যখন স্বদেশে তখন বিদেশের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। বিদেশের মানুষের জন্য, প্রকৃতির জন্য, আজব সব কর্মকাণ্ডের জন্য মন উড়– উড়– করে। বিদেশে থাকে আমার যেসব সমমনা মানুষ, আমার ভাষায় কথা বলে যেসব মানুষ, আমার প্রিয় মনের মানুষ, তাদের জন্য মন কাঁদে। বিদেশের যেসব স্মৃতি মনের মণিকোঠায় সঞ্চিত আছে, সেগুলো জাগ্রত হয়। স্মৃতির পাখায় ভর করে পৌঁছে যাই কোনো এক অজানা ঠিকানায় থাকি স্বদেশে ভাবনা ভাবি বিদেশের। তখন অবাক হয়ে বলি আমার ঠিকানা কোথায়? স্বদেশে না বিদেশে?
যখন বিদেশে থাকি তখন স্বদেশের জন্য মন কাঁদে। যারা অতি পরিচিত আশৈশব ঘনিষ্ঠ তাদের কথা মনে হয়। কাছের মানুষেরা আমাকে যেসব দুঃখ দিয়েছিল সেগুলো ঝাপসা হয়ে যায়, মিইয়ে যায়, আবছা হয়ে যায়। জীবন্ত হয়ে ওঠে তাদের কথা যারা আনন্দ দিয়েছিল, সঙ্গ দিয়েছিল, বুকের কোমল স্পর্শে ভরে তুলেছিল। মনে হয় মায়ের কথা, প্রিয়তমার কথা, কন্যার কথা। পুত্র, বন্ধু আর সহচর-সহচরীর কথা। এরা সব ভিড় করে আমার স্মৃতির মণিকোঠায়। বিদেশে যখন সুখে থাকি তখন এদের কথা ভেবে দুঃখ পাই, এদের জন্য চোখের জল ফেলি। এদের চিঠি পেলে খুশি হই, এদের টেলিফোন পেলে আবেগে কেঁপে উঠি। আর বিদেশে যখন দুঃখ পাই তখন এদের কাছ থেকে পাওয়া সুখগুলোকে তুল্যমূল্য করি। দুঃখের সঙ্গে সুখের তুলনা করি। সদ্য পাওয়া দুঃখ ভুলে থাকার জন্য অসদ্য পাওয়া সুখকে স্মৃতির পর্দায় প্রক্ষেপণ করি। নিজের মনের পর্দায় নিজের অতীত জীবনকে দেখি। ভাবি, আমি কোথায় অবস্থান করি স্বদেশে না বিদেশে? আমার ঠিক ঠিকানা কোথায়? বিদেশে যখন সুন্দরকে দেখি তখন বিস্মিত হই, স্বদেশের অসুন্দরকে তার পাশে রেখে তুলনা করি। ভাবি, বিদেশের সুন্দরের মতো যদি হতো স্বদেশের অসুন্দর। অসুন্দরের ঢেকে দিতে চাই সুন্দরের প্রলেপ দিয়ে। স্বদেশকে বানাতে চাই বিদেশের আদলে। স্বদেশের রাস্তায় বিদেশের বাইপাস বসাতে চাই। স্বদেশের নদীতে বিদেশের স্পিড বোর্ড চালাতে চাই। স্বদেশের ছোট নদীকে বিদেশের বড় নদীর সঙ্গে তুলনা করি।
অবাক হয়ে দেখতে পাই অন্যত্র পদ্মা নেই, ব্রহ্মপুত্র নেই, কর্ণফুলী নেই, নেই ইছামতী, নেই শীলাবতী, নেই কীর্তিনাশা, নেই আড়িয়াল খাঁ, নেই শঙ্খ, নেই নাগর। নদীই নেই যে দেশে সেখানে মন টিকতে চায় না।
