কবি ও গল্পকার সাবিউল হক (জন্ম ২৫ অক্টোবর ১৯৬৩-মৃত্যু ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ খ্রি.) চলে গেলেন বেশ কিছুদিন শয্যাসায়ী থাকার পর। গেল মাসে তাঁর খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পেরেছিলাম- তার শারীরিক অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছিল। আমার এক সিনিয়র আইনজীবীর কাছে জানলাম, নামাজ পড়তে গিয়ে একবার মসজিদে পড়ে গিয়েছিলেন। তারপর আমার উপরও ব্যস্ততাময় জীবনের ঝড় বয়ে গেছে। ভাবতে খারাপ লাগছে, এরপর তার নিয়মিত খোঁজ-খবর নেয়া হয়নি। মারা যাবার সাত দিন পর কবি ঔপন্যাসিক মঈন শেখ মারফত শোকাবহ খবর পেয়ে মনটাই বেশ খারাপ হয়ে গেল। কবি আহমদ বাসিরের মৃত্যুর পর ভেবেছিলাম এই রকম অকাল প্রয়াণের খবর আমাকে সহসা শুনতে হবে না। তবু শুনতে হলো। এটাই হয়তো মানব জীবনের ধারাবাহিকতার ফসল। তবে এই ধারাবাহিকতার ফসল সম্বন্ধে সাবিউল হক একেবারে অচেতন ছিলেন, সে রকম মন্তব্য করা আমার জন্য শোভনীয় হবে না। কারণ ১৯৯১ সালের ৯ আগস্ট তাঁর সৃজিত একটি কবিতায় প্রবল বেদনায় চমৎকারভাবে তার আগাম আভাসও দিয়েছিলেন। এ যেন তাঁর কবরের এপিটাফ-
তেমনি সাজানো থাকবে এইসব আশ্চর্য দুপুর
সুন্দর প্রচ্ছদপট শোকেশের বইপত্র, দেয়ালে সুদৃশ্য ক্যালেন্ডার।
থাকবে ফুলের টব, ডিসটেম্পার, টেবিলে নতুন ম্যাগাজিন
আমি নেই। তবু ঠিক কেটে যাবে সেইসব দিন।
(আশ্চর্য নতুন: সেইসব দিন)
সাবিউল হকের সাথে রাজশাহী মহানগরীতে কবে কোথায় দেখা হয়েছিল- আজ আর মনে পড়ছে না। আর এ কথা বললে খুব আশ্চর্য শোনাবে, আশির দশকে একঝাঁক তৌহিদবাদী কবির ঝাঁজালো কণ্ঠস্বর তথাকথিত সা¤্রাজ্যবাদীদের হৃদয় কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ফলশ্রুতিতে এই ধারাকে শামসুর রাহমানের মত বিশিষ্ট কবিরা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। আর সাবিউল হক সেই শুভবোধের আস্তিক স্রােতধারার একজন অন্যতম ফসল। আমাদের সাহিত্য-জগৎটাই বড় অদ্ভুত। কুরআন হাদিস বা ইসলামের চমকপ্রদ ঘটনাবলি যে কবিতা গল্পের, নিদেনপক্ষে উপন্যাসের বিষয়বস্তু হতে পারে; এই সত্য কথা বলতেই অনেকের পিলে চমকে যায়। আমি এ পটভূমিতে প্রয়াত কবি গল্পকার সাবিউল হককে আমাদের সাহিত্যাঙ্গনের একজন সাহসী সন্তান বললে কম কলা হবে না। আল মাহমুদের কাব্য সাধনার বাঁক পরিবর্তন তাকে দারুণ আন্দোলিত করেছিল। বিশেষত ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পর। আমি তার কণ্ঠে একাধিকবার এই কাব্যগ্রন্থের ‘নারী’ কবিতাটি আবৃত্তি করতে দেখেছি। তবে এই সময় আল মাহমুদের প্রথমদিককার কবিতার কথা উল্লেখ করলেই তিনি মৃদু