-এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে আল মাহমুদ বাঙালির ‘বিষয়ে’র সাথে নিজেকে একাকার করে ফেলেছেন। বলা হয়ে থাকে, মাছে ভাতে বাঙালি। আসলে, বাঙালির বড় অংশটি মূলত কৃষকই। অস্ট্রিকদের আগমনের সাথে সাথে বাংলায় যে কৃষির সূচনা, তার পূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল আর্য আগমনের আগেই। আর বাংলা কবিতায় আল মাহমুদই প্রথম কৃষিকে এতটা উচ্চতর আসনে বসিয়েছিলেন। তবে কৃষির বাইরেও যা কিছু তার সবটাই বাংলাদেশ। যেমনটা তিনি নিজেও বলেছেন, ‘আমার ভাঙা সুটকেসের ভেতর আমি নিয়ে এসেছিলাম বাংলাদেশের সবগুলো নদী, পাখি, পতঙ্গ, নৌকা, নর-নারী অর্থাৎ বহমান আস্ত একটি বাংলাদেশ।’ (কবির সৃজন বেদনা)
যদিও আল মাহমুদ বাঙালি জাতিসত্তার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত ছিলেন না। বরং ছিলেন কথিত ‘বহিরাগত’ মুসলমান। কিন্তু বৃহত্তর বাঙালি সমাজে শুধু লীনই হননি, তাকে বেশ আত্মস্থও করেছেন তিনি। ইসলাম ধর্ম প্রচারক সম্ভ্রান্ত মীর বংশীয় আল মাহমুদ নিজেকে নামিয়েছেন কৃষকের স্তরে, বাঙালির স্তরে। আত্মস্থ করেছেন বাঙালির সুদীর্ঘকালের লড়াই-সংগ্রামকেও। যারা আর্য আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দুর্বার ও অপ্রতিরোধ্য ভূমিকা পালন করেছেন। আল মাহমুদ তাঁর সেমেটিক হওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারণা রাখতেন। ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ বইতে এ নিয়ে আলোচনাও করেছেন। তিনি তাঁর নয়জন পূর্ব-পুরুষের নাম জানতেন। কাব্যেও আল মাহমুদ তা অস্বীকার করেননি। তিনি ‘জীবনানন্দের প্রতি’ কবিতায় সগর্বেই তা উচ্চারণ করেছেন-
জন্মের পরেই আমি মানুষের বাচ্চার মতোই
দারুণ চিৎকার করে কোনো এক সেমেটিক নারীর বুকের
রক্তিম দুধের বোঁটা নাগালের মধ্যে পেয়ে যাই।
কিন্তু তিনিই আবার দাবি করেন ‘আমার মধ্যে আদি বাঙালিদের যে প্রাগৈতিহাসিক বর্বর রক্ত ছিল…’ (মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো)। আল মাহমুদের পরিবার বাইরে থেকে আসলেও তিনি বাঙালির মূল স্রোতের সাথে এত ঘনিষ্ঠভাবেই মিশে গেছেন যে বাঙালির শরীরের ‘প্রাগৈতিহাসিক বর্বর রক্ত’ নিয়ে গর্ববোধ করতেও কুণ্ঠিত হননি।
স্বীয় কবিতার মাধ্যমে পরাজিত অনার্যদের সেই স্তিমিত লড়াইকে এক অন্য মাত্রায় উপনীত করেছেন আল মাহমুদ! বাঙালির সহস্রাব্দের এই লড়াই তাঁর নানান রচনায় ফুটে উঠেছে। সত্তরের দশক কিংবা তার পরে সুস্পষ্টরূপে কবির যে পরিবর্তন চিহ্নিত করা হয়, তাতে আল মাহমুদের আধ্যাত্মিক চেতনার স্ফুরণ লক্ষ করা যায়। একইসাথে লক্ষণীয় অনার্য সভ্যতার স্তবগাঁথা ও আর্য আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান। যার বলেই বলীয়ান হয়ে রাজা লক্ষ্মণ সেনকে ‘জালিম’ অভিধায় ডাকতে কুণ্ঠিত হন না কবি। তবে, বাস্তবে অনার্য সভ্যতার এই স্তব ও আগ্রাসনের প্রতি দ্রোহচেতনা ‘সোনালি কাবিন’ থেকেই প্রকট হতে থাকে। কিন্তু সোনালি কাবিনের যে মাদকতা, তার আড়ালে অন্য কোন বিষয় যেন নজরেই পড়ে না!
