ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজির নদীয়া ও গৌড় বিজয় একটি ইতিহাসের মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা। এ বিজয় রাজা লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বকালের ঘটনা। বিজয়ের ফলে বাংলায় দীর্ঘদিনের হিন্দু-বৌদ্ধ রাজত্বের অবসান এবং মুসলিম রাজত্বের সূচনা হলো। লক্ষ্মণ সেন ষাট বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহণের পর দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে বয়সের ক্লান্তিতে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। ডোম্মনপালের স্বাধীনতা লাভ এবং অন্যান্য বিষয় থেকে সহজেই তা দৃষ্টিগোচর হয়। ইতোমধ্যে আর্যাবর্তে মুসলিম শক্তির আবির্ভাব হয়। এদিকে এ সময়েই দিল্লির শাসক মুহাম্মদ ঘুরি চৌহানরাজ পৃত্থিরাজকে পরাজিত করে সম্পূর্ণ দিল্লি ও আজমির এবং গাহড়বাল রাজা জয়চন্দ্রকে পরাজিত করে কনৌজ দখল করে নিয়েছিলেন। মুহাম্মদ ঘুরির উত্তরাধিকারী কুতুবউদ্দীন আইবকের নেতৃত্বে মুসলিম সেনাপতিরা ভারতে রাজ্যবিস্তারে আত্মনিয়োগ করেন। আর্যাবর্তের প্রসিদ্ধ রাজপুত রাজ্যগুলো একে একে তুর্কি মুসলিমদের অধিকারে আসতে শুরু করে। ধীরে ধীরে মুসলিম অধিকারের সীমানা বৃদ্ধি পেয়ে যুক্তপ্রদেশ হয়ে মগধের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। উত্তর ভারতের শান্তি-শৃংখলা বিনষ্ট হয় এবং হিন্দু রাজশক্তি ধীরে ধীরে খান খান করে ভেঙে পড়ে। বৃদ্ধ রাজা লক্ষ্মণ সেন বাংলাকে শেষ পর্যন্ত পতনের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেননি। বখতিয়ার খলজি সহজেই নদীয়া ও লক্ষণাবতী আক্রমণ করে বিজয় করে নেন খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে।
ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজি কর্তৃক লক্ষ্মণ সেনের নদীয়া পতনের পর পরই বাংলায় হিন্দু শাসনের পতন সম্পন্ন হয়ে যায়নি। দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় লক্ষ্মণ সেন আরো দুই, তিন কিংবা চার বছর শাসন করেছেন। এমনকি রাজা লক্ষ্মণ সেনের মৃত্যুর পরেও তাঁর পুত্রদ্বয় বিশ্বরূপ সেন ও কেশব সেন বিক্রমপুরে আরো প্রায় পঁচিশ বছর রাজত্ব করেন। তাঁদের পরে এই অঞ্চলে দেব রাজবংশের উদ্ভব হয়। এরও প্রায় একশত বছর পরে সেখানে মুসলিম শাসনের কথা জানা যায়।
মিনহাজ উদ্দীন সিরাজের তবকাত-ই-নাসিরী, ইসামীর ফুতুহাত-উস-সালাতিন, গোলাম হুসাইন সলিমের রিয়াজ-উস-সালাতিন গ্রন্থ ছাড়াও অনেক গ্রন্থসূত্রে বখতিয়ার খলজি কর্তৃক বাংলার নদীয়া বিজয়ের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। বখতিয়ার খলজির এ বিজয় অভিযানের বিভিন্ন দিক নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে তীব্র কৌতূহল ও চিন্তার উদ্রেক করেছিল। এ সময়কালে, অভিযানে সৈন্যসংখ্যা, অভিযানের জন্য কোন পথ বেছে নেয়া হয়েছিল, কেন এ পথ বেছে নেয়া হলো, অভিযানের ফলাফল, রাজা লক্ষ্মণ সেন এত শক্তিশালী শাসক হয়েও কেন এ অভিযান দমনে ব্যর্থ হলেন এ সমস্ত বিষয় নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের আলোচনার সূত্রপাত দেখা যায়।
