার সঙ্গে একা সময় কাটানো উপভোগের সময় তার স্বামী ও সন্তানদের খোঁজখবর নেই। সে আমার খোঁজ নেয়।
কী করে তাকে বলি যে তার সঙ্গে একা কাটানো আমি কতটা পছন্দ করি। আল্লাহ ক্ষমা করুন। দুই পাশে গাছের সারি শোভি খয়রাত স্ট্রিটের কথা মনে পড়ে, কেমন চমৎকার ছিল দিনগুলো। ফিকরিয়া ও রাতিবা নামের দুই নার্সের কথা ভাবি। মওসুম অনুযায়ী জীবন উপভোগ করতাম, প্রতিটি ঋতুর বিশেষ বৈচিত্র্য ছিল। যারা জীবন যেমন ঠিক সেভাবে উপভোগ করেছে আল্লাহ তাদের আশীর্বাদ ধন্য করেছেন। একদিন রান্দার পিতা সুলায়মান মুবারকের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি বলেন, “মুহতাশিমি, আপনি এখনও সুঠাম দেহের অধিকারী, আমি আপনাকে ইর্ষা করি।”
“জনাব সুলায়মান, এটি বংশধারা ও বিশ্বাস থেকে পেয়েছি,” আমি আস্থার সঙ্গে বলি। তিনি কুশলীর মতো প্রশ্ন করেন, “আমাকে কি বুঝতে হবে যে আপনার মতো ব্যক্তিরা রূপকথায় বিশ্বাস করেন?
“আল্লাহ যাকে খুশি তাকে তাঁর নির্দেশনা প্রদান করেন।”
“এ কথা দ্বারা কি এমন বোঝা যায় যে অতীত দিনে আপনি নাস্তিক ছিলেন?”
“উত্তরাধিকার হিসেবে বিশ্বাস, সন্দেহ, নাস্তিকতা, যুক্তিবাদ, সন্দেহবাদ পেয়েছি এবং অবশেষে আবার বিশ্বাসে ফিরে এসেছি। এ ছাড়া জীবন পরিপূর্ণ হতো না।”
আমি আমার অটলতায় গর্বিত, কোনো কিছু না পেলেও সুখী এবং সত্যের উপাসক। আমি জয়নাবকে অনুরোধ করেছিলাম যে যখন সময় আসবে, তখন কোনো মৃত্যু সংবাদ দেওয়া উচিত নয়, কোনো জানাজা, দাফন নয়, এবং কোনো শোক জ্ঞাপন নয়।
“সব কথার মর্ম হলো, তুমি বার্ধক্যে উপনীত হয়েছো এবং মৃত্যু এখন নিকটে।” নিষ্ফল একটি বক্তব্য : বলো, সত্য সমাগত এবং মিথ্যা দূরীভূত। মিথ্যাকে মুছে ফেলার জন্য তাড়া করা হয়েছে। আমার বন্ধু এক শূন্য জগতে বাস করছেন, আর আমি ভালোবাসা দ্বারা পরিপূর্ণ এক জগতে। আল্লাহ না করুন! উম্মে আলীর আগমন হলেই বা কী লাভ। এলওয়ানের কী হবে? সে তো বদমাশদের তামাশার মধ্যে হারিয়ে গেছে।
আমি তার সঙ্গে এই আশায় পুরোনো সুখকর দিনগুলো কথা বলি যে শেষ পর্যন্ত কৌতুকাভিনেতার শ্লোগান পরিহার করবে। কী সব অর্থহীন শ্লোগান! উম্মে আলী তার কাজে ব্যস্ত। সে তার হাত মুখ ধুয়ে ওভারকোট পরে এবং হাতঘড়িতে সময় দেখে তার পাওনা হিসাব করে। আমি তাকে প্রাপ্য অর্থ বুঝিয়ে দেই এবং আমার কল্যাণ কামনা করে চলে যায়।
আমি আমার একাকিত্বে ফিরে আসি। বাইরে বের হওয়া আমার জন্য ঘরের মধ্যে পায়চারি করি। রেডিও-টেলিভিশনে কোরআন তিলাওয়াত ও গান শুনি। যে রেডিও ও টেলিভিশন আবিষ্কার করেছে, আল্লাহ তার ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ বর্ষিত হোক। ঢেঁড়স ও নুডলস দিয়ে লাঞ্চ সেরে নেই। আল্লাহ আমাকে নামাজ পড়ার মধ্যে আনন্দ দিয়েছেন। আহার্য গ্রহণের মধ্যেও আমাকে আনন্দ থেকে বঞ্চিত করেননি। চারপাশে লাখো মানুষের ভিড়ে আমি কোন্ নিঃসঙ্গতার কথা বলছি? আমি জীবনকে ভালোবাসি, কিন্তু যখন মৃত্যু আসবে তখন মৃত্যুকে স্বাগত জানাবো। আমার অনেক সাবেক ছাত্র এখন মন্ত্রী হয়েছে! ইসলামে সন্ন্যাস নেই। জীবন তো গ্রীষ্মে তাপদগ্ধ দিনে গাছের ছায়ায় হাঁটার চেয়ে বেশি কিছু নয়। আমি অনেক সময় আমার প্রিয় নাতিকে অতীতের কাহিনি বলি এবং আশা করি যে মুহূর্তের জন্য হলেও সে তার দুঃখগুলো ভুলে থাকবে। আমি তাকে পড়তে উৎসাহিত করতে চেষ্টা করি, কিন্তু সে সামান্য পড়াশোনা করে। আমার কথা সে অবাক হয়ে শোনে, যেন আমার কথা সে বিশ্বাস করছে। পরিস্থিতি কি তোমাকে তোমার দেশ ও গণতন্ত্রের ওপর তোমার বিশ্বাসকে হ্রাস করেনি? যে বীরের মৃত্যু ঘটেছে এবং নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে তার প্রতি এত সংলগ্নতার অর্থ কী?
