চাঁদ গায়েনের দুই কানে তখনও ভোঁ ভোঁ বাজে। সদরঘাটের ইস্টিমারের আত্মা-চমকানো ভেঁপু! এম.ভি রাজীব- ছাড়বে ঘণ্টাখানেক বাদে। ভেঁপু বাজাইয়া মানুষ ডাকে? প্যাসিঞ্জার! …
গায়েন ইলিশের আড়তের ছমেদ মৃধার সাথে লঞ্চে উঠছে। ছমেদ তার বাল্য বয়সের দোস্ত লাগে। রঙিলা শহরে এই প্রথম।
এত্তো মানুষ কই যায়- আলাঝালা বোচকা বুচকি লইয়া হাঁটতাছে-, হুঁশ নাই। মানুষের গায়ে সাড়া দেয় না কুত্তা বিলাইয়ের গা মড়াইয়া ছুটতাছে? এইডা নাহি ঢাকা শহর। এইডা দোস্তের কিলবিলা শহর! ইট পাথরের শহর খান! …
এতক্ষণে মুখভরা জর্দাপানের ছিবড়াগুড়া বাতাসে উড়াইয়া দিয়েছে ছবেদ মুখ খোলে। ‘তোমার তো হাজিসারা, মটখোলা, লন্ডন ঘাট ছাড়া দুয়ারি- কিন্তু কাহিনি জানা নাই। তবে শহরডায় শুনি বাতাসে টাহা উড়তাছে- খালি চকচকা টাহা! ধরবা আর পটেকে ভরবা। জিন পরীর শহর, ভেলকিবাজির থান।’
‘দেহ দোস্ত আমি সুরুজ গায়েনের বংশের বাত্তি। একটাই সন্তান। চাঁদ গায়েন। খালি একটু গলা টাইনা এটুঁ ভাব নামাইবার পারি। বাতাসে উড়া টাহা ধরবার খায়েস নাইকা। সেইডা পারবোও না।’ চুল দাঁড়ি সয়লাব সুন্দর মুখখান গায়েনের।
দিন এরই মধ্যে গড়াইতে গড়াইতে সাত মাস। আও ভাও কিসযুদ্ধ বোঝতাছে না গায়েন। এত্তো মানুষ- তারা আবার ছুটতাছে বেহুঁশমতো। কী কাম তাগরে! রিকশা ভর্তি মনুষ্য, ভটভটি, সি.এন.জি, লেগুনা মানুষের জড়াজড়ি। বড় বড় বড়লোকী গাড়ি ভর্তি মানুষ! ডানে বামে মুর্দাও ফেলায় তারা! বাপরে বাপ! কী দুশমন। হেরপর মনখালি ছুটতে যায়, কোন দুরান্তে- রক্তের ভিতরে মরা আধমরা মানুষ শুইয়া যাচ্ছে!…
হায় আফসোস নাই। ঐ যে তুরতুর কইর্যা হাইট্টা যায় দুইজন যুবতী কন্যা! মাগো আল্লাহপাক কী তাগো সাজি মাটি দিয়া তৈয়ার করছেন। পাকা ডালিম যেন বা রোদের আঁচে ফাইটা যায়।
গত দিন বাদলা আকাশের তলে গায়েনের মনডা সরপরনাই আইঢাই করতে লাগল। শহরে এখন মেটোরেইল হইবো, মাটি কাটার কামলা লাগে তাই গায়েন একখান ঝুড়ি, কোদাল আর লালটুকটুকা গামছা খরিদ করছে। দোতারাখান তার বুকের পাঁজর! সেইডা ঝুলাইয়া রাখে হরদম শরীলে। ঐ মাটি কাটার কালে খানিক তফাতে রাখে। গতদিন কী মনে কইর্যা শাহবাগ হাতিরপুল পার হয়্যা সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড়ে