দুই বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নজরুল গবেষক ছিলেন সাহিত্যিক আজহারউদ্দিন খান। প্রকৃত সৎ ও বিশুদ্ধ ধারার সাহিত্য সাধক মহৎপ্রাণ মানুষ আজহার উদ্দিন খান গত ২২ শে জুন ২০২১ একানব্বই বছর বয়সে আমাদেরকে নিঃস্ব করে মহামারীর কালে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে আজহার উদ্দিন খান লিখেছিলেন দুই বাংলায় কবি নজরুল ইসলামকে নিয়ে প্রামাণ্য আকরগ্রন্থ ‘বাংলা সাহিত্যে নজরুল’।
সাহিত্যিক আজহারউদ্দিন খান লিখেছেন, “দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমার হাতে ‘সঞ্চিতা’ আসে। ‘সঞ্চিতা’র ‘সাম্যবাদী’ কবিতা সমষ্টি আমাকে আলোড়িত করে, ‘বিদ্রোহী’ কবিতা আমার ঘুম কেড়ে নেয়। কলেজে ভর্তি হয়ে নজরুলের দারিদ্র্যের খবর জানতে পারি। জীবন সায়াহ্নে কবিকে আমি দেখতে গেছিলাম। কবি তখন ছিলেন বাদুড়বাগান লেনে। ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৪৯। কলকাতা গেছিলাম জরুরি কাজে। ইচ্ছে হলো কবি নজরুলকে দেখবার। মনে ভয়ও ছিল কেমন না জানি তাকে দেখবো। তাড়াতাড়ি কাজ সেরে কবিকে দেখতে গেলুম। গিয়ে দেখলুম কবির স্ত্রী একটি খাটে শায়িত। তার পালিত মেয়েটি কাপড় সেলাই করছেন ও অনিরুদ্ধ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে একটা পত্রিকা উল্টাচ্ছেন। আমাকে হঠাৎ দেখে একটু থমকে গেলেন। আমি কেন এসেছি জিজ্ঞাসা করলেন অনিরুদ্ধ। আমার ইচ্ছে তাকে জানালুম। কবির স্ত্রীর সঙ্গে প্রথমে এমনি সাধারণ পরিচয়ের কথাবার্তা হলো। কথাবার্তায় জানলুম তিনি পাশ ফিরতেও পারেন না। নিচের অঙ্গ পক্ষাঘাতে একেবারে অচল।
অতিকষ্টে চিঠিপত্রের উত্তর দেন। কথাবার্তা হতে হতে হঠাৎ দেওয়ালে টাঙানো কবির ছবি দেখলুম, কি অপরূপ সুন্দর ছবিখানা।
ছবিটা দেখে মনটা একটু গুমরিয়ে উঠলো। সেই উজ্জ্বল, প্রোজ্জ্বল মহান মুখশ্রী, সেই তীক্ষè আরক্ত অপাঙ্গ চোখ, সেই উদার গম্ভীর স্বচ্ছ ললাট আর কি দেখবো? ছবি থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলুম। মুখ নিচু করে বসে আছি। এমন সময় কবির পালিতা কন্যা উঠে গিয়ে পাশের ঘরের কপাট খুললেন। কবি নজরুল বেরিয়ে এলেন। চমকে উঠলাম, এ নজরুলকে দেখে চোখ কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না যে, ইনিই বিদ্রোহী কবি নজরুল। পরনে একটি লুঙ্গি ও ধূসর বর্ণের হাফ শার্ট।
মুখে একটা উত্তেজনার ভাব ফুটে বেরোচ্ছে তার। সেই বিদ্রোহী প্রাণশক্তির ছাপ অস্তরাগের বিলীয়মান আভার মত মুখে খেলা করছে।
দরজার পাশেই আসন পাতা, চারিদিকে বিভ্রান্তের মত তাকিয়ে আসনে বসে পড়লেন। পাশেই পুরনো মাসিক সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলো ছেঁড়া অবস্থায় গুটানো রয়েছে। সেগুলোর পাতার পর পাতা উল্টিয়ে চলেছেন পড়েন না। যখন সবগুলো উল্টানো শেষ হয়ে যাচ্ছে সেগুলোকে ফিরিয়ে গোছ করে আবার উল্টিয়ে চলেছেন। কথাবার্তা বলেন না।
মাঝে মাঝে কি একটা বলছেন তা জড়িয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারা যাচ্ছে না।
কবির স্ত্রী বললেন, কথাবার্তা তো বলেন না।
যখন কপাট খুলে দেওয়া হয় বা কখনো নিজে কপাট খুলে ওই জায়গাটিতে বসে ওই বইগুলো উল্টাতে থাকেন।
এই ওল্টানোর ফলেই বইগুলোর অবস্থা এরূপ হয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম খাওয়া-দাওয়া সম্বন্ধে তিনি কিছু বলেন কি?
