মহাসড়কের এ মোচড়টি দেখতে হুবহু উটের কুঁজের মতোন। আর সে মোচড়ের কাঁধের ওপর বসানো ইমতিয়াজ ইলেকট্রিক। নিহত নারদ নদের দাফন-কাফনের পর- এ মহাসড়কটি চালু হলে এরফান আলীর দোকানের এই পজিশনটি যেন হয়ে উঠলো এ বাজারের কোহিনূর। আগে তার এদিকে কে আসতো? রশিদ সরকারের দোতলা, এইসব চালের আড়ত, ঝিলমিল স্টোর এগুলো তো এই সেদিন হলো। ঝোপঝাড়-জঙ্গলে অন্ধকার ছিল এদিকটা। নারদ নদের ঘাট ছিল ঐ কাচারি মাঠের দক্ষিণের কোনাতে- পাতাম নৌকাতে মানুষ আসতো, বাজারে বিক্রির জন্য ফল-ফসলাদি নিয়ে আসতো- ঐ ঘাটে নেমে ছুটে যেতো যে যার দরকারে। তবে অধিকাংশ মানুষ তখন সরষে-তিলের বস্তা, আখের গুড়ের পাটালি কিংবা পাটের বোঝা মাথায় নিয়ে হেঁটেই আসতো হাটে। মানুষের বেশি যাতায়াত ছিল আবু সাইদের পাটের আড়তের দিকে- মানে এখন যে বিল্ডিংয়ে সুন্দরবন কুরিয়ারের অফিস সেখানে। ওদিকটাতে তখন জমজমাট ছিল এ বাজার। আর এখন বাজার ও বেচাকেনা দুই-ই এদিকে বেড়েছে।
মাড়োয়ারি জাতের কোন ব্যবসায়ীর কাছে এ পজিশনটি থাকলে- এতোদিনে সে হয়তো লাল হয়ে যেতো। কিন্তু এরফান লোকটি সে জাতের না। ব্যবসায়ীকে মুনাফা লাভের জন্য কঠোর এবং কঠিন হতে হয়। অথচ এরফানের ধাঁচটি কেমন যেন উল্টা। তারপরও এ পজিশনটি তার পৈতৃকসূত্রে পাওয়া, তাকে মোট টাকার জমানত দিয়ে ভাড়া নিতে হয়নি।
অনেকে বলে
-এডি বাপের জায়গা তো, জমিজমা আছে, পুকুর-পুষ্কুণী আছে, খেজুর বাগান আছে, আমের বাগান আছে… সংসারে টান নাই। তাই এই ভাবে চলে। আমার মতোন সংসারে টান থাকলে, ঠিকই দৌঁড়াতো।
আবার তখনি অন্যজন কথা ঘুরিয়ে তারা বলে
-আসল ব্যাপারটা বোধ হয় ঐটা না। খবির হাজীর ব্যাটারাও তো- বাপের থেকে কম সম্পত্তি পায়নি। সটিং মিল, পেট্রোলপাম্প আর কত কী সব? কিন্তু তারা তো এখনো রাতকে দিন করে দুনিয়া চষে বেড়াচ্ছে।
দোকানটিতে কারেন্টের তার, বাল্ব, হোল্ডার-সকেট- এগুলো আছে ঠিকই। সময় সময় ভালো বেচা-বিক্রিও হয়। বিক্রি হলে যে, আরো বিক্রির নেশা ওঠে। আরো বিক্রি হলে, আরো মুনাফা- আরো আরো… মরিয়া হয়ে মানুষ- এই ভাবটি এরফানের মধ্যে নেই। দোকানটি সে খোলে- কিছু বেচা-বিক্রি হয়। কোম্পানির লোকজন আসে, তাদের কাছে থেকে দুই-এক ববিন তার, বাল্ব, সকেট, হোল্ডার- এগুলো নেয়। বিক্রি করে এসব নিয়ে তার কোন তাড়াহুড়ো নেই। যেন কোন দায়ও নেই। চলছে। কেউ তাকে দোকানটিকে আরো গোছগাছ করার পরামর্শ দিলে- এরফান আলী তাকে বলে-
-ভিতরে আসো, বসো একটা চা খাও। তোমার গ্রামের দিককার খবরাখবর বুলো শুনি। তোমার গ্রামের অমুক জনের এখন কি অবস্থা? আমরা একসাথে পড়তুম, বুঝলে?
তার বিলের জমিগুলোর অবস্থাও ঐ একই রকম। ঐ জমিগুলোতে পুরোনো স্টাইলে ধান-গম করে। ফসল যা হয়- তাতে আবার বছর ঘুরে আসে। পেঁয়াজ-রসুন বা আলু-বেগুন- এগুলো হাল আমলের আবাদ। এগুলো লাভও বেশি। কিন্তু এগুলোর যে বাড়তি ঝক্কি-ঝামেলা-তার মধ্যে এরফান নেই। এই স্টাইলে কেটে যায় তার দিন-রাত-মাস ও বছর। এভাবেই তাকে মেনে নিয়েছে তার পরিবারও।
বাজারে আসলে- পাঁচ মিনিটের জন্যে হলেও আসাদ এরফান আলীর এই দোকানে যায়। আসাদের পরিচিত জনেরা বিশ্বাস করে, মোবাইলে না পাওয়া গেলেও ইলেকট্রিকের ঐ দোকানে তাকে ঠিকই পাওয়া যাবে। অথবা ঐ দোকান থেকে বলতে পারবে, আসাদ বর্তমানে হাটের কোন পট্টির দিকে আছে বা কতক্ষণ পর সে আবার এ দোকানে ফিরে আসবে অথবা সে বাড়িতে, না দূরে কোথাও গেছে?
কদমগাছটির কাছ থেকে দোকানের ভেতরটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। বানেশ^র কলেজের জয়নাল স্যার, সুগার মিলের আতিকুর, ইসহাক প্রিন্সিপাল এবং আরো একজন কে যেন বসে আছে, আসাদ তাকে চিনতে পারছে না। এদের মধ্যে ইসহাক প্রিন্সিপাল রডের তৈরি একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে আর বাকিরা সবাই দুটি কাঠের বেঞ্চে বসা। সবাই সবার মুখোমুখি বসে গল্প করছে। বয়সের হিসেবে আসাদ এদের কারো ছেলের বয়সী, কারো মেয়ের বয়সী, আবার কারো হয়তো নাতির জুড়ি। তবু এদের সাথে কেমন যেন ভাব জমে উঠেছে আসাদের- কোন একটা হাটবারে আসাদ না এলে এরাও যেন অস্থির হয়ে ওঠে। মোবাইলে খোঁজখবর নেয়। ভালো-মন্দ জিজ্ঞাসা করে। আসাদকেও শনিবার, মঙ্গলবার এ হাটে একবার আসতেই হয়। শুধু কাঁচা বাজার, মাছ-মাংস, তেল বা মসলাদি কেনার জন্য না। বাড়ির পেঁয়াজ, রসুন বা পাট- যাইহোক তা বিক্রির জন্যও এ হাট-ই তাদের গ্রাম থেকে সবচে কাছে। তাছাড়াও এ হাটে নিজেদের ফল-ফসলাদি বিক্রি করে যেমন তাদের সুবিধা হয়, তেমনি আবার তেল-লবণ বা মাছ-মাংস-মসলাদিও এ হাটে কিনতে পাওয়া যায় পাইকারি দামে। এ বেচাকেনার কোন এক ফাঁকে যখন-ই হোক আসাদ একবার হলেও এরফানের এ দোকানে আসে। তবে এখানে আসার ব্যাপারটি আসাদের বয়সীরা কিছুটা বাঁকা চোখে দেখে। তারা বলে,
