প্রাচীন বাংলার চিত্রাঙ্গনে পটচিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান লক্ষ করা গেছে। ধারণা করা হয়ে থাকে যে, গাত্রচিত্র বা গুহাচিত্রের সময় থেকেই কিংবা তার কিছু অব্যবহিত পর বা পুঁথিচিত্রের পূর্ব থেকেই হয়তো পটচিত্রের যাত্রা শুরু হয়ে থাকবে। পটচিত্রের যাত্রা ঠিক কখন থেকে শুরু হয়েছে তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। কারণ খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচশত বছর থেকে গুপ্ত সম্রাটদের সময় পর্যন্ত এই বিশাল সময়ের মধ্যে প্রাচীন বাংলার কোনোরকম চিত্রের সন্ধান বা নিদর্শন পাওয়া যায় না। তবে প্রাচীন বৌদ্ধ ধর্মের গ্রন্থ ‘আর্যশ্রীমূলকল্প’-এ উল্লেখ করা হয়েছে যে, বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তাদের ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে পটচিত্রের উদ্ভাবন করেছিলেন। অর্থাৎ ধর্মচেতনা থেকে পটচিত্রের উদ্ভাবন। হিন্দুদের ‘দেবীপুরাণে’ও পটচিত্রের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতকের কাছাকাছি কোনো এক সময়ে নির্মিত ফুল, লতাপাতার নকশা করা একটি জলপাত্রের টুকরো অংশ পাহাড়পুরের সত্যপীরের ভিটা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এই পাত্রটিতে হালকা ফ্যাকাশে ক্যানভাসের উপর উজ্জ্বল সাদা ও সবুজ রঙ ব্যবহার করে আঁকা হয়েছে। প্রাপ্ত এই ভাঙা অংশটি গুপ্ত সময়ের সমসাময়িক বলে প্রত্নতত্ত্ববিদগণ মনে করে থাকেন। এটিই প্রাচীন বাংলার চিত্রশিল্পের সবচেয়ে পুরাতন নিদর্শন। এরপর ভারতের বাকুঁড়ার বীরভূমের এক পটুয়া সম্প্রদায়ের নিকট কাগজের উপর চিত্রিত কয়েকটি সুপ্রাচীন চিত্র পাওয়া গেছে। এসব খ- চিত্রের পূর্বেও পটুয়ারা দীর্ঘ কাপড়ের উপর কাহিনীর ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চিত্র আঁকতেন বলে মন্তব্য পাওয়া যায়।
প্রাচীনকালে পটকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এক শ্রেণির পট যার চিত্রকে বলা হতো ‘চরণচিত্র’ এবং দ্বিতীয় শ্রেণির পটের চিত্রকে বলা হতো ‘মাংখলী’ চিত্র। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে প্রথম তীর্থঙ্কর যখন তাঁর জৈনধর্ম প্রচার করতেন তখন মাংখলী চিত্রের সাহায্যে তা প্রচার করতেন। জৈন প্রাকৃত গ্রন্থে এই মাংখলী চিত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। এসব আলোচনা থেকে পটচিত্রের প্রাচীনত্ব স্বীকার করা যায়।