মিনহাজ উদ্দীন সিরাজের মতে, বখতিয়ার খলজি মাত্র সতেরোজন অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে নদীয়া জয় করেছিলেন। হিন্দু ঐতিহাসিকগণ সতেরোজন সৈন্য কর্তৃক নদীয়া বিজয়ের কাহিনী নিছক একটি কিংবদন্তি এবং অবাস্তব হিসেবে মনে করে থাকেন।
প্রমাণিত ইতিহাস এই যে, মুসলমানদের বাংলা বিজয়ের বহু পূর্ব থেকেই বাংলার সাথে আরব মুসলমান বণিকদের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রয়োজনে আরব বা তুর্কি মুসলমানগণ এদেশে নৌপথে আসা-যাওয়া করতো এবং উভয় জাতির মধ্যে চমৎকার একটি সম্পর্ক বিরাজমান ছিল। এ কথা ধরে নিলে বখতিয়ার খলজি হঠাৎ করে কেন বাংলা অভিযানে আগ্রহী হলেন তার যুক্তি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তুর্কি মুসলমানদের ভারত অভিযান বা বিজয়কালে সেন বংশের রাজারা ভারতের রাজা মহারাজাদের কোনোরূপ সামরিক বা আর্থিক সাহায্য প্রদান করেননি। এমনকি একাদশ বা দ্বাদশ শতকে যে সকল সুফি সাধক ইসলাম প্রচারের জন্য এদেশে আগমন করে বসতি স্থাপন করেন সেন বংশের রাজারা তাঁদের ইসলাম প্রচারে কোনোরূপ বাধা প্রদান করেছিলেন বলে তথ্য পাওয়া যায় না। তাঁরা স্বাধীনভাবেই ইসলাম প্রচার করেছিলেন। এমন পরিস্থিতি হলে কোনো যুক্তিতেই বখতিয়ার কর্তৃক বাংলা অভিযান সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। তবে সময় বিচার করলে একটি ধারণায় উপনীত হওয়া যায় যে, দ্বাদশ শতকের এ সময়কালে আরবের মুসলমানগণ ভারতে আধিপত্য বিস্তারের যে অভিযান শুরু করেছিল ত্রয়োদশ শতকের শুরুতে তা বাংলার পশ্চিম সীমান্তে এসে শেষ হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং ধারাবাহিকভাবে ইসলাম প্রচার ও আধিপত্য বিস্তারের এক পর্যায়ে ভারতীয় মুসলমান সুলতান বা তাঁদের প্রতিনিধিরা যে বাংলা অভিযানে এগিয়ে আসবেন এটি খুবই কাক্সিক্ষত ছিল।
এ প্রসঙ্গে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজির প্রাথমিক জীবন জানা একান্ত আবশ্যক। ড. আবদুল করিম তাঁর সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনায় বলেছেন যে,
মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজির বাংলার ও বিহার জয় মুহাম্মদ ঘুরির বিজয়ের চেয়েও চমকপ্রদ কাহিনী। বখতিয়ার খলজি একজন অসীম সাহসী যোদ্ধা ছিলেন। কিন্তু মুহাম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমণের সময় তিনি নিতান্ত নিঃস্ব অবস্থায় ভাগ্যান্বেষণে বের হন। প্রথমে তিনি চাকরির খোঁজে মুহাম্মদ ঘুরির কাছে যান। কিন্তু অত্যন্ত খাট ও তাঁর মুখম-ল বিসদৃশ হওয়ায় মুহাম্মদ ঘুরি তাঁকে সৈন্যবিভাগে ভর্তি করতে অসম্মত হন। অনুরূপভাবে তিনি দিল্লিতে কুতুব উদ্দিনের কাছে এবং পরে বাদাউনের