বাংলাদেশের কবিতা দশকে দশকে আবির্ভূত কবিদের স্বাতন্ত্র্যবাদী হওয়ার সচেতন প্রয়াসের মাধ্যমেই বিকশিত হয়েছে। তাই বলে বাংলা কবিতার ঐতিহ্যের পরম্পরা থেকে বিযুক্ত নয় বাংলাদেশের কবিতা। আর্থসামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তনে কবিতাও নতুন রূপে নির্মিত হয়। এই নির্মাণপ্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকে তত্ত্ব, নন্দনতত্ত্ব ও জাগতিক সঙ্কট। এতে থাকে নৈরাশ্য, প্রগতি পরম্পরা, বাস্তব ও পরাবাস্তব চেতনা। বাংলা কবিতার আধুনিকতার সাথে ইউরোপীয় আধুনিকতার একটি যোগসূত্র আছে। দেশে দেশে প্রকাশরীতির দিক থেকে আধুনিকতা ভিন্নতর হলেও মূলত উনিশ শতকের শেষ থেকে শুরু করে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকেই এর বৈশিষ্ট্যগুলো দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এতে প্রাধান্য পায় নতুন প্রসঙ্গ ও তা রূপায়ণের রীতি। স্বকাল সম্পর্কে তীব্র অনুরাগ এবং রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রমের প্রয়াস থেকে বাংলা কবিতার আধুনিকতার সূচনা ঘটে। তিরিশি কবিতার আধার ও আধেয়-এর মধ্যে নিহিত আছে বাংলা কবিতার আধুনিকতা। তিরিশি কবিদের কবিতার বিষয় ও শিল্পরূপ বিবেচনা করলে দেখা যাবে বিশ্বযুদ্ধোত্তর ঔপনিবেশিক আধুনিকতার রূপায়ণে এরা বিশ^সংস্কৃতি ও দেশজ আকাক্সক্ষার সম্মিলনে দ্বন্দ্বের সম্মুখীন। এই দ্বন্দ্ব তিরিশি কবিদের ব্যক্তিক অনুভবে প্রকাশিত। উক্ত কবিরা কবিতার দর্শন, প্রতীক, চিত্রকল্প রূপায়ণে স্বতন্ত্র ও বিচ্ছিন্ন। বৈদগ্ধ্য প্রকাশে স্বোপার্জিত ভাষারীতির ওপর নির্ভরশীল। এই আধুনিকতার পথ ধরেই দেশজ ও বিশ্ব পরিস্থিতিতে কবিরা দশকে দশকে রূপবদ্ধ করেছে আধুনিকোত্তর চেতনা।
১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের পূর্বেই উনিশ শতকের সূচনা থেকে বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্রমবিকশিত হতে থাকে। নতুন উপনিবেশ পাকিস্তান সৃষ্টির মাধ্যমে উক্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণির পূর্বাংশের মানুষ জীবনে ও শিল্পে প্রবল উদ্দীপনার মুহূর্তে আত্মসঙ্কটে পতিত হয়। অবাঙালি শাসকদের চাপের মুখে চল্লিশের কবিদের কেউ কেউ পাকিস্তানি ও ইসলামী ধারায় কাব্যচর্চায় ব্রতী হন। এরা ইসলামী ধারা, পুঁথির জগৎ ও আবহমান বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে সমন্বয় করতে চেয়েছেন। এদের কাব্যাদর্শে ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদী দৃষ্টি ও ইসলামী পুনর্জাগরণ থাকলেও বাস্তবতার কারণে গ্রহণ করতে হয়েছে মানবিক মূল্যবোধ ও রোমান্টিক জিজ্ঞাসা। চল্লিশের কবিরা তিরিশি আধুনিকতা ধারণ করলেও তা থেকে উত্তরণের প্রয়াসও লক্ষণীয়। এরা জাতিসত্তার আকাক্সক্ষা রূপায়ণে নিজস্ব ভূগোল ও সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধ। আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান, আবুল হোসেন প্রমুখ এ দশকের উল্লেখযোগ্য কবি।