যখন উস নদীর তীর থাকতাম তখন উসের জন্য মায়া হতো। খুবই ছোট নদী। যেন কোনো রুগ্ন বালিকার ক্ষীণ দেহবল্লবী। অসুন্দর নয়, অচঞ্চল। তখন আমাদের স্রােতা নদীর কথা মনে হয়। হালদার কথা মনে হয়। গোমতীর কথা মনে হয়। নদীতো নয় যেন প্রাণচঞ্চল চতুর্দশী রাধিকা। সেই নদী নাচে, সেই নদী বহে না।
মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা-আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে। বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে। এ নদী রবীন্দ্রনাথের কলকাতার স্মৃতি নয় শিলাইদহ-পতিসরের স্মৃতি। রবীন্দ্রনাথের ছোট নদীর স্মৃতি আমাকে কাবু করে রাখে। ছোট নদীগুলোর জন্য চোখে জল আসে। ছিলনিয়ার কথা মনে হয়, কংখাইয়ার কথা মনে হয়, ডাবুয়ার কথা মনে হয়। এদের দুর্দশার কথা মনে পড়ে। যখন সুদিন আসে আমাদের, শুষ্কতা দেখা দেয় মাটির তলায়, তখন ছোট নদীগুলো ছোটত্ব হারায়। মাটিতে মিশে যায়। মাটির তলায় ডুব দেয়। নদীর তলদেশ অনাবৃত হয়। তার অপ্রশস্ত লজ্জাস্থান আমরা দেখে ফেলি। নদী তখন নদীত্ব হারায়, চর হয়ে যায়, ডাঙ্গা হয়ে যায়। ডাঙ্গা নিয়ে আমরা দাঙ্গা করি। নদী চুপচাপ দেখে। যখন নদীর সুদিন আসে, আমাদের আসে কুদিন তখন রোষে ফেটে পড়ে ছোট্ট নদী দু’কূল প্লাবিত করে ধাবমান হয়। মত্ত হস্তীমাকবকের মতো গুড়িয়ে দেয় সব কিছু। নদী প্রসারিত করে তার বেণী। প্রসারিত করে দু বাহু, প্রসারিত করে চরণবাজি। জীবনমরণ বাজি করে ছুটে চলে ঊর্ধ্বশ্বাসে।
যখন উসের তীরে ছিলাম, যখন টেমস নদীর তীরে ছিলাম তখন এমন আত্মঘাতী উচ্ছ্বাস দেখিনি। এরা যেন বন্দী নদী। শানবাঁধা ঘাটের মতো এরা অনড়, অচল। দু’পাশে থাকে পাথরের স্থবিরতা। পাশ ফিরতে পারে না, হাত নাড়তে পারে না, পা নাড়তে পারে না। কাকেও জড়িয়ে ধরতে পারে না। বুকে নিতে পারে না এক অভিশপ্ত জঙ্গমতা নদীগুলোকে গ্রাস করেছে। ওরা যেন নদী নয় স্রােতস্বিনী মাত্র। উৎসের উচ্ছ্বাস দেখি নি, টেমস এর আবেগ দেখি নি।
উচ্ছ্বাস থাকবে কি করে বর্ষা যে নেই। আবেগ থাকবে কি করে জোয়ার যে নেই। আবেগ নেই উচ্ছ্বাস নেই একটি নিষ্প্রাণ জলপ্রবাহ-এর নাম কি নদী?