গভর্নরের কাছেও চাকরি লাভে ব্যর্থ হন। তিনি অযোধ্যায় এসে উপনীত হলেন। অযোধ্যার শাসনকর্তা মালিক হিজবরউদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজির কদর বুঝতে পারেন এবং তাঁকে সৈন্যবিভাগে ভর্তি করে বিউলি ও ভাগওয়াত নামক দুটি পরগণার জায়গির দিয়ে মুসলমান রাজ্যের পূর্ব সীমানা মির্জাপুর জেলায় পাঠিয়ে দেন। এখানে এসে বখতিয়ার খলজি স্বীয় সামরিক দক্ষতা ও অসীম সাহসের পরিচয় দিতে লাগলেন। মাত্র দুটি পরগণার জায়গির লাভ করে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না, বরং মুসলমান অধিকার বিস্তৃত করাই তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল।
বখতিয়ার খলজির উদ্দেশ্য সিদ্ধির ক্ষেত্রও প্রস্তুত ছিল; কারণ তাঁর চতুর্দিকে ছোট ছোট হিন্দু এলাকা বেষ্টিত ছিল এবং সেখানে মাঝে মাঝে হামলা চালিয়ে লুটতরাজ করে এবং নিজের অধিকৃত এলাকার সীমানা বাড়িয়ে শক্তি বৃদ্ধি করা মোটেই কঠিন ছিল না। বেশি শক্তি সঞ্চয় করে আনুমানিক ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজি বিহার আক্রমন করেন। সেখানে তখন ওদন্তপুরী বিহার নামে একটি বৌদ্ধ আশ্রম ছিল। এর চারদিকে প্রাচীরবেষ্টিত থাকায় বখতিয়ার খলজি একে দুর্গ মনে করে অবরোধ করেন এবং প্রায় বিনা পরিশ্রমে এটি অধিকার করেন। আশ্রমের অধিবাসীরা সবাই নেড়ে ছিল, তাঁরা শত্রুদের বাধা দেয়ার চেষ্টা করলো না। বখতিয়ার খলজি তাঁদের নিরীহ স্বভাব দেখে অবাক হয়ে গেলেন। পরে তিনি জানতে পারেন যে, প্রাচীরবেষ্টিত স্থানটি দুর্গ তো নয়ই বরং, একটি বৌদ্ধবিহার বা কলেজ। তিনি যাদেরকে যোদ্ধা মনে করেছিলেন, আসলে তাঁরা সকলেই বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। এরপরে মুসলমানেরা ঐ এলাকার নাম দেয় বিহার এবং এখনো ঐ নামেই স্থানটি পরিচিত।
বখতিয়ার খলজি বিহার জয় করে সেখান থেকে ধনরত্ন লাভ করে দিল্লিতে যান। সেখানে তিনি সুলতান কুতুবউদ্দীনের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁকে প্রচুর উপঢৌকন প্রদান করেন। সুলতান তাঁকে বিহারের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। বখতিয়ার খলজির বিহার অধিকারের সময় রাজা লক্ষ্মণ সেন লক্ষণাবতী ছেড়ে নদীয়ায় অবস্থান করছিলেন।
তবকাত-ই-নাসিরীতে উল্লিখিত হয়েছে যে, বখতিয়ার কর্তৃক বিহার জয়ের পরে সেন সাম্রাজ্যে একটা ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। লক্ষ্মণ সেনের মাধাইনগর তাম্রশাসনে ঐন্দ্রিমহাশান্তি যজ্ঞের উল্লেখ পাওয়া যায়। এটি এক ধরনের অনুষ্ঠান। সাধারণত কোনো বিপদ থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে এ ধরনের অনুষ্ঠান করা হয়ে থাকে। বখতিয়ার খলজি যখন বিহার ও মগধ বিজয়ে ব্যস্ত ছিলেন তখন বঙ্গের অধিপতি ছিলেন রায় লখমনিয়া (লক্ষ্মণ সেন)। তাঁর রাজধানী ছিল নদীয়হ্ বা নদীয়া নগরী। বখতিয়ারের বিজয় কাহিনী এবং তাঁর সম্পর্কে অনেক কথাবার্তা যখন সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থান থেকে রাজা লক্ষ্মণ সেনের কাছে পৌঁছলো, তখন এর প্রতিকারের কথা তিনি ভাবছিলেন। কিন্তু লক্ষ্মণ সেনের সাম্রাজ্যের কতিপয় গুণী পণ্ডিত ও জ্যোতিষী ব্যক্তি এবং রাজা লক্ষ্মণ সেনের রাজদরবারের বিশেষ পরামর্শকগোষ্ঠী তাঁকে ভবিষ্যদ্বাণীর কথা শোনালেন যে, প্রাচীন শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে যে, এ দেশ তুর্কি জাতি কর্তৃক পদানত হবে এবং সেই সময়টিও আসন্ন। তুর্কি জাতি ইতোমধ্যে বিহার বিজয় করেছে এর পরের বছরই তাঁরা বঙ্গে আসবে। রায় লখমনিয়া (লক্ষ্মণ সেন) জ্যোতিষীদের কাছে অভিযানকারীর দৈহিক বর্ণনা জানতে চাইলে তাঁরা উল্লেখ করলেন, প্রাচীন গ্রন্থে সেই অভিযানকারীর দৈহিক অবকাঠামোর বর্ণনাও উল্লিখিত হয়েছে। তিনি হবেন আজানুলম্বিতভুজ। দেখা গেল যে, বখতিয়ার খলজির দৈহিক বর্ণনার সঙ্গে তা হুবহু মিলে যায়। তাঁরা রাজসমীপে নিবেদন করলেন যে, মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজিই সেই শাস্ত্রবর্ণিত অভিযানকারী ব্যক্তি। সুতরাং রাজা যেন প্রজাবর্গসহ দেশ ত্যাগ করে পূর্ববঙ্গ ও কামরূপে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ বিষয়গুলো রাষ্ট্রময় সকলের মাঝে প্রচারিত হলে সকলের মাঝে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এ সময় অধিকাংশ ব্রাহ্মণ জ্যোতিষীদের পরামর্শক্রমে পূর্ববঙ্গ ও কামরূপে পলায়ন করলেন। রাজা লক্ষ্মণ সেন অনেক সাহসী সৈনিক ও রাজা ছিলেন। তিনি অহেতুক ভয় পাবার পাত্র ছিলেন না। তিনি যৌবনে অনেক যুদ্ধ ও বিজয়ের নায়ক ছিলেন। সুতরাং তিনি নদীয়াতেই থাকলেন।
অনেক দূরদর্শী ও সাহসী সৈনিক ছিলেন ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজি। জীবনের বিভিন্ন পদে পদে তিনি বাধার সম্মুখীন হয়ে জীবন সম্পর্কে তিনি পাঠ গ্রহণ করেছিলেন। বাংলা অভিযানের পূর্বেই তিনি বাংলার অভ্যন্তরীণ অবস্থা, বাংলার রক্ষাব্যবস্থা, বাংলায় প্রবেশের বিভিন্ন পথ সম্পর্কে অবগত হয়েছিলেন। সে সময়ে বাংলায় প্রবেশের জন্য বিখ্যাত পথ হিসেবে পরিচিত ছিল তেলিয়াগড় ও সিকড়িগলি গিরিপথ। এগুলোকে সে সময় বাংলার দরজাও বলা হতো। কিন্তু এ পথ অনেক বিখ্যাত ও সুপরিচিত হওয়ার কারণে এ পথে লক্ষ্মণ সেনের অনেক সৈনিক প্রহরায় থাকার সম্ভাবনা বিধায় তিনি তা পরিহার করে বিকল্প পথ অনুসন্ধান করেছিলেন। তিনি সহজ পথে গঙ্গার উত্তর তীর অনুসরণ করে বঙ্গে প্রবেশ করেননি। তিনি গঙ্গার দক্ষিণাস্থ মুনের থেকে যাত্রারম্ভ করে শোন অতিক্রম করে বিহার শরিফে উপস্থিত হয়েছিলেন। তারপর ছোট নাগপুরের দুর্গম পাহাড়িয়া ও অরণ্য অঞ্চল গয়া ও ঝাড়খ-ের মধ্য দিয়ে নদীয়া এসে পৌঁছান। সেকালে একটি রাজ্যের শাসক পরাজিত হলেই সে দেশটি আক্রমণকারী কর্তৃক বিজিত হয়েছে বলে ধরে নেয়া হতো। তাই বখতিয়ার খলজি দ্রুতগতিতে পৌঁছে হঠাৎ আক্রমণের মাধ্যমে বঙ্গের অধিপতিকে ধরাশায়ী করার কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। বখতিয়ার খলজি অরণ্য অঞ্চলের মধ্য দিয়ে এতই দ্রুততা ও ক্ষিপ্রতার সঙ্গে নদীয়া এসে পৌঁছেছিলেন যে, মাত্র সতেরোজন বা আঠারো জন সৈনিক তাঁর সঙ্গে থাকতে সক্ষম হয়েছিল।