এ্যাইসা পড়ে চাঁদ মিয়া। আড়ং এর সামনের ব্রিজটার এককোণে বসে পড়ে। খানিক হাঁজায়। লুঙ্গির গিঁট খুলে একটুকরা বাসি রুটি চাবায়। কালা কুষ্টি চা খায় এককাপ। চা ওয়ালা ছোকরাটা কী মনে করে টাকা নেয় না। গায়েন হাঁ করে ‘মানুষ’ দেখে! … ছেমড়াডার দিল দেখে।
মনটা একটুখানিক আসান পায়। তখনই আতকা দৌড়ের উপরে থাকা বেসবুর মানুষগুলা খেঁকিয়ে উঠে, এ মানুষটা রাস্তা জুইর্যা বইয়া রইছো ক্যা? হইটা যাও-সইর্যা বও। কাম কাজ নাইকা! জোয়ান মর্দা এখখান। সাধুবাবার ভেক ধরছে। সাধু! ঝিমাইতাছে ব্যারাইমা মুরগি যেমুন। বাইন মাছের সুরুত ধরে চাঁনমিয়া। ক্যারাব্যারা কইর্যা টুকরি আর কোদাল খান নিয়া এক্কেবারে কাম্্চিকেলায় সান্ধ্যায় মিয়া। চান্দের মতো মুখখান পাতিলের কালি হয়্যা যায় যেমুন।
ওভারব্রিজ থেকা নাইমা সে হাঁটা ধরে। শাহবাগের ফুলবাজারে এককোনায় দোতারাখান বুকে নিয়া ঝুড়িখান মাথার বালিশ বানায়। এই রাতের কালেও বাগডালার মস্ত চক্ষুর মতো পাড়ি ছুটতাছে-ছুটতাছে বিগার-চড়া মানুষজন! নিজের মনে নিজেরে বুঝ দেয় সে। মানুষের বুঝি তালগাছের লাহান উঁচা হইবার সাধ থাকে? আরো কতো আহলাদ থাকে। এমুন বেহুঁশ সাধ আহলাদ থাকাটা ভালা না মন্দ? মারফতির ল্যাজ ধরে পাগলা গায়েন।
সুরুজ গায়েন ছিল হাজিমারার বিরাট গায়েন। তাঁরই রক্ত চাঁদ গায়েনের শরীলে। বাপে ছিল বেহদু পাগলা কিসিমের। গান ছাড়া কোন বুঝ নাই তাঁর। দিন রাইত সমান কইর্যা গলার রগ ফুলাইয়া দেহতত্ত্ব গাইত। রগগুলা কুইচ্যা মাছের মত্তো ডাগর হয়্যা উঠত। কোনদিন লালন, কোনদিন মাইজভান্ডারি, কোনদিন বা শাহ আবদুল করিম।
সুরুজ গায়েনের গলায় সুরের সাত সাগর। মোহমায়া সবিশেষ। চক্ষু বুইজ্যা ভাঙ্গা চোয়াল কালাইয়া গাইত, ‘তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা, মন জানো না।’…
চাঁদ গায়েনের শৈশবকালটা ধানে চালে চিঁড়ামুড়ির আমদানিত মন্দ ছিল না। দিন তো এক ধেয়ানে কাটে না। মহল্লায় মহল্লায় গঞ্জে দূর দূরান্তে বায়না নিয়া তার বাজানে গান গাইত। টাকাকড়ির রমরমা না থাকলিও সম্মানডা ছিল। সুরুজ গায়েনের হাঁপানি বাইন্ধ্যা ফেললো! সরেস জমি জিরাতের চালডাল বারোভূতে লুইট্যা নিলো!