যখন ছিলাম বিদেশের দ্বীপে, তখন মনে পড়তো, সন্দ্বীপের কথা, হাতিয়ার কথা, নিঝুম দ্বীপের কথা। ওহাহুতে ছিলাম যতদিন সমুদ্র ¯œান করেছি সাগরের নীল জলে, ওয়াইকিকির বালুকাবেলায় শুয়ে স্বপ্ন দেখেছি বঙ্গোপসাগরের কথা। ভেবেছি বঙ্গোপসাগরের জলের তলদেশে দেখবো যেমন দেখেছি প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে। যখন গেলাম হাতিয়ার, গেলাম নিঝুম দ্বীপে তখন ঘোলাজলের ঘূর্ণাবর্তে চুরমার হয়ে গেল বিদেশে লালিত আমার স্বপ্ন। নিঝুম দ্বীপের সৈকতে যখন হেঁটে বেড়াই, তখন মনের সৈকতে ঘুরে বেড়ায় সেই আর্জেন্টিনার কথা। যখন স্বদেশে থাকি, স্মৃতি রোমন্থন করি। তার কথা মনে পড়ে, যখন বিদেশে থাকি স্মৃতি রোমন্থন করি তার কথা মনে পড়ে। তিনি আমার স্মৃতি সহচরী। ক্ষণিকের বন্ধু, চিরকালের বন্ধু। রবীন্দ্রনাথের একরাত্রি গল্পের নায়িকা।
যখন স্বদেশে থাকি, একটি করস্পর্শ প্রার্থনা করি একজনের যে করস্পর্শ কাঁপিয়ে তোলে সমগ্র আত্মাকে। মানুষের হাতের আঙুলের স্পর্শ কী বিদ্যুতের তরঙ্গ সৃষ্টি করতে পারে তা সেই করস্পর্শ না পেলে কেমন করে অন্যেরা বুঝতে পারবে। যার করস্পর্শে এমন হয়, তাকে বলেছিলাম অধর স্পর্শের তীব্র কামনার কথা। তার কাছ থেকে মেলেনি উত্তর। ভোরের সূর্যের মতো তিনি উদ্ভাসিত করেন আমার মনোজগৎকে, অথচ তিনি কাছে নেই। পাড়ায় নেই, মহল্লায় নেই, দেশেই নেই। অথচ সকাল সন্ধ্যা ঘিরে থাকেন আমার মধ্যে ছায়ার মতো, অপ্সরীর মতো, তার মৃদঙ্গ বাজে সারা অন্তর জুড়ে, তার বাঁশি বাজে মনের বৃন্দাবনে। ফাগুনের আগুন ছড়িয়ে দেন তিনি আমার গোলাপ বাগানে। তিনি স্বপ্নে আসেন মনে, জাগরণে আসেন মনে। অবসরে তাকে পাই সঙ্গী হিসেবে, কর্মে তাকে পাই প্রেরণা হিসেবে। পথ চলতে চলতে তার ডাক শুনি। তার সাথে দেখা করার জন্য মন সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দেয়। তিনি তেপান্তরের ওপারে থাকেন। চিঠি এলে ভাবি তার চিঠি। টেলিফোন এলে তার টেলিফোন। তিনি বিদেশে, আমি স্বদেশ।
বিদেশের কথা আমার ভাবতে হয় প্রতিদিন প্রতিক্ষণ। ভাবতে যখন শুরু করি তখন আমি স্বদেশে থাকি না, বিদেশে থাকি। ওর সঙ্গে থাকি। ওর পাশে ঘুরি। ওকে অনুসরণ করি, ওর সঙ্গে মান করি, ওর সঙ্গে অভিমান করি। যেন তিনি রাধা আমি কৃষ্ণ কিংবা তিনি কৃষ্ণ আমি তার রাধা। বাইরের বিদেশ অন্তরে এসে স্বদেশ হয়ে যায়, অন্তরের স্বদেশ আমাকে নির্বাসনে পাঠায় যক্ষপ্রিয়ার পর্ণকুটিরে। স্বদেশ বিদেশ আমার সব কিছুই “গরল ভেল”। আমি থাকি স্বদেশে, ভাবি বিদেশের। আর যখন থাকি বিদেশে তখন ভাবি স্বদেশের। আমার দেশ কোথায়? তার কি ঠিক কোনো ঠিকানা আছে। নাহ, আমার উত্তম পুরুষের কোন ঠিক ঠিকানা নেই।