সৈয়দ আলী আহ্সানের কবিতাকে তিনটি পর্বে আমরা ভাগ করে নিতে পারি। প্রথম পর্ব : ইসলামী কবিতার কাল; দ্বিতীয় পর্ব : ছন্দোবদ্ধ আত্মসন্ধানী কবিতার কাল; তৃতীয় পর্ব : গদ্যছন্দে বহু বিচিত্র বিস্তারের কাল। এই তৃতীয় পর্যায়ই সৈয়দ আলী আহ্সানের কবি জীবনে দীর্ঘতম, এই কবিতার মধ্যেই তাঁর আত্মপরিচয় ক্ষোদিত, এখানেই তাঁর কবিবিশিষ্টতা। সৈয়দ আলী আহসানের শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘আমার পূর্ব বাংলা’ (তাঁর দ্বিতীয় কবিতাগ্রন্থ’ একক সন্ধ্যায় বসন্ত’ ১৯৬২ গ্রন্থভুক্ত) তাঁর এই তৃতীয় পর্যায়েরই সৃষ্টি।
গণনামতে সৈয়দ আলী আহসান চল্লিশের দশকের কবি। সেখানে যাঁরা কবিরূপে খ্যাতিমান হয়েছিলেনÑ আবুল হোসেন, ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীব-চল্লিশের দশকেই আগে-পরে তাঁদের কবিতাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়ে গিয়েছিল। সিকান্দার আবু জাফর, সানাউল হক, সৈয়দ আলী আহসান, আবদুল গনী হাজারী প্রমুখের কবিতাগ্রন্থ বেরিয়েছিল অনেক পরে। পূর্বোক্তদের কবিতাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতা থেকে, পরবর্তীদের দেশবিভাগের পরে ঢাকা থেকে। আমি বাঙালি-মুসলমান কবিদের কথাই বলছি এখানে। এই বাঙালি-মুসলমান কবিদের হাতেই আধুনিক-রবীন্দ্র-নজরুলোত্তর প্রথম আধুনিক কবিতার দীক্ষা গ্রহণ হয়েছিল। তিরিশের দশকে এঁদের মধ্যে অনেক কবি এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে কবি জসীমউদ্দীন বিরাট সাফল্যের কথা মনে রেখেও বলব যে তা ঠিক আধুনিক বাংলা কবিতার (জীবনানন্দ-সুধীন্দ্রনাথ-বিষ্ণু দে প্রমুখ) সঙ্গে কোনোভাবেই তুলনীয় নয়। বাঙালি-মুসলমানদের মধ্যে প্রথম আধুনিক কবিতার দীক্ষাদাতা বরং এঁরাই-এই আবুল হোসেন, ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীব, সিকান্্দার আবু জাফর, সানাউল হক, সৈয়দ আলী আহসানই। স্মরণীয় : যে কালে এঁদের কবি-রূপে উত্থান, সেই কাল ছিল বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে সংকটের একটি সময় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ তখন বিশ^ ব্যাপে চলছে। বাংলাদেশে ঐ চল্লিশের দশকেই স্মরণকালের বীভৎস মন্বন্তর ঘটেছে। পূর্ব বাংলা আর পশ্চিম বাংলা দ্বিখণ্ডিত হল এই দশকে।
এইসবের প্রভাব-ছাপ আছে চল্লিশের বহুসংখ্যক কবির মধ্যে- যাঁরা বামপন্থী হিসেবে খ্যাতিমান তখনকার দিনে- সুকান্ত ভট্টাচার্য, সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ তো বটেই, যাঁরা সরাসরি দীক্ষিত নন তাঁদের মধ্যেও : সিকানদার আবু জাফর, সানাউল হক, আবুল হোসেন, আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদের মধ্যেও। সৈয়দ আলী আহসান তখনের কবিতা লিখছেন, কিন্তু তাঁর কবিতা তখন সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী। ইসলামী বিষয় অর্থাৎ উন্মেষ যুগের ইসলামী ভাষা (তাঁরই ভাষায়) তাঁর তখনকার কবিতার বিষয়। ঐ সময়ে সৈয়দ আলী আহসান ঢাকা-কেন্দ্রিক রেনেসাঁ সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেনÑ বস্তুত ঐ প্রতিষ্ঠানের সম্পাদক হিসেবেই কাজ করেছিলেন। রাজনৈতিকভাবে এরা পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থন করেছিলেন। ‘আইরিশ লিটারারি রিভাইভাল’-এর আদলে এঁরা ঢাকা-তথা- পূর্ব বাংলা কেন্দ্রিক একটি সাহিত্য-আন্দোলন গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। ইসলাম ও দেশজতা ছিল এঁদের কেন্দ্রীয় বিষয়। এঁরা পুঁথির পুনরুজ্জীবনে বিশ্বাসী ছিলেন। এই আদর্শেই উদ্বোধিত হয়ে ফররুখ আহমদ অনেক পরে লিখেছিলেন তাঁর বিশাল ‘হাতেম তা’য়ী’ কবিতাগ্রন্থ। তবে সৈয়দ আলী আহসান কখনো পুঁথির পুনর্ব্যহারে বিশ^াস করেননি। সেদিক থেকে তাঁর মধ্যে একটি সুপ্ত আধুনিকতা ছিলই প্রথম থেকে। কিন্তু প্রথম পর্বে থেকেই সৈয়দ আলী আহ্্সানের ভাষার একটি স্বকীয় বিশিষ্টতা দেখা গিয়েছিল। প্রথম পর্বে তিনি বিষয়ানুগ সুপ্রচুর আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার করেছেন। উত্তরকালে তিনি স্বীকার করেছেন ফররুখ আহমদ আরবি-ফারসি শব্দকে কবিতায় এমনভাবে প্রয়োগ করেছেন, যে ঐ পথে অগ্রসর হওয়াকে তিনি যুক্তিযুক্ত মনে করেননি শেষ পর্যন্ত। দ্বিতীয় পর্বে তিনি আত্মগত কবিতায় নিবিষ্ট হন। এ পর্যায়ে তাঁর কবিতার প্রধান বিষয়বস্তু শরীরী সংরাগ। সৈয়দ আলী আহসানের বিলম্বিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘অনেক আকাশ’ (১৯৫৯)-এ এর চিহ্ন আছে স্পষ্টভাবেই। ক্রমশ সৈয়দ আলী আহসান আবিষ্কার করেন তাঁর নিজস্ব-চিহ্নিত গদ্যছন্দ। ‘একক সন্ধ্যায় বসন্ত’ থেকে তার প্রকৃত সূত্রপাত হয়।
সৈয়দ আলী আহসান নিজেই জানিয়েছেন ১৯৫৬ সালে তাঁর প্রথম এবং পরবর্তী বিদেশ সফরগুলো তাঁর কবিতাকে প্রভাবিত করেছে। এখন থেকে সৈয়দ আলী আহসান ‘শব্দই কবিতা’ এই বিশ্বাসে কবিতা লিখতে থাকেন। সৈয়দ আলী আহসান তাঁর কাব্যসমগ্র (১৯৭৪)-এর ভূমিকায় জানিয়েছেন, ‘বিদেশে দেখেছি যে, শব্দকে একমাত্র অন্বিষ্ট ভেবে কবিরা কিভাবে যথার্থ বক্তব্যকে শব্দে সমর্পণ করবার প্রয়াসী হয়েছেন। কী করে পরিচিত শব্দ নতুন অর্থময়তায় প্রসারিত হয়েছে তা দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। আধুনিক চিত্রকলার সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে আধুনিক কবিতা কিভাবে বিষয়কে উপস্থাপন না করে বিষয়ের বিবেক এবং আত্মাকে উপস্থাপন করেছে তা জেনে আমি চমৎকৃত হয়েছি।’ অর্থাৎ অমূর্ততা। জীবনানন্দ দাশ এই অমূর্ততার অনুধ্যান করেছিলেন চিত্রকল্পে। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত জীবনের একেবারে উপান্তে এসে এর উপকারিতা হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন। তবে সৈয়দ আলী আহসান বরং অনেকখানি তুলনীয় কবি অরুণ মিত্রের সঙ্গে। অরুণ মিত্র তাঁর প্রথম কবিতাগ্রন্থে ছিলেন স্পষ্টবাক। ফরাসি দেশে পড়তে গিয়ে তাঁর কবিতাই আমূল পরিবর্তিত হয়ে যায়; তারপর থেকে মৃত্যুকাল পর্যন্ত তাঁর কবিতার সমস্ত বিহার সম্পন্ন হয় পরোক্ষপ্রতীকে। সৈয়দ আলী আহ্্সানের শেষ দিককার অনেক কবিতা শব্দজালেই আচ্ছন্ন হয়েছে। সুন্দর সম্ভ্রান্ত সুশান্ত লাবণ্যময় শব্দের উপস্থাপনাই কবিতা নয়। কবিতা নিশ্চিতভাবে এ সবের সমাহার হতে পারে- কিন্তু আবার কবিতা চলে যায় এসব ছাড়িয়ে। ‘আমার পূর্ব বাংলা’র তিনটি খণ্ডে কবি সেই শব্দাতিক্রমী শিখরে আরোহণ করেছিলেন। আমার বিবেচনায়, এটিই কবি সৈয়দ আলী আহ্্সানের আত্মচারিত্রসম্মত শ্রেষ্ঠ কবিতা।
‘কবিতা তো উপমা নিয়েই, উপমা নিয়েই তো কবিতা।’ এক অস্বাক্ষরিত রচনায় জানিয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশ। সৈয়দ আলী আহ্সানের ‘আমার পূর্ব বাংলা’ এই উচ্চারণের একটি উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। কবিতার তিনটি অংশেই তিনি ব্যবহার করেছেন তিনটি উপমা: (এক) নদী, (দুই) নিকুঞ্জ এবং (তিন) বৃষ্টি। লক্ষণীয় : তিনটি উপমাই এসেছে পূর্ব বাংলারই প্রাকৃতিক বিশিষ্টতা থেকে। মনে হয়, কবিতাটি রচিত হয়েছিল বহুদিন বিদেশ ভ্রমণের পরে দেশে ফিরে-কবিতার এক-চিহ্নিত অংশে তার কথা আছে : ‘হঠাৎ নতুন প্রত্যাগত আমার কাছে/বন্য উচ্ছলতায় সবুজের ঐদার্য/এখানে আমার পৃথিবী অনেক রূপময়ী/এখানে নদীর মতো এক দেশ।’ এই বর্ণনার আগে বাংলাদেশের বাইরেকার কোনো কোনো স্থানের মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে- তার তুলনায় স্বদেশ কত সুন্দর, এটিই বক্তব্য কবির। ‘আমার নিজের দেশটা কতো সুন্দর।’ একথা না বলে সৈয়দ আলী আহসান বাংলাদেশকে তুলনা করেছেন একটি শান্ত শীতল নদীর সঙ্গে। এই উপমাও নদীমাতৃক বাংলাদেশেরই। পাখিদের কথা এসেছে, গাছের কথাÑ এসেছে, নৌকোর কথা-অর্থাৎ বাংলাদেশ বলতে যে ছবি ভেসে ওঠে আমাদের সামনে। ‘আমার পূর্ব বাংলা’র দুই-সংখ্যক কবিতাংশে একটি অপরূপ চিত্রকল্পে কবি পুরো বাংলাদেশকেই যেন একটি ফ্রেমের মধ্যে ধরেছেন- ‘অনেক পাতার ঘনিষ্ঠতায় একটি প্রগাঢ় নিকুঞ্জ’।পর-পর তিনটি উপমা প্রশান্ত বাংলাদেশকে ধারণ করেছে: ‘সন্ধ্যার এ মেঘের মতো/সরোবরের অতলের মতো/কালো-কেশ মেঘের সঞ্চয়ের মতো, একটি নারীর কথা আছে এই অংশে-তারই প্রসঙ্গে কবির মনে পড়ে বৈষ্ণব পদাবলীর রাধার প্রসঙ্গ- কিন্তু সমস্তই ইশারায় : এই নারীর মধ্যেও পূর্ব বাংলাই প্রতীকায়িত। তৃতীয়াংশের প্রথমেই বলা হচ্ছে: “আমার পূর্ব বাংলা অনেক রাত্রে গাছের/পাতায় বৃষ্টির শব্দের মতো”। এখানেও প্রকৃতির প্রতীকে