“দাদাজি, এর কারণ হলো, পৃথিবীকে যাতে আমার কাছে শূন্য মনে না হয়,” সে বলে। অথচ আমি তার মনোযোগ আকৃষ্ট করতে চেষ্টা করি পরম সৌন্দর্যের প্রতি।
সে হাসে এবং বলে, “আমি এখন শুধু একটি অ্যাপার্টমেন্ট এবং ভালো যৌতুক লাভ।”
আমি যখন আমার প্রিয় নাতির কথা ভাবি তখন কিভাবে আমার পক্ষে পৃথিবীর দুঃখ-যাতনাগুলো ভুলে যাওয়া সম্ভব? পবিত্র মানুষের অলৌকিকত্ব সত্যি বিস্ময়কর জিনিস!
এলওয়ান ফাওয়াজ মুহতাশিমি
আমাদের সময়ই আমাকে ভাবতে শিখিয়েছে। সবকিছুর ব্যাপারে নির্বিকার হতে এবং সবকিছুতে সন্দেহ পোষণ করতেও শিখিয়েছে আমাদের সময়। চেতনা জাগ্রত করে বা আশাবাদ জাগায়, এমন কোনো বিষয়ে কখনও পাঠ করলে কিছুদিন পরই দেখা গেছে সত্য কোনো নোংরা কৌশলের মতোই তিক্ত। কারও কি উচিত জাহাজ ডুবতে দেওয়া? আমাদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে মাফিয়ারা। সুন্দর পুরোনো দিনগুলো কোথায়? আমি নিজেও ভালো দিন দেখেছি, যখন আমার বোনেরা আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে থাকতো এবং জীবন পরিপূর্ণ ও উষ্ণতায় ভরা ছিল। বাড়িতে বাবা মার উপস্থিতিও অনুভব করতে পারি। ওই সময়ে পড়াশোনায় উত্তেজনা এবং বীরত্বের প্রতি মোহমুগ্ধতা ছিল। আমরা মানুষের হৃদয় থেকে বন্ধু বাছাই করতাম। ভালোবাসা ছিল আশায় মোড়ানো গোলাপের তোড়া। আমরা আমাদের প্রথম নেতা, প্রথম জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পীকে হারিয়েছি। আরেকজন নেতা, যিনি সম্পূর্ণ বিরোধী আসেন পরাজয় থেকে আমাদের মুক্ত করতে এবং তা করতে গিয়ে আমাদের জন্য তার আনন্দকে ধ্বংস করেন। দুটি পরাজয়ের জন্য একটি বিজয়। মানুষের হৃদয় থেকে আমরা আপনাকে নির্বাচন করেছিলাম।
আমার প্রেমিকা পানি থেকে বড়শি টেনে তোলে, বড়শি শূন্য, কিন্তু তা আমার বৃদ্ধাঙ্গুলিতে বিঁধে যায়। সেই ক্ষতচিহ্ন এখনও রয়ে গেছে। আমাদের বাড়ির সামনে নীল নদের তীরে আমি তাকে বলেছিলাম যে বড়শিতে মাছ ধরতে দক্ষ নয়, কিন্তু আগের মতোই আমাকে বড়শিতে গেঁথে ফেলে এবং আমার রক্তক্ষরণ ঘটে। বন্ধুত্ব প্রেমে রূপান্তরিত হওয়ার ধীরে পরিবর্তন আসে, বসন্তের সূচনায় সহসা গাছে পাতা গজানোর মতো, যা মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করলেই শুধু চোখে পড়ে। নারীত্ব হচ্ছে গালের লালিমা, অন্তর্বাসে সূক্ষ্ম সূচিকর্ম; একটি ভাষা, যা শব্দে এক অর্থ, কিন্তু মর্মার্থ ভিন্ন। অনভিজ্ঞতা পথ করে কথা বলা ও অনুনয়ে। আমাদের দুই পরিবার অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়ে। তোমার সৌন্দর্যের সঙ্গে মানানসই জামা পরিধানে তোমার অসামর্থ্যে আমার দুঃখ হতো। সামনে আরও কত দায়িত্ব পড়ে আছে।
একদিন পিরামিড রেস্টহাউজে তাকে বলি, “চলো আমরা আমাদের দুশমনের সংখ্যা গণনা করে মজা করি।”
“ওপেন ডোর পলিসির দানব এবং এক্সপার্ট নামের বদমাশগুলো,” খেলায় অংশ নিয়ে সে বলে।
“দশ লাখ মানুষ মেরে ফেলতে পারলে কি ভালো হয়?”
