অ্যাশফোর্ড থেকে ট্রেনে ক্যান্টারবারি বিশ মিনিটের পথ। ট্রেনে উঠে বসতেই সময় যেন শেষ হয়ে যায়। মে-জুন মাসে বিলাতে বসন্ত। ট্রেনের জানালা দিয়ে সেই বসন্তের রূপ দেখছি। শীতের শেষে মরা গাছগুলো নতুন পাতায় ভরে গেছে। ফুলে ছেয়ে গেছে চারদিক। জানালা দিয়ে দেখছি বিস্তীর্ণ রেপসিডের ক্ষেত। হলুদ ফুলে পুরো মাঠ ঢাকা পড়েছে। আমাদের দেশের সরিষার ক্ষেতের মতো। রেপসিড থেকেও সরিষার মতো ভোজ্যতেল তৈরি হয়। দূরে মাঝে মাঝে একটা দুইটা ফার্ম হাউজ। অসীম মমতায় কৃষক সেই ফার্ম হাউজগুলোকে পরিবেষ্টন করে থাকে। এদেশের কৃষকরা দরিদ্র নয়। অনেক জমি নিয়ে এরা এক একটি ফার্ম হাউজ গড়ে তোলে।
তবে এদেশের মানুষ দারুণ প্রকৃতিপ্রেমী। প্রকৃতির স্পর্শে এরা সবসময় শ্বাস নিতে চায়। প্রত্যেক বাড়ির সামনে ফুলের কেয়ারি। পাতাবাহারের সমারোহ। রাস্তায়, পাবলিক প্লেসের গাছগুলো নিত্যনতুনভাবে ছেঁটে রাখা হয়। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। বৃক্ষনিধনের কথা এরা বোধ হয় ভাবতেই পারে না। বৃক্ষকে ছেঁটেছুটে সাজিয়ে রাখার জন্য এখানে একদল পেশাদার তৈরি হয়েছে। এদেরকে বলে ট্রি সার্জন। আর আছে পেশাদার গার্ডেনার। এরা বাণিজ্যিকভাবে পেশাদারিত্বের সাথে বিভিন্ন বাড়ি, কর্পোরেট হাউজের সামনে বাগান তৈরি করে দেয়। প্রকৃতিকে উপভোগ করবার এই বিস্ময়কর অনুভূতি এরা কোথা থেকে পেয়েছে তা ভাবতে অবাক লাগে।
ট্রেন আমাদের ক্যান্টারবারি নামিয়ে দিয়ে হু হু করে চলে যায়। আমার সাথে মীরা আর যাইয়ান এদের কাছে এ শহর নতুন নয়। আমি কেবলমাত্র নতুনত্বের বিস্ময় নিয়ে চেয়ে থাকি। স্টেশনের বাইরে এসে কিছুটা হাঁটলেই নগর তোরণ। পুরো এক মধ্যযুগীয় কায়দায় এই তোরণ নির্মিত। এর তলা দিয়েই নগরে প্রবেশ করতে হয়। আগের দিনের রাজা-বাদশাহরা রাজকীয় শকটে করে এই তোরণ দিয়ে নগরে প্রবেশ করতেন। হাতি-ঘোড়া, পাইক-পেয়াদা-সান্ত্রী, উজির-নাজির নিয়ে নগরে উৎসব জমিয়ে তুলতেন-ঠিক এরকম ব্যাপারটা এখন আর নেই। সেই দিন, সেই রেওয়াজ উঠে গেছে। কিন্তু কান পাতলে তোরণের ইটগুলো সেই ইতিহাস যেন কানাকানি করে বলতে চাইছে।
ক্যান্টারবারি বিলাতের একটি প্রাচীন শহর। শুধু প্রাচীনতার জন্যই নয়, এ শহর থেকেই বিলাতে প্রথম দিকে খ্রিস্টধর্ম প্রচারিত হয়। সে হিসেবে বিলাতের মানুষের কাছে এ শহরের একটি আধ্যাত্মিক মর্যাদাও আছে বৈকি। নগর তোরণের তলা দিয়ে যে রাস্তাটা সোজাসুজি চলে গেছে হাই স্ট্রিট যার নাম, সেটাই এ শহরের প্রাণকেন্দ্র। কারণ এ শহরের চারপাশে গড়ে উঠেছে টাউনসেন্টার। শপিং