সংস্কৃত পট্ট শব্দের ভাষাতাত্ত্বিক বিবর্তনের উচ্চারণ হচ্ছে পট। পট শব্দের প্রতিশব্দ বা অর্থ হচ্ছে বস্ত্রখ- বা কাপড়। পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে কাপড়ের উপর চিত্রিত চিত্রকলা, যাকে পট্ট বা পট বলা হয়। প্রাচীন বাংলায় পটচিত্র বলতে চিত্রিত এমন বস্ত্রখ-কেই বোঝাতো। আধুনিক শব্দ ছবির প্রতিশব্দ হিসেবে পট্ট বা চিত্রপট ব্যবহৃত হয়ে থাকতো। প্রাচীন ভারতবর্ষের দ্রাবিড় ভাষাসমূহের তামিল ও মালয়লাম ভাষায় আর্য পূর্ববতী সময়ে পটচিত্র অর্থে ‘পডম’ শব্দ ব্যবহার করা হতো। সেখান থেকেই ‘পট’ শব্দটি বাংলা রূপ গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ ‘পডম’ (দ্রাবিড়), পট্ট (সংস্কৃত), পট (বাংলা)।
প্রায় ৭০০ বছর আগে ভারতের রাজস্থানে এক ধরনের চিত্রকলা বিকশিত হয়েছিল যাকে বলা হয় ‘ফাডশিল্পকলা’। ‘ফাড’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘পাট্টা’ থেকে। পাট্টা হচ্ছে ছবি আঁকার জন্য একটি সমতল মসৃণ পর্দা। রাজস্থানের আঞ্চলিক ভাষায় যাকে বলা হয় ‘পাট’। এই ফাডচিত্রের বিষয়বস্তু আর পটচিত্রের বিষয়বস্তু প্রায় একই রকম। বিভিন্ন দেবদেবী বা ধর্মীয় বিষয়াদি আর রাজপুতদের গৌরবময় কীর্তিগুলো ‘ফাড’ এর মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। পটচিত্রেও ধর্মীয় বিষয় স্থান পেত। ঐতিহ্যবাহী এক একটি ‘ফাড’ লম্বায় প্রায় ১০ মিটার এবং প্রস্থে প্রায় ১.৫ মিটার হয়ে থাকে। ‘ফাড’ এর ক্যান্ভাস হিসেবে খাদি কাপড় ব্যবহার করা হয়। প্রথমের দিকে ‘ফাড’ তৈরিতে প্রাকৃতিক রঙ ব্যবহার করা হতো; পরে কেমিক্যাল রঙও ব্যবহার করা হয়েছে। আবার সংস্কৃত ‘পট্ট’ শব্দের ধ্বনি বিপর্যয়ের ফলে উচ্চারিত হতে পারে ‘ফাড’। এর আর একটি উচ্চারণ ‘পাট’, যা ‘পট’ এর ভিন্ন উচ্চারণ। কাজেই ধারণা করা যেতে পারে যে ‘ফাডচিত্র’ আর ‘পটচিত্র’ একটি অন্যটির পরিপূরক। অর্থাৎ পটচিত্র’ই হয়তো অঞ্চল বিশেষে ‘ফাডচিত্রকলা’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
প্রাচীন বাংলায় সে সময়ে যে ছবি আঁকতো তাকে পটুয়া বা পটো বলা হতো। অর্থাৎ চিত্রকর অর্থে পটুয়া বা পটো শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। তবে দ্রাবিড় পট্টি শব্দের অর্থ বাসগৃহ। যারা বাসগৃহ নির্মাণ করেন, অভিধানগত ভাবে তাদেরকে পট্টকার বলা হতো। অনুমান করা যায় সংস্কৃতভাষী যাযাবর আর্যরা পট্টকারদের চিত্রকর্মকে ‘পট্ট’ নামে অভিহিত করে থাকতেন। এ প্রসঙ্গে আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ‘ওডিবিএল’ গ্রন্থের প্রথম খ-ে পটুয়া/ পটো সম্পর্কে বলেছেন, পটুয়া থেকে পটো হয়েছে। [Painter (potue > poto). In Eastern Bengali the epenthetic stage is faund (pauta, poitua)]। প্রাচীন বাংলায় পটের যে প্রচলন ছিল তার উল্লেখ পাওয়া যায় ভারতীয় প্রাচীন সাহিত্যে। পট সম্পর্কে যেসব গ্রন্থে বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় তার মধ্যে রয়েছে ‘বিদগ্ধমাধব’ (খ্রি. ১৬ শতাব্দী), ‘উত্তর রামচরিত’ (খ্রি. সপ্তম/অষ্টম শতাব্দী), ‘হর্ষচরিত’ (সপ্তম শতাব্দী), ‘মুদ্রারাক্ষস’ (খ্রি. পঞ্চম শতাব্দী), ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ ও ‘মালবিকাগ্নিমি’ (খ্রি. চতুর্থ শতাব্দী), ‘হরিবংশ’ (খ্রি. দুই শ শতাব্দী)। বৌদ্ধ সাহিত্য ‘সারথ্থকাসিনী’ (খ্রি. পঞ্চম শতাব্দী), ‘সংযুক্তনিকায় খন্দসংযুক্ত (খ্রি. পূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী) এ ছাড়াও কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, বৌদ্ধ ও জৈন জাতকসহ অন্যান্য গ্রন্থে পটের বিবরণ রয়েছে।
প্রত্নতাত্ত্বিক উপকরণেও পটের স্বপক্ষে অনেক চিত্রের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। হরোপ্পা-মহেঞ্জোদারো, সিঙ্গানপুর, কাংড়া, অজন্তা, খাজুরাহো, পাহাড়পুর, অমরাবতী, বালীদ্বীপ, সিংহলী ইত্যাদির চিত্ররীতির সাথে আর্যপূর্ববতী লোকচিত্রকলায় পট আঁকার যথেষ্ট সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। এইসব তথ্য-উপাত্ত ঘাঁটাঘাঁটি করলে অনুমান করা যায় যে, প্রাচীন বাংলার চিত্রকলার ঐতিহ্য প্রায় তিন হাজার বছর পূর্ব থেকেই চলে আসছে।
পটচিত্রের প্রাচীনত্ব সম্পর্কে দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর ‘বৃহৎ বঙ্গ’ গ্রন্থে লিখেন-‘চিত্রপট প্রদর্শনের রীতিটা বিক্রমপুরে ‘পটনাচানো’ নামে পরিচিত। বঙ্গের কোনো কোনো স্থানে এই শ্রেণির পটুয়াদিগকে ‘পটিদার’ বলে। এই রীতিটি খ্রিষ্ট জন্মের বহুপূর্ব হতে এদেশে প্রচলিত আছে।’ সুপ্রাচীন এই পটচিত্রের শিল্পীদের আর একটি উপাধি ছিল তা হলো ‘মস্করী’। এই মস্করীরা ছবির মাধ্যমে জনগণকে ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষাদান করতো এবং সেটিই ছিল তাদের পেশা। মানুষকে বুঝানোর জন্য যেসকল চিত্র তারা আঁকতো তাতে প্রচুর ব্যঙ্গরসের ব্যবস্থা থাকতো। এজন্য এখনো ‘মস্করা’ শব্দকে তামাসা অর্থে বা ফাজলামো অর্থে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে মস্করীদের নাম পটিদার। ব্রাহ্মণদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে পটুয়ারা মুসলমানদের আগমনের পর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন কিন্তু তারা পৈতৃক বৃত্তি ত্যাগ করেননি।
পটচিত্রের প্রাচীনত্ব সম্পর্কে আরও একটি ধারণা পাওয়া যায় গ্রামীণ সংস্কৃত সাহিত্যে। সেখানে পটুয়াদের সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশাখা দত্তের মুদ্রারাক্ষস নাটকের প্রথম অঙ্কে ‘যমপট’ প্রদর্শন ও গান গেয়ে গৃহস্থবাড়ি থেকে সংবাদ সংগ্রহের জন্য ‘নিপুনক’ নিজেই পটুয়ার ছদ্মবেশ ধারণ করেছে। এ কাজে নিপুনককে নিয়োগ করেন চানক্য। এছাড়া অভিজ্ঞান