-ধুর! ব্যাক ডেটেড ঐসব লোকের সাথে তোর কিসের এতো খাতির রে? আমরা শালা- কোনমতে ক্লাসের সময়টুকু পার করতে পারলে আর স্যারদের ধারে-কাছে ঘেঁষি না। আর তুই বাজারে এসে তাদের সাথে- আড্ডা মারিস! এদের সাথে মিশে তোর চিন্তা-ভাবনাও বুড়ো হয়ে যাচ্ছে।
এরই মধ্যে ধানহাটা চা-স্টলের ঐ ছেলেটি চা ভর্তি চারটি কাপ এরফানের দোকানের র্যাকের ওপর রেখে যেন দৌড়ে পালাল। অন্যদিন হলে- সে এতো সহজে এখান থেকে যায় না। এখানকার চলতি গল্পের মাঝে সেও ঢোকার চেষ্টা করে। অপেক্ষা করে কোন কোনদিন, আবার কোনদিন এখানকার চলতি গল্পের মাঝে-ই তার কথার বাঁধ তুলে বসে। এটা মেনেও নেয়, এখানে উপস্থিত সবাই। তবে আজ শনিবার- হাটের দিন, এক জায়গাতে দাঁড়িয়ে থাকার সময় আজ তার নেই।
আসাদও দোকানের কাছে যাবে কিন্তু রাস্তা খুঁজে পাচ্ছে না। সড়ক থেকে দোকানটির বারান্দা পর্যন্ত একটি সাইকেলের গা ঘেঁষে দাঁড় করিয়ে রাখা আরেকটি সাইকেল, এদের মধ্যে মোটর সাইকেলও আছে তিনটি। এ সাইকেল-মোটর সাইকেলগুলোর ফাঁক-ফোকরগুলোকে যোগ-বিয়োগ করে আসাদ ওপারে যাওয়ার একটা রাস্তা খুঁজছিল- এমন সময় কদমগাছের গোড়াতে বসা মুচিটি আসাদকে বলল,
-দাদা, স্যান্ডেল জুড়া দেন, কালি করি দিই। ভালো কালি গো দাদা। আপনের স্যান্ডেলের কালি তো উঠিই গেছ এখিবারে।
সম্ভবত ঐ মুচির কথার সত্যতা যাচাই করতেই- নিজের পায়ের দিকে ফিরে তাকাল আসাদ। হ্যাঁ, সত্যিই তো স্যান্ডেল জোড়া একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তবু আসাদ বলল,
-না। আজকে থাক। আজকে আমার সুমায় নাই।
আসাদের পায়ের গোড়ালি চেড়ে উঠেছে দেখে- মুচিটি আরো করুণ কণ্ঠে আবারও বলল,
-দেন গো দাদা। কালি করি দিই। কম দামের জিনিস বাজারে আসিছে, তাই মানুষ আর বেশি দামের জিনিস কিনছে না। আমারে কামও আর নাই বুললেই হয়। কি করবো, বুলেন। কেউ-ই আর কাম করাতে চাছে না। আপনে পনোরোডা ট্যাকা দিয়েন খালি! আপনের স্যান্ডেল জুড়া ভালো আছে। কালি করালে- পায়ে দিতে আরাম লাগবেন, গো দাদা।
আসাদের পাশেই চার্জার ভ্যানের ওপর চলছে আখ মাড়াইয়ের মেশিন। মেশিনটি চার্জে চলার কারণে- তার শব্দ অতোটা বিকট বা বিশ্রী নয়। প্রায় নিঃশব্দেই- অনবরত সে পিষে চলেছে আখগুলোকে। আখের রসের জন্য সিরিয়াল দিয়ে অপেক্ষা করছে মানুষ। মুচির এইবারের কথাগুলো আসাদের কাছে ঐ আখের রসের মতোন লাগল। কথাগুলো যেন অনটনের জাঁতাকলে পিষ্ট হৃদয় থেকে বেরিয়ে আসছে। পা থেকে স্যান্ডেল জোড়া খুলতেই- মুচি তার রিজার্ভ থেকে একজোড়া পুরোনো বার্মিজ বের করে মেলে ধরলো আসাদের পায়ের সামনে। এইবার তার ঠোঁট জোড়াও যেন ফুটে উঠলো ভোরের শিউলির মতোন হাসিতে।
সাইকেল-মোটর সাইকেলের তৈরি এই দুর্গ দেয়াল টপকে ওপারে যাওয়া আসাদের জন্য প্রায় অসম্ভব। তাই সে চা-স্টলের ছেলেটির দেখানো ঐ পথে দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল। সালাম দিতেই- এরফান উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
-আরে আসাদ মিয়া আসো আসো- ভিতরে আসো। এরফানের আহ্বানে দরদের কোন ঘাটতি নেই। আসাদও দোকানের ভেতরে যেতে চায় কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, দোকানের ভেতরে আর কোন আসন ফাঁকা নেই। এরফান তার নিজের জায়গাটি ছেড়ে দিয়ে জোর গলায় বলল -আরে বাবা ভিতরে আসো তো আগে। আমি দেখছি, বলেই- সে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। মিনিট খানেকের মাথায় সে ফিরে এলো পাশের দোকান থেকে প্লাস্টিকের একটা টুল নিয়ে। ইসহাক প্রিন্সিপাল বাদে, বাকি সবার হাতেই চায়ের কাপ। এরফান, আসাদকে বলল,
-একটু দাঁড়াও, এর পরের চালানে তুমিও চা পাবে। আসাদ ইশারায় এরফানকে- ইসহাক প্রিন্সিপালের কথা জিজ্ঞাসা করল। মোটা কাচের চশমা ছাড়া একটা অক্ষরও এখন আর পড়তে পারে না ইসহাক প্রিন্সিপাল। অথচ এরফানকে ইশারাতে জিজ্ঞেস করা ছোট্ট এ প্রশ্নটিও তার এড়ালো না। তিনি নিজেই বললেন,
-আমি চা খাইছি গো, কমরেড আখতারুজ্জামান সরকারের সাইকেল গ্যারেজে। তার আগে, বাড়িতে খাইছি এককাপ। এ কারণে, এ বেলাতে আর খাবো না। বেঁচে থাকলে, বিকালের দিক আরেক কাপ চা খাবো। রাত্রে আর চা খাই না, রাত্রে চা খেলে- ঘুম আসে না। আসাদকে দেখে আজকে বেশ সাজানো-গোছানো লাগছে। আজকে হাটে কিছু নিয়ে আসো নি মনে হচ্ছে? কোথাও যাবে নাকি?
আসাদ বলল,
-না স্যার, আজকে হাটে মসুর নিয়ে আসার কথা ছিল। কিন্তু বাড়ির ওপরে লোক আসাতে- গতকাল বিকেলেই ঐগুলো বিক্রি হয়ে গেছে। তাই হাটে আজকে আর তেমন কাজ নেই। দুপুরের দিক একবার বামনদিঘীতে যাবো স্যার। একটা দাওয়াত আছে।
-কিসের দাওয়াত গো? বিয়েশাদির ব্যাপার নাকি?