সেন্টারগুলো প্রধানত এ রাস্তার চারপাশেই দাঁড়িয়ে আছে। মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার, ডরথি পারকিনস, সৌল ট্রেডার্স, হটার্স, প্যান্ডোরা, ডব্লিউ এইচ স্মিথ কত রকম ব্র্যান্ডের দোকান রাস্তার দু’ধারে তাদের পণ্য সাজিয়ে বসেছে। আর পণ্য পসারীরা সেই দোকানগুলোকে অনবরত জমিয়ে রেখেছে। বসন্তের মোলায়েম রোদ ও বাতাসের লুকোচুরিতে ক্যান্টারবারির নর-নারীরা যেন জেগে উঠেছে। পুরো টাউনসেন্টার হাস্যোজ্জ্বল নর-নারীর কলরব, কোলাহল ও মিতালিতে মেতে উঠেছে। বসন্ত আসলে পুরো ইংল্যান্ড যেন জেগে ওঠে। শীতে ঘুমিয়ে পড়ে।
ক্যান্টারবারি শহরটা ঘুরলেই বুঝা যায় এখানে আধুনিকতা ও ঐতিহ্য পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। এরা পুরনো ইমারতকে ভেঙে ফেলে না। বরং এটিকে যথাসম্ভব সংস্কার করে সংরক্ষণ করে এবং এর ভিতরেই যতদূর সম্ভব আধুনিক সুযোগ সুবিধা প্রতিস্থাপিত করে। এদের আধুনিকতা ঐতিহ্যকে বাদ দিয়ে নয়। ক্যান্টারবারি আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের সঙ্গমস্থল। পুরো বিলাতই হয়তো তাই। যেন মধ্যযুগ আধুনিকতার কোলে এসে ঢলে পড়েছে। টাউনসেন্টারের ভিতরে এক চৌমাথায় দেখি স্ক্রল হাতে জিওফ্রে চসারের একটি আবক্ষ মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। এই সেই মধ্যযুগের ইংরেজ কবি যিনি ক্যান্টারবারি টেলস লিখে এই শহরটিকে জগদ্বিখ্যাত করেছেন। অন্তত ইংরেজ কলোনি যে দেশে গিয়েছে আর যারা ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়েছে তারা এই শহরটিকে চেনে। ক্যান্টারবারি টেলস হচ্ছে চসারের ম্যাগনাম ওপাস। এটা ২৪টি গল্পের সমারোহে ১৭০০০ লাইনের একটি দীর্ঘ কবিতা। সেকালে গল্প বলার ভঙ্গিতে সাহিত্য চর্চার রেওয়াজ ছিলো। চসারের কবিতায় তীর্থযাত্রীরা লন্ডন থেকে ক্যান্টারবারির সেন্ট টমাস বেকেটের মাজার জিয়ারত করতে আসে। এই তীর্থস্থান পরিভ্রমণ করার সময় যাত্রীরা যে গল্প বলার প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় তাই এ কবিতার সারবস্তু। এ কবিতায় সেকালের সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতির বহু ছবি পাওয়া যায়। ক্যান্টারবারি টেলস হচ্ছে ইংরেজি সাহিত্যের উন্মেষ যুগের সৃষ্টি এবং এ কবিতার মাধ্যমে ইংরেজি সাহিত্য এমন একটা জায়গায় চলে আসে যে এটি ফ্রান্স, ইতালি ও ল্যাটিন ভাষার সমকক্ষ হয়ে যায়। সে হিসেবে বলা যায় ক্যান্টারবারি টেলস হচ্ছে ব্রিটিশ জাতীয়তাবাদের প্রথম কুসুম।