আমারও নিবাস জেনো লোহিতাভ মৃত্তিকার দেশে
পূর্ব পুরুষেরা ছিলো পাট্টিকেরা পুরীর গৌরব,
রাক্ষসী গুল্মের ঢেউ সবকিছু গ্রাস করে এসে
ঝিঁঝিঁর চিৎকারে বাজে অমিতাভ গৌতমের স্তব।
আল মাহমুদের এই ‘লোহিতাভ মৃত্তিকার দেশ’ ‘পাট্টিকেরা পুরী’ আজকের লাল মাটির কুমিল্লা। ময়নামতি। কবির নিবাস লোহিতাভ মৃত্তিকার দেশ পাট্টিকেরা পুরী হতে খুব সুদূরে নয়। তবে সুপ্রাচীন এই পুরী এখানে বাংলার সেসব জনপদের প্রতীক-
অতীতে যাদের ভয়ে বিভেদের বৈদিক আগুন
করতোয়া পার হয়ে এক কঞ্চি এগোতো না আর।
ভারতে আর্য আগমনের প্রায় হাজার বছর অব্দি বাংলায় তাদের আগ্রাসন সফল হয়নি। পরে বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখলে আসলেও পূর্ব বাংলার বিশাল আঙিনা ধরা ছোঁয়ার বাইরেই ছিল। অবশ্য এই ঘরের ভিতে আজ ‘কৌটিল্যের ঘুণ’ ধরেই গেছে। তবুও আল মাহমুদ স্পষ্ট ভাষায় সেই সংগ্রামের সিলসিলা ঘোষণা করেছেন। তিনি এমন প্রেমের বাক্য উচ্চারণ করতে বলেন ‘যেন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ।’
অন্যত্র, ‘ভারতবর্ষ’ কবিতায় আল মাহমুদ শুধু ‘গৌতমের স্তব’ই করেননি, নিজেকে গৌতমের রক্তের সাথে একাকার করে ফেলেছেন। তাঁর দাবি, তিনি শাক্যরাজকুলের সন্তান। শাক্যবংশ অন্য অর্থে আর্য ক্ষত্রিয়দের প্রভাবশালী চন্দ্র বংশের একটি শাখা। তবে এই বংশেই পৃথিবীতে আগমণ করেছিলেন ‘শাক্যমুনি’ গৌতম বুদ্ধ। যার প্রচারিত ধর্মমত পরবর্তীতে আর্য আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ হিসাবে আবির্ভূত হয়। পরবর্তীতে বুদ্ধের মৃত্যুর অল্প কিছুদিন পরেই মগধের আর্য রাজা শিশুনাগ বংশীয় মহানন্দের শূদ্রপত্নীর গর্ভজাত পুত্র মহাপদ্ম নন্দ আর্যদের পরাজিত করেন। তিনি সমগ্র উত্তর ভারত দখল করে ‘একরাট’ উপাধি ধারণ করেছিলেন। তার মাধ্যমেই পত্তন হয়েছিল নন্দ রাজবংশের। এসময়েই গ্রিকবীর আলেকজান্ডার ভারত অভিযানে এসেছিলেন। ঐতিহাসিকদের ধারণা, নন্দরাজদের ভয়েই আলেকজান্ডার ফিরে গিয়েছিলেন। মহাপদ্ম নন্দকে আর্য ইতিহাসে ‘আর্যাবর্ত নিঃক্ষত্রিয়করণ’ -এর দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে। শুধু মহাপদ্ম নন্দই নয়, অন্যান্য রাজা-প্রজাদের প্রতিরোধে পুরো ভারতেই আর্যরা কখনোই একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি। বিশেষত বাংলায়। (বাঙালির ইতিহাস, ১ম খ-, রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়)। আল মাহমুদ তাই লিখতে ভুলেন না- ‘আমার মাথায় ধরে শ্বেতচ্ছত্র পরাজিত ক্ষত্রিয়েরা কত/ ভিড় ঠেলে এগোতো তোরণে।’
সোনালি কাবিন- যৌনতার এক অনন্য শিল্প। এখানেও জাতিসত্তার মিশেলে এক অদ্ভুত স্বাদ আস্বাদিত হয়। আল মাহমুদের সর্বাধিক যৌনতাআশ্রিত কবিতা সোনালি কাবিনের দ্বিতীয় সনেটটি। যেখানে তিনি প্রেয়সীকে ‘বাঙালি কৌমের কেলি কল্লোলিত’ করতে বলছিলেন। পরবর্তী ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’ কাব্যগ্রন্থের ‘অলীক অসতী মায়া’ কবিতাতেও তিনি এই অনার্য যৌনতার প্রসঙ্গ টেনেছিলেন। আল মাহমুদের বিশ্বাস অনার্য যৌনতাই আর্য অধিক উৎকর্ষ। তিনি এই কৌমের কেলির উৎকর্ষতার ব্যাপারে এতটাই আত্মবিশ্বাসী যে, এর ব্যাপারে বলছেন- ‘জানতো না যা বাৎসায়ন, আর যত আর্যের যুবতী।’
‘সোনালি কাবিন’র প্রেমের বোরকায় ঢাকা পড়ে গেছে আল মাহমুদের অনার্য বাঙালি জাতিসত্তার আবেগ। আর্য আগ্রাসনের প্রতি তাঁর দ্রোহ, ক্ষোভ স্পষ্ট হলেও কামনার উদগ্রতায় টের পাওয়া যায় না অতটা। তবে পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’তে দুইটা মাত্র কবিতাতেই তা খুব জোরালো ও সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রথমটা ‘চক্রবর্তী রাজার অট্টহাসি’। এই কবিতায় ‘অবলুপ্ত নগরী মহাস্থানগড়’ কবির কাছে ‘অভিশপ্ত নগরী’। এখানে সম্ভবত বল্লাল সেনকেই চক্রবর্তী রাজা ইঙ্গিত করে থাকবেন। এই চক্রবর্তী রাজাকে নৃশংস দেখতে পাওয়া যায়। যেখানে তিনি দাঁড়িয়েছেন কবির প্রেমের বিপক্ষে।
অন্য কবিতাটি ‘বুদ্ধদেব বসুর সাথে সাক্ষাৎকার’। আল মাহমুদ যখন জেলখানায়, তখন বুদ্ধদেব বসু মৃত্যুবরণ করেন। সে খবর শুনে জেলখানা থেকেই লিখেছিলেন কবিতাটি। বেশ চমকে যাওয়ার মতো কবিতা। ১৯৭১ সালের এক সন্ধ্যার স্মৃতিচারণ। কবি থরথর কাঁপছেন। দেখা হবে ‘শাপভ্রষ্ট দেবদূত’ বুদ্ধদেব বসুর সাথে। ‘যার আশীর্বাদে একদা বেশ্যা, বেকার আর/ বাউ-ুলেদের আস্তানায় এক পদ্যমাতাল কিশোরের পিঠে/ একজোড়া পাখা গজিয়ে গিয়েছিল’।
অবশ্য আসরে অনাহূত ছিলেন তিনি। তারপরেও, বুদ্ধদেবের সাথে সাক্ষাৎ হলে হতাশ হন আল মাহমুদ। তিনি লক্ষ্য করেন (তাঁর ভাষায়)-
কিন্তু একি, আপনার হাত বুদ্ধদেব, বরফের মতো ঠা-া।
আপনার মুখ ফসিলের মতো কুঁচকানো! আর
আপনার চোখ? না, আপনার চোখ
ইন্দ্রের অস্ত্রের মতো উজ্জ্বল! যজ্ঞের ঘৃতদীপ্ত হুতাশন!
তিনি প্রশ্ন রাখেন-
তাহলে, এই হলো আর্যদের আদি অগ্নিশিখা?
যা রক্ত, মেদ, প্রাণ ও অপ্রাণ, কাম ও কর্মফলের মধ্যে
পক্ষপাতহীন লেলিহান জিহ্বা তুলে ধরে?
‘পক্ষপাতহীন লেলিহান জিহ্বা’। কেন? কারণ মুক্তিযোদ্ধা, প্রবাসী সরকারের কর্মচারী আল মাহমুদ, যদিও কবি পরিচয়েই গিয়েছিলেন বুদ্ধদেবের সাথে মোলাকাতের জন্য; বুদ্ধদেবকে শুনিয়েছিলেন বাংলার দুর্দশার কথা। কিন্তু! কিন্তু বুদ্ধদেব নিদারুণ অবহেলাই দিয়েছেন তাঁকে। কবি বিবরণ দিয়েছেন এভাবে-
হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও আক্রান্তদের মধ্য থেকে আমি এসেছি
আমি বললাম।
আপনার মুখ হিটাইটদের প্রাচীন মন্দিরের
পুরোহিতের মতো নিষ্কম্প রইল।
রেখা ভাঙলো না, ঢেউ উঠলো না।
যেন পরাজিত হও, লুটিয়ে পড়ো, সেবা কর-ছাড়া
নৈরাজ্যের গহ্বর থেকে আর কিছুই বেরুবে না।
আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম কবিদের অন্যতম। যে ভাষায় কথা বলেন, যে মাটির ঘাসে শরীর এলিয়ে দুরন্ত শৈশব কাটিয়েছেন আল মাহমুদ, সে মাটির আর সে ভাষার মানুষকে এতটা নিবিড় আর এতটা আপন করলেই সম্ভব তার সহস্র বছরের সংগ্রামের সাথে নিজে একাত্ম করা। সর্বশেষ সেন দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অংশ হিসাবে মুসলিম সুফি-সাধক ও শাসকদের সাথে আদিম বাঙালির ঐক্যেরও স্বীকৃতি দিয়েছেন তাঁর ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ কবিতায়। বাঙালি মুসলমানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে কাব্যররূপে হাজির করেন দক্ষতায়।
এক্ষেত্রে আল মাহমুদের আত্মচেতনার পাশাপাশি সচেতনতাও লক্ষণীয়। শুধু জুলুমের প্রসঙ্গই তাঁকে আর্য আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে। নইলে প্রেমিক কবি কি লেখেননি ‘বিশ্বাসে মিলয়ে কৃষ্ণ তর্কে শুধু বেজে ওঠে বাঁশী’ (কৃষ্ণকীর্তন) কিংবা ‘কদম ফুলের ইতিবৃত্ত’-এর মতো কবিতা?