উত্তরে তিনি বললেন, খাওয়া-দাওয়া সম্বন্ধে একেবারে উদাসীন।
আমরা সময়মতো খাইয়ে দিই। যা দেওয়া হয় তাই খেয়ে নেন।
দুপুর বেলা কোনদিন একটু ঘুমায়, নইলে ঘরে বসে শুধু পাগলের মত চলাফেরা করতে থাকেন, বা চুপ করে বসে থাকেন, আর ওই বিড়বিড় করে বকে চলেন। রাত্রে তার বেশ ঘুম হয়। স্মৃতিশক্তি একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সবই যেন তার কাছে অন্ধকার।
পুরনো বন্ধু-বান্ধবদের দেখলেও চিনতে পারেন না।
কবি মাঝে মাঝে আমার দিকে উদাসভাবে তাকাচ্ছেন, আর ভিজে আঙুল দিয়ে পাতা উল্টিয়ে চলেছেন। কি যেন একটা জরুরি জিনিস খুঁজছেন। একটি একটি করে পাতা উল্টান না, একসঙ্গে দশ বারো পাতা উল্টানো হয়ে যাচ্ছে। পূর্বের পাঠাভ্যাস ছাড়তে পারছেন না যেন। আমার দিকে তাকিয়ে কি যেন বললেন। কবির স্ত্রীকে এর অর্থ জিজ্ঞাসা করলুম। কবিপত্নী বললেন, কিছু বুঝতে পারলুম না। আবার কবির টাঙানো ছবির দিকে দৃষ্টি পড়ে গেল। শিউরে উঠলুম, যেন চিনতে পারছি না। এ কবি আর ছবির কবি যেন এক নয়-ভিন্ন। যে কবি বলেছিলেন, ‘আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি এক চির-উন্নত শির’-তার উন্নত শিরের ও ইন্দ্রিয়ের দরজাগুলো একে একে রুদ্ধ হয়ে আসছে। মুখ তার শীর্ণ, আগুনের মত গায়ের রঙ ফিকে হয়ে গেছে, কেশব এর মত যে কেশগুচ্ছ তার ঘাড় বেয়ে নামতো, তা উঠে গেছে।
সে সৌম্য মূর্তি আর নেই। তার কবিতার বই রইল।
রইল তার বিচিত্র বহু কর্মজীবনের উজ্জ্বল অবিনশ্বর ইতিহাস।
কিন্তু সমস্ত কীর্তির অন্তরালে ছিলেন যে কবি নজরুল, তিনি আর নেই।
তার স্থানে আছে রোগে জীর্ণ নজরুল। কবির স্ত্রীকে তাদের সাংসারিক অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করলুম।
তিনি বললেন, পূর্বে যে অবস্থায় চলত সেই অবস্থা।
কবির স্ত্রীকে অনুরোধ করলাম যে আমার খাতায় কবি যেন তার নামটি লিখে দেন।
তখন অনিরুদ্ধ আমার খাতা আর ফাউন্টেন পেন নিয়ে কবিকে দিয়ে বললেন, লেখ তো বাবা, কাজী নজরুল ইসলাম।
কবি নামটি লিখে দিলেন।
কবিপত্নী সেটা দেখে আমাকে বললেন, আপনার ভাগ্য দেখছি খুব ভালো, কেননা আজকাল উনি কোনো কিছু লিখতে চান না। যদিও লেখেন তাও দু’ একটা অক্ষর।
লেখার পরই খাতা কলম ছুঁড়ে ফেলে দেন, কিংবা একটা আঁকাবাঁকা লাইন টেনে দেন। কবি এখনো আনমনে বইয়ের পাতা উল্টিয়ে চলেছেন। বেলাও বেশ হয়েছে। কবির স্ত্রীকে নমস্কার জানিয়ে আর নির্মম দেহবন্ধনে জর্জরিত কবিকে অন্তরে আমার শ্রদ্ধা ও প্রণতি জানিয়ে বিদায় নিলুম। আমাদের অবহেলায় বিষাক্ত সমাজের কদর্য পরিবেশ ও দারিদ্র্যের নিষ্ঠুর আঘাতে জর্জরিত হয়ে কবি নজরুল মৃত্যুপথযাত্রী হয়েছেন।”
অসুস্থ কবিকে প্রত্যক্ষ দর্শনের অনুভূতি থেকে লিখেছিলেন নজরুল ইসলামকে নিয়ে প্রথম লেখা কবি দর্শনে। ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসে যুগান্তর সাময়িকীতে লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর, আরো কয়েকটি পত্রিকায় লেখাটি পুনঃপ্রকাশিত হয়। তারপর থেকে কবি নজরুল ইসলাম সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের কাজে উন্মাদের মতো নিজেকে নিয়োজিত করেন। সেই পরিশ্রমের ফসল ‘বাংলা সাহিত্যে নজরুল’। ১৯৫৪ সালের ২৬ মে ‘বাংলা সাহিত্যে নজরুল’ গ্রন্থটির যখন প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়, তখন আজহারউদ্দিন খান ছিলেন কলেজপড়ুয়া। নজরুল গবেষক আজাহারউদ্দিন খানের কৃতিত্ব হলো তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যে নজরুল’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পরই কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে দু’-বাংলাতেই নজরুল-বিষয়ক গ্রন্থ রচনার আগ্রহ তৈরি হয়। এই মুহূর্তে নজরুল-বিষয়ক পুস্তকের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক হলেও আলোচনার গভীরতা ও তথ্যের ব্যাপকতায় তাঁর রচিত নজরুল বিষয়ক গ্রন্থটি সাহিত্য সমালোচকদের কাছে আকর গ্রন্থের মর্যাদা লাভ করেছে। ‘বাংলা সাহিত্যে নজরুল’ গ্রন্থের প্রথম সংস্করণ এর ভূমিকায় সাহিত্যিক আজহারউদ্দিন খান লিখেছিলেন, ‘আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ধ্রুবাকাশে কাজী নজরুল ইসলাম একটি জ্যোতিষ্ক বিশেষ। এই জ্যোতিষ্কের উজ্জ্বলতার যথার্থ বিচার এখন পর্যন্ত হয়নি।’
সাহিত্যিক আজহারউদ্দিন খানের জন্ম ১৯৩০ সালে ১ লা জানুয়ারি মাতুলালয়ে মেদিনীপুরের মীর বাজারে। মামার বাড়িতে থেকে মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুল ও মেদিনীপুর কলেজে পড়েছেন। মেদিনীপুরের জেলা গ্রন্থাগারে গ্রন্থাগারিক ছিলেন। নিজের বিদ্যালয় জীবন সম্পর্কে কলেজিয়েট স্কুলের ‘আলো’ পত্রিকাতে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন, শহরে কোন গণ্যমান্য ব্যক্তি এলে তাঁকে দিয়ে স্কুলের সভার আয়োজন করা হতো। কবি অমিয় চক্রবর্তী বাইশে শ্রাবণ উপলক্ষে একবার মেদিনীপুর কলেজে এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে স্কুলে আনা হয়েছিল এবং তাঁর হাত দিয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি উন্মোচিত করা হয়েছিল। একবার কবি গোলাম মোস্তফা বাঁকুড়া জেলা স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে প্রীতি ফুটবল খেলতে এসেছিলেন। তাঁকে নিয়েও একটি সভার আয়োজন করেছিলেন প্রধান শিক্ষক। এই বিদ্যালয়ের কল্যাণে আমি ছাত্রাবস্থায় রবীন্দ্রনাথকে দেখি, রবীন্দ্রনাথকে দেখা এক পুণ্য সঞ্চয়। রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৯ সালের ২৬ শে ডিসেম্বর বিদ্যাসাগর স্মৃতি মন্দির উদ্বোধন করতে মেদিনীপুর এসেছিলেন। ‘মেদিনীপুরে রবীন্দ্রনাথ’ এই প্রবন্ধটি আজহারউদ্দিন খানের প্রথম লেখা। কিন্তু পত্রিকাটি প্রকাশে বিলম্ব হওয়ায় নজরুলকে নিয়ে ‘কবি দর্শনে’ লেখাটি প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধের মর্যাদা পেয়েছে। আজহারউদ্দিন খান তাঁর দীর্ঘ সাহিত্যচর্চার জীবনে রচনা করেছেন শতাধিক মূল্যবান প্রবন্ধ, ২৬টি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধগ্রন্থ এবং ১২টি গ্রন্থ। তিনটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন লিখেছেন ৩০টির বেশি গ্রন্থের ভূমিকা।
লেখক জীবনের সূচনাপর্বে নিজের লেখার বিষয় কি হবে- সাহিত্য না ইতিহাস, সমাজ না দর্শন এ বিষয়ে দ্বিধান্বিত ছিলেন সাহিত্যিক আজহারউদ্দিন খান। সাহিত্যিক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের পরামর্শে আত্মানুসন্ধানের লক্ষ্যে নিজের ধর্ম ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে জানার প্রবল আগ্রহে লেখা শুরু করেছিলেন। ১৯৫৭ সালে আবদুল আজিজ আল আমান সম্পাদিত ‘জাগরণ’ পত্রিকায় আজহারউদ্দিন খানের ‘ইসলাম ও বহু বিবাহ’ নামক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। এই প্রবন্ধটিতে মুসলিম সমাজের বহুবিবাহ ও পীরপ্রথা নিয়ে লেখকের কিছু বক্তব্যে কলকাতার মুসলিমদের একাংশ ক্ষুব্ধ হয়ে জাগরণ পত্রিকার দফতর ও প্রেস পুড়িয়ে দিয়েছিল। প্রশাসনিক নির্দেশে আজহারউদ্দিন খানের এক বছর কলকাতা যাওয়া নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এই ঘটনা প্রবাহের জেরে আজহারউদ্দিন খান তাঁর লেখালেখির ধারা পাল্টে ফেলেন। এই পরিবর্তিত সাহিত্য-সাধনার উজ্জ্বল উদ্ধার ‘বিলুপ্ত হৃদয়’ গবেষণাগ্রন্থ। আজহারউদ্দিন খান গভীর যন্ত্রণায় উপলব্ধি করেছিলেন এ বঙ্গের সাহিত্য সমালোচকদের আলোচনায় মুসলিম লেখকদের প্রতি স্বাভাবিক উপেক্ষার মনোভাব। কিন্তু এদের বাদ দিয়ে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস অসম্পূর্ণ। আজহারউদ্দিন খানের কৃতিত্ব উপেক্ষিত সারস্বত ব্যক্তিদের আলোচনার বৃত্তে এনে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের অসম্পূর্ণতা অনেকটা পূরণ করেছেন। বিলুপ্ত হৃদয় গ্রন্থের ভূমিকায় আজহারউদ্দিন খান লিখেছেন, বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্য সাধকদের সম্পর্কে কিছু কথা বলার একটা আর্তি, ইচ্ছে আমি মাঝে মাঝে অনুভব করেছি। তাঁরা ঐতিহ্য সৃষ্টি করেননি, তুঙ্গশীর্ষ প্রতিভার অধিকারীও নন। কিন্তু ঐতিহ্য গঠনে ও সাহিত্যে সম্প্রসারণে নিজেদের সাধ্যমত সহায়তা করেছেন। বিস্মৃতপ্রায় মুসলিম সাহিত্য সাধকদের নিয়ে তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হলো- ‘অফুরন্ত রৌদ্রের তিমির’, ‘দীপ্ত আলোর বন্যা’।
সাহিত্যিক আজহারউদ্দিন খানের বৈশিষ্ট্য প্রধানত সাহিত্যচর্চার যে সমস্ত দিক অনালোচিত, বা যে সমস্ত প্রতিভাবান সারস্বত ব্যক্তি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা গ্রন্থ রচনায় কেউ উৎসাহ বোধ করেননি। সেসব বিষয়ে গবেষণামূলক কর্মে নিজেকে নিবিড়ভাবে যুক্ত রেখেছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল পথিকৃতের। নজরুল ইসলাম, মোহিতলাল মজুমদার, মুহম্মদ আবদুল হাই, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের মত সাহিত্য ব্যক্তিত্বদের জীবন ও কর্মবিষয়ে আজহারউদ্দিন খানই প্রথম গ্রন্থ রচনা করেন। প্রতিভাবান মুসলিম সাহিত্য ব্যক্তিত্বদের অন্যতম মীর মশাররফ হোসেন, গোলাম মোস্তফা, কায়কোবাদ, মোজাম্মেল হক, এস ওয়াজেদ আলী, শাহাদত হোসেন এবং জসীমউদ্দীনের জীবন ও সৃষ্টি সম্পর্কে এ বাংলায় আজহারউদ্দিন খানই প্রথম আলোচনার সূত্রপাত ঘটান। বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসের অসম্পূর্ণতা মোচনে আজহারউদ্দিন খানের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল ফজল, হুমায়ুন কবীর, বন্দে আলী মিঞা, আবদুল কাদিরের পত্রালাপের সম্পাদনা। এদের প্রত্যেকের গ্রন্থপঞ্জি প্রণয়ন মূল্যবান সংযোজন। সাহিত্যিক আজহারউদ্দিন খান ভাষাতাত্ত্বিক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর জীবন ও সাহিত্য সৃষ্টি নিয়ে লিখেছেন ‘মেধাবী নীলিমা’ গ্রন্থ। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের জীবন ও সাহিত্যসৃষ্টি নিয়ে লিখেছেন ‘মাঘ নিশীথের কোকিল’। সাহিত্যিক আবদুল হাইয়ের জীবন ও সাহিত্যচর্চা নিয়ে লিখেছেন ‘ভোরের আকাশের শুকতারা’। আর সাহিত্যিক মুনীর চৌধুরীর জীবন ও সাহিত্য নিয়ে লিখেছেন ‘রক্তাক্ত প্রান্তরের বিষণœ নায়ক’।
নজরুল ইসলামকে বাদ দিলে বাংলাসাহিত্যের অনন্ত আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্রদের মধ্যে ভাষাতাত্ত্বিক মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, মুহম্মাদ আবদুল হাই ও মুনীর চৌধুরী এই চারজন সাহিত্য সেবককে নিয়ে তিনি কেন বারবার আলোচনা করেছেন, সে সম্পর্কে ‘দীপ্ত আলোর বন্যা’ গ্রন্থের পূর্বাভাস অংশে লিখেছেন, একটা জাতির মনঃশ্চক্ষু উন্মীলনে এঁরা প্রধান সহায়ক ছিলেন। ইংরেজরা মুসলমানদের কাছ থেকে সাম্রাজ্য ছিনিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান সমাজ সবদিক থেকে নিঃস্ব, দরিদ্র, হতোদ্যম হয়ে পড়ে। শুধু সামাজিক