মুখটা একটু কাঁচুমাচু করে আসাদ এবার বলল,
-না স্যার, মানে স্যার ঐ আমার এক বন্ধুর বাড়ি।
বলে এবং না বলে আসাদ ইসহাক প্রিন্সিপালকে যা বোঝাতে চাইলো, তা হয়তো তিনি বুঝতে পেরেই- স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে একটু হাসলেন। আর কোন প্রশ্ন করলেন না। বামনদিঘীতে রুবির বড় ভাইয়ের শ^শুরবাড়ি। রুবি তার ভাবীর সাথে গতকাল সেখানে গেছে। তাই আসাদেরও সেখানে যাওয়ার কথা।
এরপর জয়নাল মাস্টার বলল,
-এই শোনো আতিকুর, তোমারে পেঁয়াজের দাম তো কমে গেলো। তিনশো টাকা কেজির পেঁয়াজ- এখন পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ টাকা কেজি। এই দামে পেঁয়াজ বেচলে তো, তোমারে অবস্থা কেরাসিন! তোমরা জোটে আছো, কিছু একটা করো। না, হলে তো এবার পেঁয়াজ যারা করেছে, তারা মরিছে। মানুষ মরলেও তো- তোমারে কোন অসুবিধা নাই। কারণ গ্রামের পেঁয়াজওয়ালারা তো আর তোমারে বন্ধু না। এরা মরা পদ্মার এই পাড়ের মরাধরা মানুষ। অমনি আতিকুর জয়নালকে বলল,
-তুমি করো মাস্টারি। নাবালক সগ ছেলিপেলিক পড়াও। নিজেকেই- নিজে পণ্ডিত মনে করো। বাজারের তুমি কী বুঝো, কাঁচা পেঁয়াজ মানে মাটি, তুমি জানো? খালি শিলপাথরের হাত থেকে বাঁচায়ে কোনমতে তুলতে পারলেই লাভ। কাঁচা পেঁয়াজের দাম- চল্লিশ ট্যাকা মানে ষোলশো ট্যাকা মণ। মানে ভালো বাজার।
জয়নাল স্যার মাথা নাচিয়ে বলল
– হ্যাঁ হ্যাঁ… ঠিক-ই! পেঁয়াজ এখনো কাঁচা আছো তো? আর কাঁচা পেঁয়াজ মাটি, কথা ঠিক-ই। কিন্তু পেঁয়াজের বীজের দাম, সার-বিষের দাম, চাষের খরচ, চারা লাগানোর লেবারের বিল… এসব কত? এসবের কোন হিসাব-খতিয়ান তোমার কাছে আছে? বোধহয় নাই। আরে তোমারে বিএডিসি পেঁয়াজের বীজ দিয়েছিল গতবার- ঐ বীজের অর্ধেক আগের বছরের, বাকি অর্ধেকের মধ্যে ভারতের বীজ মেশানো ছিল। যারা ঐ বীজ নিয়েছিল, তাদের সবাইকে পরে পেঁয়াজের চারা কিনে পেঁয়াজ লাগাতে হয়েছিল। অথবা ভুট্টা লাগাতে হয়েছিল পেঁয়াজের জন্যে রাখা ঐ জমিতে। ঐসব হতভাগার মধ্যে আমিও ছিলাম।
এই হলো, তোমারে অবস্থা! ও তুমি তো আবার একই সাথে জোটের লোক- আবার সুগার মেলেরও লোক। তোমারে কথাবার্তা আসলে এ রকম-ই তো হওয়ার কথা। তোমারে হিসাবের সাথে তো আর আমারে সাধারণ মানুষের হিসাব মিলবে না। তোমারে হিসাব-ই আলাদা। মেল বন্ধ করিছো ফেব্রুয়ারিতে- আর আবার কুশির ওঠার সময় হয়ে যাচ্ছে, লোকজনকে এখনও বিল দাওনি। মানুষ অল্প দুঃখে কুশির লাগানি বন্ধ করি দেয়নি! কুশির হতে লাগবে দেড় বছর। সাথে কয়টা মসুর হলে- হলো। আর না হলে, নাই। কিন্তু মানুষ মাড়াইয়ের কলও তুলতে পারবে না। আবার তোমরা নিজেরাও ঠিক মতোন নিবে না। আর না হলে- কুশির লিবে কিন্তু লোকজনকে টাকা দিবে না। তোমারে জ্বালাতে মানুষ কী মরবে? আবার খবরে দেখাও যে, চিনি বেচতে পারো নি। তাই তোমরা বেতন পাওনি। নাটক সব। শফিউদ্দিন স্যারের নাটক। সুগার মেলের লোকজনের আবার বেতন লাগে? মানুষ তো বলে যে, হরিয়ান সুগার মেলের চাকরি মানে কুয়েতের চাকরি। এই শোনো, মানুষে বলে কিন্তু আমি না। আমার শোনা কথা ভাই। সত্য-মিথ্যা আমি জানি না, ভাই।
জয়নাল স্যারের অভিযোগের জবাব দিতে যাচ্ছিল আতিকুর। কিন্তু এরফান তাকে থামিয়ে বলল,
– এই আতিকুর শোনো, মাস্টারের কথাতে তুমি পারবে? আরে চাপার জোর আছে বলে-ই সে মাস্টার…! সতেরো-ঊনিশ কী তোমাকে বুঝায়ে দিবে- তুমি জি¦ স্যার বলতে বাধ্য। অতএব কথাতে- মাস্টারের সাথে লাগা যাবে না। এখন অন্য একটা বিষয়ে যাই-
এ কথাটা বলে সে আসাদের উদ্দেশ্যে বলল,
-তোমার আসাতে ভালোই হলো আসাদ মিয়া! এখন তোমাদের গ্রামকে নিয়ে বজলুর রশীদ স্যারের লেখা একটা কবিতা পড়বে খলিল, খলিল আগে- এই হাটে, এই কবিতাটা পড়ে পড়ে বিক্রি করছিল। স্বাধীনতার আগের কথা, তোমার গ্রামের রেজা মাডারের কাহিনি। প্রচুর বিক্রি হয়েছিল, এই কবিতাটা। পড়ে পড়ে খলিলের মুখস্থ হয়ে গেছে, এখনও তার মুখস্থ আছে। দু-একটা লাইন ছুটে যেতে পারে।
এরফানের মুখ থেকে এ কথা শুনে, নতুন পানির স্বাদ পাওয়া ব্যাঙের মতোন বুকের ছাতিটা ফুলিয়ে খলিল বলল,
-খালি রেজা মাডারের কবিতা না গো চিয়ারম্যানের ব্যাটা। আমি- এহুনো শা-জাহানের কবিতা, আজিজ ও সন্ধ্যা রাণীর কবিতা, ইউসুফ ও সন্ধ্যার কবিতা, স্বাধীন বাংলার কবিতা- ছাড়াও আরো দুই-একখান কবিতা আমি এহুনো মুখস্থ বুলতে পারি। ঐ একখান-আধখান লাইন এমন-তেমন।
ইসহাক প্রিন্সিপাল জিজ্ঞেস করল, বজলুর রশীদের খবর কী?
-পিজি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল, শোনেছিলাম। ওর ছেলেটা এখন কোথায়? রাশিয়াতে- না দেশে? রশীদ ভালো মানুষ গো, লেখাপড়া জানা সব মানুষ-ই ভালো হয়, তার কোন গ্যারান্টি নাই। কিন্তু রশীদ ভালো মানুষ। তার গ্রামের লোকজনকে নিয়ে সে চিন্তা করতো। তাদের জন্য কাজও করেছে। আমিনুল হাজীও তার গ্রামের গরিবের জন্যে কাজ করার চেষ্টা করেছে কিন্তু পাইপলাইনে সমস্যা আছে। যতটা তিনি করতে চাচ্ছেন, তা হচ্ছে না। মানুষের চিন্তাভাবনা এখন আরো বেশি ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। ব্যক্তিগত লাভ ছাড়া মানুষ যেন আর কিছু-ই ভাবতে পারছে না এখন! তাছাড়া আমিনুল হাজীর মতোন ধনী মানুষেরা কতোজন আর এখন নিজের গ্রামের মানুষের কথা চিন্তা করে- সে সংখ্যা খুব কম। কিন্তু তিনি কিছু করার চেষ্টা করেছেন কিন্তু ঐ যে তিনি যাদের দিয়ে কাজটা করাতে চেয়েছিলেন- তাদের কারণে আমিনুল হাজীর মহৎ উদ্দেশ্যটাও সফল হচ্ছে না। শুনলাম, গ্রামে তার তৈরি হাসপাতালটা নাকি বন্ধ হয়ে গেছে!