তবকাত-ই-নাসিরী গ্রন্থের বর্ণনা থেকে জানা যায়, বখতিয়ার তাতার দেশীয় আরব অশ্ববিক্রেতার ছদ্মবেশে মাত্র আঠারো জন অশ্বারোহী নিয়ে লক্ষ্মণ সেনের প্রাসাদের সম্মুখে বিনা বাধায় উপস্থিত হয়ে প্রাসাদরক্ষীদের হত্যা করা শুরু করেন। তখন শহরে শোরগোল শুরু হয়ে যায়। এ সময়টি ছিল দুপুর। সৈন্য-সামন্ত, অন্যান্য উর্ধ্বতন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কেউ কেউ দুপুরের খাবার খাওয়া কিংবা দুপুরের খাবার পরের আলস্যতায় মগ্ন ও অসচেতন ছিল। রাজা লক্ষ্মণ সেন এ সময় মধ্যহ্নভোজনে বসেছিলেন। প্রাসাদ অভ্যন্তরে শোরগোল ও উচ্চকণ্ঠের আর্তনাদ শুনে রাজা লক্ষ্মণ সেন ভীত হয়ে পড়লেন। এ ক্ষেত্রে জ্যোতিষী পণ্ডিতদের ভবিষ্যদ্বাণী ও তুর্কি কর্তৃক বঙ্গ অভিযানের কথাও তাঁর স্মৃতিতে ছিল, বিধায় রাজা কালবিলম্ব না করে অন্য কোনো উপায়ের চিন্তা না করে প্রাসাদের পেছনের দরজা দিয়ে পলায়ন করেন এবং নৌকাযোগে পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুরে আশ্রয় নেন। বখতিয়ারের পক্ষে বাংলা অভিযানে আর কোনো বাধা থাকলো না।
রাজা লক্ষ্মণ সেনের বিপুল ধনসম্পদ, ভৃত্যবর্গ এবং বহুসংখ্যক হাতি বখতিয়ার খলজির হস্তগত হলো। ইতোমধ্যেই বখতিয়ারের পিছনে থাকা সৈন্যবাহিনী এসে বখতিয়ারের সাথে যোগ দেয়। এভাবেই নদীয়া বিজয় সম্পূর্ণ হয়। লক্ষ্মণ সেনের হস্ত হতে এভাবেই নদীয়া বিচ্যুত হয়ে যায়।
নদীয়া বা নবদ্বীপ ছেড়ে রাজা লক্ষ্মণ সেন পূর্ববঙ্গের রাজধানী বিক্রমপুরে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর আমলের কয়েকটি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হয়েছে। বিক্রমপুরের জয়স্কন্দাবার হতে আবিষ্কৃত লক্ষ্মণ সেনের লিপিগুলোর মধ্যে ভাওয়াল ও মাধাইনগর লিপি দুটি পরবর্তী সময়ের হওয়া অসম্ভব নয়। কবি শরণ এবং কবি উমাপতি ধর একটি শ্লোকে লক্ষ্মণ সেন কর্তৃক একজন ম্লেচ্ছ রাজাকে যুদ্ধে হারানোর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ধারণা করা যায় যে, লক্ষ্মণ সেনের নদীয়া হতে বিক্রমপুরে পলায়নের পর গৌড়ের কিংবা বরেন্দ্রের কোনো কোনো মুসলিম শাসক বা সেনাপতিরা উক্ত সেন শাসিত অঞ্চল তথা পূর্ব ও দক্ষিণবঙ্গের অঞ্চলগুলো বিজয়ের চেষ্টা করেছিল। ধারণা করা যায় তাঁদের সে চেষ্টা সফলতা লাভ করেনি। বিক্রমপুরে আগমনের তিন চার বৎসরের মধ্যে লক্ষ্মণ সেনের মৃত্যু ঘটেছিল।
লক্ষ্মণ সেন ১২০৫ খ্রিস্টাব্দে আশি বৎসর বয়সে মারা যান। বখতিয়ার খলজির দেবকোট জয়ের চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে হতাশা ও যন্ত্রণায় তিনিও কিছুদিনের মধ্যে অসুস্থ হয়ে মারা যান।