“মাত্র একজন লোককে হত্যা করাই যথেষ্ট!” সে হেসে বলে।
“আজ তুমি রান্দা আল-মাহরুকি,” আমিও তার হাসিতে যোগ দেই।
আমার ঊর্ধ্বতন অফিসার আনোয়ার আলম আমাকে তার রুমে ডেকে বিকেল পাঁচটায় তার বাড়িতে যেতে বলেন, বার্ষিক হিসাব চূড়ান্ত করার আগে চুলচেরা যাচাই করার জন্য। আমি রান্দাকে বলার পর সে কোনো মন্তব্য করেনি।
ডোককি’তে সেতুর মুখোমুখি নতুন এক ভবনে তার অ্যাপার্টমেন্ট। তিনি আমাকে স্বাগত জানান। “আমার ফ্ল্যাটের জাঁকজমক দেখে চমকে যাবেন না। আমার বোন আমার সঙ্গে থাকে এবং সে একজন বিত্তবান বিধবা,” তিনি আমার সম্ভাব্য সন্দেহ দূর করতে চেষ্টা করেন। এখন সবাই সন্দেহভাজন। আমরা রাত আটটা পর্যন্ত কাজ করি। তার বিধবা বোন চা পরিবেশন করেন। তিনি পরিচয় করিয়ে দেন, “আমার বোন গুলিস্তান।” চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়সী হবেন, দেখতে মন্দ নন, একটি মুটিয়ে যেতে শুরু করলেও আকর্ষণীয়া। তিনি তার ভাইকে উদ্দেশ করে বলেন, “আপনার মেহমানকে ডিনার করে যেতে বলুন।” আনোয়ার আলম বলেন, “এটি একটি আদেশ।”
ডিনারের সময় আনোয়ার আলম বলেন, “আমি তার বিষয়-সম্পত্তি দেখাশোনা করি, স্বামীর কাছ থেকে দুটি বিল্ডিং এবং শেয়ার সার্টিফিকেট পেয়েছে উত্তরাধিকার সূত্রে।”
তার বোনের মালিকানায় কী আছে তা তিনি আমাকে জানাতে চান। এর একাধিক কারণ থাকতে পারে বলে কল্পনা করলাম। এরপর তিনি তাকে আমার বাগদানের সম্পর্কিত সমস্যাগুলো বর্ণনা করে বললেন, “বিষয়টি আরও জটিল হয়েছে, কারণ এলওয়ান একজন নীতিপরায়ণ মানুষ!”
“শুনে ভালো লাগলো। পৃথিবীতে নীতিবান হওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ,” তার বোন প্রশংসার সুরে সাড়া দিলেন। তার কণ্ঠে আন্তরিকতা রয়েছে। তাকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় মনে হলো। আনন্দিত হলে আমি বারুদে পরিণত হই। আমার তো আসলেই সমস্যা রয়েছে। আনোয়ার বলেন, “আমার বোন একটি দিক ছাড়া সকল দিক থোকে খাঁটি, এবং তা বিয়ে বিয়ের একাধিক ভালো প্রস্তাব সে নাকচ করে দিয়েছে।”
“আমি কেনাবেচার বস্তু হওয়ার মতো নই, তাছাড়া ওদের কেউ মানুষ ছিল না, এখন কোনো পুরুষকে বিশ্বাস করা যায় না,” তিনি শান্তভাবে বলেন।
প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য আমি আনোয়ার আলমকে বলি, “কিন্তু স্যার, আপনি এখনও বিয়ে করছেন না কেন?” তিনি উত্তর দেন, “এর পেছনে অনেক কারণ আছে।” এরপর তিনি আমার ও রান্দা’র পরিবার সম্পর্কে জানতে চান। আমি খোলামেলা হলেও তার প্রশ্ন আমার ভালো লাগেনি।
তিনি বলেন, “রান্দা চমৎকার মেয়ে, তার জন্য ভালো সময় আসছে।” আমার কাছে ছুরিকাঘাতের মতো মনে হলো। তার কথা কি ইচ্ছাকৃত অথবা আকস্মিক। আমার সন্ধ্যাটা বরবাদ হয়ে গেল। আমি বিদায় নিলাম।
রান্দা সুলায়মান মুবারক
আমার অনুবাদ করা চিঠিগুলোতে আনোয়ার আলম স্বাক্ষর করেছেন। আমি যখন ফিরে আসছিলাম তখন তিনি তার রিভলভিং চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, “মিস রান্দা, আমি একটি কথা বলবো, তাতে আপনি আগ্রহী হতে পারেন।” আমি অবাক হলাম, কী কথা হতে পারে।
“মেয়েটি তরুণী ডাক্তার, বহু বছর আগে তার বাগদান হয়েছিল তারই সহকর্মী এক ডাক্তারের সঙ্গে। কিন্তু একসময় বিয়ের ব্যাপারে হতাশ হয়েছে তারা সিদ্ধান্ত পাল্টায়। এরপর মেয়েটি উইকালাত আল-বালাহ’র এক ধনী ব্যবসায়ীকে বিয়ে করে এবং বাড়িতে সাধারণ গৃহবধূ হিসেবে থাকবে বলে সম্মত হয়,” তিনি বললেন।
“আপনার কেন মনে হলো যে এই কাহিনি আমার ভালো লাগবে?” আমি শান্তভাবে বললেও তিনি গল্পটি আমাকে বলায় আমি বিস্মিত ও বিরক্তি বোধ করেছিলাম।
আমার প্রশ্ন অগ্রাহ্য করে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, “মহিলা ডাক্তার সম্পর্কে আপনার কী মনে হয়?”