সেদিন শ্রাবণ মাস টানা তিনদিন বৃষ্টির পর সূর্য উঠছে। একদলা খাজুরা গুড় দুই মুষ্ঠি মুড়ি আর দুই মগ পানি খাইয়া কার্তিক সহৃর বাড়িত জলসায় রাতভর গাইছে আত্মা ভইরা। চাঁন্দ তো বাপের সাথ ছাড়ে না। সেও রাতভর বাপধনের সাথে টান ধরছে- ছেলে সুবীর সাহা দুপুরকালে চিকনচালের ভাত লাবড়া, থোড়ের ছালুন মুগডালে মুড়িঘন্ট খাওয়াছিলেন ভরপেট। কিছু সম্মানী দিছিলেন।
বাড়ি ফির্যা দিনভর বেহুঁশ ঘুম। বৈকাল বেলা সব ময়ূরী হাঁসগুলারে চৈ চৈ কর্যা ডাকতিছিল। জলা ছাইড়া উধনার চায় না। বজ্জাত হাঁসের দিল। মায়ের গলা ভাইঙ্গা গেছে যেমুন। চৈ চৈ… আয়… সাঁঝ নামছে। …
সুরুজ গায়েনের মনটা ফুরফুরা। বৌ ময়ূরী বিড়া খোঁপা বানছে। চক্ষু ভইর্যা কাজল! নাক চোখের গোছমিছিল সুন্দর। বড়বাড়ির ঝি আবার সাজন গোজনেও এলেম আছে। মটখোলা থেকা খ্যাসেরা আসে বিয়ার পাত্রী সাজানির বায়না নিয়া। হাসি তামশার ময়ূরীবিবি সুরুজ গায়েনের গানের পাগলও ছিল একসময়।
এখন দিন দিন গায়েনের গলা হাঁপানির খোঁয়াড়ে বান্দা পড়েছে। বয়স থাইম্যা নাই। শুধু সম্মান ধুইয়্যা পানি খাইলে প্যাট ভরে না ময়ূরীর।…
সুরুজ দুধের ননীর মতো মিহি কইর্যা কইল, ‘ময়ূরী ভাত দ্যাও গো চারটা। মুসুরির ডাল রানছ? পেঁয়াজ কাঁচা মরিচও দিও কইলাম। হাটে যাই। আইজ শাহ আবদুল করিমের গান গাইবুনে। মানুষ জড়া হইলে পর কিছু পয়সাপাতি জুটবো আল্লাপাকের ইচ্ছায়।’ বলেই ঘোর কালির তোড়! গায়েনরে ঢেউয়ের মাথাত নৌকা যেমুন উথালপাথাল করে তেমুন দশা। সরষার তেলের শিশি লইয়া চাঁদ দৌড়ায়। বাজান-বাজান কচি গলায় কান্দনের হিক্কা!
চাঁদের মা অভাব সইতে পারে না এক পহরও।
সে ঘাড় ঘুরাইয়া কইল, ‘মুরাদ যা আছিল সব শ্যাষ। ঐ দোতারার টুঙুর টুঙুর আর মরার মারফতি মানষে বাম পায়েও পৌঁছে না। আমার সকল কেচ্ছা জানা আছে। এইবার ঝুলি নিয়া ভিক মাগো গিয়া।’
বাজানের করুণ চোপসানো মুখখানা এখনও চক্ষু মুদলেই দেখে চাঁদ। বয়স তখন কত- তেরো চৌদ্দ হইবে। ঘরে আর খানিক সুখ শান্তি থাকলেই সুরুজ গায়েন আকাশের চান হইতে পারতো। কী তার সুরমাখা গীত ধ্বনি! … গাছের পত্র পাখি সকল কান লাগাইয়া শুনতো। এক্কেবারে সাধু বাবা গায়েন। দাড়ি চুলে সয়লাব চেহারা। জোব্বায় আর গলায় লম্বো বড় দানার তসবি দুলতে থাকতো গোটা ছয়। বাজানের দোতারা টুঙ্গুর টুঙ্গুর শেষ হইলে মজমা জম্যা উঠতো একেবারে জমাট দধি? … শতে শতে মনুষ্যের মাথা। সাদাপাকা চুল, কালা ভ্রমরা চুল, শিখুন তুলা চুল। কারোবা চান্দিজোড়া টাকের হাটবাজার। সুরে সুরে সয়লাব সোনালু গাছতলা… ‘আমার দয়াল আল্লাহ পন্থের দেহা দেও’। … আর ‘শুয়া চাঁদ পাখি তুমি ঘুমাইছ নাকি।’… মানুষের চোখ ভিজা যাইতো।
আজ চাঁদ গায়েনের মনে পড়ে পিতা-মাতার কথা! গায়েন বাপজানের কথা মনে পড়লে চোখ দিয়া কান্দন নামে। শেষে চোখ চুলকায়। মনে হয় চক্ষুজোড়া নিমের দাঁতন দিয়া ঘষে। চুলকানির চোটে চামড়া বরবাদ। প্রায় রাত্রিকালে বাপধন তাপিমারা জোব্বা গায়ে দ্যাহা দেয় পরাণ পাখি পুত্রধনের শিথানে!… স্বপনের উছিলায়।… দিনে খুঁজতাছি তোমারে, রাইতে আহ স্বপনে! …. বিড়বিড় করে চাঁদ গায়েন।
চাঁদের গায়েন বাপটা পরাণ ভরা অভিমান নিয়া দজ্জাল নারীর ঘর ছাড়ছে? নাকি সেই ফেরিশতা মানুষটা দুনিয়া ছাড়ছে- দ্যাশ গাও তো ছাড়ছেই! সেই যে সাতটা চড়াই পক্ষী উঠানের পেয়ারা গাছটার ডালে বইস্যা কিচির মিচির করতাছিল, সেদিক পাণে চাইয়া একটু হাসি দিলেন বেহেশতি হাসি! তারপর আঁতকা মাথাড়া ঝুঁকাইতে ঝুঁকাইতে হাঁটা ধরলেন। বারোডা বছর!…
কেউ কয় বেনাপোলে তাঁরে কুয়াশামতো এক ঝলক দেখছে। কেউ কয় বান্দা তো কামরূপ কামাখ্যা গেছেন। সাধন সঙ্গী খুঁজতাছেন বুঝি বা!