ব্যক্তি হিসেবে লক্ষ্মণ সেন খুব মন্দ ছিলেন না। তিনি ছিলেন একাধারে সমরকুশলী সেনানায়ক, পরম বৈষ্ণব ধর্মানুরাগী, নিবেদিতপ্রাণ লেখক, সুকবি, বিদ্যোৎসাহী, জনকল্যাণকর ব্যক্তিত্ব। সমকালীন সমাজের কবি ও লেখকদের তিনি পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। তাঁর পিতা ও পিতামহের মত শাস্ত্র ও ধর্মচর্চায় আন্তরিক ছিলেন। তবে তিনি পিতা বা পিতামহের মত পরম মাহেশ্বর উপাধি গ্রহণ না করে পরম বৈষ্ণব উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা বা পিতামহের তাম্রশাসনে যেখানে শিবের স্তুতিবাচক শ্লোক এবং মুদ্রায় সদাশিবের মূর্তি অঙ্কিত থাকতো সেখানে তাঁর নিজের তাম্রশাসনে দেখা যায় নারায়ণের স্তুতিবাচক শ্লোক। তিনি আমৃত্যু ধর্মানুরাগী ছিলেন। তাঁর পিতা কর্তৃক রচিত অদ্ভুতসাগর নামক গ্রন্থটি তিনি পিতার নির্দেশে বাকি অংশ লিখে সমাপ্ত করেন। তিনি সে সময়ে কবিতার শ্লোকও লিখেছিলেন যা পরবর্তীতে প-িতদের হস্তগত হয়েছে। শ্রীধর দাস কর্তৃক সংকলিত সদুক্তিকর্ণামৃত নামক সংস্কৃত গ্রন্থে লক্ষ্মণ সেন ও তাঁর পিতার কয়েকটি কবিতা সংকলিত হয়েছে।
লক্ষ্মণ সেন জ্ঞানী-পণ্ডিত ব্যক্তি, কবিতা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর রাজ্যসভা জ্ঞানী-পণ্ডিত ব্যক্তিদের পদভারে মুখরিত ছিল। এ সকল কবিদের মধ্যে জয়দেব বিখ্যাত একজন কবি ব্যক্তিত্ব। তিনি বীরভূমের অধিবাসী ছিলেন। ধর্মীয় দিক থেকে তিনি ছিলেন বৈষ্ণব ধর্মের অনুসারী। গীত গোবিন্দ তাঁর রচিত অন্যতম একটি গ্রন্থ। তাঁর রচিত জনপ্রিয় একটি পদাবলির নাম হচ্ছে বৈষ্ণব পদাবলি। এ গ্রন্থটি এখনো ভারতের বিভিন্ন স্থানে বহুল পঠিত। এ গ্রন্থের বিষয়বস্তুই হচ্ছে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকাহিনী। জয়দেবের পিতা ছিলেন ভোজ দেব এবং মাতার নাম রামদেবী। সংস্কৃত সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে তিনি আজও বিখ্যাত হয়ে আছেন। গোবর্ধন ছিলেন একজন বিখ্যাত গ্রন্থকার। তিনি আর্য-সপ্তসতী নামক একটি গ্রন্থ রচনা করে রাজা লক্ষ্মণ সেনের রাজদরবার অলঙ্কৃত করেছিলেন। শৃঙ্গার রসাত্মক কবিতা রচনায় তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। রাজা লক্ষ্মণ সেন তা খুব আগ্রহের সাথে উপভোগ করতেন।
রাজা লক্ষ্মণ সেনের রাজদরবারের বিখ্যাত কবিদের মধ্যে কবি ধোয়ী, শরণ, উমাপতি ধর ও হলায়ুধের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কবি ধোয়ী পবনদূত নামক যে কাব্যগ্রন্থটি লিখেছিলেন তা বর্তমানে ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান। গ্রন্থটি কালিদাসের মেঘদূত কাব্যগ্রন্থের অনুকরণে রচিত। মালয় পর্বতের গান্ধর্বকন্যা কুবলয়বতী রাজা লক্ষ্মণ সেনের রূপে মুগ্ধ হয়ে পবনমুখে তাঁর হৃদয়ের কথা রাজার নিকট পাঠান। এতে সেন রাজাদের রাজধানীর বিবরণও উল্লিখিত হয়েছে। কবি উমাপতি ধর দেওপাড়া প্রশস্তি রচনা করেছিলেন। তিনি ছিলেন সে আমলের বাকবিন্যাসে পটু একজন পণ্ডিত কবি।