“যার পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি কিছু জানি না, আমার পক্ষে তার ব্যাপারে মন্তব্য করা সম্ভব নয়,” আমি উত্তর দেই।
“আমি তাকে স্মার্ট মনে করি। একজন অবিবাহিতা ডাক্তার হিসেবে থাকার চেয়ে গৃহবধূ হওয়া অনেক ভালো সিদ্ধান্ত।”
চরম বিরক্তির মাঝে বিদায় নিলাম। তিনি আমাকে এমন দৃষ্টিতে দেখেন, যা সহ্য করা যায় না। লোকটি আমার ও এলওয়ানের জন্য বোঝা।
শুক্রবার সকালে আমরা পিরামিড রেস্টহাউজে গেলাম। সেটি আনোয়ার আলমের বাড়িতে এলওয়ানের যাওয়ার পর। চা পান করার সময় আমি প্রশ্ন করি, “মহামান্য ডাইরেক্টরের বাড়িতে তোমার কেমন সময় কাটলো?” সে আমাকে বিস্তারিত বললো, যা আমার সুন্দর সকালটি নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট ছিল। আনোয়ার আলম তাকে কাজের অসিলায় ডাকলেও অন্য উদ্দেশ ছিল। আমি বিদ্রƒপের সঙ্গে প্রশ্ন করি তার বোনটি কেমন?”
“মর্যাদাবান এবং বাস্তববাদী। একজন সন্তান যেমন তার নিজ মাকে শ্রদ্ধা করে, আমিও তাকে অনুরূপ শ্রদ্ধা করি।”
“এবং তিনি তোমার সঙ্গে তার সন্তানের মতো আচরণ করেছেন,” আমি শীতল কণ্ঠে বলি।
সে প্রতিবাদ করে, “রান্দা, তুমি আমাকে অভিযুক্ত করে বিচার করছো।”
এরপর আমি তাকে অফিসে আমাদের মধ্যে কী কথা হয়েছে তা বললাম। সে চিৎকার করে উঠলো, “আমি তাকে বলবো আমাদের কোনো বিষয়ে নাক না গলাতে।” আমি তাকে অগ্রাহ্য করতে বলি। লোকটি আমাদের দু’জনের অসহায় পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করতে চাইছে।
আমরা একজন আরেক জনকে অত্যন্ত ভালোবাসি এবং আমাদের আকাক্সক্ষা আমাদের কথায় প্রতিধ্বনিত হয়। খুব কম বয়সেই আমার মাঝে প্রচণ্ড আত্মনিয়ন্ত্রণ বোধ সৃষ্টি হয়েছে। আমি আমার অদম্য ইচ্ছাগুলো পূরণে সবসময় জয়ী হয়েছি।
মুহতাশিমি জায়েদ
গত রাতে আমি আমাদের ওস্তাদ আবু দারকে স্বপ্ন দেখেছি। ইবাদত আমার দৃষ্টিকে একটি সুনির্দিষ্ট স্বচ্ছতা দিয়ে ধন্য করেছে। কিন্তু আমি যেহেতু পৃথিবীকে ভালোবাসি, সেজন্য আমি নিজেকে অপর পাশে নিয়ে যেতে পারি না। হঠাৎ একটি গল্প মনে পড়লো: মুহাম্মদ ইবনের আল-আত্তার বলেছেন, “একদিন শেখ মুহাম্মদ রাহিন আমাকে বলেন, ‘আপনার হৃদয়টা কেমন?’ কথাটি যখন সেখানে উপস্থিত আমাদের ওস্তাদ শাহ নকশবন্দকে বলি, তিনি হঠাৎ আমার পা মাড়িযে দেন এবং আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। অচেতন অবস্থায় আমার হৃদয়ে ঘনীভূত সকল অস্তিত্বকে দেখানো হয়। আমি যখন চেতনায় ফিরে আসি, তখন তিনি বলেন, ‘হৃদয় যদি এমন হয়, তাহলে কিভাবে এর পরিমাপ পৌঁছা সম্ভব?’ সেজন্য হাদিসে আমাদের বলা হয়েছে, ‘পৃথিবী অথবা আকাশ আমাকে ধারণ করতে পারে না। কিন্তু বিশ্বাসী নামাজির হৃদয় তা ধারণ করতে পারে।’”
এই গল্প মনে পড়লে দরবেশদের প্রতি আমার ইর্ষা জাগে এবং আমি কামনা করি যে অলৌকিক কিছু ঘটুক। কিন্তু আমি সুফিবাদের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি, ইবাদতের আনন্দ আঁকড়ে ধরে পরিতৃপ্ত বোধ করছি যে এখানেই আল্লাহর পৃথিবীর হৃদয়। আমার কল্পনা পরম দাতার আলোতে ¯œাত। আমি যে জীবন অতিক্রম করে এসেছি তাতে আমার অনুশোচনা করার কিছু নেই, কারণ জীবনের প্রতিটি পর্যায় আমাকে এর নিজস্ব আলো দান করা হয়েছে। পৃথিবীতে তুমি এমন ভাব দেখাও যেন তুমি চিরকাল বেঁচে থাকবে এবং পরকালের কথায় এমন করো যেন তুমি আগামীকালই মারা যাবে।