অর্থনৈতিক দিক দিয়ে নয়, ঐতিহ্য বিস্মৃত হয়ে একটি হীনম্মন্য জাতিতে পরিণত হয়। ১৮৫৭ সালের পর মুসলমানরা নিজেদের ভুল বুঝতে শুরু করলো। নতুন দিনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী হলো। তখন কিন্তু হিন্দুরা ইংরেজি শিক্ষা আয়ত্ত করে জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। এসময় মাতৃভাষা বাংলা হবে না উর্দু হবে অভিজাত ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষ বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যায়। এই রকম মুহূর্তেই একঝাঁক মুসলিম লেখকের আবির্ভাব ঘটে। যার নেতৃত্ব স্থানীয় ছিলেন মীর মোশাররফ হোসেন। তখন মধু-বঙ্কিমের যুগ চলছে। আর মুসলমান লেখকরা সঙ্কট কাটিয়ে সবে হাঁটি হাঁটি পা নিয়ে চলতে শুরু করেছেন। ঐ নতুন লেখকরা তখনকার সাহিত্য রীতিতে সাধ্যমতো সৃষ্টিশীল রচনায় ব্যাপৃত ছিলেন। কিন্তু প্রাচীন ঐতিহ্য উদ্ধারের কোনো প্রয়াস তাদের মধ্যে দেখা যায়নি। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদই প্রথম যিনি অতীত সাহিত্যসম্পদ উদ্ধার করে বাঙালি মুসলমানকে এক শক্ত ভূমির ওপর দাঁড় করিয়ে দিলেন। তিনি মধ্যযুগের মুসলিম রচিত পুঁথি যা ইতঃপূর্বে কি হিন্দু কি মুসলমান সংগ্রাহক উদ্ধারের কোনো উৎসাহ দেখাননি, তিনি সেসব লুপ্তপ্রায় পুঁথি উদ্ধার করে দেখিয়েছিলেন যে হিন্দুর মতন এদেশীয় মুসলমানরা পনেরো-ষোলো শতক থেকে বিশুদ্ধ বাংলায় সাহিত্য রচনা করে আসছে এবং মধ্যযুগের সাহিত্য রচনায় তারাই অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। বাংলা ভাষা শুধু তাদের মাতৃভাষায় নয়, জাতীয় ভাষাও। এর ফলে মুসলমানদের মধ্যে নতুন সৃষ্টি উন্মাদনা প্রবলভাবে জাগরিত হলো। আর ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ উনিশ শতকের রেনেসাঁস মানুষের মতো মুসলমান সমাজে শ্রেয়বোধের উন্মেষ ঘটালেন। ফলে মুসলমান সমাজ দুঃসহ অন্তর্ভেদী অলৌকিক আনন্দের ভাব চারিদিকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠলো। ১৯৪৭ সালে এল আবার এক নতুন সঙ্কট। দেশভাগের পর মুসলমান সমাজে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার একটা ঝোঁক দেখা দিলেও শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটা ছিন্নভিন্ন অবস্থা দেখা দেয়। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিন্দু শিক্ষক, অধ্যাপকরা, সাহিত্যিকরা দলে দলে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। ফলে সেখানে শূন্যতা বিরাজ করতে থাকে। এইরকম অবস্থায় মুহম্মাদ আবদুল হাই দৃঢ় হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের হাল ধরেন এবং নানা সাংস্কৃতিক কর্মের দ্বারা শূন্যতার অনেকাংশ ভরাট করে তোলেন। আর মুনীর চৌধুরী মুসলমান সমাজের সেই নবলব্ধ চেতনাকে আধুনিকতার মন্ত্রে সঞ্জীবিত করে একটি অপ্রতিহত গতিতে দান করেন। সামগ্রিকভাবে এই চারজনের সাহিত্য সাধনা বাংলাসাহিত্যকে ঋদ্ধ করেছে। তাঁদের কাজ বাংলাসাহিত্যের দিগন্তকে যেমন প্রসারিত করেছে, তেমনি এক উদার উন্মুক্ত প্রান্তরে আমাদের সবাইকে দাঁড় করিয়েছে। ঐক্যের মিলন ভূমি প্রস্তুত করেছে।