হলায়ুধ মিশ্র লক্ষ্মণ সেনের প্রধানমন্ত্রী ও রাজপুরোহিত ছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থ ব্রাহ্মণসর্বস্ব, বিখ্যাত গ্রন্থ। এ গ্রন্থটি লিখে তিনি ভারতজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এছাড়াও তাঁর লিখিত আরো গ্রন্থগুলোর মধ্যে মীমাংসাসর্বস্ব, পণ্ডিতসর্বস্ব, শৈবসর্বস্ব, মৎস্যসুক্ত বিখ্যাত হয়ে আছে। ব্রাহ্মণসর্বস্ব গ্রন্থটিতে বেদের তাৎপর্য বর্ণিত হয়েছে। বইটি বর্তমানেও পাওয়া যায়। এ গ্রন্থ রচনার উদ্দেশ্য ছিল ব্র্রাহ্মণদের সচেতন করে তোলা।
রাজা লক্ষ্মণ সেনের শাসনামলে কোষকার ও ব্যাকরণবিদ ছিলেন পুরুষোত্তম। তিনি ভাষাবৃত্তি, ত্রিকা-শেষ, হারাবলী, মর্নদেশনা, দ্বিরূপকোষ প্রভৃতি গন্থ রচনা করেন।
ইশান ও পশুপতি তাঁর উভয়েই হলায়ুধের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ছিলেন। তাঁরা বৈদিক অনুষ্ঠান ও শ্রাদ্ধ সম্পর্কে পা-িত্য অর্জন করেন। তাঁরা এ সকল বিষয়ে গ্রন্থও রচনা করেছিলেন। এ সময়ের তাঁরা শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ছিলেন।
লক্ষ্মণ সেনের আমলকে সংস্কৃত সাহিত্যের স্বর্ণযুগ হিসেবে অভিহিত করা হয়। সংস্কৃত সাহিত্যের উৎকর্ষতার কারণে সেন আমল বিশেষভাবে উন্নতির শীর্ষে পৌঁছেছিল। শিল্পকলার ক্ষেত্রেও রাজা লক্ষ্মণ সেনের শাসনামল বিশেষভাবে খ্যাতি অর্জন করেছিল।
তবকাত-ই-নাসিরীর লেখক মিনহাজ উদ্দীন সিরাজ রাজা লক্ষ্মণ সেনকে উদারচেতা, দয়ালু ও পরাক্রমশালী রাজা বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি লক্ষণ সেনকে হিন্দুস্তানের রায়গণের পুরুষানুক্রমিক খলিফার মত বলে বর্ণনা করেছেন এবং তাঁর শাসনরীতি সম্পর্কে অনেক প্রশংসা করেছেন। লক্ষ্মণ সেনকে মিনহাজউদ্দীন সুলতান করিম কুতুবউদ্দীন হাতেমুজ্জামান বা সে যুগের হাতেম কুতুবউদ্দীনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি আরো বলেছেন যে, রাজা লক্ষ্মণ সেন মহৎ রাজা ছিলেন। সারা হিন্দুস্থানে তাঁর মত আর কেউ সম্মানিত রাজা ছিলেন না। তিনি কারো প্রতি অত্যাচারের হস্ত প্রসারিত করেননি। তিনি যখন দান করতেন তখন তা অবশ্যই এক লক্ষ কড়ির কম হতো না। তিনিই ছিলেন সেন রাজাগণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।
বাল্যকাল হতে রাজা লক্ষ্মণ সেন যুদ্ধক্ষেত্রে যে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তা অসামান্য। গৌড়, কামরূপ, কলিঙ্গ, বারানসী ও প্রয়াগ পর্যন্ত তাঁর বীরত্বের খ্যাতি বিস্তার লাভ করেছিল। সৈনিক ও সেনাপতি হিসেবে তিনি তাঁর পিতা ও পিতামহকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন। প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে আর কোনো রাজা এতটা খ্যাতি ও সফলতা অর্জন করতে পারেননি। প্রায় ষাট বৎসর বয়সে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করে গোটা সাম্রাজ্যকে তিনি সফলতায় পরিপূর্ণ করে তোলেন। পরবর্তীতে আরো বৃদ্ধ হলে তিনি শেষ বয়সে আর সে