আমাদের ষাটের দশকের চলচ্চিত্রকে বলা হয়ে থাকে চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগ। এ সময়ের চলচ্চিত্রে মানুষের আশা-নিরাশা, চাওয়া পাওয়া, দুঃখ বেদনার গল্প মূর্ত হয়ে উঠেছে, এমনটাই অভিমত শিল্প বোদ্ধাদের। একঝাঁক পরিচালক ছিলেন, দর্শকদের প্রিয় অভিনেতা অভিনেত্রীরা ছিলেন আর সাহিত্য থেকে কাহিনী নেয়ায় সেই সব চলচ্চিত্র এক দিকে যেমন বাজার পেয়েছে ব্যবসা করেছে অন্যদিকে দর্শক মনও জয় করেছে। তেমনই একটি চলচ্চিত্র ‘আনোয়ারা’। এটি বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্যরত্ন রচিত কালজয়ী উপন্যাস ‘আনোয়ারা’ অবলম্বনে নির্মিত। বাঙালি মুসলমান সমাজে মীর মশাররফ হোসেন রচিত ‘বিষাদ সিন্ধু’র পর এটি সর্বাধিক পঠিত ও জনপ্রিয় বই। তিন পর্বে বিভক্ত (মহররম পর্ব, উদ্ধার পর্ব, এজিদবধ পর্ব) ‘বিষাদ সিন্ধু’ প্রকাশিত হয় ১৮৯১ সালে। ঠিক তার ২৩ বছর পর ১৯১৪ সালে প্রকাশিত হয় আনোয়ারা। এর এক বছর আগে কবি রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন। এসময়ই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে দশম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় বাঙালি পল্টনে যোগ দেন কাজী নজরুল, হয়ে যান সৈনিক। সময়টা বুঝবার জন্য এ দু’জনের নাম উল্লেখ করতে হলো। ১৫ জুলাই ২০১৪ ছিল ক্লাসিক এ উপন্যাসের শতবর্ষ। ‘আনোয়ারা’ বাঙালি মুসলমানের আটপৌরে জীবনের সমাজচিত্র। ১০৮ বছর আগে এরকম একটি উপন্যাস রচনা ও জনপ্রিয় হওয়া ছিল ব্যতিক্রমী এক ঘটনা। কারণ তখন বাঙালি মুসলমানের লেখালেখি ও পড়াশোনার বিস্তার ছিল অপ্রতুল। বাংলা ১৩৬৮ সনের চৈত্র মাসে এর সপ্তবিংশতি সংস্করণ প্রকাশিত হয় এবং ঐ সময় পর্যন্ত এর সাড়ে পাঁচ লক্ষ কপি বিক্রয় হয় বলে জানা যায়। এ থেকে এর জনপ্রিয়তা সম্পর্কে ধারণা করা চলে। চলচ্চিত্রের পাশাপাশি টিভি নাটকও হয়েছে আনোয়ারা উপন্যাস নিয়ে।
২.
মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে মোহাম্মদ নজিবর রহমানের পরিচয় দিয়ে নেয়া আবশ্যক। তার জন্ম ১৮৬০ সালে পাবনা জেলার (বর্তমান সিরাজগঞ্জ) শাহজাদপুর উপজেলার চর বেলতৈল গ্রামে। জন্ম সাল নিয়ে ভিন্নমতও আছে। সাহিত্যরত্ন তার টাইটেল। তাকে ঊনবিংশ শতাব্দীর বিকাশোন্মুখ মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমান সমাজের প্রতিনিধি গণ্য করা হয়। তিনি কয়েকটি গল্প ও দুটি প্রবন্ধ পুস্তকও রচনা করেন। তাঁর রচিত উপন্যাসের মধ্যে আরো রয়েছে ‘প্রেমের সমাধি’, ‘গরীবের মেয়ে’ ,‘চাঁদ তারা বা হাসন গঙ্গা বাহমণি’ ও ‘মেহেরউন্নিসা’। মেহেরউন্নিসা ১৯২৩ সনে প্রকাশিত হয়। সে বছরই ১৮ অক্টোবর তিনি ইন্তেকাল করেন। নজিবর রহমানের সর্বশেষ সামাজিক উপন্যাস এটি। তিনি ২০টির মতো উপন্যাস লিখেছেন বলে জানা যায়। অনেকগুলো নানা বিশেষণে ভাগ করা।
নজিবর রহমান তাঁর উপন্যাসে মুসলিম সমাজের বাস্তবচিত্র অতি বিশ্বস্ততার সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন। বাঙালি মুসলমানদের আশা-আনন্দ, প্রেম-ভালোবাসা, দুঃখ- বেদনা, আচার-অনুষ্ঠান, কুটিলতা-দুর্বলতা, সফলতা-ব্যর্থতার এক জীবনধর্মী প্রাণবন্ত চিত্র এতে বাঙ্ময় রূপ লাভ করেছে। লেখক শুধু একজন শিল্পী নন, তিনি একজন সমাজ-হিতৈষী, সমাজের উন্নতি ও কল্যাণকামী আদর্শ মুসলিম। তাঁর উপন্যাসের চরিত্রগুলো সবই গ্রাম-বাংলার সাধারণ মানুষ। তাদের জীবনে যেমন স্বপ্ন আছে, আশা-আনন্দ- প্রেম আছে, তেমনি আছে স্খলন, পতন, দুর্বলতা ও নানারূপ সীমাবদ্ধতা। লেখক অতি বাস্তব ও সূক্ষ্ম জীবনদৃষ্টির মাধ্যমে তা অবলোকন করেছেন ও কুশলী শিল্পীর ন্যায় তার হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা দিয়েছেন। নজিবর রহমানের জনপ্রিয়তার অন্যতম প্রধান কারণ হলো তাঁর অসাধারণ প্রাঞ্জল, সহজ, সরল, অনবদ্য ভাষা। তাছাড়া নজিবর রহমানের উপন্যাসের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো তাঁর অসাম্প্রদায়িক, মানবিক উদার দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি মুসলিম সমাজের চিত্র অঙ্কন করতে গিয়ে কখনো হিন্দু-বিদ্বেষের পরিচয় দেননি বা অমুসলমানদের জাত্যাভিমানে আঘাত লাগে এমন কোন কাজ করেননি।
৩.