মোহিতলাল এবং বিদ্যাসাগরকে নিয়ে যেমন লিখেছেন, তেমনি ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে লিখেছেন ‘বঙ্কিমচন্দ্র অন্য ভাবনায়’ গ্রন্থ। আজহারউদ্দিন খানের এই গ্রন্থটি বঙ্কিমকে নিয়ে তাঁর ক্ষোভ ও যন্ত্রণার ফসল। এই বইটি বহু জায়গায় বিতর্কের অবকাশ তৈরি করেছে। এ বিষয়ে তাঁর মন্তব্য, “আমি যা বুঝেছি যা সত্য বলে মনে করেছি এই গ্রন্থে তা নির্দ্বিধায় বলেছি। চাঁদেরও কলঙ্ক থাকে, বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্যেও সেই কলঙ্ক আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এপারের বুদ্ধিজীবীরা এ বিষয়ে একেবারে নির্বাক। আমি সত্য উদঘাটন করেছি মাত্র। সেইসঙ্গে উদাহরণ দিয়েছি যা কোনমতেই অস্বীকার করা যায় না। আমার বইটি বঙ্কিম ভক্তদের চক্ষুশূল। রেজাউল করিম পণ্ডিত ব্যক্তি হতে পারেন। তিনি একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে বঙ্কিমের গুণগান করেছেন। আমার কোন উদ্দেশ্য ছিল না, যা সত্য তাই বলেছি। আমার বক্তব্যকে অস্বীকার করার সাহস কারোর নেই।” এক সাক্ষাৎকারে আজাহারউদ্দিন খান জানিয়েছিলেন, তাঁর প্রিয় কবি তিনজন- রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ এবং ফররুখ আহমদ। যদিও জীবনানন্দ ও ফররুখ আহমদকে নিয়ে তিনি কোনো প্রবন্ধ লেখেননি। তবে তিনি তাঁর প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার লাইন দিয়ে জীবনী গ্রন্থ গুলির নামকরণ করে পাঠককে চমকে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথকে সরিয়ে রেখে তাঁর সাহিত্য জীবনের পথ চলা শুরু হলেও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আজহারউদ্দিন খান তিনটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। মেদিনীপুরে রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক বাংলা কবিতা এবং হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল (রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তার উপর আলোচনা)। সমালোচনা সাহিত্যে আজাহারউদ্দিন খানের মৌলিক ক্ষমতার অন্যতম উদাহরণ তিনটি সংস্করণ প্রকাশিত হওয়া ‘গ্যেটে ও বাংলা সাহিত্য’ নামক গ্রন্থটি। সাহিত্যিক আজহারউদ্দিন খান ছিলেন মেদিনীপুরের স্বচক্ষে রবীন্দ্রনাথকে দেখা শেষ জীবিত সাহিত্যব্যক্তিত্ব। সেইসঙ্গে আজহারউদ্দিন খানই দুই বাংলায় একক ব্যক্তিত্ব হিসেবে সবচেয়ে বেশি জীবনীগ্রন্থ লিখেছেন। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, আচার্য যদুনাথ সরকার, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন রায়, অন্নদাশঙ্কর রায়, রমেশচন্দ্র মজুমদার, সুশীল কুমার দে, প্রবোধচন্দ্র সেন, গোপাল হালদার প্রমুখ বরেণ্য সব সারস্বত সাধকের সান্নিধ্য আজহারউদ্দিন খানের সাহিত্যচর্চার জীবনে আশীর্বাদ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সাহিত্যিক আজহারউদ্দিন খানের যে সমস্ত গুণাবলি সহজেই সকলের নজরে পড়তো, তা হলো তিনি ছিলেন মৃদুভাষী, স্নেহশীল ও অতিথিপরায়ণ। অতি সাধারণ জীবনযাপন করতেন, ধুতির সঙ্গে ইস্ত্রি না করা সাদা পাঞ্জাবি পরতেন।
সাহিত্যিক আজহারউদ্দিন খানের সভাপতিত্বে ১৯৮২ সালে পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের মেদিনীপুর জেলা সংগঠন গড়ে উঠেছিল। আজীবন তিনি এই সংগঠনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। আজীবন তিনি বাম রাজনীতিতে বিশ্বাসী হলেও কোনদিন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেননি। সক্রিয় রাজনীতির পরিবর্তে সাহিত্যচর্চাই ছিল তাঁর আজীবনের সাধনা। এই সংগঠনের মুখপাত্র ‘শব্দের মিছিল’ পত্রিকাটির তাঁর দক্ষ ও মেধাবী সম্পাদনায় রাজ্যের সেরা লিটল ম্যাগাজিন হিসেবে রাজ্য সরকারের পুরস্কার পেয়েছিল। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে ‘সারস্বত সাধনায় মেদিনীপুর’, ‘অগ্নিবীণা’ (নজরুল জন্মশতবর্ষ স্মারকগ্রন্থ), ‘প্রত্যহ নবীন’ (গোপাল হালদার জন্মশতবর্ষ স্মারক গ্রন্থ), ‘অরূপ রতন’ (মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মশতবর্ষ স্মারকগ্রন্থ), ‘নিত্যকালের যাত্রী’ (রবীন্দ্র সার্ধশতবর্ষ স্মারকগ্রন্থ) প্রভৃতি গ্রন্থ। এই পত্রিকায় লেখালেখি সূত্রে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়ের সুযোগ হয়েছিল। গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের জেলা সম্মেলন হয়েছিল হলদিয়াতে। সংগঠনের সভাপতি হিসেবে তিনি হলদিয়াতে এসেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা শেষ করে আমি তখন হলদিয়াতে আপনজন নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় সাংবাদিকতা করতাম। এই পত্রিকার সম্পাদক কবি তমালিকা পন্ডা শেঠ তিনি নিজেও গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দিদির আমন্ত্রণে সাহিত্যিক আজহারউদ্দিন খান আপনজন পত্রিকা দফতরের অফিসে এসেছিলেন। তমালিকাদি আমাদের আপনজনের সাংবাদিকদের সঙ্গে আজহারউদ্দিন খানের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের সহকর্মী সাংবাদিক বন্ধু মেদিনীপুরের আরিফ ইকবাল খান আত্মীয়তার সূত্রে আগে থেকেই আজহারউদ্দিন খানের পরিচিত ছিলেন। তিনি আমাদের বলেছিলেন, ‘তোমরা তো আপনজন পত্রিকায় খুব ভালো লেখালেখি করছ, শব্দের মিছিল পত্রিকায় লেখা পাঠাচ্ছো না কেন? তোমরা লেখা পাঠাবে।’ আজহারউদ্দিন খানের এই কথায় আমরা খুব আপ্লুত হয়ে ছিলাম। সে সময় আমরা সাংবাদিকতার সঙ্গে সাহিত্য চর্চা করলেও শব্দের মিছিল পত্রিকায় লেখালেখি পাঠাতে ভয় পেতাম। কারণ আমরা জেনেছিলাম এই পত্রিকায় আসা সমস্ত লেখাই সম্পাদক হিসেবে আজহারউদ্দিন খান নিজে পড়ে দেখতেন, তারপর ছাপানোর অনুমতি দিতেন। আসলেই সেসময় আমরা যে লেখালেখি করতাম তা নিয়ে নিজেরাই যথেষ্ট সন্দিহান ছিলাম। তাই আজাহারউদ্দিন খানের মতো এরকম গভীর পড়াশোনা করা মেধাবী সম্পাদকের পত্রিকায় লেখা ছাপানোর মতো যোগ্য লেখা যে আমরা লিখে উঠতে পারিনি তা নিয়ে নিশ্চিত ছিলাম বলে লেখা পাঠাতে আমাদের দ্বিধা ছিল। আজহারউদ্দিন খানের এই সস্নেহ প্রশ্রয়ে আমরা তারপর থেকে লেখা পাঠাতে শুরু করি। তার আগেও বেশ কয়েকটি সাহিত্যের অনুষ্ঠানে তাঁকে দেখার এবং তাঁর বক্তব্য শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। কিন্তু কাছে গিয়ে আলাপ পরিচয় করার মতো সাহস অর্জন করে উঠতে পারিনি। তমালিকাদি অনেকবারই আমাকে এবং আরিফকে বলেছেন, তোমরা আজহারউদ্দিন খানের বাড়ি গিয়ে একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়ে এসো। সেই সাক্ষাৎকার আপনজন পত্রিকার উৎসব সংখ্যায় প্রকাশ করব। আমরা শেষ পর্যন্ত সেই সাহস অর্জন করে উঠতে পারিনি, কারণ তাঁর মতো পণ্ডিত এবং মেধাবী ব্যক্তিত্বের ইন্টারভিউ নিতে গেলে যে ধরনের প্রস্তুতি দরকার তা আমাদের মধ্যে ছিল না। এমনিতেই তিনি কম কথা বলেন। নিজের সাহিত্য চর্চা নিয়ে সাক্ষাৎকার দেয়া একদমই পছন্দ করেন না। নিজে বলেছেন, ‘আমি লেখক হতে চাইনি, পাঠক হতে চেয়েছি।’ পেশার জীবনে গ্রন্থাগারিকের চাকরিকে পুরোদস্তুর ব্যবহার করেছেন বই পড়ায়। পড়তে পড়তে যেখানে মনে করেছেন আলো ফেলা দরকার সেখানেই কলম ধরেছেন। তাঁর লেখা পুস্তকগুলির বেশির ভাগই আমাদের পড়া ছিল না। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু লেখা আমরা পড়েছিলাম। তাই কিভাবে তাঁর ইন্টারভিউ নেব, কি প্রশ্নই বা তাঁকে করব এ নিয়ে আমরা বিড়ম্বিত ছিলাম বলে এই মহৎপ্রাণ সাহিত্য সাধকের দীর্ঘ ইন্টারভিউ আমাদের আর নেয়া হয়ে ওঠেনি। তাঁর মৃত্যুতে এই বেদনাবোধ আমাদেরকে আজীবন পীড়িত করে যাবে। ২০১১ সালে এক বাইক দুর্ঘটনায় নিজের ছোট ছেলের স্ত্রী বৌমা এবং নাতনিকে হারিয়ে মানসিকভাবে এতটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে তিনি লেখালেখি থেকে দূরে ছিলেন। ২০১০ সালে হলদিয়া সারস্বত সম্মিলন সংগঠনের অনুষ্ঠানে সাহিত্য সম্মাননা গ্রহণ করতে এসে সভায় তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিলেন, সারা জীবন ধরে যে এত পুস্তক লিখলাম, লিখে কি লাভ হলো? সেগুলি পড়বে কে? আমাদের নাতি-নাতনিরা তো ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে। তারা তো বাংলা বই পড়তে চায় না। সাহিত্যিক আজহারউদ্দিন খানের এই ক্ষোভ যথার্থ। কিন্তু সমস্যা হলো আমরা যারা তাঁর সমস্ত বই পড়তে চাই, চেষ্টা করেও তো তাঁর সব বই নাগালের মধ্যে পাচ্ছি না। কারণ তাঁর প্রকাশিত পুস্তক গুলির বেশির ভাগই আর নতুন করে ছাপা হচ্ছে না। এ বাংলায় একটা সময় তাঁর বেশির ভাগ পুস্তকের প্রকাশক ছিল ডিএম লাইব্রেরি। পরবর্তীতে সুপ্রিম পাবলিশার্স তাঁর বেশ কিছু বই রিপ্রিন্ট করেছে। কিন্তু আজহারউদ্দিন খানের সমগ্র রচনাবলী এখন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। তাই আগামী দিনে আজহারউদ্দিন খানের সমগ্র রচনাবলি সরকারি উদ্যোগে কিংবা বেসরকারি উদ্যোগে প্রকাশিত না হলে আগামী প্রজন্মের কাছে তিনিও বিস্মৃতপ্রায় লেখকের তালিকায় চলে যাবেন। নজরুল গবেষণায় এ রাজ্যে তিনি পুরোধা ব্যক্তিত্ব হলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি’র ‘নজরুল পুরস্কার’এর সম্মান পেতে তাঁকে ২০০০ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। নজরুল পুরস্কার প্রাপক হিসেবে তিনি ছিলেন পঞ্চম ব্যক্তি। অথচ তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের নজরুল’ গ্রন্থ পড়ে যাঁরা নজরুল চর্চায় উৎসাহী হয়েছিলেন তাঁরা তাঁর আগেই পুরস্কার পেয়ে গিয়েছিল। সারা জীবনের সাহিত্যকীর্তির জন্য বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ২০০৭ সালে সাম্মানিক ডি লিট প্রদান করেছে। পেয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবদুল হাই সাহিত্য পুরস্কার। এছাড়া দুই বাংলাতে নজরুল গবেষণা ও সাহিত্যচর্চার জন্য আরও দশটির বেশি পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন।
সাহিত্যিক আজহারউদ্দিন খান কেবল নজরুলকে নিয়ে পুস্তক লেখেননি। অথচ বেশির ভাগ সাহিত্য সমালোচকদের কাছে ‘নজরুল গবেষক’ এই অভিধায় তিনি যেন আটকে রয়ে গিয়েছেন। নিজের ষাট বছরের সাহিত্য সাধনায় কত পথ যে অতিক্রম করেছেন তিনি তা খুব অল্প মানুষজনই তার খোঁজখবর রেখেছেন। সাহিত্যিক আজহারউদ্দিন খান সারা জীবন ধরে বাংলা সাহিত্যে বিস্মৃত প্রায় বিখ্যাত লেখকদের সম্পর্কে আকর গ্রন্থ রচনা করে বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসের সম্পূর্ণতা আনার চেষ্টায় নিমগ্ন থেকেছেন। অথচ তাঁর নিজের সাহিত্যকীর্তি নিয়ে আলোচনা করতে এখন পর্যন্ত কোনো বিদগ্ধ সাহিত্য-সমালোচক এগিয়ে আসেননি। এই বেদনাবোধ সাহিত্যিক আজহারউদ্দিন খানের মধ্যেও ছিল। তিনি নিজেও সেটা সম্যকভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তাই বলেছেন, ‘‘আমার একমাত্র আকাক্সক্ষা ছিল কবিকে নিয়ে আলোচনা ব্যাপক হোক, আমার এ আকাক্সক্ষা ফলবতী হয়েছে। সাধারণ পাঠক থেকে বিদগ্ধজনের প্রশংসা লাভ করেছে। এপার-ওপার বাংলায় বইটি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আকর গ্রন্থ (জবভবৎবহপব নড়ড়শ) রূপে সম্মানিত হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ডকুমেন্টারি চিত্রে স্বীকৃতি পেয়েছে। পাঠক আমার প্রত্যাশা পূরণ করেছেন, এর চেয়ে বেশি আর কী পাবার আছে। আমি তৃপ্ত, আমি আনন্দিত।’’