আমিনুল হাজীর ব্যাপারে কেউ-ই তেমন কিছু বলল না। এমনকি এরফানও না। আবারও সে লাগলো বজলুর রশীদ সম্পর্কে। সে বলল,
-এখন বোধহয় খুব একটা ভালো না। ময়মনসিংহেই আছে, মোবাইলেও খুব ভালো করে কথা বলতে পারে না। আমি ফোন করেছিলাম, সপ্তা খানেক আগে। বজলুর রশীদ সত্যি-ই ভালো মানুষ, স্যার। তিনি তার সীমিত সম্পদ এবং তার অগাধ জ্ঞানকে সারা জীবন মানুষের জন্য ব্যয় করার চেষ্টা করেছেন।
নিজের মতের প্রতি এমন নিখাত সমর্থন পেয়ে মুচকি হাসলেন ইসহাক প্রিন্সিপাল। এ হাসি শিশুসুলভ সহজ ও সরল। ড. বজলুর রশীদ ময়মনসিংহ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। দেশের অন্যতম একজন বীজ বিজ্ঞানী। এখন অবসরে আছেন। বজলুর রশীদ আসাদদের পাশের গ্রাম জামিরার মানুষ। খলিল কবিতাটি পড়তে যাচ্ছিল।
আসাদ তাকে থামিয়ে বলল,
-চাচা একটু দাঁড়ান, রেকর্ড করে নিই- বলে পকেট থেকে সে তার মোবাইলটি বের করলে, খলিল পড়তে লাগল-
শুনেন বন্ধুগণ দিয়া মন আশ্চর্য কাহিনি, বিসমিল্লাহ্ বলিয়া আমি ধরিলাম লিখনি।
লিখে দুটি কথা (২) জানাই হেথা দশেরও আগেতে, চারঘাট থানার অন্তর্গত জেলা রাজশাহীতে।
ডাকঘর জামিরা (২) আছে সেথা বাদুড়িয়া গ্রাম, সে গ্রামের প্রধান ছিল রেজা মিয়া নাম।
সে হয় অতি ভদ্র (২) নন ক্ষুদ্র, টাকা-ধনে-জনে, সবার সনে সৎ ব্যবহার হিংসা নাই তার মনে।
রেজা দানশীল অতি (২) ভাগ্যবতী, ভিখারিনি যত, বাড়িতে আসিয়া তারা থাকত অবিরত।
আরও ভিক্ষুকেরা (২) গরিবেরা অন্নদান পাইত, এভাবেতে রেজা মিয়া পুণ্যের কাজ করিত।
দেশের উন্নতিতে (২) গেরামেতে শিক্ষাগার খুলিল, খোদাখানা, মাদ্রাসা আর হাইস্কুল গড়িল।
সে হয় সেক্রেটারি (২) প্রধান ভারি বসে নাই থাকিত, দেশের জন্য সব সময়ই কাজ করিয়া যাইত।
গ্রামের হাইস্কুলটির (২) পরিপাটি ছাত্র বহু ছিল, তারই চেষ্টায় হাইস্কুলটির সব উন্নতি হইল।
কিন্তু রইল একদিক (২) হইল না ঠিক ছাত্রদের যা দরকার, খেলাধুলার মাঠটি তাদের মিলল নাকো আর।
তাইতো রেজা মিয়া (২) টাকা দিয়া জমিন- চাহিল, হাইস্কুলের সামনে মাঠটি ঠিক করিয়া দিল।
কিন্তু জমিওয়ালা (২) টাকা লইয়া জমি নাহি দেয়, জমির জন্য রেজা মিয়া ভালো মনে কয়।
হইল রেষারেষি (২) কষাকষি গ্রামেরও ভিতরে, ঝাগড়াঝাঁটির কারণ ছিল গ্রাম্য রাজনীতিতে।
গ্রামে পার্টি হইল (২) দল গড়িল দুষ্টুরা সব যত, রেজাকে তাই খুন করিতে হইল সব উদ্যত।
কিন্তু সুযোগ পায় না (২) দেখা হয় না রেজা মিয়ার সাথে, যেথা তারা খুন করিবে তার যে একাপথে।
এরূপ চলল বিদ্রোহ (২) হয় না রূদ্ধ শত্রু পক্ষের দল, গ্রামের ভিতর ধীরে ধীরে বাঁধল গণ্ডগোল।
রমজান শেষ হইল (২) ঈদ পড়িল পরদিন সকালে, মহাধুমধাম পড়ে গেল সকল ঈদ মহলে।
– এই পর্যন্ত পড়ে অকস্মাৎ ঢাকা কোচের মতোন ব্রেক কষলো খলিল। আসাদের ধারণা হলো, কবিতাটি হয়তো এ পর্যন্তই- তাহলে তো কবিতাতে রেজা মার্ডারের পুরো ঘটনা উঠে আসেনি। তার বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে সে রেজা মার্ডারের এ কাহিনি গ্রামের নানান লোকের মুখে গল্পের ফরম্যাটে শুনে আসছে। মানুষ ও মুখের ভিন্নতাতে কাহিনিতে কিছু হেরফের হয়েছে। কিন্তু রেজা যে নির্যাতনকারী ছিল, এ কথা সে সবার গল্পেই শুনেছে। আসাদ নিজেও একবার এ ব্যাপারে জিয়ালের কাছে জানতে চেয়েছিল। জিয়াল তখন আর ভারী কোন কাজকাম করতে পারতো না। তবে পাট-ধানের ক্ষেতের নিড়ানি দেয়া বা মসুর তোলার মতোন হালকা সে কাজগুলো করতে পারতো। তার হাতের কাজগুলোতে পরিচ্ছন্নতা ছিল। সেদিন আসাদদের পাটক্ষেতে নিড়ানির কাজ করছিল জিয়াল। সেদিন তার সাথে মোজাম্মেল ছিল, তুকরেজুলও ছিল। কথা বলতে বলতে আসাদ তার কাছে রেজা মার্ডারের ব্যাপারে জানতে চায়। প্রথমে সে এ ব্যাপারে কিছু-ই বলতে আগ্রহী ছিল না। তার কথা ছিল,
-অতো পুরাতন কথা তুলার দরকার কী আছে বুলো? এর মধ্যে গ্রামের মধ্যে কত কিছু হয়ে গেছে! কত রকম হিসাব-নিকাশ হয়ে গেছে এহুন। বিয়েশাদি, আত্মীয়তা হয়ে গেছে কতজনার সাথে কতজনার! এহুন তো ভালো-ই আছে গ্রামে সগলাই। ওসব কথা থাক।
কিন্তু আসাদের নানান প্রশ্নে এক সময় যেন বাঁধ ভেঙে গেল। তখন সে জোরগলায় বলেছিল,
– আমরা কুনু অপরাধ করিনি। তাই আমারে ফাঁস হয়নি। স্বাধীনের যুদ্ধের সুমায় আমরা জেল ভাঙি- বাহির হই আসিছি। না হলে দিনে-দুফরে মাডার করি কেউ বাঁচতে পারিছে? তাও তহুন পাকিস্তানের সুমায়। ফিল্ড মারশাল আইয়ুব খানের আমল। দ্যাশে আইন ছিল তহুন। আর চারঘাট থানার বাকী দারোগা ছিল রেজার বন্ধু। ওরা সগলাই বানিশ্বরে রেজার ত্যালের মেলে বসি আড্ডা মারত। হিসাবে সগই তহুন রেজার পক্ষে ছিল। খালি আল্লা বাদে, আল্লা আমারে দিক ছিল। আল্লাহু আকবার। তলে তলে গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ-ই ছিল আমারে সাথে। আমরা গ্রামের মানুষেক রক্ষা করিছি। রেজা কতখানি খারাপ লোক ছিল, তার প্রমাণ লেও- আমার থেন, তমিজুদ্দিন দফাদার ছিল রেজার ব্রিন। রেজার মাথাতে কী ছিল? ওর মাথা ছিল একটা রাগের ডালি। মাথা ভর্তি ছিল রাগ। ঐ পশ্চিমপাড়ার লোকজন যা বুঝাতো, রেজা তাই বুঝতো, তাই করতো। সকাল বেলা মানুষ লাইন ধরতো রেজার বাড়িতে।
মফেজ, আবতার, আলমাস- এরা ছিল রেজার খাস লাঠিয়াল। রেজা ভালো মানুষ হলে এরা সগলাই আমারে সাথে আসলো ক্যা বুলো? আমরা কী তারখে কাখু ট্যাকা দিই কিনি আনিছুন, না। আর সে সুমায় রেজার সুমান লগদ ট্যাকা বোধহয় আশপাশের পাঁচ-সাত গ্রামের মধ্যে কারু ছিল না। জমি ছিল- মানুষের! কিন্তু আমি লগদ ট্যাকার কথা বুলছি। সস্তার আমল তহুন দেড় ট্যাকা সের গরুর গোস্ত আর আড়াই সের ওজনের একটা ইলিশের কেজি- আড়াই ট্যাকার বেশি ছিল না ঐ সরদহ’র পুুলিশ একাডেমির গেটে হলেও। ইলিশ মাছ তো মানুষ তহুন খাইতে-ই চাইতো না!