এবারে আমরা আনোয়ারা চলচ্চিত্রটির কথা তুলে ধরবো। বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নির্মাতা জহির রায়হান ১৯৬৭ সালে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন এবং বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ১৯৮৭ সালে এর নাট্যরূপ সম্প্রচার করে। আনোয়ারার এই অর্জন আমাদের সাহিত্যের জন্য আনন্দ ও গৌরবের। ‘আনোয়ারা’ উপন্যাসের শব্দচয়ন, চরিত্রচিত্রণ ও কাহিনী বিন্যাসে গ্রামীণ মধ্যবিত্ত মুসলমান সমাজের জীবনের প্রতিচ্ছবি উপস্থাপিত হয়েছে। কিছু সংলাপের কথা বলা যাক। দাদিমা আনোয়ারাকে জিজ্ঞেস করলেন-
‘‘আচ্ছা ডাক্তারের সঙ্গে তোর বিবাহ প্রস্তাব করিলে কেমন হয়?’’
আনোয়ারা ইহাতে কোনো উত্তর করিল না। কিন্তু ডাক্তার সাহেবের নামে তাহার ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়িতে লাগিল। ….
‘‘বৃদ্ধ ডাক্তারের সঙ্গে বিবাহ দিলে তুই সুখী হবি?”
আনোয়ারা বাইরের দিকে চাহিয়া কহিল, ‘‘দাদিমা দেখ জানালার পাশে কি সুন্দর চাঁদের আলো আসিয়াছে।” এখানে একটা নাটকীয়তা আছে। দাদিমা প্রস্তাব আনোয়ারার মনঃপূত হয়নি কিন্তু তা সরাসরি না বলে সে প্রসঙ্গান্তরে চলে গেল। এই সমাজচিত্র ও সংলাপ রচনার ভঙ্গি নজিবর রহমানের বড়ত্বকেই প্রকাশ করে। চলচ্চিত্রেও সংলাপগুলো সেভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এর প্রযোজক ছিলেন ইফতেখারুল আলম। চিত্রনাট্যকারও ছিলেন জহির রায়হান। সংলাপ রচনায় আমজাদ হোসেন। অভিনয়ে ছিলেন সূচন্দা, রাজ্জাক, বেবী জামান, রুবিনা, রানী সরকার, আমিরুদ্দিন, আমজাদ হোসেন, রহিমা, সবিতা, অরুণা, ভানু, জাভেদ রশীদ ও মেসবাহ প্রমুখ। সূচন্দা আনোয়ারা চরিত্রে আর রাজ্জাক নূর ইসলাম চরিত্রে অভিনয় করেন। নূর ইসলাম উপন্যাসের নায়ক ও আনোয়ারা নায়িকা। এর সুরকার ছিলেন কিংবদন্তির সঙ্গীতকার আলতাফ মাহমুদ। চিত্রগ্রাহক করেছে অরুণ রায়। সম্পাদনায় ছিলেন এনামুল হক, শব্দ গ্রহণ করেন এম এ জহুর, পরিকল্পনা ও তত্ত্বাবধানে ছিলেন এ ইউ এম খলিলুল্লাহ, সমন্বয় ও পরিবেশনা: আমীর আলী, প্রধান ব্যবস্থাপক: জাকারিয়া হাবিব, শিল্প নির্দেশনা: আবদুস সবুর, গীত রচনা: আবদুল লতিফ, কণ্ঠশিল্পী ছিলেন : আঞ্জুমান আরা বেগম, শাহনাজ বেগম (পরে নাম হয় শাহনাজ রহমতুল্লাহ), সাবিনা ইয়াসমিন, আবদুল লতিফ প্রমুখ। এরা সবাই নামীদামি শিল্পী। এ ছাড় যন্ত্রসঙ্গীতে ছিল ঢাকা অর্কেস্ট্রা, রূপসজ্জা: আকবর, প্রচার: স্টার অ্যাডভার্টাইজার্স। আর প্রয়োজনা সংস্থা ছিল স্টার সিনে করপোরেশন। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি দিকে। আর এর দৈর্ঘ্য ১২৬ মিনিট। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয় ১৯৬৭ সালে আরো অনেকগুলো বিখ্যাত চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে চকোরী, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, আগুন নিয়ে খেলা, কাঞ্চনমালা, জুলেখা, দরশন, ছোটে সাহেব ও নয়নতারা। এর মধ্যে কয়েকটি বাংলা ও উর্দু ডাবল ভার্সন ছবি।
আনোয়ারা ছবিটিতে উপন্যাসের বর্ণনার আলোকে লোকেশন বাছাই করে চিত্রায়ণ করা হয়েছে। আমাদের গ্রামবাংলার চিত্র উপন্যাসে যতখানি উঠে এসেছে চলচ্চিত্রে মনে হয় তার চেয়ে বেশি উঠে এসেছে। আর দর্শকরা সেটা লুফে নিয়েছেন। উপন্যাসের চলচ্চিত্র রূপ দেয়ার সময় প্রয়োজনে কিছু হের ফের করতেই হয়। তবে বলা যায় জহির রায়হান এ ক্ষেত্রে তেমন আপস করেননি, যতটা সম্ভব মূলের সাথেই থাকার চেষ্টা করেছেন।