হাই স্ট্রিটে চসারের মূর্তি ছাড়িয়ে একপাশে মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার অন্যদিকে স্টারবাকের দোকান। মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার বিলাতের বিখ্যাত মনিহারি দ্রব্যের ব্র্যান্ড। প্রধানত পোশাকই বিক্রি করে। এদের দোকানের বিশালতা দেখলে খেই হারাতে হয়। আমরা তিনজনে মিলে সেখানে ঢুকে পড়ি। শপিং মীরার পছন্দ। ব্র্যান্ডের এই দোকানে বাংলাদেশের কাপড় দেখে মুগ্ধ হই। মেড ইন বাংলাদেশ লেখা। স্যালুট সেই সব গার্মেন্টস কর্মীকে যারা আধুনিক সভ্যতার রাজধানী বিলাতে বাংলাদেশকে এইভাবে পৌঁছে দিয়েছে।
মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার থেকে আমরা সোজা ঢুকে পড়ি স্টারবাকে। উদ্দেশ্য দুপুরের লাঞ্চ। স্টারবাকের কফির খ্যাতি জগৎজোড়া জানতাম। কিন্তু লাঞ্চের ব্যবস্থাও এখানে আছে। আমি এক পিস বানানা ব্রেড নেই। যাইয়ান ও মীরা নেয় পনিরের টোস্ট। স্টারবাক, এক্সপ্রেস, ম্যাকডোনাল্ডের লাঞ্চ এখানে বিখ্যাত। মোটামুটি সস্তা। কোন কোন কোম্পানি প্যাকেজ মিলেরও ব্যবস্থা করে। স্টারবাকে এসে দেখি খদ্দের একেবারে কম নয়। এরা প্রধানত খাওয়া দাওয়াটা আউটডোরেই সারে। নানা রকম সামাজিক অর্থনৈতিক কারণে তাদের এ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়েছে। যাইয়ানকে জিজ্ঞাসা করি এরা তাহলে কী খায়?
– কখনো কেক, কখনো পটাটো চিপস আর ফিস পিলেট, কখনো বার্গার।
এরা কি ঘরে কোন খাওয়ার ব্যবস্থাই রাখেনি।
দরিদ্র ও বৃদ্ধরাই প্রধানত এ কাজ করে-যাদের কোন বিকল্প নেই। রাতেও টেকএওয়ে থেকে খাবার নিয়ে যায়।
আমি তাজ্জব হয়ে জিজ্ঞাসা করি, এদেশেও দরিদ্র আছে?
– কেন থাকবে না। ক্যাপিটালিজম যেখানে আছে সেখানে দারিদ্র্যও থাকবে। এই কারণেইতো এরা মার্কসের ভূত ছাড়তে পারে না।
– কিন্তু এরাও তো ক্যাপিটালিজমের অনেক সংস্কার করেছে। ক্যাপিটালিজমের কাঠামোর মধ্যে নানা রকম সামাজিক কর্মসূচি যোগ করে এর একটা নির্দোষ চেহারা আনার চেষ্টা করছে।
– সে কথা অবশ্য ঠিক। ফ্রি হেলথ সার্ভিস, আবাসনের সুযোগ সুবিধা। বয়স্ক ভাতা এগুলো অবশ্যই ফেলনা নয়।
দুনিয়ার বাস্তবতার মুখে ক্যাপিটালিজম কি তার চরিত্র কিছুটা পালটিয়েছে?
-ক্যাপিটালিজমের এই চরিত্র বদল সার্বজনীন নয়। ক্যাপিটালিজম দেশে গণতন্ত্র চায়, বিদেশে চায় না। যেই ক্যাপিটালিজম দেশের নাগরিকের নিরাপত্তায় টনটনে ব্যবস্থা নেয়, সেটিই আবার বিদেশের নাগরিক অধিকার বোমা মেরে হটিয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত ক্যপিটালিজম ক্যাপিটালিজমই।
চাঁদের কি অমাবস্যা থাকতে নেই?