শকুন্তলা, মালবিকাগ্নিমিত্র, হর্ষচরিত এবং উত্তর রামচরিত গ্রন্থেও পটের কথা পাওয়া যায়। এসব নিদর্শন বা তথ্য থেকে ধারণা করা যায় যে, পটুয়াদের অস্তিত্ব খ্রিষ্টীয় সপ্তম-অষ্টম শতকেও ছিল। তবে পটে ছবি আঁকার প্রচলন খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতক থেকেই পাওয়া যায়। অনুমান করা যায় আরো প্রাচীন কাল থেকেই পটচিত্রের অস্তিত্ব ছিল। কেননা সাঁওতালসহ অনেক আদিবাসী সম্প্রদায় তাদের আদিম লোকপুরাণকে অবলম্বন করে পট আঁকতেন। কোনো কোনো প-িত মনে করেন যে, বৌদ্ধ যুগের বহুপূর্ব থেকেই পটশিল্পের প্রচলন ছিল। পালযুগের পুঁথি ও পাটাচিত্রে এই পটশিল্পের নির্ভরযোগ্য প্রমাণাদি পাওয়া যায়।
কাগজের প্রচলন হওয়ার পূর্বে পটচিত্র কাপড়ের উপরই আঁকা হতো। প্রাচীন কালে পটুয়ারা পট আঁকার জন্য তুলট কাগজ নিজেরাই বানিয়ে নিত। অব্যবহার্য পাট, সুতা, ছেঁড়া কাপড়-চোপড়, গাছের ছাল, বাঁশ ইত্যাদি উপকরণ সহযোগে তৈরি করা হতো পটের উপযোগী জমিন বা ক্যান্ভাস। কাগজ আবিষ্কারের পর কাগজেও পট আঁকা হতো। পটে যে রঙ ব্যবহার করা হতো তা বর্তমান সময়ের মতো বাজার থেকে কেনা সাধারণ কোনো রঙ নয়। পটের জন্য বিভিন্ন ধরনের গাছ-গাছড়া, ফুল-লতাপাতা-ফল ইত্যাদির সমন্বয়ে তৈরি করা হতো ভেষজ রঙ। গিরিমাটি, তুঁতধূণা, মোম-মধু, দুধ, হলুদ, সিঁদুর, ভূষোকালি প্রভৃতি উপাদান সংমিশ্রণে প্রয়োজন মতো রঙ তৈরি করে নেয়া হতো। পটে আঠাও ব্যবহার করা হতো। আঠা তৈরিতে ব্যবহার হতো নিমের গাদ, তেঁতুল বিচি, কাঁচাবেল এবং প্রাকৃতিক ভাবে গাছের আঠাও ব্যবহার করা হতো। কাপড় অথবা কাগজ আঠা দিয়ে কয়েক পুরৎ পুরু করে তৈরি করা বিছানা বা জমির উপর ঘরোয়া উপকরণ দিয়ে নিজের প্রস্তুত করা রঙে তৈরি হতো পট। সম্ভবত কাপড়ের উপর ছবি আঁকার পদ্ধতি প্রথম দিকে খুব বেশি ছিল যা ‘পট’ শব্দ বা পট্ট শব্দ দ্বারা অনুমান করা যায়। প্রাচীন বাংলার কোনো কোনো অঞ্চলে এই শ্রেণির পটুয়াদেরকে পটিদারও বলা হতো।
বৌদ্ধগণ জাতকের কাহিনী পটের মাধ্যমে যেভাবে প্রচার করতেন সেভাবে খ্রিষ্টানগণও ধর্ম প্রচার করতেন। রোমের ভ্যাটিকানে খ্রিষ্টীয় প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীতে ‘পেপিরাস’ পত্রে আঁকা এরকম কয়েকটি ছবি আছে।
পটচিত্রের প্রাচীন ধারার অনুসরণে পটের বেশ কয়েকটি প্রকরণ করা হয়েছে। যেমন কালিঘাটের পট, গাজিরপট, জাদু বা চক্ষুদান পট, যমপট ইত্যাদি। এছাড়াও মাটির চারকোনা পাতে আঁকা পঞ্চকল্যাণী নামে আরও এক ধরনের পটের সন্ধান পাওয়া যায়।
পটের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো সাধারণত পট পাঁচ-ছয় মিটার লম্বা এবং এক মিটারের থেকে কিছু কমের মতো প্রস্থ করা হতো। এই মাপের আয়তনের একটি কাপড়ের জমিনের উপর প্রচলিত কোনো একটি পৌরাণিক বা লোক পৌরাণিক কাহিনীর খানিকটা অংশকে ধরে পনেরো বিশটি ছবির ক্রমবর্ণনার ধারার সংকলন হিসেবেই পট অঙ্কিত হতো। ছবি আঁকার কাজ শেষ হলে সেটিকে সরু একটি লাঠিতে তা পেঁচিয়ে রাখা হতো বা জড়ানো হতো। এই সবকিছু মিলে হতো এক একটি পট বা পটচিত্র। এগুলো দেখানোর সময় জড়ানো কাপড়ের এক প্রান্ত ধরে ধীরে ধীরে খুলে ছবির বিষয়বস্তুর সাথে মিল রেখে কাহিনীর বর্ণনা সুরে সুরে নেচেগেয়ে দর্শক শ্রোতাদেরকে আকৃষ্ট করতেন পটুয়ারা। সে কারণেই জড়ানো পটের দ্বারা একই সঙ্গে দেখা ও শোনার মাধ্যমে ভিজুয়াল অডিও এফেক্ট সৃষ্টি হতো।
ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ হতে জানা যায় পটুয়ারা বিশ্বকর্মার বংশধর। বিশিষ্ট শিল্পী এবং স্থপতি বিশ্বকর্মার আভিজাত্য দেবকুলে অতি স্বল্প বেতনভুক্ত কর্মচারীর ন্যায়। তিনি আর্যকন্যা শুদ্রাণী ঘৃতাচিকে বিয়ে করেন। ঘৃতাচির গর্ভে যে নয়টি (৯) সন্তান জন্মগ্রহণ করেন তাদের মধ্যে চিত্রকর ছিলেন অন্যতম। এই চিত্রকরই হচ্ছেন পটুয়াদের পূর্বপুরুষ বলে প্রচলিত।
প্রাচীন বাংলাতে যে পটচিত্রের প্রচলন ছিল তা সন্দেহাতীত। প্রাচীন বাংলার পটচিত্রের ধারাবাহিকতার প্রভাব পড়েছে মধ্যযুগেও। মধ্যযুগের বাংলায় পটচিত্রের চর্চা ছিল প্রায় প্রতিটি সমাজে। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ প্রায় সকল সমাজেই পটচিত্র আঁকা হতো। মুসলমানদের জন্য গাজিরপটের মতো পট আঁকা হতো আর হিন্দু বৌদ্ধদের জন্য তাদের নিজ নিজ ধর্মের বিষয় প্রাধান্য পেত। মধ্যযুগের পটুয়ারা মুসলমানদের মতো নামাজ পড়তো আবার একই সাথে হিন্দু দেবদেবীর ছবিও আঁকতো। রবীন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, ‘মধ্যযুগে বাংলার পটিদাররা বৈষ্ণবধর্ম প্রচার উদ্দেশে পটের পুনঃপ্রচলন করেন। সেজন্যে পটের বিষয়বস্তুতে কৃষ্ণলীলা প্রাধান্য লাভ করেছে। সপ্তম শতাব্দীর রচনা বাণভট্টের ‘হর্ষচরিত’ কাব্যে যম পটের কথা উল্লেখ আছে। সেখানে বলা হয়েছে পটুয়ারা পালা শেষে যমপট দেখিয়ে থাকেন। এ মন্তব্য মধ্যযুগের পটুয়াদের সাথে মিলে যায়। সেজন্যে বলা যায় মধ্যযুগের পটুয়ারা প্রাচীন বাংলার পটুয়াদের উত্তর প্রজন্ম। দীনেশচন্দ্র সেনের মতে মধ্যযুগের পটুয়াদের পূর্বপুরুষ ‘মস্করী’ উপাধিধারী বৌদ্ধরা।
মধ্যযুগের পটে যে রাধা-কৃষ্ণ ও রাম-সীতার কাহিনী চিত্রিত হয়েছে তা সংস্কৃত ভাগবত ও রামায়ণ থেকে এদেশে প্রচার লাভ করেছে। তবে আর্যসংস্কৃতির সাথে বাঙালিদের পরিচয় ঘটে প্রাচীন কাল থেকেই। কিন্তু সাধারণ জনগণের কাছে এর সামগ্রিক প্রভাব পড়ে মধ্যযুগের কবি মালাধর বসুর অনুবাদ গ্রন্থ ‘কৃত্তিবাস’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে। মালাধর বসু ছিলেন পনেরো শতকের কবি। এসময় থেকে কৃষ্ণলীলা, রামলীলা পটচিত্রের বিষয় হিসেবে প্রচলিত হতে পারে বলে মনে করা যেতে পারে।
মধ্যযুগে বাংলায় যখন পীর-দরবেশদের প্রতিপত্তি বিস্তার লাভ করে তখন গাজি পীরকে কেন্দ্র করে ‘গাজিরপট’ নামে আর এক প্রকার মুসলমানি পট রচিত হতে থাকে। এধরনের পটকে পীরের প্যাঁচালিও বলা হয়। গাজি পীরের আবির্ভাব কাল পনেরো শতকের শেষের দিকে বলে অনুমিত। ষোলো শতকের মাঝামাঝি সময়ে হয়তো গাজিরপট চিত্রিত হয়ে থাকবে। এছাড়াও মধ্যযুগের পটচিত্রের কথা কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘চ-িমঙ্গল’ কাব্যেও পাওয়া যায়। এসব তথ্য থেকে জানা যায় যে, পালযুগের মস্করীরা যে পটচিত্র ও পটগীতের প্রচলন করে ছিল তা ক্রমশ মুসলিম বিজয়ের পরও এদেশে স্থায়িত্ব পেয়েছিল। কাজেই বলা যায় মধ্যযুগের পটচিত্র প্রাচীন বাংলার পটচিত্রের প্রতিরূপ। মধ্যযুগের এসব পটচিত্র থেকেই প্রাচীন বাংলার পটচিত্র সম্বন্ধে ব্যাপক অভিজ্ঞতা লাভ করা যেতে পারে।
পট একটি যৌথ শিল্পকর্ম। পুরুষ-নারী সকলেই এই শিল্পকর্মে অংশগ্রহণ করে থাকেন। প্রাচীন বাংলাতেও এমনই হয়ে থাকবে। পটে যে ছবি আঁকানো হবে তার বিষয়বস্তু নির্ধারিত হওয়ার পর সেই ছবির বিষয়ে গান লেখেন পটুয়ারা নিজেই। সাহিত্যিক তথ্যমতে পটের কয়েকটি সাধারণ প্রকার পাওয়া যায়। যথা-
প্রথম. ‘চৌকাপট’। এ পটে এক একটি ছবি আলাদা আলাদাভাবে আঁকা হয়। এ ধরনের পটের ছবির ব্যাখ্যার জন্য গান/গীতও আলাদা হয়।
দ্বিতীয়. ‘জড়ানো পট’। এ পট আকারে লম্বা হয় এবং ছবিগুলো বিষয় অনুপাতে উপর থেকে নিচে ক্রমানুসারে অঙ্কিত হয়। এইসব পট নিয়ে পটুয়ারা গানবাজনার মাধ্যমে ছবিগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে পাড়া-মহল্লা-গ্রামে-গঞ্জে গৃহস্থের ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়ান এবং প্রদর্শন করান।
তৃতীয়. ‘পঞ্চকল্যাণীপট’ এ ধরনের পটে বিশেষ কোনো দেবতার পরিবর্তে একাধিক দেবতার গল্প সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হয়। এ ধরনের পট আবার পটুয়ারা আঁকেন না। এগুলো আঁকেন আচার্য সম্প্রদায় অথবা কুম্ভকাররা।
চতুর্থ. মাটিরপট। এর আর একটি নাম হচ্ছে ‘সরা’। এসব সরা পোড়ামাটির তৈরি। এ পটের উপর নানান ধরনের ছবি এঁকে সেগুলোর বর্ণনা করা হয় গানের সুরে সুরে।