দুপুরের দিকে দরজার ঘণ্টি বাজে। কে হতে পারে? আজ তো উম্মে আলীর আসার কথা নয়। দরজা খোলার পর রান্দার মা জয়নাব হানিম ঘরে প্রবেশ করে। সোফায় বসে তিনি বলেন, “মুহতাশিমি বে, আপনি ছাড়া আমাকে উদ্ধার করার কেউ নেই।” আমি অবাক হয়ে বলি, “আমরা সবাই আল্লাহর হাতে।”
তিনি এলওয়ান ও রান্দার সমস্যা নিয়ে কথা বলতে এসেছেন, “আপনিই বলুন মুহতাশিমি বে, মেয়েটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। আপনারা আমাদের অতি পছন্দের মানুষ। কিন্তু রান্দাকে আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে?” আমার প্রিয় নাতিকে কেন্দ্র করে যে বিপদ আমি তা আঁচ করতে পারি। কিন্তু রান্দা ভালো মন্দ বিচার করার জন্য যথেষ্ট বয়স্ক এবং যথেষ্ট শিক্ষিত, আমি তাকে সে কথা বলি।
“কিন্তু মুহতাশিমি বে, প্রেম বিভ্রান্ত করে এবং আজকাল প্রেম ঈশ্বরে পরিণত হয়েছে। আপনি কি প্রেম করে বিয়ে করেছেন? ফাওয়াজ বে কি প্রেম করে বিয়ে করেছে?” তিনি জানতে চান। আমার দীর্ঘনিঃশ্বাসে অসহায়ত্ব প্রকাশ পায়। তিনি পুনরায় বলেন, “ওদের রক্ষা করতে আমাদের কিছু করা উচিত।”
তার কাছে সুলায়মান বে’র মতামত জানতে চাই। তিনি বলেন যে তাদের দু’জনের একই অভিমত এবং তারা এলওয়ানের জন্য দুঃখবোধ করেন। তিনি বিদায় নেন। সবাই বাড়িতে ফিরে এলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয় এবং সকলে হতাশা ব্যক্ত করে।
এলওয়ান ফাওয়াজ মুহতাশিমি
এটি আনন্দমুখর একটি উৎসব হোক এবং আমরা এক ঘন্টা বা আরও বেশি সময় আমাদের দুঃখগুলো ভুলে থাকি। কিন্তু কিভাবে ও কখন দরজায় একশ’টি ফাটল সৃষ্টি হয়েছে? নীল নদ বা বৃক্ষগুলো কিসের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হতে চেষ্টা করছে? মনোযোগ দিয়ে শোনো। তারা বলছে: বেচারা এলওয়ান, তুমি চার দেয়ালের মধ্যে আটকা পড়েছো। বন্ধুত্বের ছদ্মবেশে ও অল্পস্বল্প কথা বলে, ইস্পাত ও নৈরাশ্যের দুটি স্তম্ভেও ওপর ভর দিয়ে অঘোষিত প্রেমের আড়ালে এবং অস্পষ্ট স্বপ্নে আচ্ছাদিত হয়ে রান্দা তোমার কাছে ফিরে আসছে। মার্চ মাস সামরিক তৎপরতার মাস, কারণ আজ ‘সেনা দিবস’। ক্যাফে চাপাবাজদের দ্বারা পূর্ণ। অনুষ্ঠান উপলক্ষে একটি রেডিও আনা হয়েছে, সেটি একটি টেবিলে রাখা হলো। ১৯৬৭ সালের জুন মাসে মরহুম প্রেসিডেন্ট বেতার ভাষণে তার পরাজয় ঘোষণা করেছিলেন। মরহুম প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে আমি প্রথম যে কথাটি শুনেছিলাম তা হলো, তিনি তাঁর নিজের মহত্ত্বের চেয়ে বরং তাঁর পরাজয় মহান ছিলেন। এ প্রসঙ্গে দাদাজি যা বলেছিলেন, তা মনে পড়ে: ‘আমরা এমন এক জাতি, যাদের বিজয়ের চেয়ে পরাজয় বেশি দেওয়া হয়েছে। আমরা যে অসংখ্য পরাজয় সহ্য করেছি তা থেকে সৃষ্ট হতাশার ক্ষত আমাদের মাঝে গভীরভাবে খোদিত। সেজন্য আমরা বিষাদের, বিয়োগ ব্যথার গান এবং যারা শহীদ হয়েছে সেইসব বীরদের ভালোবাসতে শিখেছি। আমাদের সকল নেতা শহীদ হয়েছেন: মোস্তফা কামাল, মুহাম্মদ ফরিদ ও সা’দ জগলুল, মোস্তফা আল-নাহাস, জামাল আবদ আল-নাসের- তারা কোনো না কোনোভাবে শহীদ। এই আত্মতুষ্ট বিজয়ীর কথা বলতে হয়, তিনি সকল বিধি ভঙ্গ করেছেন, তাঁর বিজয় এমন এক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে, যার ফলে নতুন অনুভূতি, আবেগ সৃষ্টি হয়েছে, যার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। এজন্য আমরা তাঁকে অভিশাপ দেই এবং আমাদের হৃদয় বিদ্বেষে পূর্ণ। বিজয়ের ফল তিনি নিজে রেখে আমাদের জন্য রেখেছেন ‘ওপেন ডোর পলিসি’, যা আমাদেরকে দারিদ্র্য ও দুর্নীতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
আমরা যখন তর্কে লিপ্ত তখন লাউডস্পিকারে বিজয় দিবসের বিস্তারিত কর্মসূচি ঘোষণা করা হচ্ছিল। কিন্তু সহসা অদ্ভুত কণ্ঠ শোনা যাচ্ছিল। ঘোষক চিৎকার করে বলছিলেন: “বেইমানের দল— বেইমান। সকল জিহ্বা আড়ষ্ট হযে গেছে, সকলেই রেডিও ঘিরে দাঁড়িয়েছে। উৎসবের ঘোষণা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল এবং গান বাজতে লাগলো। সবাই কানাঘুষা শুরু করেছে, নিশ্চয়ই অস্বাভাবিক কিছু ঘটেছে, বা হামলা হয়েছে।
কিছু সময় পর ঘোষকের কণ্ঠ আবার শোনা গেল, তিনি বললেন যে প্রেসিডেন্টের জীবনের ওপর ব্যর্থ হামলা হয়েছিল, প্রেসিডেন্ট চলে গেছেন এবং পরিস্থিতি নিরাপত্তার রক্ষীদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আবারও গান বাজতে লাগলো।
তাহলে এটাই সত্য। যা অনিবার্য তা চেপে রাখা যায় না। বড়জোর কালক্ষেপণ করা যায়। কারা হামলা করতে পারে? ধর্মীয় আন্দোলনের যারা জড়িত তারা ছাড়া আর কে হতে পারে? প্রেসিডেন্ট তো সৈন্য ও রক্ষীদের মাঝ বরাবর বসে ছিলেন- প্রত্যেকে কোনো না কোনো কথা বলছে। লাউডস্পিকারে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন শুরু হলো।
সহসা নতুন ঘোষণা করা হলো যে প্রেসিডেন্ট সামান্য আহত হয়েছেন, হাসপাতালে তাঁকে প্রয়োজনীয় সকল চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আমাদের মনে নতুন সম্ভাবনার ভাবনা প্রবল হলো। সময় থেমে গেছে এবং নতুন রূপ নিয়ে আসছে। লোকটি আহত, এরপর কী হবে? কারাগারে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হও। সন্ত্রাস যে ফিরে আসছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই, তিনি টিকে যাবেন এবং প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন।
গানের পর কোরআন থেকে তিলাওয়াত শুরু হলো। প্রথমে আমাদের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। তাহলে ঘটনা সত্য! লোকটির অবসান ঘটেছে। এ কথা কার বিশ্বাস হবে? অনেক সময় আমরা কেন এমন ভাবি যে অসম্ভবই আসলে সম্ভব? আমরা কেন কল্পনা করি যে, এই পৃথিবীতে মৃত্যু ছাড়াও আরেকটি বাস্তবতা আছে? মৃত্যুই প্রকৃত একনায়ক। আমরা সরকারের চূড়ান্ত বিবৃতি শুনতে পাই। ক্যাফের লোকজনের কথা আমার কানকে বিদ্ধ করতে থাকে- আল্লাহ ছাড়া আর কারও ক্ষমতা বা শক্তি নেই। একমাত্র তিনিই স্থায়ী। দেশ চরম বিপদের মধ্যে। তিনি যত মন্দ কাজই করে থাকুন না কে তার এমন মৃত্যু কাম্য হতে পারে না। এর পেছনে নিশ্চয়ই বড় কোনো ষড়যন্ত্র আছে। মৃত্যু তাঁকে উন্মাদনা থেকে রক্ষা করেছে। যাহোক, তাকে তো যেতেই হতো। যারা মনে করে যে দেশ একটি মৃতদেহ ছাড়া কিছু নয়, তাদের ক্ষেত্রে এমন ঘটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। না, এটি বিদেশি চক্রান্ত। যিনি হত্যা করেন, শেষাবধি তিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। মুহূর্তের মধ্যে দস্যুদের এক সা¤্রাজ্য ভেঙে পড়েছে।