সফলতার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেননি। এ সময় তিনি শাস্ত্রচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। ফলে শাসনব্যবস্থায় কিছুটা বিশৃংখলার সৃষ্টি হয়। মিনহাজউদ্দীন তাঁকে চরিত্রবান হিসেবে অভিহিত করেছেন। তবে বখতিয়ার খলজির অভিযানের সময় তাঁর পলায়নের ঘটনায় অনেক সাহিত্যিক-নাট্যকার ও ঐতিহাসিক বিশেষ করে কবি নবীনচন্দ্র সেন, দিজেন্দ্রলাল রায়, নন্দলাল বসু ড. আবদুল করিমসহ অনেকেই মিনহাজউদ্দীন সিরাজের লেখনীর উপর ভিত্তি করে তাঁকে ভীরু ও কাপুরুষ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে দীনেশচন্দ্র সেন, নীহাররঞ্জন রায়সহ অনেকেই তাঁকে অনেক যুক্তি উপস্থাপন করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, তিনি ভীরু-কাপুরুষ ছিলেন না। এ ধরনের অভিধায় আখ্যা দেয়াটা ছিল তাঁর প্রতি এক ধরনের অবিচার। তবে সমকালীন বাঙালির জাতীয় ঐক্য প্রচেষ্টায় তিনি তেমন কোনো অবদান রাখতে পারেননি। এতে শুধুমাত্র লক্ষ্মণ সেনকে এককভাবে দায়ি করা যায় না। কারণ, পুরো সেন শাসনামল খুব বেশি দীর্ঘ বলা যায় না। এ ছাড়াও তাঁরা ছিলেন অবাঙালি। এক্ষেত্রে সমকালীন সাধারণ মানুষের ভূমিকাও কম থাকে না। তাই তাঁদের একার পক্ষে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। পূর্বের সেন রাজারা যদি এ প্রচেষ্টা শুরু করে যেতেন হয়তো বা লক্ষ্মণ সেন তাতে ভূমিকা রাখতে পারতেন। এমন কোনো সূচনাচেষ্টার কোনো নজির দেখা যায় না। যুগপরিবর্তনে এ সময়কালে তুর্কি বাংলায় আধিপত্য বিস্তার প্রায় অবশ্যম্ভাবী হলেও মুসলমানগণ কর্তৃক বাংলা ও বিহার জয়ের যে দৃশ্য আমাদের চোখের সামনে ভেসে আসে তাতে রাজা লক্ষ্মণ সেনের ব্যক্তিত্ব কলঙ্কিত হয়েছে বলেই প্রতিভাত হয়। রাজা লক্ষ্মণ সেনের ব্যক্তিগত শৌর্যবীর্য বা অন্যান্য গুণাবলি যুগ পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন, His name should go down in history as that of a great and noble, though unfortunate ruler. শত্রুর আক্রমণ অত্যাসন্ন জেনেও এবং অন্যদের পরামর্শসত্ত্বেও তিনি রাজ্যত্যাগ করেননি। যখন সকলে তাঁকে ত্যাগ করে এবং আত্মরক্ষার সকল পথ রুদ্ধ হয়ে যায়, তখনই মুসলমানদের আক্রমণে তিনি পলায়নে বাধ্য হয়ে যান। তাই নীহাররঞ্জন রায় বলেন, লক্ষ্মণ সেন কাপুরুষ ছিলেন না, তিনি হতভাগ্য। ইতিহাসে তাঁর অবস্থান তবুও অনড় বলে সকলেই স্বীকার করে নেবে।
তবকাত-ই নাসিরীতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বখতিয়ারের নদীয়া বিজয়ের অল্পকালের মধ্যেই লক্ষ্মণ সেনের মৃত্যু হয়। সদুক্তিকর্ণমৃত গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে যে, ১২০৫ খ্রিস্টাব্দে রাজা লক্ষ্মণ সেন বাংলা শাসন করেছিলেন। তাঁর পরে তাঁর দুই পুত্র বিশ্বরূপ সেন (১২০৬-১২২০ খ্রিস্টাব্দ) ও কেশব সেন (১২০২০-১২২৩ খ্রিস্টাব্দ) বিক্রমপুরের সেন সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন।