হাফিজ রশিদ খান
নিন্দা
হা প্রভু আমাকে শুধু
নিন্দার বুলেটে লোকেদের শাসাতে তোমার ভুবনে পাঠালে
স্বর্গের উদ্যান থেকে ভুল জায়গায় পাঠিয়ে তুমিও কি মাথায়
হাত দিয়ে বসে আছ এখন একলা
তোমার সমস্ত গুণের পরাগ দেবদূতগণে দিয়েছ তো অকাতরে
শুধু নিন্দাটাই এলো সুবর্ণসর্পের ভঙ্গিতে
আমার বরাতে
নাকি নিজের পথের কাঁটা সারা গায়ে জড়িয়েছি
আমারই আগের কোনো ভুলে
আমার প্রাণের না-না ধ্বনিতে কাঁপছে পৃথিবীর বুক
আর ভোগবিলাসীরা শিরোভূষণে হাসছে হর্ষধ্বনি তুলে
এ সাজা আমার শেষ হবে কবে প্রভু …
কাজী গোলাম গউস সিদ্দিকী
সত্য কি বহুরূপী হতে পার?
এখনও তোমার ডাক শুনতে পাই, মধ্যদিনে, সূর্যের পড়ন্ত বিকালে
এখও তোমার পায়ের শব্দরা আমার কানে খেলা করে, এ সব শব্দরা আমার সাথে খেলা করে জনতার কোলাহলে, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত
গরম ভাতের উষ্ণতার পেলব ছোঁয়া প্রতিদিন মনে করিয়ে দেয় মমি” তুমি আছ আমাদের মাঝে
মৃত্যু মানে কি চিরতরে চলে যাওয়া? না, অদৃশ্যতার মধ্যে অবিরল বিচরণ,
মৃত্যু মানে স্মৃতি-সত্তা-কাহিনির অব্যক্ত কথা
মৃত্যু সত্য হলে সংস্কারে এত ভিন্নতা কেন?
একই সত্য তো বহুরূপী হতে পারে না।
তুমি আছ, যেমন সমস্ত বিদেহী আত্মা বার বার ফিরে আসে পরিজনের কাছে
তুমি আছ বলে, অসম্পূর্ণতার মানে বুঝতে পারি, মৃত্যু মানে তো শূন্যতা নয়, আরেক জীবনে হাতছানি।
ভালো থেকো,আর বার বার ফিরে এস এ ভাবেই
স্মৃতিতে, নবজীবনের মাধুরী নিয়ে, আমার ঘরে।
মুস্তফা হাবীব
মানুষের অধিকার ও মুক্তির কথন
ভোরের কা কা শব্দের ব্যঞ্জনায় কালো কাকগুলো
রোজ মানুষকে বিব্রত করে, তৈরি আইনের ফাঁদে ফেলে
দখলে রাখতে চায় জমকালো ফুলেল বিছানা।
পচা জলাশয়ে জন্ম নিয়ে পদ্মফোটা জলের কীর্তন গায়
সকাল সন্ধ্যায় স্বেচ্ছাচারী-বিপদগামীদের
তর্জন গর্জন শুনে মানুষ শঙ্কিত, বাকরুদ্ধ-বিমূঢ়।
ওরা বিরাম চিহ্নের সত্যতা অস্বীকার করে,
চিরপতনের অগ্রিম সুর-সঙ্কেত শুনেও অসত্য ধারায়
অবিশ্রাম উত্থানের ফানুস উড়ায় অনীল আকাশে।
মানুষ বুঝে গেছে এসবই ভেলকিবাজ, তখ্তে তাউস;
এখন একটাই নিঃশর্ত বাসনা
আঠারো উত্তীর্ণ প্রতিটি মানুষ প্রতিষ্ঠা করবে অধিকার;
মানুষ চায়, মাটির নির্যাসে ন্যায্য অংশীদারিত্ব
পুষ্প বাগান থেকে তাড়াতে বিষাক্ত জলফড়িং।
আমিও চাই, সত্য ও সুন্দরের অনির্বাণ আভায়
আকাশ থেকে সরে যাক ভয়াল কালো অজগর।
আমিও চাই জনমানুষের নিরঙ্কুশ বিজয়, স্বাধীন পৃথিবী।
আশরাফ আল দীন
বৃষ্টিহীন আষাঢ় শ্রাবণ
নদী ও নারীর সাথে যেমন
সাহিত্যের কবিতার গানের
এক নিবিড় আত্মীয়তা আছে, তেমনি
শ্রাবণ-ধারার সাথে ছন্দের
ঝুম-বরষার সাথে তাল ও মাত্রার প্রগাঢ় সখ্যতা।
আর, আষাঢ়ের ঘন মেঘ দেখে
প্রায় প্রতিটি মানব মানবীর
হৃদয়ের গোপন প্রকোষ্ঠে লুকিয়ে রাখা ভালোবাসা কিভাবে হঠাৎ গুমড়ে ওঠে একাকিত্বের ভেতর,
কখন ঝরায় গোপন অশ্রু মেঘ চুঁয়ে পড়া
বৃষ্টির ফোঁটার সাথে,
দীর্ঘশ্বাস হারিয়ে যায় ভেজা হাওয়ার দমকের ভেতর; এসব কথার নানা চুনিপান্না আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে
আমাদের লোকগান বচন শ্লোক ও
লোক প্রিয় সাহিত্যের পাতায় পাতায়।
কিন্তু, হা কপাল! বদলে গেছে কি সব?
এক জীবনেই দেখতে হচ্ছে এমন সব অনাসৃষ্টি!
কোথায় বৃষ্টির ফোঁটা? কোথায় শ্রাবণ ধারা?
বর্ষা জুড়ে এখন তো দেখছি নিত্য দাবদাহ!
উত্তপ্ত বালুকাময় উষ্ণতার প্রতিবেশে যেন
আমার চিরচেনা আষাঢ় শ্রাবণ আর
ঝমঝমিয়ে নেমে আসার বৃষ্টির পয়ার
অঝোরে লুকিয়ে কাঁদছে কোথাও, হয়তোবা!
হায়! হায়! আমার সাথে দেখা নেই, কথা নেই।
এদিকে ভ্যাপসা গরমে হাপিত্যেস ঘামছে কবিরা আর, কবিতা বুঝি পালিয়ে গেছে
মেঘ রাজ্যের ওপারে, আমাদের দৃষ্টির বাইরে।
আমার এসব সমস্যার কথা কিভাবে বুঝাবো বলুন!
জাতিসংঘ কিংবা উন্নয়নের নামে
পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টকারী
সবচেয়ে ধনী ও ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোকে?
বৈষয়িক ধনাঢ্যতার পরও হৃদয়ে ওরা কত না দরিদ্র!
সাধারণ নাগরিককেওবা কী করে বুঝাবো বলুন! যারা অবলীলায় হত্যা করে বৃক্ষ, আর
দেদারসে সৃষ্টি করে প্লাস্টিকের আবর্জনা!
নষ্ট করে সুপেয় পানি এবং
পরিবেশ রক্ষার কথা তাদের মাথায় নেই মোটেও।
আমাদের আগামী প্রজন্মকে কিভাবে বলবো?
কিভাবে ওদের কল্পনায় এঁকে দেখাবো
আমাদের আশৈশব চেনা সেই দৃশ্যটি:
একজন ব্যস্ত গ্রাম্য হাটুরে
রাস্তার কাদাপানি ভেঙে
ঝুম বৃষ্টির ভেতর, ছাতা বা মাথাল মাথায়
ত্রস্থ পায়ে সওদা করতে যাচ্ছে হাটে বা গঞ্জে!
এখন তো পাকা রাস্তায় প্রত্যন্ত গ্রামেও
হনহনিয়ে ছোটে সবাই!
: গ্রাম আছে কাদা নেই, বর্ষা আছে বৃষ্টি নেই!
হায় রে! দুর্ভাগ্য আমার!
এসব উন্নতি ও জৌলুসের হাত ধরে
আমাদের সবার অজান্তে পালিয়ে গেছে
বৃষ্টি ছন্দ ও কবিতা!
পর-পুরুষের হাত ধরে পালিয়ে যাওয়া
ও’ বাড়ির রাঙা বউয়ের মতো!
এই বদনাম আমি এখন কিভাবে ঘুচাবো বলুন!
আনোয়ারুল ইসলাম
কৃষ্ণচূড়ার দিনকাল
কতো অজানারে জানা হলো আজ ধূসর গোধূলিবেলায়
শত চেনা মুখ সহসা হারিয়ে অচেনা হয়েছে চেনা
স্মৃতিগুলো যেন সতেজ দহনে বাড়িয়ে দিয়েছে দেনা
মেঘলা মুখর বরিষণ ক্ষণে মেতেছি এ কোন খেলায়!
পাহাড় সমান পার হয়ে বাধা যারে খুঁজি পথে দাঁড়িয়ে
তারে কোনদিন হলো না পাওয়া কোথাও হলো না ঠাঁই
ফুল ভেবে যাকে মালাতে গেঁথেছি তাতে শুধু ব্যথা পাই
বিষের যাতনা অনুভবে দোলে কৃষ্ণচূড়াকে মাড়িয়ে।
হরিষে বিষাদ কুহেলিকা গীতি কান পেতে শুনি মরমে
কোন্ কাননের পুষ্প গো তুমি আঁধারেতে জেগে রও
ভুলের পরশে অকারণে তুমি অবিরাম কথা কও
জীবন মরণ পাশাপাশি হাঁটে নেই পরিচয় শরমে।
কান্না হাসির ভীরু ভাবনারা নিজেকে সাজায় গোপনে
নিঠুর সময় হাতছানি দেয় কাউকে করে না ক্ষমা
পারে যদি আরো কাছে টেনে রাখে মুছে সব দাঁড়ি কমা
ছিন্ন পাতার তরণী তবুও ভাসে যে আশার স্বপনে।
মাঈন উদ্দিন জাহেদ
শাদাপাথরের মর্মর
পাথরে আবার শাদা বা ধূসরতা কী-
ভাবতে ভাবতে যখন শাহ্ পরানের কাছে যাই,
গভীর ধ্যানে নিস্তব্ধ নিরালা ডেকে বলে-
গভীর গভীরতর হও।
ধ্যানের মাজেজা বোঝো,
যাপনে উষ্ণ হও
জ্ঞানী হও হৃৎ গুণে।
পাথরেরও প্রাণ আছে,
কোটি বছর ধরে যিকির ও গভীর যাপনে…।
কী দেখেছো বাপু, সরল চক্ষে?
কতটুকু দেখা হয় দৃষ্টির সীমায়?
লালাখালের নীল জলে শান্ত হৃদয় চুবে আমি আর প্রশ্ন করিনি-
ভোলাগঞ্জ! তোমার বুকে এতো পাথর চেপে কেনো তুমি কলকল বও?
নৌকার মাঝি গুনে স্বল্প টাকা, অথচ নদী ও নৌকো গিলছে মধ্যস্বত্বভোগী!
বেচারা মুঈনুদ্দীন মাঝি জীবন নায়ের লগি টানে এগায় ওগায়।
শাদা পাথরের ঠা-া স্রোতে পা চুবিয়ে যখন মেঘালয় কন্যা দেখি-
অভিমানী পাথর এক, ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে, শুনো হে পুরুষ !
জীবন জলের সীমায় কঠিনেরে ভালোবেসে
শাদাপাথরেরা জেগে আছে লাল-সবুজের সীমায়,
যেখানে লক্ষ বীর যাপন সংসারে শ্রমে- ঘামে সপৌরুষে দয়িতাকে টানে,
তাহাদের ভাত ও নুনের দাম মিটে পাথরের হৃদয় ভেঙে জ্বালানো উনুনে।
ঐ জাফলং এর পাথরও কাঁদে প্রেমিকের শ্রমে-ঘামে,
ওতেই মৈরাং বধুর স্বপ্ন-শাড়ি ওড়ে নীল আসমানে।
স.ম. শামসুল আলম
চঞ্চল চড়–ই ও বিষাক্ত সাপ
বিনিদ্র রাতের ঘুলঘুলিতে জেগে থাকে চঞ্চল চড়–ই
তার শরীরের চারপাশে খড়কুটো নড়ে
নাকি সে নিজেই তার বাসাটি নাড়ায়
মাঝে মাঝে খড়কুটোগুলো শীতল সাপ হয়
ছোট ছোট সাপগুলো ক্রমশ বিষাক্ত হয়
টের পায় চড়–ই এবং উন্মুক্ত প্রহর
এসব নিয়ে আজকাল আমি ঘাঁটাঘাঁটি করি না
কেননা আমার খাদ্যখানার কমতি নেই
বসন্ত এলে বাসন্তি কালার শাড়ি পরে
প্রেমোন্মাদ প্রেমিকের হাত ধরে ঘুরি
বৈশাখ এলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে রঙিন সাজগোজ নিয়ে
আমার উপস্থিতি থাকবেই
অতএব অধিক আনন্দে বেঁচে থাকাটা আমার বিলাসী জীবন
হতাশার কোনো চিহ্ন আমার মধ্যে নেই
তবুও একদিন রাতে একটি ভয়ানক স্বপ্ন দেখে চিৎকার দিয়ে জেগে উঠি
আমি গর্ভবতী এবং আমার পেটের মধ্যে অসংখ্য বিষাক্ত সাপ কিলবিল করছে
আর অন্ধকার ঘুলঘুলিতে অনবরত চিঁচিঁ করে ডাকছে চঞ্চল চড়–ই।
মাহবুবুল মাওলা রিপন
একটি বিনিদ্র রজনী
তোমাকে চিনতে পেরেছি
চকবাজারের হোটেল আল আসকার
কোন এক বিনিদ্র রজনীতে।
আল্লাহর রাহে মস্তক অবনত চিত্তে
সেজদায়রত গোপন এবাদতখানায়।
গভীর রাতে হোটেল কক্ষে তুমি নেই;
আমি হন্য হয়ে ঘুরছি, কক্ষের পর কক্ষ।
কি জবাব দেব আমি; তোমার পাহারাদার!
অবশেষে ছুটে যায় নিচতলার গেইটকিপারের কাছে।
সে শুনে চমকে উঠে! স্যার গেইটে তালা।
তখন কি যন্ত্রণা আমার দেহমনে;
নীরব কান্নায় দৌড়াদৌড়ি হোটেলের ভেতর।
তারপর গেইটকিপারসহ চিরুনি তল্লাশি।
অবশেষে তোমার সন্ধান-
হোটেলের কর্নার এবাদতখানায়।
গভীর রাতে গোপন এবাদতে
দু’হাত তুলে কাঁদছ বুদ্ বুদ্
হে আল্লাহ! মাফ কর মোরে!
পেছনে দাঁড়িয়ে আমিও হাত তুলি
কাঁদি তোমার সাথে আমিন্ আমিন্ ।
আজো কান্নার ধ্বনি শুনি, আসমান ও জমিনে।
তুমি অমর হয়ে থাকো ‘সোনালী কাবিন’-এ।
প্রদীপ কর
উপহার
এ কবিতার একটিমাত্র লাইন আমার লেখা।
দু’লাইন লেখা হয়েছে পুরুলিয়ায়। দু’লাইন জঙ্গলমহলে
পাহাড়ে বরফপড়া শুরু হলে, তারাও কয়েকলাইন লিখবে বলেছে
পদ্মাপাড়ের বন্ধুরা বলেছে, তারাও সবাই মিলে
গোটা একটা স্তবক লিখে পাঠাতে চায়
যন্তরমন্তরের ধর্ণা থেকে দুরন্ত একটা পঙক্তি উঠে এসে
ধূসর বারুদের মতো মিশে আছে অক্ষরের অবচেতন প্রেমে
একটু দূরে অনন্তজ্যোতির আগুন লকলক করে তাকে ডাকছে…
চিলিতে, গোপনে, লেখা হচ্ছে আরো কয়েকটা লাইন
নাজিম হিকমতের বংশধর জানাচ্ছেন, এ কবিতা দিয়েই
তিনি কবিজীবন শুরু করতে চান
যাঁরা লোরকার মৃত্যু সামনে থেকে দেখেছিলেন, তাঁরাও লিখবেন
নিকানোর পাররা বলেছেন, এ কবিতাই হবে তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা
এ কবিতায় কয়েক লাইন সংযোজন করতে চান
ঊনত্রিশ বছরের ভ্যান গখ!
কবিতাটি সংশোধন বা কাটাকুটি করবেন স্বয়ং নেরুদা
গোলাপের পাপড়িতে মুড়ে, কবিতাটি, উপহার পাঠাব, তোমাকে।
তুমি, সহ্য করতে পারবে তো,
শাসক?
অনন্ত রিয়াজ
ভূলতে কি আর পারি
পৃথিবীর বুকে আমি পিপীলিকা পায়ে
হেঁটে যাই অনেক দূরে যেদিকে চোখ যায়,
চারিদিক থেকে ঘ্রাণ আসে আম কাঁঠাল বাতাবি লেবু ও আতাফলের।
ঘুম ভাঙে দোয়েল শালিকের গানের মিষ্টি সুরে
বসন্তের দুপুরে,
খেজুর রসে পৌষের সকালে চিতুই পিঠার আনন্দ আয়োজন,
ভুলতে কি আর পারি সেইদিনের কথা।
সমুদ্রের জলপানে স্বাদ পাই গাভী দুগ্ধতায়,
ফুলের সুবাস রজনীগন্ধা শেফালি গোলাপ দোলনচাঁপা বেলি ফুলে।
কোকিলের গান শুনে আমার
প্রতটিা দিনই মনে হয় বসন্তের দুপুর।
সুজন আরিফ
ব্যক্তিগত জিন
খালি পায়েই যেতে হয় উঁচু-নিচু পাহাড়ের চূড়ায়
গায়ে নেই কোনো বিশ্বাসী দৈত্যের পোশাক
ভঙ্গুর কাঁধ, ভয়ার্ত চোখ
মোড়ে মোড়ে শিকারি সব চেকপোস্ট যেন মৃত্যুর সহোদর।
তবুও বয়ে বেড়াই অভিশপ্ত জীবনের ঘানি
আমাদেরতো নেই কোনো ব্যক্তিগত জিন
জাদুকরী মন্ত্র কিংবা কুদরতি ইশারায়
প্রতিকূল রাতগুলো খুঁজে নেবে ঝকঝকে দিনের ঠিকানা।
ম্যাপল পাতার দেশেই হোক যাবতীয় জিনের আসর।
সুমন সাজ্জাদ
আয়না
তুমি একটা অন্ধ আয়না।
তাকাচ্ছো, কিন্তু দেখছো না,
দেখছো, কিন্তু তাকাচ্ছো না;
তোমার সামনে দিয়ে ঝরে পড়ছে
স্তব্ধতার সাঁকো, ভেজা নদী
আর বিষণœ কাশফুল।
তুমি একটা অন্ধ আয়না।
ঝাড়বাতির অনন্ত উৎসবে
টুকরো টুকরো কাচ, রংমশাল–
তুমি তার কিছুই দেখছো না!
নজর উল ইসলাম
মনবাস
উড়ন্ত মনবাস চেয়ে আছি
পাখির নরম বুক ভেসে ছুঁয়েছি উৎকর্ষ
আগুন উৎসব হবে আকুল কণ্ঠে
মন শুধু বিভোর উথাল পাথাল
জলের অনুরণন ফুটে গন্ধে ম-ম
তাও চিহ্নিত সংগোপনে কর অনুসন্ধান
আলোর অনন্ত সম্ভোগে সঙ্গম
ভেজে সমন্বিত পাখির বালুকাবেলা
অতৃপ্তি মন্থন প্রাসঙ্গিক গানে
বাউলের মাহাত্ম্য যেন উপুড় বাস্তবিক
তীর্থের কাক আমরা সহাস্য হেসে উঠি
ডানার প্রশাখা জুড়ে বৃহৎ গাছ
পৃথিবী টিকে আছে পার্থিব রূপান্তরে
উড়াল শুধু ভ্রমণের এক মহাস্নান…
বিবিকা দেব
এক টুকরো চড়–ইভাতি
হালদার পাড়ে সবুজ ঘাসের ডগায় শিশিরের অস্তিত্ব।
সূর্যটা ঘুম থেকে উঠে এক ঝলক হেসে রাঙিয়ে
দেয় প্রকৃতি। শৈশবের উঠোন জুড়ে চড়–ইভাতির
আয়োজন। মাছ কিংবা মাংস ছিল না। ক্ষুধার্ত দুপুরে
অপার্থিব আনন্দে গরম ভাতে শাক সবজি চেটেপুটে
নিঃশেষ। নকশি কাঁথা জড়িয়ে নেমে আসে ভাতঘুম।
ঘুমের ভেতর সংক্রান্তির মেলায় নানান বয়সের রঙিন
স্বপ্নগুলো। সময়ের হিসেবে বয়স বেড়েছে দ্রুত। তবু
এখনো শীতের প্রত্যক দিন, সকালের ঘুম ভাঙে
চুড়–ইভাতির ঘ্রাণে।
জাফর পাঠান
জীবন গহন
দেখতে- দেখতে- জীবনের দ্বি-প্রহর হলো পার
উষা থেকে গোধূলি, মাস- বছর ধরে পারাপার,
স্মৃতির খাতা খুলে পাতা- স্মৃতির হয় দেখাদেখি
মনে হয় বাবার হাতে- মাত্র শিখছি লেখালেখি।
দেখছি, খাবার নিয়ে মা ঐতো করছে ডাকাডাকি
ভাই-বোন শত চেষ্টা করে দিতে পারছিনা ফাঁকি,
খাবার খেয়ে অর্ধেক, দিচ্ছি দৌড় খেলতে দুয়ারে
আদুরে মনে ছিলো না ভয়, মা কখন এসে মারে।
জীবন অপরাহ্ন বেলায়, কেউ আছে- কেউ নাই
চন্দ্র- সূর্য- আকাশ, যেমন ছিলো তেমনই পাই,
হেলে পড়ছে- জীবন সূর্য- পশ্চিম দিগন্ত তল্
হারাচ্ছি যৌবন শৌর্য-বীর্য, তারুণ্যের বাহুবল।
শিশু আবেগ- যেই পড়শিকে- দিয়েছিলাম ঢেলে
আত্মিক ছোঁয়ার পরশ পেয়েছি নিত্য হেসে খেলে,
সেই হাসি হাসেনা কেউ- ভাসেনা স্বপ্ন নাও আর
ছিলাম কার, কে ছিলো আমার, হবো আবার কার।
হাতে নেই হাল, উড়ে পাল, ভেলায় ছুটছে কাল
ছিলাম গতকাল, আছি আজ, জানি না কতকাল !
স্বপঞ্জয় চৌধুরী
এন্তেজাম
মাটি থেকে সরাও খড়ি কাঠ, শুকনো মরা পাতা
ঝাট দিয়া রাখো তুমি কৃষ্ণচূড়ার পাতা,
শুকনা বীজের বাকল।
মৌতের ঘণ্টা বাজে সখী
তাই করো এন্তেজাম
উঁচা ঢিবির চারাগাছ ফুইরা জানি সুরুজ দেহন যায়
আমারে ততটুকু উঁচা কইরো
যতটুকু উঁচায় যেন আরশ থিকা
তোমারে দেহন যায়।
সখী ফুল দিওনা, আগর জ্বালাইওনা
আমার দুইচোখে ফুল,
একচোখে চান আর চোখে
চির আন্ধারের মতো প্রিয়তম তোমার মুখ
এন্তেজাম করো বাঁশের চাই দিয়া
ঢাইকা রাখো মারকিন
ঢাইকা রাখো আমার মহব্বতি চোখ
মৌতের এন্তেজাম করো
দূর হইতে ফুঁকে কে বাঁশের বাঁশি
চালতা তলায় আমায় ছেড়া তফন
কাদামাখা স্যান্ডেলের বেল্ট
বর্ষার অথৈ জ্বলে ভাসাইয়া দিও
আমি যাই তবে
তুমি ভালো থেকো।
শাজাহান কবীর শান্ত
ভয়ঙ্কর ঈগল
বাজারে যেতে চাইনি
জোর করে বাবা থলে ধরিয়ে দিলেন-
টাকার বান্ডেল ধরে বাজারে গিয়ে দেখি দাঁড়কাক
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাপড় ভাজা খাচ্ছে!
শকুনগুলো মাছের লেজ ধরে টানাটানি করছে
ডায়নোসরও দেখি বাজারের মুখ আগলে রেখেছে…
আমি ভয়ে দৌড় দিতে গিয়ে দেখি-
বাবা, আমার কাঁধ স্পর্শ করে পেছনে দাঁড়িয়ে আছে!
বাবা বললেন- ভীত হলে চলে?
ফুল তুলতে গিয়ে কাটার ভয়ে ফিরে গেলে ফুলের মর্যাদা হানি হয়!
একদিন বাবা আমাকে বাঘের সামনে ছেড়ে দিয়ে আমার মনকে,
হৃদয়কে শক্ত করতে গিয়েছিলো!
আমি টলমল করে উঠে দেখি বাবা আমার পাশে!
বাবার ব্লাক মাম্বা সাপের গল্প শুনতে শুনতে আমি হয়ে উঠেছি এক ভয়ঙ্কর ঈগল!
আমি গোখরো নিয়ে খেলি আর চন্দ্রবোড়ার মাংশে করি জটিল সংসার।
অলোক আচার্য
এই শহরে আমি
এই শহরে আমার অস্তিত্বকালের সবটুকু
কেটে গেছে; আমি তবুও এই শহরের মতো
ইট-কাঠ ঘেরা সঙ্কীর্ণ হতে পারিনি।
চারিদিকে প্রাণহীন কংক্রিটের জঞ্জাল হলেও
আমার বুকের ভেতর বয়ে চলেছে
শান্ত নদীর স্রােতধারা; মিশে আছে বুড়িগঙ্গার সাথে।
এই নদীতে- প্রেম আছে, বৃষ্টি আছে
টিনের চালে বর্ষা আছে; ইচ্ছে হলেই
ডিঙি নৌকা বেয়ে চলে যাই কাশফুলের কাছে
দিগন্ত ছোঁয়া আকাশের গায়ে হাত রাখি
তারপর আবার ফিরে আসি এই শহরের কাছে।
জহুরুল ইসলাম
অদ্ভুত আঁধার
দুপুরের বুক জুড়ে অদ্ভুত আঁধার-
এখানে হৃদয়ের কথা এসে থমকে দাঁড়ায়।
কচি ঘাসে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে ফড়িঙের দেহ।
রাঙামুখি বউ এসে কেঁদে মরে,
মরণ যেন তার ঘাড় চেপে ধরে।
গ্রহণের চাঁদ যেন পেচার চোখ,
উঁকি মেরে ডুব দেয় আঁধারে।
এদিকে মরণের ঝড় ওঠে জননীর বুকে-
ম্লান চোখে আলো এসে নিভে যায়।
অদ্ভুত আঁধার গিলে খায় ঘুম।
তৌহিদ আকবর
দুঃখ
কিছু দুঃখ মাছের ফুলকার ন্যায়,
নিঃশ্বাস নেয় হাওরের ভেতর।
দুঃখ মানে নীল পৃথিবী
দুঃখ মানে আকাশের তর্জনী
দুঃখরা উচ্চ-স্বরে হেসে ওঠে,
টেবিলের ওপর রাখা
দুঃখগুলো মাথা ঠুকরে পৃথিবী মাতাল করে।
কাছাকাছি দুঃখ-প্রেমের পসরা সাজিয়ে
ব্যবসায়ীরা সওদা কিনছিল।
দুঃখের ভেতর দুঃখ
দুঃখ… দুঃখ… দুঃখ…