– ওদের অমাবস্যা দীর্ঘতর হয়ে যায়।
যাইয়ানের এই ক্যাপিটালিজম দর্শনে আমি হো হো করে হাসতে থাকি। স্টারবাকের কর্পোরেট পরিবেশে ক্যাপিটালিজমের ক্রিটিক বেশ জমে উঠেছিলো। বেলা গড়িয়ে যাওয়ায় আমরা উঠে পড়ি। এবার আমাদের গন্তব্য ক্যান্টারবারি ক্যাথিড্রাল। এই ক্যাথিড্রাল হচ্ছে এ্যাংলিকান চার্চের প্রধান কেন্দ্র। এই বিশেষ চার্চ হচ্ছে বৃটেনের রাজধর্ম।
ক্যান্টারবারি ক্যাথিড্রালকে বলা হয় ইংল্যান্ড ইন স্টোন। এর কারণ এটির সাথে ইংল্যান্ডের ইতিহাসের অনেক ভাঙাগড়ার যোগ রয়েছে। মধ্যযুগে যেসময় চার্চ ও রাজার সাথে বিরোধ শুরু হয় সেসময় সেই বিরোধিতার সূত্রে রাজারা তখনকার কয়েকজন আর্চবিশপকে খুন করেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন থমাস বেকেট। তার মৃত্যুর পর তার অলৌকিকতার কথা ছড়িয়ে পড়ে এবং তীর্থযাত্রীরা দলে দলে এখানে ভিড় জমাতে থাকে। চসারের ক্যান্টারবারি টেলস-এ আছে এখানে তীর্থ যাত্রীরা বিভিন্ন অসুখ বিসুখের নিরাময়ের জন্য আসতো এবং এদের আগমনে এই শহরের অর্থনৈতিক কর্মকা- মুখর হয়ে উঠতো।
সাধু বেকেটের হত্যাকান্ড পুরো ইংরেজ জাতির উপর এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিলেন যে পরবর্তীকালে ইংরেজ কবিরা তাদের কবিতা, সঙ্গীত ও ধর্মকথায় তুলে আনেন সেই করুণগাঁথা। সাধু বেকেট হত্যার দু’শ বছর পর চসার লেখেন ‘ক্যান্টারবারি টেলস’। পরবর্তীকালে এই হত্যাকান্ড এবং চসারের কাজে প্রভাবিত হয়ে আলেক্সান্ডার পোপ লেখেন ‘দ্য টেম্পল অফ ফেম’। ১৯৩৫ সালে টি. এস. এলিয়ট বেকেটের স্মরণে লেখেন ‘মার্ডার ইন দ্য ক্যাথিড্রাল’ নামের নাটক। এ নিয়ে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে।
প্রত্যেকে ১০ পাউন্ড দিয়ে টিকিট কেটে আমরা ক্যাথিড্রালের মূল চত্বরে প্রবেশ করি। পাথরে তৈরি ক্যাথিড্রালের বিশাল আকৃতি, সুউচ্চ টাওয়ার এবং চারিপাশের ল্যান্ডস্কেপ মুহূর্তে দর্শনার্থীর চোখে বিস্ময় সৃষ্টি করে। এটা মূলত একটা গথিক ক্যাথিড্রাল। আকাশচুম্বী বিশালতা এর বৈশিষ্ট্য। যেন স্বর্গের সাথে এটি কানাকানি করছে। এই ক্যাথিড্রালের স্থাপত্য শিল্পীর মনে এরকম একটা ভাবনা কাজ করেছে যেখানে খোদার বন্দনা হবে সেটি যদি বিশালাকৃতি না হয় তাহলে তার গৌরবের প্রকাশ কিভাবে ঘটবে। প্রকৃতপক্ষে শিল্পীরা এসব অতুলনীয় স্থাপত্যের সৌন্দর্য সৃষ্টি করে গ্লোরি অফ গড- খোদার মহিমাকেই প্রকাশ করতে চেয়েছেন। পুরো ইউরোপ জুড়েই গথিক ক্যাথিড্রালের ছড়াছড়ি। এর মধ্যে প্যারিসের নটরডাম ক্যাথিড্রাল খুবই বিখ্যাত। ধর্মের প্রেরণায় এরকম সৌন্দর্য সৃষ্টির বান জেগেছে। গথিক ক্যাথিড্রালগুলো তার বড় উদাহরণ। যারা শিল্পকে ধর্মনিরপেক্ষ মনে করেন তারা শিল্পের ইতিহাসের গভীরে যান না। শিল্প সৃষ্টির পিছনে ধর্মের অনিঃশেষ প্রেরণা রয়েছে। একটা শিল্পকে বুঝতে হলে তাই এর পিছনের ধর্মকে বুঝাও জরুরি।