বিভাগোত্তর পাঁচের দশকের কবিরা পরিচিতি পান মূলত ‘নতুন কবিতা’ (১৯৫০) ও ‘একুশে ফেব্র“য়ারি’ (১৯৫৩) কবিতা সঙ্কলনের জন্য। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তানি উদ্দীপনা ¤্রয়িমাণ হয়ে যায়। এদের কবিতায় প্রাধান্য পায় উদার মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। গণতান্ত্রিক জীবনাদর্শ ও সাংস্কৃতিক জাগরণের পরিপ্রেক্ষিতে কবিতায় ভাষাভিত্তিক ঐতিহ্য অনুভূত হতে থাকে। বিষয়ের নবমাত্রিক চেতনা সত্ত্বেও এরা তিরিশি কবিতার অনুবর্তী। তবে এদের কবিতার আঙ্গিকে রূপায়িত হয় স্বকীয় সমাজ ও সংস্কৃতিজাত উপমা, রূপক ও চিত্রকল্প। স্বদেশ চেতনায় দায়বদ্ধ থেকে এ সময়ের কবিতা ধারণ করেছে বুর্জোয়া মানবতাবাদী ভাবাদর্শ। আধা সামন্তবাদী সমাজে উক্ত চেতনাই পরিবর্তনকামী ও প্রগতিশীল বলে প্রতীয়মান হয়। পঞ্চাশের প্রধান দুই কবি শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ। এ দশকের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কবি হলেন হাসান হাফিজুর রহমান, শহীদ কাদরী, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, ফজল শাহাবুদ্দীন, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আলাউদ্দীন আল আজাদ প্রমুখ।
ষাটে আবির্ভূত কবিদের কবিতা ধারণ করেছে আধুনিকতার আরেকটি মাত্রা। পাঁচের দশকের কবিতার জীবনসংলগ্ন, মানবিক আত্মিক অনুভবের সঙ্গে ষাটের কবিরা যুক্ত করলেন স্বীকারোক্তিমূলক মনোভঙ্গি। ষাটের কবিদের কাব্যভাবনা ‘কণ্ঠস্বর’, ‘স্বাক্ষর’, ‘সাম্প্রতিক’, ‘প্রতিধ্বনি’, ‘বক্তব্য’, ‘স্যাড জেনারেশন’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতে থাকে। ষাটের দশক জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা এবং স্বাধীনতার ক্ষেত্র প্রস্তুতে গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ের কবিরা অবক্ষয়ী ও উজ্জীবনী ধারায় বিভক্ত। অবক্ষয়ী ধারার কবিতায় প্রাধান্য পেয়েছে অবক্ষয়চেতনা, নগরমনস্কতা ও আত্মজৈবনিক জিজ্ঞাসা। এদের মধ্যে কেউ বিশুদ্ধ কাব্যচর্চায় নিবেদিত থেকে নির্মাণ করেছেন সমাজ থেকে বিযুক্ত পরাবাস্তব কবিতা। তবে ষাটের শেষার্ধে সামাজিক ও রাজনীতিক বোধের কারণে কাব্যে প্রকাশ পায় এক ধরনের স্ববিরোধিতা। সমকালের আগ্রাসী সঙ্কট মোকাবেলা করে তারা শেষ পর্যন্ত জীবন থেকে পলায়ন করেননি। ষাটের কবিতায় পরিলক্ষিত হয় মুখের ভাষা, সাংবাদিকতার ভাষা, আত্মজৈবনিক প্রত্যক্ষকথন ও গদ্যছন্দ। এ ক্ষেত্রে কেউ কেউ ব্যতিক্রমও ছিলেন। আবুল হাসান, আবদুল মান্নান সৈয়দ, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, আল মুজাহিদী, আসাদ চৌধুরী, মহাদের সাহা, সিকদার আমিনুল হক, অরুণাভ সরকার প্রমুখ ষাটের প্রধান প্রধান কবি।
ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সত্তরের কবিতার মুখচ্ছদ। এ সময়ের কবিতায় যুদ্ধের আবেগ নৈর্ব্যক্তিক অনুভবে জারিত হয়নি। কবিদের অভিজ্ঞতাপুঞ্জ রোমান্টিক অনুভবে ও অতিকথনে আক্রান্ত। কবিতায় প্রত্যাশিত ছিল মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা কিন্তু সময়, স্বভাব ও ঘটনাপ্রবাহ থেকে নিরাসক্ত না থাকায় কবিতাগুলো হয়েছে আবেগঘন, শোক ও বীরত্বব্যঞ্জক। সত্তরের শেষার্ধে গণতন্ত্রের অভিযাত্রা ব্যাহত হয়। দুর্ভিক্ষ ও গুপ্তহত্যা সৃষ্টি করে ঘনায়মান হতাশার। এই নৈরাশ্যের মধ্যে হারিয়ে যায় যুদ্ধোত্তর চেতনা। প্রতিকূল পরিবেশে কবিরা প্রাত্যহিক জীবনের হতাশার রূপায়ণে মগ্ন থাকেন। সীমাহীন প্রত্যাশা ও অপ্রাপ্তির বেদনায় নীল কবিরা একটা সময়কে ধারণ করে পাঠককে কবিতার প্রতি আগ্রহী করে তোলেন। অনিবার্যভাবেই এ সময়ের কবিতায় দেখা যায় সংলাপ ও স্লোগান। আবিদ আজাদ, হেলাল হাফিজ, ময়ুখ চৌধুরী, ফারুক মাহমুদ, হাসান হাফিজ, জাহাঙ্গীর ফিরোজ, আবু হাসান শাহরিয়ার, ত্রিদিব দস্তিদার প্রমুখ ধারণ করে আছেন সাতের দশকের মূল কাব্যস্পিরিট।
সত্তরের বিবরণধর্মী কবিতালোক থেকে আশির কবিরা দেশের দীর্ঘকাল থেকে চলে আসা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনীতিক পরিস্থিতিকে বাইরে রেখে অন্তর্লীন হন ব্যক্তিক দর্শনে। জীবনের পরিব্যাপ্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনুভব থেকে এরা ইশতেহার ও ঘোষণাপত্র প্রকাশ করেন। এগুলো ছিল তত্ত্বনির্ভর। কবিরা ব্যক্তিক অনুভব থেকে যে কাব্যদর্শন সৃষ্টি করেন তা ছিল অতীতের মতই নানা ইজমে বিভক্ত, জ্ঞানকান্ডের পরিভাষায় সমৃদ্ধ। এদের অনুভবগুলো মননধর্মী হলেও তা ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারায় কার্যকারণসম্পৃক্ত নয়। কবিদের প্রতিরূপকধর্মী কাব্যধারা নিয়ে যায় প্রাকৃতলোকে। মিথের বহুমাত্রিক ব্যবহারে আশির কবিরা উৎসাহী। তবে মিথ বিষয় হিসেবে নয় বরং অনুষঙ্গ, সঙ্কেত ও ভাষ্য হিসেবে তা বিন্যস্ত। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার পরিবর্তে কবিতায় প্রাধান্য পায় ব্যক্তিক অনুভব। আশির কবিতা আধুনিক কবিতার পরম্পরা থেকে কিংবা ভেঙে বিনির্মাণ করেছে বিচিত্র রূপ। খোন্দকার আশরাফ হোসেন, রেজাউদ্দিন স্টালিন, আবদুল হাই শিকদার, হাফিজ রশিদ খান, মোশাররফ হোসেন খান, সাজ্জাদ শরিফ, ফরিদ কবির, মতিউর রহমান মল্লিক প্রমুখ আটের দশকের উল্লেখযোগ্য কবি।
আশির উত্তরসূরি হিসেবে নব্বইয়ের কবিরা বাংলা কবিতার প্রচলিত আধুনিক ফর্মকে মেনে নিতে দ্বিধান্বিত বলেই তৈরি হয় দূরত্ব। নব্বইয়ের কবিরা তত্ত্ব ও বাস্তবের সংঘাতে অমীমাংসিত বলেই বাস্তব পৃথিবীর বদলে প্রতিচ্ছায়াময় পৃথিবীর সন্ধান করেন। এ সময়ের কবিদের অনেকে বুঝে না বুঝে গ্রহণ করেন উত্তরাধুনিকতা। কবিদের কবিতায় একদিকে রূপায়িত হয় প্রাচীন বাংলার প্রাকৃত জীবন অন্যদিকে প্রাধান্য পায় প্রান্তিক সংস্কৃতির জীবনালেখ্য। নব্বইয়ের কবিতায় যে জীবন তা বিমানবিক জীবন। এ জীবন বিনির্মাণে কবিদের ব্যবহৃত শব্দ অর্থচ্যুতির দ্যোতনা ও বেদনায় সমৃদ্ধ। নব্বইয়ের কবিতার যে প্যারাডাইম তা কবিতার টেক্সটকে করে তুলেছে বহুমাত্রিক ও অনেকান্ত। এ সময়ের কবিরা কবিতার নতুন টেক্সট বিনির্মাণের জন্যই খ্যাতিমান। নব্বইয়ের প্রধান কবিরা হলেন সায়ীদ আবুবকর, সরকার মাসুদ, জাফর আহমদ রাশেদ, সরকার আমিন, ওবায়েদ আকাশ, টোকন ঠাকুর, মুজিম ইরম, চঞ্চল আশরাফ, নয়ন আহমেদ প্রমুখ। বারবার বাঁক নেয়া বাংলা কবিতা নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নতুন প্রত্যয়ে নতুন স্বপ্নে এগিয়ে চলেছে ক্রমাগত নতুন দিগন্তে, এটাই আশার কথা। হ