সন্ধ্যার মধ্যে আমার মনে হলো, ক্লান্তিতে আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন বোধ করছি। নানা ধরনের কথাবার্তা আমাকে নিঃশেষ করে ফেলেছে। ক্যাফে থেকে বের হয়ে হাঁটতে শুরু করলাম, প্রতিটি পথচারীর মুখে মৃত্যুর ছায়া। হঠাৎ নিজেকে গুলিস্তান হানিমের ভিলার সামনে আবিষ্কার করলাম। আনোয়ার আলমের গাড়ি পার্ক করা। সব ধরনের যৌন তাড়না আমার ওপর ভর করলো এবং এর সঙ্গে হত্যা করার অপ্রতিরোধ্য তাগিদ বোধ করলাম।
রান্দা সুলায়মান মুবারক
কী ভয়াবহ! হত্যাই কী এর একমাত্র উপায়? তাঁর স্ত্রী ও কন্যারা এখন কী করবে? আমি তাঁর পক্ষে নই, কিন্তু তাঁর এই পরিসমাপ্তি আশা করা যেতে পারে না। আমার নিজস্ব সমস্যার মধ্যে আমি দীর্ঘদিন যাবৎ এত জড়িয়ে আছি যে জনগণের সমস্যা নিয়ে কোনো ভাবনা আমাকে কম্পিত করে। হত্যা করা জঘন্য ব্যাপার এবং আল্লাহ তা পছন্দ করেন না। আমার মা খুব কাঁদছেন এবং ড্রয়িং রুম স্বাভাবিক সময়ে চেয়ে অস্বাভাবিক বিষণœতায় আচ্ছন্ন। আমি জানতে চাই যে আমার বাবা এ সম্পর্কে কী ভাবেন। তিনি বললেন, “আমার মতামতে নিশ্চয়ই মৃত পুরুজ্জীবিত হবে না। দেশ ধর্মান্ধতায় অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তারা আমাদের চৌদ্দ শ’ বছর পেছনে টেনে নিতে চায়। আমি জানি, তুমি আমার সঙ্গে পুরোপুরি একমত হবে না। কিন্তু আমরা নীতিগতভাবে একমত পোষণ করি যে হত্যা করা ভুল।”
আমি এ ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে একমত হতে পারি। আমি ভাবছি, এলওয়ান তুমি কোথায়? তুমি তাঁকে পছন্দ করতে না। তাহলে তুমি কি এভাবে তাঁর জীবনাবসানে সুখী? হঠাৎ দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকার পর সম্পূর্ণ অনাকাক্সিক্ষতভাবে এলওয়ান আমাদের ফ্ল্যাটে উপস্থিত হলো। তাকে বিক্ষিপ্ত লাগছিল। ডাইনিং রুমে আমরা যখন একা, আমি জানতে চাইলাম, “ঘটনাটি যখন ঘটে তখন তুমি কোথায় ছিলে?”
“ওসব ভুলে যাও! নতুন কিছু ঘটেনি। রান্দা, আমার কথা মন দিয়ে শোনো,” সে বললো। “আজ সন্ধ্যায় আমি গুলিস্তানের ভিলার সামনে ছিলাম। সেখানে আনোয়ার আলমের গাড়ি ছিল। আমন্ত্রণ ছাড়াই আমি ভিলায় প্রবেশ করি। তাকেই প্রথম দেখতে পাই এবং তিনি আমাকে স্বাগত জানান। আমি অসচেতনভাইে চিৎকার করে বলি, “আপনি অত্যন্ত জঘন্য লোক!” আমি তার বুকে প্রচণ্ড ঘুষি মারি এবং তিনি মেঝের ওপর পড়ে যান। গুলিস্তানের আবির্ভাব ঘটে, তিনি চিৎকার করে আমাকে থামতে বলেন। আমি আনোয়ার আলমকে তুলে বেডরুমে দিয়ে আসি।
“আমি প্রায় অচেতন অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। গুলিস্তান পনেরো মিনিট পর আসেন, তার মুখ ফ্যাকাশে। তিনি বিড় বিড় করে বলে, “তুমি এক মূর্খ, কী করেছো তুমি? তুমি তাকে খুন করেছো। কেন তাকে খুন করলে।” তার চোখ অশ্রুতে ভরা। আমি চেতনা ফিরে পাওয়ার পর আমার কাজের ভয়াবহতা টের পেলাম এবং বললাম, “পুলিশ ডাকুন, এটাই আমার ভাগ্য।” তিনি নড়ছিলেন না। আমি এই পরিস্থিতির জট থেকে নিজেকে মুক্ত করার তাগিদ অনুভব করলাম এবং বললাম, “আমি নিজেই পুলিশের কাছে যাচ্ছি।” তিনি হাতে অস্পষ্ট ইশারা করে আস্তে বললেন, “যেখানে আছেন সেখানেই থাকুন।” আমি বললাম, “সময় আমার প্রতিকূলে চলে গেছে, আমার ¯œায়ুর ওপর বুলডোজারের মতো আঘাত করছে। আমার অপেক্ষা করার কোনো অর্থ হয় না।”
তিনি আমার চোখ এড়িয়ে অস্ফুট কণ্ঠে বললেন, “অপেক্ষা করুন। তিনি দীর্ঘদিন থেকে হৃদরোগে আক্রান্ত ছিলেন।” আমি বুঝতে পারছিলাম না যে তিনি কী ভাবছেন। প্রথমে সন্দেহ হলো, এরপর আশার মৃদু রেখা দেখা গেল, আমি বললাম, “কিন্তু আমিই কাজটি করেছি।”
“আঘাতের কোনো চিহ্ন নেই,” তিনি শান্তভাবে বললেন, বোঝা গেল তার বিঘিœত মন নতুন করে কাজ করতে শুরু করেছে। এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি অপরাধের সঙ্গীতে পরিণত হলেন। হতবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কী অদ্ভুত এক নারী! আমার মাঝে ডুবন্ত অবস্থা থেকে উদ্ধার লাভের আনন্দ জাগলেও বললাম, “কিন্তু ডাক্তারের পরীক্ষায় কোনোকিছু গোপন থাকবে না।
তিনি আস্থার সঙ্গে উত্তর দিলেন, “তা নিয়ে আপনার মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই।” আমাদের দৃষ্টি যেন চক্রান্তকারীর, তিনি বললেন, “আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে আমি কেন আপনাকে রক্ষা করার চেষ্টা করছি।” আমি অবিশ্বাসে মাথা নাড়লাম। তিনি আবারও বললেন, “আমি কি আপনার কথার মর্যাদায় বিশ্বাস স্থাপন করতে পারি?” আমি তাকে আমার কথা দিলাম।”
এলওয়ানের কথা শেষ হলে আমি প্রশ্ন করলাম, “কিন্তু তুমি এসব গোপনীয় বিষয় আমাকে বলছো কেন?”
“আমাদের মাঝে কোনো গোপনীয়তা নেই, রান্দা।”
“আমার ওপর যা ঘটেছে, তাতে প্ররোচিত হয়ে তুমি একটি অপরাধ করেছো, তোমাকে রক্ষা করা প্রয়োজন,” আমি তিক্ততার সঙ্গে বললাম। আমি তোমাকে সম্ভবত নিন্দা করতে পারি না।”
“আসলে আমি তোমাকে পুরো সত্য বলিনি। কারণ আমি ভিলা ত্যাগ করার পর নিজের ওপর বিতৃষ্ণ হয়ে পড়েছিলাম। দ্বিধা নিয়ে এখানে এসেছি তোমার কাছে সবকিছু স্বীকার করার জন্য,” এলওয়ান বললো। আমি কখনো কোনো কিছুর জন্য অনুতাপ করবো না। আমি গুলিস্তানের কাছে গিয়ে পুরো বিষয় ব্যাখ্যা করবো।”
“আমার মনে হয় না যে তোমার তা করা উচিত,” আমি পরামর্শ দিলাম।
মুহতাশিমি জায়েদ
এলওয়ান গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে আমি সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছি। চারপাশের পৃথিবীতে নতুন আশার সৃষ্টি হচ্ছে। রান্দা কতটা সাহসীতে পরিণত হয়েছে : সে শালীনতা বজায় রেখে মর্যাদার সঙ্গে আদালতে যাচ্ছে এক তরুণ ব্যক্তির পক্ষে সাক্ষ্য দিতে। বছরের পর বছর কেটে যাবে, এলওয়ান একদিন কারামুক্ত হয়ে আসবে এবং কোনো বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করবে, জীবনের সব সমস্যা সমাধানের জন্য উপযুক্ত পদে অধিষ্ঠিত হবে এবং তার আশাগুলোকে বাস্তবে রূপ দেবে। আমার মনে হয় না যে আমি তাকে আর দেখতে পাবো। সে আমার শূন্য কক্ষের অধিকার লাভ করবে এবং তার প্রেমিকাকে বিয়ে করবে। আমি কি আরও দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবো? যদি বেঁচে থাকি, তাহলে কি নিজের অজ্ঞাতেই তার সমস্যাকে আরও জটিল করতে ভূমিকা পালন করবো?
আমার জন্য তাদের কাতারে যোগ দেওয়ার সময় এসেছে, যারা মহান আল্লাহর অনন্ত জগতে প্রবেশের আশায় নিজেদের নিবেদন করেছেন।