তহুনি রেজা লাখ ট্যাকার মালিক, কথা হিসাব করতে পারো? নাটোরের পাগলা রাজার মতোন তহুন রেজার দাপট ছিল। রেজা ইচ্ছা করলে, সে সুমায় হয়নি- এ রকম কুনু কাম ছিল না। তোমরা ছেলিপেলি মানুষ, সগই তুমারখে ভাঙি বুলতে পারছিনি। কিন্তুক রেজা ছিল হরিয়ান সুগার মেলের কাটাবাবু। সে সুমায়ের মেলের জিএম সাবও ওর সাথে টক্কর দিয়ে পারেনি। শ্যাষ পর্যন্ত ঐ জিএম সাব-ই এই মেল থাকি বদলি করি দিয়ার ব্যবস্থা করিছিল রেজা। এতো দূর ছিল, ওর হাত। বদলি অডার পাওয়ার পর ঐ জিএম সাব একবার রেজার বাড়িতে আসিছিল। কী জানি, একটা কথা বুলতে কিন্তু রেজা কিছু করি বাড়ি থাকি বাহির হলো না।
জিয়ালের একটা কথা আসাদের মনে খুব দাগ কেটেছিল। তা হলো- তারা রেজাকে খুন করার পরিকল্পনা করার পর, একদিন নাকি গ্রামের সব লোকের রেজার বাড়িতে দাওয়াত ছিল, পরিস্থিতির কারণে জিয়ালকেও যেতে হয়েছিল সেই দাওয়াতে। কিন্তু জিয়াল যেহেতু তাকে খুন করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল, তাই সেদিন সে রেজার বাড়ির তরকারি খায়নি। কারণ তার বাড়ির তরকারি খাওয়া মানেই- তার লবণ খাওয়া। আর তার লবণ খেয়ে তাকে খুন করলে- এটা নেমক হারামি হয়। জিয়াল যে কাজ করতে পারবে না। তাই সে সেদিন রেজার বাড়িতে আখের গুড় দিয়ে কয়েক লোকমা ভাত মুখে দিয়েছিল।
ঢ্ক ঢ্ক করে কয়েক ঢোক পানি গলার মধ্যে ঢেলে দিয়ে খলিল বলল, বয়স তো ভাটার দিকে যায়। তাই দমে কুলাচ্ছে না। পানির বোতলটা তার হাত থেকে ধরে নিল আসাদ। তারপর আবারও শুরু করল খলিল-
রাতে রেজার ঘরে কাটলো সিঁদ। আজরাইল ঢুকলো এসে(২) সিঁদপথে রেজার ভিতরে।
পরদিন সকালে খাওয়া অন্তে রেজা মিয়া দেরেশকে সঙ্গে করে, আশা… যাইবে স্কুলে, স্কুলের যত কাজকাম সব তদারক করিতে।
রেজার মোটর সাইকেল (২) ঘুরাইল সোজা রাস্তার দিকে, শত্রুরা সব রাস্তার ধারে গাছ কাটিতে থাকে।
তারা দেখতে পেল (২) আসতেছিল তাদের মহাশিকার, এ সুযোগে ছিনবে তারা গর্দান রেজার।
রেজা চলিতেছে (২) দেরেশ আছে তাহার পেছনে, ধীরে ধীরে মোটর সাইকেল গেল তাদের সামনে।
নাদের আসল কাছে (২) কুড়াল আছে দুই হস্তে ধরে, আচমকাতে মারল কুড়াল রেজার উপরে।
রেজা পড়ে গেল (২) বলতে লাগল ওগো ভাই সকল, কি কারণে মারলে কুড়াল আমারও ওপর।
হঠাৎ জ্ঞান হারাল (২) পড়ে রইলো মাটিরও ওপর, জিয়াল এসে দুইভাগ করল গর্দানও তাহার।
কিন্তু দেরেশ ডাক্তার দেখে সমাচার(২), ছুটে পালাইলো, উঠে পড়ে দেরেশ ডাক্তার রেজার বাড়ি পৌঁছিল।
তারপর রব উঠিল (২) শোনা গেল কান্নারও আওয়াজ, মিসেস রেজা পড়ছে লুটে কাঁদছে জারেজার।
কাঁদছে পুত্র-কন্যা (২) এমন অন্যায় কে করিল ভাই, দেশের মাথা শেষ করিল, ওগো মালেক সাঁই।
কাঁদছে প্রতিবেশী (২) দেশবাসী কাঁদছে সবার দেল, রেজার পাশে পড়ে কাঁদছে রেজার মোটর সাইকেল।
কাঁদছে বৃক্ষলতা (২) তরুলতা, কাঁদছে নদীর জল, বসুমাতা কাঁদতে কাঁদতে হইল আকুল।
থানায় এজাহার গেল (২) দারোগা এলো ত্বরান্বিত করে, ভালোভাবে দারোগা বাবু ইনকুয়ারি করে।
লাশ পাটিতে জড়ে ট্রাকে করে (২) চালান যখন করে, রেজা মিয়ার বড় মেয়ে কাঁদছে পাটি ধরে।
বলে আব্বা জানও (২) তুমি কখনও ট্রাকে চড়ো নাই, তোশক ছাড়া খালি পাটিতে শয়ন কর নাই।
কিন্তু আজ কেন হায়! (২) এ অবস্থায় লুকাইয়া যাও, মিসেস রেজা কেঁদে বলে সঙ্গে করে নাও।
লাশ থানায় ফেলে (২) মেডিক্যালে একজামিন হইল, একজামিন হইয়া লাশ বাড়িতে ফিরিল।
মামলা গেল কোটের্ (২) পুলিশ ছোটে আসামি ধরিতে, সব আসামি ধরা পড়ে পুলিশের হাতে।
ধরা পড়লো যারা (২) ছিল তারা জিয়াল, করিম, নাদের, জব্বার, আলমাস, তমিজুদ্দিন, এক নম্বর হয় কাদের।
আরো আলমাস মিয়া (২) ফাঁকি দিয়া তাহার বাপ-মায়, পুলিশের হাতে ধরা দিয়া হাজত বাসী হয়।
হান্নান পড়লো ধরা (২) পুলিশেরা আমিনুলকে ধরল, মফেজ মিয়াও এভাবেতে ধরা পড়ে গেল।
মামলা ধীরে ধীরে (২) দিন-দুপুরে বাড়িয়া চলিল, সাক্ষী-সাবুদ নিয়ে মামলার আর্গুমেন্ট হইল।
কবিতা পাঠ শেষে আবারও হাঁপাতে লাগল খলিল। আসাদের হাতেই ধরা ছিল পানির বোতলটি, বোতলটিকে দেখে খলিলের চোখ জোড়া যেন আরো তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠলো। তার চোখের আকুতি মুখে ফুটে উঠতে যাচ্ছিল- কিন্তু তার আগেই আসাদ পানির বোতলটি উঁচু করে ধরলো। ইসহাক প্রিন্সিপাল বলল,
-এই খলিল মিয়া থামো। এতো সুন্দর কবিতা পাঠ করলে আর শুধু পানি খেলে চলে। এই তোমরা কেউ শিঙ্গাড়ার কথা বলোতো। সাথে যেন কাঁচা মরিচ দেয়। না, অন্য কিছু খাবে? মিষ্টি কিছু?
– না, স্যার! মিষ্টি খাওয়া চলবে না। দেহেন তো স্যার, আমার মুতোন মানুষের আবার ডায়বেটিস, আবার হাই-পেশার। আমার মুতোন মানুষের এইসগ অসুখ হবে ক্যা স্যার। আমার গায়ে কয় কেজি গোস্ত আছে? এইসগ অসুখ হবে আমার পাড়ার মাসুমের… মাসুমের ওজন স্যার ঐ রড মাপা দাঁড়িতে না তুললে জানা যাবে না!
– যাইহোক, অসুখ যেহেতু হয়েই গেছে। তখন সাবধানে থাকতে হবে খলিল মিয়া। সাবধানে থাকলে, ডায়াবেটিস তেমন কিছু-ই না। কিন্তু ভুল করলে, আর রক্ষা নাই। অতএব সাবধান।
ইসহাক প্রিন্সিপালের এ পরামর্শটি যেন মাথা নিচু করে গ্রহণ করলো খলিল।
আসাদ বাদে এখানে উপস্থিত সবাই এ কবিতাটি খলিলের কণ্ঠে আগেও বহুবার শুনেছে। তাদের কাছে এ কবিতা নতুন কিছু নয়। তবে আসাদের কাছে এ কবিতা বিস্ময়। তখনি নাকি খলিলের মাথার চুল প্রায় অর্ধেক সাদা হয়ে গিয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের দুই বছর আগের কথা। সোজা ব্যাপার! খলিল খাটোখুটো মানুষ বলে- বাইরে থেকে দেখে তার বয়স বোঝা যায় না। কাঁচা মরিচসহ শিঙ্গাড়া চলে এসেছে। শিঙ্গাড়ার সাথে এইবার আসাদ এক রকম জোর করেই- আলোচনার মধ্যে ঢুকে গেল। আসাদের বুকের ভেতরে এ কথাগুলো যেন ঝড় তুলেছে। তারা ভেঙেচুরে যে পথেই হোক বের হয়ে আসতে চাচ্ছে। সে বলল,
-এই কবিতাটি সুন্দর স্যার। শুনতে ভালো লাগছে। কথাগুলোর মিলও আছে। কাহিনিও জসীম উদদীনের কবর কবিতার মতোন। কিন্তু এ কবিতার কথাগুলো সত্য নয়। বানানো এবং মনগড়া। আমি স্বচক্ষে, এসব ঘটনা দেখিনি। বজলুর রশীদ স্যারকে দেখেনি কোনদিন। আমি জানি স্যার, আমি কবিতা-নাটক বোঝা লোকও না। তবে যদি নিরেট সত্য দিয়ে কবিতা-নাটক না লেখা যায়। তাহলে এ কবিতা ঠিক আছে। সোনার গহনা বানাতে নাকি খাদ লাগে। তাছাড়া নাকি গহনা হয় না। আর গহনা না হলে তো আর সোনার কোন দাম থাকে না। মান থাকে না, তাই না?