বাংলাদেশ রূপায়িত। ওখানেও এসেছে বিদেশের কথা’ বৈদেশিক বৃষ্টির সঙ্গে বাংলাদেশের বৃষ্টির পার্থক্যÑ‘আমার পৃথিবীর বৃষ্টি মাটির গন্ধ/ধানক্ষেত্র ভেসে যাওয়া/আম গাছের ডাল ভেঙে পড়া/হঠাৎ গরুর ডাক, ভিজে-যাওয়া/পাখির ডানা ঝাপটানো/আবার পুকুরে, নদীতে/ডোবায় লাবণ্যের সাড়া’। ভিতরে এ বর্ণনা, কবিতায় শেষাংশে সমস্ত বিবরণ যেন একটি উপমায় সংহত হয়ে এল : ‘আমার পূর্ব বাংলা অনেক রাত্রে গাছের পাতায় বৃষ্টির শব্দের মতো।’
‘আমার পূর্ব বাংলা’ কবিতার তিনটি খণ্ডাংশেই প্রথম ও শেষ অংশগুলো কবিতাংশগুলোকে যেন সংহতি দিয়েছে একটি : এভাবে:
এক. আমার পূর্ব বাংলা কি আশ্চর্য
শীতল নদী…
এ আমার পূর্ব বাংলা
যার উপমা একটি শান্ত শীতল নদী।
দুই. আমার পূর্ব বাংলা একগুচ্ছ স্নিগ্ধ অন্ধকারের তমাল
তুমি আমার পূর্ব বাংলা…
পুলকিত সচ্ছলতায় প্রগাঢ় নিকুঞ্জ।
তিন. আমার পূর্ব বাংলা অনেক রাত্রে গাছের
পাতায় বৃষ্টির শব্দের মতো…
আমার পূর্ব বাংলা অনেক রাত্রে
গাছের পাতায় বৃষ্টির শব্দের মতো।
সাধারণভাবে গদ্যকবিতা অনেক সময় ছন্দহীনতার কারণেই অবারিতভাবে পতিত হয়ে যায়। এখানে কবিতাংশ তিনটি যেন টান করে বেঁধে রেখেছে প্রথমে- উচ্চারিত কথাগুলো ঈষৎ পরিবর্তিত বা অবিকল শেষে ফিরে এসে।
পূর্ব বাংলারই অন্য দু’জন কবির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে : দুই শতাব্দীর দুই কবি : মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-৭৩) এবং জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪)। মাইকেলের ‘চতুদর্শপদী কবিতাবলি’ এবং জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ঐশ^র্যকে বিস্ময়করভাবে ধারণ করেছে। দু’জনই এদেশের জাতক। সৈয়দ আলী আহসান দীর্ঘকাল ধরে অনেক কবিতা লিখেছেন। ‘আমার পূর্ব বাংলা’ কবিতাগুচ্ছও দেশপ্রেমেরই একটি কবিতা-পরস্পরা। হয়তো বাংলাদেশের প্রাকৃতিকতাই এমন যে খুব ঘনসন্নদ্ধ কবিতায় নয়- শিথিলতায়, নদী বৃক্ষ প্রাণী পতঙ্গ নৌকাবহুল এই দেশকে ধারণ করতে হয় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে।
সৈয়দ আলী আহসান প্রথম জীবনে ও মধ্যবর্তীকালে ৬ মাত্রার মাত্রাবৃত্তে কবিতা লিখেছেন; তারপর লিখেছেন অক্ষরবৃত্ত ছন্দে; সবশেষে গদ্যছন্দে। যে কোনো ছদ্মেই রচিত হোক না, সৈয়দ আলী আহ্সানের কাব্যভাষা অনুপূর্ব তাঁরই চরিত্র-খণ্ডিত। তবে, শেষ- বিশ্লেষণে, গদ্যছদ্মেই তিনি সর্বাধিক সফল। আর এই সফলতার একটি অত্যুৎকৃষ্ট সৃষ্টিও তাঁর ‘আমার পূর্ব বাংলা’ কবিতাটি। এখানে তিনি সমসাময়িক কারো সঙ্গে মেলেন না, অন্যদের সঙ্গেও না। গদ্যে এবং কবিতায় সৈয়দ আলী আহসান সব সময়ই পরিশীলিত। মননের কথা যখন বলেন তিনি, তখনো হৃদয়ের মধ্য দিয়েই সঞ্চার করেন তিনি। ‘আমার পূর্ব বাংলা’ কবিতাগুচ্ছে সেই হৃদয়েরই এক পতাকা অধিষ্ঠিত হয়েছে।