মৃদু হাসতেন। আসলে সাবিউল হক কোন রকম বিতর্ক করতে চাইতেন না। এই গুণ আমি তার অন্যতম প্রিয় বন্ধু কবি হাসানুজ্জামান নান্নুর মধ্যে দেখেছি। সেই হাসানুজ্জামান এখন ব্যাংকার হয়ে কবিতার জগৎ ছেড়ে দিলেন। আমাদের সৌভাগ্য তিনি হাসানুজ্জামানের পথ অনুসরণ করলেন না। শেষ পর্যন্ত সাহিত্যকে মনে প্রাণে ধারণ করেই চলে গেলেন। আর এখানেই তার মহত্ত্ব। সাবিউল হক এক সময় হয়ে উঠেছিলেন তুমুল সৃজনশীল লেখক। কী লিখেননি তিনি। ছড়ার পাশাপাশি লিখলেন ছোটগল্প। তাতেও সন্তুষ্ট না হয়ে লিখলেন আবার উপন্যাস। গল্পের তুলনায় কবিতা কম সৃজন করেছেন। তবে যেটুকু লিখেছেন- তাও শিল্পসম্মত- আর সেগুলো গ্রন্থিত হয়েছে ‘আশ্চর্য নতুন’ নামের কাব্যগ্রন্থে (এযাবৎ একমাত্র)। এই কাব্যগ্রন্থটি পড়তে পড়তে অবাক হয়েছিলাম এই ভেবে যে, গ্রন্থটি কেন আলোচিত হয়নি। প্রশ্ন করে লাভ নেই। আমাদের সাহিত্যের ভালো তরুণ কবিদের এই এক অনিবার্য বিধিলিপি। কবিতায় সাবিউল হক ছিলেন কবিতার প্রাণিত ধারার একরকমCounter Image. সেটা কী রকম। সাম্প্রতিককালের কবিরা যেখানে নদী-নারীর কবিতা লিখে দিস্তা দিস্তা পাতা ভরে দিয়েছে- আর সেখানেই সাবিউল হক বিপরীত উচ্চারণ করেন এইভাবে-
নদী ও নারীর কাছে নতজানু
আর কতদিন?
সিজদার আঙ্গিনা থেকে সরিয়ে নাও
এসব সম্পদ
সময়ের সমান্তরালে এসব তো
হবেই বিলীন
আঙ্গুরের তাজা ঘ্রাণ কেন বল
হতে দেব মদ?
(উপলব্ধি)
এই কবিতাটি প্রথম পড়েছিলাম, ঢাকা ডাইজেস্ট-এ ছাপার অক্ষরে। পড়ে খুব যে আলোড়িত হয়েছিলাম সেই রকম বলা যাবে না। তবে বলতে দ্বিধা নেই, ভালো লেগেছিল। তখন ভেবেছিলাম একজন কবি বিপরীত উচ্চারণ করে খ্যাতিময়তা অর্জন করে, তবে তো আমাদের সাহিত্যেরই লাভ। তবে কবিতা বেশি লিখলে বলা যেতো, সাবিউল হক কবিতায় কোন জায়গায় যেতে পারতেন। পাশাপাশি তিনি কবিতায় যে সপ্রতিভাটা দেখিয়েছেন, তা বর্তমানের কবিতায় পাওয়া অনেকটা অসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার কবিতার যে গুণটি আমাকে বরাবর আকর্ষণ করেছে, সেটি হলো তার অসাধারণ ছন্দ সচেতনতা। বোঝাই যাচ্ছে কবিতা সৃজনের আগে ছন্দপাঠের ভালোই প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। এই তথ্য আমাদের খুশি করেছিল। আপাতত কয়েকটি উদাহরণ পাঠকের সামনে তুলে ধরলাম।
মাত্রাবৃত্ত:
তুমিতো এখন নাগরিক হয়ে গেছ
ভুলেই গিয়েছ প্রজাপতি-মাঠ, ঋণ
দোয়েলের শিষে মুগ্ধ সকালবেলা
পাল তুলে যাওয়া নৌকার মতো দিন।
(সেইসব কথা)
মুক্তক অক্ষরবৃত্ত:
তুমি যাও। চলে যাও। সাথে করে নিয়ে যাও সুখ রাজহাঁস।
সূর্যাস্ত, সূর্যোদয় দেখবার সযত্ন প্রয়াস।
নিয়ে যাও গাঙচিল, গোলাপের সৌরভ, যৌবনের মধুরতম দিন।