আমি ঐ গ্রামের মানুষ। কাদের মাস্টার, জিয়াল নানা, মফেজ বড়বাপ, তমিজুদ্দি বড়বাপ… ওনারা সবাই মারা গেছেন। শুধু আলমাস চাচা, আবতার চাচা এখনো বেঁচে আছেন। তারাও রেজা মার্ডারের আসামি ছিল। স্বাধীনতার পরে আলমাস চাচা যুদ্ধ থেকে ফিরে এলে- ঘটনাক্রমে রেজার-ই দুই মেয়ের সাথে বিয়ে হয় আলমাস চাচার। এরপরে তিনি পুলিশের চাকরিতে গেছেন। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে ফিরে এসেছেন। তার ছেলেরা বড় হয়েছে, তারা ভালো লেখাপড়া শিখেছে। তার বড় এ ছেলেটা এখন কানাডাতে থাকে- সেখানেই নাকি বাড়িঘর কিনেছে। হয়তো তাই চায়ের দোকানে বসলে- তিনি আর পুরোনো বিষয়-আশয়গুলো ঘেঁটে কারো মনে কষ্ট দিতে চান না। এটাই তার জন্য স্বাভাবিক।
দেশের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে তিনি এখন বেশ কথাবার্তা বলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তার ট্রেনিংয়ের কথাগুলো বলেন। তার ছেলেদের সাফল্য সম্পর্কে গল্পগুজব করেন। একজন পিতা হিসেবে তিনি সার্থক তো বটেই, এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার মনে হয়, তার সবচে বড় সফলতা একজন প্রেমিক হিসেবে। তার এ গল্পটি অপরিচিত মানে আলমাস চাচাকে যারা চেনে না, তাদের কাউকে বললে- আমার ধারণা বিশ্বাস করবে না। হয়তো বলবে- এটা কোন সিনেমা বা নাটকের কাহিনি।
তবে ইদানীং তার সবচে বেশি আগ্রহের বিষয়গুলো বোধহয় ভারতীয় সিরিয়াল নাটকগুলো। আমিও দুদিন, সেগুলো নিয়ে তার কাছে গল্প শুনেছি। রেজার এ মেয়েটির ব্যাপারে আমার নিজেরও একটা প্রশ্ন ছিল- কিভাবে জেনেশুনে বাবার খুনির সাথে সংসার করা যায়? এও কি সম্ভব? কারণ আলমাস তো মহাপ্রতাপশালী কোন স¤্রাট বা সুলতান নন যে, তার হেরেম দেয়াল ভেদ করা একজন অবলা-অসহায় নারীর জন্যে অসম্ভব ছিল? তার সাথে বিয়ে হওয়ার পর- আলমাস চাকরিতে ছিলেন। তখন রেজার মেয়েটি যেকোন কিছুই ভাবতে পারতো। কিন্তু তিনি তা ভাবেননি। তিনি সংসার ধর্ম যথাযথভাবে পালন করেছেন। তিনি বাচ্চাদের লেখাপড়া লিখিয়েছেন। তার ফলাফল তো আজ আমরা দেখতেই পাচ্ছি। তার ছেলেদের দেখে- তার বড় ছেলেটি। যে এখন কানাডাতে থাকে- সে সময়ে এসএসসিতে রাজশাহী বোর্ডে তৃতীয় হয়েছিল। এসব হিসেব করে এখন আমার মনে হয়, বাবা-মা কিংবা রক্তের ভাই বিষয় নয়। আসল বিষয় হচ্ছে, সত্য। এখন মনে মনে আমি রেজার এই মেয়েটিকে স্যালুট করি- তিনি সত্যকে গ্রহণ করতে পেরেছেন। বাস্তবে এ শক্তি কতজনের আছে?
শা- করে আসাদের কথার মাঝে এরফান ঢুকে জিজ্ঞেস করল,
-আলমাস রেজার দুই মেয়েকে বিয়ে করেছে, মানে?
আসাদ, এরফানের প্রশ্নের উত্তর দিতে যাচ্ছিল কিন্তু ইসহাক প্রিন্সিপাল বলল,
– আরে বাবা, হ্যাঁ, আসাদের কথা ঠিক আছে। স্বপ্না, মেয়েটা ডেলিভারির সময় মারা গিয়েছিল বোধহয়। তারপর, স্বপ্নার ছোটো বোনটার সাথে আলমাসের বিয়ে হয়। রেজার ছোটো মেয়েগুলোর নাম আমার মনে থাকে না। রেজার মার্ডারের পরে তো আর আমি ওদিকে তেমন একটা যাইনি। হ্যাঁ, আসাদ বলো, তোমার আমরা শুনছি- ভালো লাগছে। বলো।
ইসহাক প্রিন্সিপালের আগ্রহ আছে দেখে- দ্বিগুণ উৎসাহে আবারও বলতে শুরু করলো আসাদ,
তবে আবতার চাচার কাছে আমরা শুনেছি, নামাজ শেষে মসজিদের বারান্দাতে বসে তিনি রেজার মার্ডারের গল্প করেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন,
-হ্যাঁ, আমি জানি- মানুষ খুন করা মহাপাপ। আল্লাহ কোরআন এ পাকে বলছেন,
– একজন মানুষকে খুন করলেই সে খুনি দোজগে যাবে। আল্লাহ যেন আমারখে মাফ করেন। কিন্তু তহুন গ্রামের পরিবেশ-পরিস্থিতি মানুষের সহ্যির বাহিরে চলি গেছিলো। আমারে আর কুনু উপায় ছিল না। আমি কুনু দিনই খালি লিজের চিন্তা করিনি রে বাপ। রেজা মাডারে- যাবৎ জীবন জেল হলো। যুদ্ধের বছর জেল থাকি পালায়ে আসি দেখছি, গ্রামের পরিস্থিতি পুরাটা উল্টায়ে গেছে। গ্রামে আমারে আর টিকে থাকার উপায় নাই। কারণ রেজার সাঙ্গোগাঙ্গ যারা ছিল- সগ রাজাকারে-শান্তি কমিটিতে যোগ দিছে। তারে হাতে বন্দুক। তাই আমরাও ভারতে যায়ে টেনিং করনু, মুক্তি হয়ে যুদ্ধ করনু। ষোলো তারিখে রায়- আমারে পক্ষে আসলো। তহুন আমরা ফিরে আসনু গ্রামে।
ছোটো বেলাতে, আমরাও আবতার চাচাদেরকে আমাদের পাড়ার- মানে আমাদের গ্রামের বীর মান্য করতাম। অন্তত আমি মান্য করতাম। তিনি মুক্তিযোদ্ধা, সেই হিসেবে আমরা তাকে নিয়ে অবশ্যই গর্বিত। কিন্তু আমি তাদের বীর মান্য করতাম- ঠিক ঐ কারণে নয়। তাদের সামনে শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হতো কারণ তারা আমাদের গ্রামকে একজন অত্যাচারীর হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। কারণ ঐ নির্যাতিত মানুষগুলোর একজন হয়তো আমার বাবা অথবা আমার একজন ভাই অথবা আমার নিকট আত্মীয়দের কেউ একজন। আমার বিশ^াস, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল আবতার চাচার বাম হাতের ঢাল আর রেজা বধ ছিল তার ডান হাতের তলোয়ার।
আমি মনে মনে কতদিন আমার বাবার ওপর রাগ করেছি- এই ভেবে যে, আব্বাও তো আবতার চাচা-আলমাস চাচার বয়সী। তবে তিনি কেন তাদের সাথে গেলেন না? স্যার, এই কবিতাটা আজকে আমার গ্রামের যে কোন জায়গাতে দাঁড়িয়ে পড়লে- গ্রামের অন্তত নব্বই-পঁচানব্বই ভাগ মুরব্বিরা বলবে,
-এই কবিতাতে সত্য কথা বলা হয়নি। কবিতাটি বানানো ও মনগড়া।
রেজাকে এখানে হিরো করে দেখানো হয়েছে। কিন্তু না, সুগার মিলে চাকরির সুবাদে সে সময় রেজা যে অঢেল পরিমাণ অবৈধ টাকা কামাই করেছিল। যে টাকা তার বয়সের তুলনাতে অনেক বেশি। এই ব্যাপারটা সে সামাল দিতে পারেনি। বেসামাল হয়ে পড়েছিলো সে। একটু খেয়াল করে দেখুন স্যার, তিনি ছিলেন মাওলানা আজিমুদ্দিন আল আজহারীর মেয়ে জামাই। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আজহারী সাহেবের মতোন মাওলানা পাঁচ-সাতজনের বেশি ছিলেন না, তাই বলা হতো। তাঁর মতোন মানুষও তাকে সুপথে ফেরাতে পারেননি। আজহারী সাহেব, নিশ্চয় কম চেষ্টা করেননি! আমার দাদা-নানার কাছে শোনা, শত শত মানুষ তাঁর কাছে আসতেন! যারা আসতেন, তারা ফিরে যেতেন সু-পথের সন্ধান নিয়ে।
আমরা যতদূর শুনেছি, ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য করার মতোন ভেদ জ্ঞান তার মধ্যে একেবারেই ছিল না। যাকে ইচ্ছা, তাকেই ধরে এনে বেঁধে রাখত, পেটাত। নূরুল হক বিএসসির মতোন মানুষও তার হাত থেকে রেহাই পাননি। এ কথা কল্পনা করা যায়! তার মতোন জ্ঞানী মানুষ। যিনি বোর্ডের অংক বই লিখেছিলেন। রেজার এই বেসামাল ভাবটাকে কাজে লাগিয়েছিল, আমাদের গ্রামের কূটবুদ্ধির কিছু লোকজন। গ্রামে গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব, জমিজমা নিয়ে ভাগীদের মাঝে বিরোধ অথবা প্রেম-পিরিতি, পরকীয়া এসব নিয়ে যেইসব দ্বন্দ্বগুলো গ্রামে আগে থেকেই ছিল। সেগুলো আজও আছে। কিন্তু রেজার কাঁচা টাকা এবং তার ডন্ট কেয়ার স্বভাবটা- ঐসব ব্যাপারগুলো তখন আরো উসকে দিয়েছিল বলা যায়। কিছু লোক রেজাকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। ফায়দা লুটেছে। আর ওদিকে রেজা ভেবেছে, সবকিছু তার কন্ট্রোলে।
এ পর্যন্ত বলেই আসাদ থামল। কিন্তু উপস্থিত সবাই ভাবছে, সেও হয়তো খলিলের মতোন দম নিয়েছে। গলাটা ভিজিয়ে সে হয়তো আবারও বলতে শুরু করবে। কিন্তু না, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দেখা গেল আসাদের মুখে আর কোন কথা ফুটছে না। তবু কেউ কিছু বলছে না, সবাই তাকিয়ে আছে ইসহাক প্রিন্সিপালের মুখের দিকে। আসাদ হয়তো জানে না, কিন্তু সে ছাড়া এখানে উপস্থিত সবাই জানে ইসহাক প্রিন্সিপাল রেজার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তিনি ধীর-স্থির মানুষ। প্রাজ্ঞজন। কিন্তু রেজার ব্যাপারটা তিনি কিভাবে নেন। এটাই এখন ব্যাপার। তিনি মুখ খুললেন,
-শোনো আসাদ- তোমার বয়স তো একেবারে অল্প কিন্তু তোমার বুদ্ধিসুদ্ধি ভালো। জানাশোনা ভালো। এতো ভালো বিশ্লেষণ আর এমন গভীর-অকাট্য যুক্তিসঙ্গত কথা অনেকদিন শুনিনি। তোমার কথাগুলো মন্ত্রের মতো শুনছিলাম। দারুণ। তা তুমি কী করছো এখন?
– জি, মানে স্যার? এই যে গত গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করেছি। এখনও রেজাল্ট হয়নি।
-ভালো। স্কুলে, না কলেজে?
-কলেজে, স্যার।
-তোমার পড়াশোনা যেন কোন বিষয়ে? নিবন্ধন পরীক্ষার মার্ক কেমন?
-ইতিহাসে স্যার। আর মার্ক ৬৯% স্যার।
-ভালো। কলেজের চাকরিটা হলে, তোমার জন্য ভালো-ই হয়। তোমার উপস্থাপনা আমার ভালো লেগেছে। আল্লাহ তোমার মনের আশা পূরণ করুন।
-তবে আমি ভাই, ইসলামের ইতিহাসের ছাত্র। তুমি পিওর ইতিহাসের… এসব বিষয়ে তোমাদের জানাশোনা বেশি। জানি না, তোমাকে বোঝাতে পারি কি না? এখন আমার এই সাদা চুল-দাড়ি আর এই মোটা কাচের চশমা- মানে আমার অভিজ্ঞতাটুকু-ই ভরসা।
-এই এরফান শোনো, জামিরার জাকারিয়া পীর সাহেব আর বাদুড়িয়ার বিশ^ জয়ী মওলানাদের বাহাজ শুরু হয়ে গেছে। সবার জন্য- আবার চা বলো। এবার, আমার জন্যও বলো। আজকে বাহাজ জমে উঠবে, মনে হচ্ছে। অনেকদিন পর একজনকে পেয়েছি। আমি আগেও আসাদের সাথে কথা বলেছি কিন্তু কখনো তো তাকে বুঝতে পারিনি। জয়নাল পান-টান কিছু খাবে নাকি? খেলে- খাও। এখন তোমরা বড় হয়েছো। এখন কলেজে পড়াও। তোমার চাকরি আর কত বছর আছে?
ইসহাক প্রিন্সিপালের প্রশ্নের উত্তর দিতে যাচ্ছিল জয়নাল মাস্টার কিন্তু ইসহাক প্রিন্সিপালের নিজের কথার চাপেই- জয়নাল মাস্টার আর কিছু বলতে পারলো না।
– শোনো আসাদ, প্রথমে একটা বিষয় তোমাকে ক্লিয়ার করি- আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধও একটা যুদ্ধ ছিল। আর পৃথিবীর সব যুদ্ধ-ই জটিল বিষয়। তাতে নানামুখী দিক থাকে। নানান ঘটনা থাকে। ঘটনার ভেতরেও থাকে নানান ঘটনা। গোপনীয়তার আড়ালেও লুকানো থাকে গোপন আরেকটা বিষয়। খালি চোখে বা অনেক সময় আমার মতোন মোটা চশমাতেও যা দেখা যায়- তা সত্য নাও হতে পারে! আবার সত্যও হতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আমি, নিউ গভর্মেন্ট কলেজে ছিলাম। আমি চাকরি ছাড়িনি। আমার পরিবারের জন্য। তবে আমি জ্ঞানত কারো সাথে অন্যায় করিনি। তাহলে কী, আমি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের লোক ছিলাম। না, তা না। আবার, এই যে- এরফানের বাবা- সে সময় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল। তার মানে কী? সে অন্যায়কারী ছিল। তুমি খোঁজ নিয়ে দেখো- এমাজ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে তাদের গ্রামে বা কোথাও মুক্তিযুদ্ধকালীন কোন অপরাধের প্রমাণ পাবে না। এককথাতে তিনি সৎ লোক ছিলেন। হ্যাঁ, তিনি পাকিস্তানকে সাপোর্ট করতেন। এটা তো তার দোষ না।
-পঁয়ষট্টিতে কলকাতার নাখোদা মসজিদে মুসলমানদের ওপরে হামলা হলো। তার জেরে, এপারেও বিভিন্ন জায়গাতে হিন্দুদেরও ওপরে হামলা হলো। তখন এই পালপাড়াতেও হামলা করলো কিছু জামিরার লোকজন, পালপাড়া লুট করা হলো। কিন্তু পালপাড়ার লুট হওয়া মালামাল এমাজ চেয়ারম্যান সেদিন ফেরত নিয়ে এসেছিল। সে মালামাল তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন পালপাড়ার মানুষদের। এমন কি নিজ বাড়িতে তিনি ঐসব নিরাশ্রয় মানুষদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। এই যে, পালপাড়ার সবচে বড় ডাল মিলটির মালিক মানিক সাহার বাবা- তাদের সমুদয় সম্পত্তি এমাজ চেয়ারম্যানকে লিখে দিয়ে ভারতে চলে যেতে চেয়েছিল। তিনি তাদের সম্পত্তি নেননি। তাদের যেতেও দেননি। তারা সেই বিপদের মুহূর্তে মুসলমান হতে চেয়েছিলেন কিন্তু এমাজ চেয়ারম্যান বলছিলেন,
– না, আমি আমার ধর্ম সম্পর্কে যতটুকু জানি এবং বুঝি- তাতে আমার ধর্ম এটা চায় না। আপনি মুসলমান হলে আমি খুশি কিন্তু এ রকম বিপাকে পড়ে না। এ বিপদ কেটে গেলে- স্বাভাবিক এবং সুস্থ ব্রেনে তখন আপনি মুসলমান হোন, তাহলে আমি খুশি। এখন আপনাদের নিরাপত্তা- আমাদের দায়িত্ব। এটা কি তিনি অন্যায় করেছিলেন? না। তিনি রাজনীতি করতেন। মানুষের মঙ্গল করার চেষ্টা করতেন? আমি ব্যক্তিগতভাবে তাকে জানতাম, তিনিও চাইছিলেন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হোন কিন্তু পাকিস্তান যেন ভেঙে না যায়। বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারেও এ প্রশ্ন তোলা যায়, ইসলামীয়া কলেজে পড়ার সময়, বঙ্গবন্ধু কেন? মুসলিম লীগে যোগ দিলেন? কেন তিনি নেতাজীর সাথে গেলেন না? এই প্রশ্নগুলো এখন কেউ-ই প্রকাশ্যে তুলতে চাচ্ছে না। আজকে তোমাদেরকে সহজ একটা বিষয় শেখানো হচ্ছে,
-একাত্তরে কেউ পাকিস্তানকে সাপোর্ট করতো মানে সে অপরাধী। ঘৃণিত একজন ব্যক্তি। আমি বলছি না, সে সময় পাকিস্তানকে যারা সাপোর্ট করেছে- তারা কেউ অপরাধী নয়। তাদের মধ্যে ভয়ানক অপরাধী রয়েছে। তারা সে সময় ভয়ানক অপরাধ করেছে। সে অপরাধের কথা ভাবলেও গা শিউরে উঠে আমার! ঘৃণাতে গা ঘিনঘিন করে ওঠে এখনও। দেশ স্বাধীনের পর- রাজশাহী ভার্সিটির জোহা হলের নির্যাতিত মা-বোনদের স্বচক্ষে দেখলে- কোন মরা মানুষও বোধহয় ঠিক থাকতে পারতো না! সে সময়ের কিছু মানুষের মুখের দিকে তাকালেই- এখনও আমার রক্ত গরম হয়ে ওঠে। মনে হয়, পিঁপড়ার মতোন তাদের পায়ে পিষে হত্যা করি। কিন্তু পারি না।
আবার অন্যদিকে- অনেক মুক্তিযোদ্ধাও ছিল! যারা তাদের হাতের পবিত্র সে অস্ত্রটি ব্যবহার করে- ডাকাতি করেছে। নিছক ব্যক্তিগত লাভের জন্যে সেই অস্ত্রটিকে ব্যবহার করেছে- এমন ডজন খানেক মানুষের নাম আমি এখনও বলতে পারি! মোট কথা হচ্ছে, পৃথিবীর অন্যতম সেরা পেশাদার একটা বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের তেমন কোন পূর্বপ্রস্তুতি আমাদের ছিল না। আর থাকার কথাও নয়- কারণ আমরা কেউই তো যুদ্ধ চাইনি।
– মার্চের ২৪-২৫ তারিখেও হয়তো তাদের ধারণা ছিল! পশ্চিম পাকিস্তান ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। তাই সশস্ত্র যুদ্ধের জন্যে- যে প্রস্তুতি দরকার, তার কিছু-ই ছিল না। যে কারণে, এই যুদ্ধে মানুষ নানান কারণে নিজেদের জড়িয়েছে। ব্যক্তিগত ক্ষোভ বা লাভের আশাও ছিল এর মধ্যে অনেকের- একটা আদর্শিক সশস্ত্র আন্দোলন নয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। চে গুয়েভারা এবং ফিদেল কাস্ত্রো যেটা করেছে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ঠিক সেই প্যার্টানের ছিল না। এখানে নানান মতের-নানার পথের লোক অংশ নিয়েছিল, নানান উদ্দেশ্যে। বলা যায়, এদেশের মানুষ নিজেদের রক্ষা করতে যা দরকার, তাই করেছে।
-এই যে, এখানে আতিকুর আছে। এরা সে সময় রাতে শলুয়ার রেল ব্রিজ পাহারা দিয়েছে। জামিরার লোকজনকে পাহারা দিতে হয়েছে- বেলপুকুরের রেল ব্রিজ- ওখানে তো আবার এ মহাসড়কের ব্রিজও ছিল, সেটাও তাদের পাহারা দিতে হয়েছে। মুক্তিবাহিনী যেন এ ব্রিজগুলোকে গুঁড়িয়ে না পারে তাই। তার মানে, এরা কী রাজাকার? না, এরা সে সময়ের অসহায় সাধারণ মানুষ। এখনও যেমন তারা মাঠে-ঘাটে বা বাজারে ক্ষুধার সাথে লড়াই করে বাঁচতে চায়, ঠিক তেমনি। তখন তারা অস্ত্রের মুখে রেল ব্রিজ পাহারা দিতে বাধ্য হয়েছে। এ এলাকার মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আওয়াল কাজী- মানে এই দারা এমপির বাবা- আতিকুরদেরকে রেল ব্রিজ পাহারা দেয়ার জন্য পাঠিয়েছে। চৌদ্দ মাইলের ব্রিজ পাহারা দেয়ার জন্য তিনি লোক পাঠিয়েছেন। যেন গ্রামের মানুষকে বাঁচানো যায়। এলাকার মানুষকে বাঁচানো যায়। এটা যুদ্ধের কৌশলগত ব্যাপার। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এখন যেভাবে পড়ানো হচ্ছে অথবা সিনেমা-নাটকে দেখানো হচ্ছে- সেই সূত্রে তো আওয়াল কাজী মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ছিলেন। তওবা। আমি তাকে সম্মান করি।
আমাদের আজকের এই স্বাধীনতা তো আর আকাশ থেকে পড়া অচেনা-অজানা কোন কিছু নয়। আমাদের এই স্বাধীনতা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে তাদের জন্মলগ্ন থেকে চলে আসা যুদ্ধগুলোর একটির ফলাফল- এর সাথে জড়িয়ে আছে কাশ্মিরের তৎকালীন হিন্দু মহারাজা হরি সিংয়ের সিদ্ধান্তের ফলাফল- বাষট্টিতে চীন-ভারত যুদ্ধ, পঁয়ষট্টির পাক-ভারত যুদ্ধ এ রকম নানান কিছু। আজও পৃথিবীর ক্ষমতাধর দেশগুলো আমাদের মুুক্তিযুদ্ধকে- আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নামে ডাকে না। তারা আমাদের স¦াধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, ঠিক। আমি সে প্রসঙ্গে বলছি না, আমি বলছি তাদের গোপন নথিগুলোর কথা- সেখানে আজও আমাদের এই মুক্তিযুদ্ধকে পাক-ভারত যুদ্ধগুলোর একটি মনে করা হয়। ভারতের ‘র’ দাবি করে তাদের সবচে সফলতা হচ্ছে, ‘মিশন বাংলাদেশ’। অর্থাৎ পাকিস্তানকে তারা ভেঙে দিতে সমর্থ হয়েছে। ভারতও তাদের সিনেমা-নাটকগুলোতে হর-হামেশাই এই দাবি করে- তুমি খেয়াল করলেই দেখতে পাবে।