প্রাচীন পটুয়ারা কোন সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন তা নির্ণয় করা এখন খুবই কঠিন। তাঁদের প্রধান পরিচয় ছিলো যে, তাঁরা পট আঁকতো। তবে সাধারণভাবে পটুয়ারা ছিলেন চিত্র সম্প্রদায়ের মানুষ। বিভিন্ন জাত-গোষ্ঠীর মানুষ ছবি আঁকার জন্য ছোটবেলা থেকেই চিত্রসম্প্রদায়ে যোগ দিতেন। প্রথমত পুণ্য অর্জনের উদ্দেশেই হয়তো তাঁরা পট আঁকতো এবং তাতে তাঁদের জীবিকাও নির্বাহ হতো। সেজন্য জাত নির্ণয় করে পটুয়া হতো না। বাঁকুড়া বীরভূম প্রভৃতি অঞ্চলের শিল্পীগোষ্ঠী ব্যতীত কলকাতার কালিঘাট অঞ্চলেও এক পটুয়া সম্প্রদায় বাস করতো। এ সব সম্প্রদায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়বস্তু বা ঘটনা নিয়ে চিত্র রচনা করতো। এসব পটের খদ্দের ছিলেন তীর্থযাত্রীরা। যারা কালি মন্দিরে মায়ের চরণধূলির জন্য আসতেন। এই পটুয়ারা সাধারণত শ্রীরামপুরী কাগজে হালকা মেজেন্টা রঙ দিয়ে এক প্রকার ছবি আঁকতেন এবং সেগুলোই কালিঘাটের পট হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে। গাঢ় রঙ বা টেম্পেরা পেইন্টিংও তাঁরা জানতেন। সাধারণত দামি টুকরো ছবিসমূহ টেম্পেরা রঙ দিয়ে নির্মিত হতো। এসব চিত্রে দেব-দেবীরাই স্থান করে নিয়েছিল সবচেয়ে বেশি। এছাড়া ছবিগুলোতে জীবজন্তুর মধ্যে টিয়া, বিড়াল, হনুমান ও গরু বিশেষভাবে স্থান করে নিয়েছিল। বিড়ালের মাছ চুরি করে পালিয়ে যাওয়ার চিত্রটি কালিঘাটের পটচিত্রের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল।
ভারতশিল্পের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রেখাপ্রবণতা ঠিক রেখে পটুয়ারা চিত্রকে একটি স্বতন্ত্র গতিপথে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন। রাজপুত ও মোগল শিল্পের সূক্ষ্ম কলাকর্ম বা রেখা গতি নিয়েছিল সূক্ষ্ম পথে আর পটচিত্র চলেছিল স্থূলপথে।
মোটা এবং দামি টেম্পেরা রঙ দিয়ে যে ছবি আঁকা হতো সে ছবিতে প্রাণ ছন্দের প্রকাশ হতো না। ছবিগুলো ধরে ধরে খুঁটে খুঁটে আঁকা হতো। হালকা রঙয়ের ছবিগুলো ইম্প্রেসনিস্ট ভাব নিয়ে চিত্রিত হয়েছিল। টেম্পেরা চিত্রে বর্ণের ওজন ও আলোছায়া প্রয়োগের প্রাথমিক প্রচেষ্টা থাকার কারণে সে গুলোতে স্থূলত্ব ও মডেলিং সৃষ্টি হতো। গাঢ় ও হালকা রঙয়ের ছবিগুলো ভাব-বিষয়বস্তু ও অঙ্কন শৈলীতে একবারে ভিন্ন পদ্ধতির ছবি হয়ে উঠতো। একই শিল্পীর দ্বারা দু’ভাবে চিত্রাঙ্কন একপ্রকার দক্ষতারই পরিচায়ক। আশ্চর্যের কথা হচ্ছে শিল্পীগণ ছবি এঁকেছেন ঠিকই কিন্তু পেন্সিল বা রাবার দিয়ে কোনো প্রকার ড্রয়িং বা ট্রেসিং কিছুই করতেন না। অথচ চিত্রগুলো দেখে মনে হতো এগুলো যেন ব্লক থেকেই উৎপন্ন হয়েছে। এ ধারা প্রাচীন বাংলা থেকে হয়ে আসছে বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। বংশপরম্পরায় শিল্পীগণ শিশুকাল থেকেই তুলির চর্চা করতেন বিধায় তাঁদের তুলি জাপানি শিল্পীদের তুলির মতো রেখার মাধ্যমে মুখর হয়ে উঠেছিল। এসব আলোচনা থেকে জানা যায় প্রাচীন বাংলার পটচিত্র গুণে ও মানে চিত্রধারার এক মূল্যবান সহযাত্রী এবং প্রাচীন বাংলার চিত্রচর্চার প্রামাণ্য দলিল।