নিয়ে যাও, নিয়ে যাও, রাখব না আমি এই সময়ের কাছে কোনো ঋণ।
(নিয়ে যাও)
৮/১০ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত
নদী ও নারীর কাছে কবিদের নেই
কোনো ঋণ
যদিও এসব থেকে প্রেরণা যে পায়
চিরদিন
(ঋণ)
অন্যদিকে আবার সাবিউল হক সনেট লিখেও নিজের ভাব-বেদনা ব্যক্ত করেছেন। আর সেই ভাব-বেদনার ভাববস্তু হলেন তার প্রিয় কবি আল মাহমুদ। স্বীকার করা ভালো, তার এই প্রথম শ্রেণির সনেট কবিতাটি এর আগে আমার পড়ার সৌভাগ্য হয়নি। তিনি কবিতাটি লিখেছেন কবি আল মাহমুদকে স্মরণ করে। এর কয়েকটি চরণ এখানে উদ্ধৃত করছি-
যেভাবেই বেড়ে ওঠ, যেভাবেই কাটুক কৈশোর
নুন ও পানি সাঁতরিয়ে, মৌমাছি বয়স পেরিয়ে
জীবন নদীর পাশে জমে থাকা জঞ্জাল এড়িয়ে
এই লোক লোকান্তরে খুঁজে পেলে বিশ্বাসের চর।
… …. …
দুলিয়ে মায়াবী পর্দা শেষে পেলে সুরভিত ছবি
সেই সৌরভের কাছে পরাজিত হলে তুমি কবি।
(আল মাহমুদের প্রতি)
কবিতাটি পুরো তুলে দিতে পারলে কৃতার্থবোধ করতাম। তবে আমার ব্যক্তিগত বিশ^াস, কখনও বাংলাদেশের তরুণ কবিদের সনেট সঙ্কলন হলে সেখানে এই কবিতাটি ঠাঁই করে নিবে। কবি এই গ্রন্থে গদ্য কবিতাতে তার দক্ষতা দেখালেও স্বরবৃত্ত ছন্দের কোন কবিতা আমার চোখে পড়ল না। কেন পড়ল না সেটাও গবেষণার বিষয় হতে পারে। তবে তার মত বিশ^াসী মানুষও মনে মনে অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগছেন সেটাও আমার ভাবতে অবাক লাগে। আবার তিনি ছিলেন চিরকালের আধুনিক মানুষ। তাই বলেছেন-
মাঝে মাঝে আমি নিজের কাছে নিজেই দুর্বোধ্য হয়ে উঠি
আশ্চর্য এক অচেনা আমিকে নিয়ে আমার ভেতরে আমি করি বসবাস।
(আত্মকথন)
আগেও উল্লেখ করেছি সাবিউল হক কেবলমাত্র কবিতার জগতে সীমাবদ্ধ থাকেননি। গল্পও লিখেছেন। আর এটাও রীতিমত বিস্ময়কর বিষয় যে, তার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থই ছিল গল্পের, যার নামকরণ করেছিলেন ‘ঢেউ’। প্রকাশিত হয়েছিল সেই ১৯৯৫ সালে। এই গ্রন্থটি যখন প্রথম পড়েছিলাম তখন আমাদের সমকালীন কারো কোন বই প্রকাশ পায়নি। তবে সেই সময় এই গল্পগ্রন্থটি পড়েছিলাম কি না এখন আর মনে পড়ছে না। এখন তার দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘একগুচ্ছ ফুল’ হাতের কাছে পাওয়া গেল। স্বীকার করা ভালো, গল্পে সাবিউল হক ছিলেন মারাত্মক আদর্শবাদী। এই ধরনের আদর্শ নিয়ে চমৎকার গল্প লেখা যায় কিনা জানি না; এতে অনেক ক্ষেত্রে গল্পের শিল্প-মান ক্ষুণœ করে থাকে। সাবিউল হকের গল্প কোন কোন ক্ষেত্রে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে- যেটা নির্দ্বিধায় স্বীকার করা যায়। আবার কোন কোন গল্পে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। যেমন ‘একগুচ্ছ ফুল’ গ্রন্থে ‘সেরা উপহার’ গল্পের শুরুতেই পাচ্ছি-