ক্যাথিড্রালের সংস্কার কাজ চলছিল। তাই আমরা উত্তর দিকের ক্লয়েস্টার দিয়ে মূল ভবনে প্রবেশ করি। ক্লয়েস্টার মানে হচ্ছে সন্ন্যাসীদের থাকার জায়গা। সেই কালে এখানে খ্রিস্টান সন্ন্যাসীরা বসবাস করতো। এজন্য এটাকে মোনাস্ট্রিও বলা হয়। মোনাস্ট্রির সিলিংটা তৈরি হয়েছে রিবড ভলট ডিজাইনে যেখানে আর্চগুলোকে ক্রস প্যাটার্নে সাজিয়ে সিলিংকে ধরে রাখা হয়। পুরো ক্যাথিড্রালের সিলিংই এই ডিজাইনে তৈরি। দর্শনার্থীদের কাছে আকর্ষণের বিষয় হচ্ছে সিলিং কিভাবে তৈরি হয়েছে সেটা নয় বরং সিলিং-এর ডিজাইন কি সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। ক্যাথিড্রালের গাইড আমাদেরকে আয়না সমান্তরাল ভাবে ধরে উঁচু সিলিং-এর ডিজাইন দেখিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করেন কিভাবে এটি দর্শকের প্রাণে রূপ ও রসের অনুভূতি তৈরি করে।
ক্লয়েস্টার থেকে আমরা যাই ক্যাথিড্রালের প্রধান কক্ষে। এর চারিপাশে ছোট ছোট চ্যাপেল, চ্যাপটার হাউজ রয়েছে। ভিতরে যেয়ে যে জিনিসটা বেশি চোখে পড়ে সেটা হলো এর পেন্টেড গ্লাস। এই গ্লাসের ভিতর দিয়ে যখন আলো এসে পড়ে তখন ভিতরের কারুকাজগুলো রীতিমত বর্ণিল ও রোশনাই হয়ে ওঠে। এই সব পেন্টেড গ্লাসে আঁকা রয়েছে বিভিন্ন আর্চ বিশপ ও সেন্টদের ছবি। গাইড আমাদের একটি গ্লাসের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন এটি ১২ শতাব্দীর সময়কালের। চোখ ছানাবড়া করে দেখি সেই পুরনো কেমন করে আজকের মানুষের সাথে কথা কইছে।
ক্যাথিড্রালের মধ্যে মূর্তিও আছে। নানা সময়ের সেন্ট, আর্চ বিশপের মূর্তি। যিশু, মেরির মূর্তিতো আছেই। এই মূর্তি নিয়ে আইকনোক্লাস্টদের সাথে মূর্তির পক্ষের কনফর্মিস্টদের বহু দ্বন্দ্ব সংঘাত এমনকি খুনোখুনি পর্যন্ত হয়েছে। আইকনোক্লাস্টরা এসে সব মূর্তি ভেঙে দিয়ে গেছে। যদিও গত শতাব্দীতে এগুলোকে আবার প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে।
এখান থেকে আমরা যাই ক্যাথিড্রালের কয়েরের দিকে। কয়ের মানে হলো প্রার্থনার জায়গা। কয়েরে যাওয়ার পথে দেখি একদল স্কুলের ছাত্রছাত্রীকে এনে ক্যাথিড্রাল দর্শন করানো হচ্ছে। শিশু মনে ঐতিহ্য গেথে দেয়ার এটি এক কার্যকর পদ্ধতি। এ কারণেই ইংল্যান্ড ইতিহাসচ্যুত জাতি নয় মোটেই। ইতিহাসের জঞ্জাল সে নেয়নি। কিন্তু ইতিহাসের সম্পদকে জাতিগঠনের শক্তিতে পরিণত করেছে।
কয়েরে এসে দেখি এখানে কিছুটা অন্ধকার পরিবেষ্টন করে আছে। সুনসান নীরবতা সেই অন্ধকারকে যেন আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রার্থনার জন্য এরকম জায়গাইতো চাই। এর মধ্যে দেখি কিছু পুণ্যার্থী বসে আছে প্রার্থনা শুরুর অপেক্ষায়। একটি তরুণী এসে সোজাসুজি মোমবাতি জে¦লে প্রার্থনায় বসলো। ঠিক যেন গৌতম বুদ্ধের ঢং-এ। পৃথিবীর সব ক্লান্তি ছেড়ে ছুড়ে অনাদি অনন্ত খোদার কাছে কি সে চেয়েছিল তা আমরা কখনো জানতে পারিনি। কিন্তু তার সেই প্রার্থনার ভাষা তার চোখে মুখে দীপ্তি ছড়িয়ে আমাদের প্রাণেও কি কিছুটা নাড়া দিয়েছিল। বলতে পারি না।