সহকর্মী আহাম্মদ হোসেন রাজুকে বললাম, ‘একই গল্পের দুটো নাম। দুটো নামই সার্থক। কোনটা রাখি, কোনটা বাদ দিই বলোতো?’ ও গল্পটা পড়ে বলল, ‘দুটো নামই সার্থক। ভাইয়া, মানুষেরও তো একাধিক নাম থাকে। দুটো নামই থাক। না হয় হোক না নতুন একটা স্টাইল। বাংলা সাহিত্যে নতুন একটা স্টাইল চালু হোক।’ তাই রেখেই দিলাম।
গল্পের দুই রকম নামকরণ এর আগে কোন সময় চোখে পড়েনি। এবারই প্রথম পড়লো। তবে তার গল্পের বিষয়বস্তু বেশ সাধারণ। বাজার চলতি গল্প থেকে আবার আলাদা। অন্যদিকে অনেক গল্প শেষ হতে গিয়ে শেষ হয়নি। এর কারণ হলো তার খানিকটা অতিরিক্ত আদর্শবাদিতার প্রয়োগ। ভবিষ্যতে কোন আলোচক এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবেন বলে আশা করি। আসলে চুলচেরা বিশ্লেষণ করার সময় এটা নয়। সত্যি বলতে কি আমাদের এখানে সমালোচনা-সাহিত্য বারোদিনের শিশুর মতো। তবে পাঠকদের জানিয়ে রাখি সময়ের কালান্তরে সাবিউল হক সাহিত্যে মুখচেনা মানুষ হতে গিয়ে পথ হারালেন।
পারিবারিকভাবে বিপর্যয় নেমে আসে তার পিতার মৃত্যুর পর। বলতে গেলে পরিবারের ভার পুরোটাই তার কাঁধে এসে পড়ে। এর মধ্যে থেকে তার সাহিত্য-সাধনা চলতে থাকে। ১৯৮৮ সালে জেলা পর্যায়ে প্রথম হন একুশের বাংলাদেশ পরিষদ আয়োজিত প্রতিযোগিতায়। আবার ‘নতুন চাঁদ’ মাসিক পত্রিকা আয়োজিত দেশব্যাপী রাসূল সা.-এর উপর গল্প প্রতিযোগিতায়ও প্রথম হয়েছিলেন। এছাড়া তার অনেক লেখা দেশের প্রথম শ্রেণির পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ‘পরিচয় সংস্কৃতি সংসদ’- এর এক অনুষ্ঠানে তাকে খুব নিবিড়ভাবে পেয়েছিলাম। সেই অনুষ্ঠানে তার নিজের সাহিত্যকেন্দ্রিক ধ্যানধারণা ব্যক্ত করেছিলেন। আমার যতদূর মনে পড়ে- বিশিষ্ট কথাশিল্পী নাজিব ওয়াদুদ ও নতুন এক মাত্রার নির্বাহী সম্পাদক ড. ফজলুল হক তুহিনও ছিলেন। তারাও সাবিউল হকের সাহিত্য-সাধনার প্রশংসা করেছিলেন। সাবিউল হক তার ভাষণে জানিয়েছিলেন- পাঁচটি মাধ্যমে প্রায় ৫০টি পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছেন। এই তথ্য শোনার পর নাজিব ওয়াদুদ সাবিউল হককে পরামর্শ দিয়েছিলেন বই আকারে বের করতে। অথচ জীবদ্দশায় তিনি হলেন মাত্র তিনটি গ্রন্থের ¯্রষ্টা। অপ্রকাশিত রয়ে গেল অজ¯্র লেখার সমাহার। আর সত্যিকারের দেশপ্রেমিক ছিলেন বলেই লিখতে পেরেছিলেন-
সময় কাউকে জয় করে নেয়, কেউ সময়কে জয়
তুমি ধরে আছ জয়ের পতাকা
জাগ্রত বিস্ময়!
(জাগ্রত বিস্ময়)
সাবিউল হকের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।