ছয় মাস বারোদিনের মাথায় এক রাইতে চাঁন্দের মা ময়ূরী বেগম চামড়ার ব্যবসায়ী জমসেদ মণ্ডলের সাথে নিকাহ বইলো। দালানের পালঙ্কের পাটরানিডা যেমুন। সুসময় গড়াইয়া যায়। এইডারে হেলাফেলা করণ বলদা মানুষের কাম। মায়ের তো শেষদিকে বাপরে তার হাঁপানি দলরে, তার হতদরিদ্র দলারে দুইচক্ষুতে ভস্ম করতো।
ব্যাপারী বাড়িত মায় সুখের নদীত্্ কেমুন ঝাপুর ঝুপুর করতাছে সেইডা জানতে একটুক ইচ্ছাও হয় নাই পাগলা চান্দের। মায়ে জননীর জাত! কেমনে ডাইনি হয় গো! মায়ে কোলে বাহারে সরাইয়া নয়া নাগর ধরলো! মানষে চান্দের কামের কাছে জোর জব্বর আকথা কুকথা শুনায়, কত যে মজা পায় তারা। চান্দের ছরাছর বমি বমি লাগে। দুনিয়াটারে বিষ লাগে।
সইতে না পাইর্যা শেস্তের সাথে সদরঘাট আইল-গায়েন। আল্লাহ্র ইচ্ছায় রমিজ চাচার লগে দেখা, তিনি তারে কামরাঙ্গীর চরে নিয়া গেলেন- ভাতে কাপড়ে তিন মাস পুষলেন। কিছু বিদ্যাশিক্ষাও দিলেন। বাপের ভাই, খালাতো। আৎকা সেই চাচাও ইন্তেকাল করলেন। কী কপালখান!
আবার চাঁদ গায়েন রাস্তার মানুষ! তয় দুঃখের তাপে লালন ভর করে, ‘আট কুঠুরি নয় দরজা আটা/ মাঝে মধ্যে ঝরকা কাটা/ তার উপরে সদর কোটা/ আয়নামহল তায় ….। কেমনে আসে যায়। “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।”…
আজকাইল ফুলপাড়ায় বড় ঝাপড়া গাছটার তলে আখড়া বানছে মনে হয়। প্রায় সময় সেখানেই দেহতত্ত্ব গায়। রাতের আকাশ যখন ফিসফিস করে ভাবের কথা ভালবাসার কথা কয় তখন, চান মিয়া ভাবের নদীত জোয়ার নামে। টুকরি আর কোদাল খান পিছনে লুকায় সে।
চাঁদপুরের হাজিমারার বসতভিটি আম জাম লটকনের গহিন বৃক্ষ মাচানের ধুন্দুল সব গিল্যা খাইল সোহরাব মাতব্বর। তখনতো সব নিশানা গায়েব। ঐ লিলুয়া বিলে কত পক্ষী, শীতকাল আইলো তো ঝাঁকে ঝাঁকে। মেঘনার পাড়ে বাস বেটা কতদিন- না গলা ছাইড়্যা গান ধরছে ‘নদীর কূল নাই, কিনার নাইরে’ … দুই চক্ষু নয়নের জলে জেরবার। মানুষগুলা ভিড় জমাইছে! … তারা গান শুনবার চায়, গরিব মানুষ। টাকা পয়সা দিতে পারে কই। বাড়িত্্ ফিরলে সেই চিল চ্যাঁচানি, ‘চাল নাই, একদলা গুড় নি আছে খোরাত? হারাদিন টুঙ্গুর টুঙ্গুর।’ কইতে কইতে মা বাপধনের জানের টুকরা দোতা রাখাল তুইল্যা আছাড় দিবার ধরছিল। বাপধন একটা লাম্বা চিক্কুর দিয়া কলজার টুকরাডা আর ঝোলতা নিয়া হুড়মুড় কইর্যা বাবরি চুল ঝাঁকাইয়া বাইর হইয়া গেলেন। … তখনও মাডার চিক্কুর “ফকিন্নির গুষ্ঠি, গায়েন হইবারও মুরাদ লাগে।’
এরপর কত সরস আইল বিলের ধারে। কত ঘুঘু, টিয়াপক্ষী, বুলবুলি, কইতর আইত খাইত, বাজানে পক্ষী ভালোবাসত। তাগরে খুদ কুড়া দিত। পানি দিত চাড়ি ভইর্যা। তো সেই সব পক্ষী, জোছনা, রাইত, ঝিঁঝিঁ পোকার গাল, জোনাক, ব্যাঙ সবাই ছিল। শুধা উড়াল দিল গানরাক্তা বড় পক্ষীডা! তারে আজও খুঁজতাছি। চান মনের ভেতর এইসব কথাগুলা নিজেরে শুনায়। বাড়িত আর কটকতারা, বাঁশফুল চাল এ কণাও আসতো না। চিঁড়ামুড়ি ভাজা হইতো না! জমিজিরাত বেদখল ততদিনে।
সুবহে সাদেকে বরাবর চাঁদের নিদ্রা টুটে যায়। বাজানেরও সেই স্বভাবডা ছিল। নামাজ কালাম শেষে পক্ষী আর ফুল ফল দেখতো তারা বাপবেটা।
আজও ফুলপাড়া শাহবাগে ফজরের ওয়াক্তে ঘুমটুকে গেছে। বাসি গাঁদা ফুল লাল গোলাপের পাপড়ি ঝাঁটপাট দিবে মংলার মা। লম্বা শলার ঝাড়– হাতে আসতাছে আবছা দেখা যায়- একটু কুয়াশা ভাব বাতাসে। দোতারা খান আসমান বরাবর তুইল্যা চাঁদ গান ধরে, ‘বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে সই লো…’
সোহাগী আসতেছে। এই বেটি মানুষটারে গায়েন দেখছে বহুবার। কিচু ভাবছে কিনা কে জানে! এই মানুষটাই সায়েন্স ল্যাবরেটরির ব্রিজের কোনা কানচি থেকা শাহবাগ ফুলপাড়া আইয়া পড়তে শলা দিছিল! ঐ চিপার চাইতে এই কড়ই গাছ তলাটাতো বেহেশতো।
আজ খিয়াল কইর্যা দেখছে গায়েন মেয়ামানুষটার মুখখান রুটি বেলা পিঁড়ির মতোন চ্যাপ্টা কিসিমের। গায়ের চামড়া মোটামুটি জ্বলজ্বলা। ভাবসাবে মনে হয় মনডা হাসি তামশায় জড়ায়ে রাখতে জানে- চেষ্টা করে। পূর্বদিকে থিকা জোর পায়ে আসতাছে সে। মাথার গোছাভরা চুলে গন্ধত্যাল চুয়াইয়া পড়তাছে। বায়ু চড়া ব্যাধি আছে বোধ হয়। হঠাৎ মনে টান দিল সোহাগী হাঁইটা আসে যেমুন ঘটকীখান। কিন্তু ঠোঁটের কিনারে একটা ঠাণ্ডা হাসি জুৎ করে বইস্যা থাকে। … গায়েন রহস্যের একটা বাতাসে দুলে ওঠে! পরনারীরে চোখ টাইনা দেখনের কী? …
সোহাগী ছুটে যায় মংলার মার কাছে। ‘মাইয়ো তোমার বউয়ের চারটা পোলাপান। দেইখ্যা আসচি খামচাখামচি করতাছে। ভ্যাঁ ভোঁ ট্যা টো-মারে। একটারি দেওন লাগব। ঘণ্টা চার। ঘন্টা মাইপা পয়সা উসুল। তুমি খালি বাধা দেও। আগে দিছি না- কাচা ট্যাহা হাতে তুইল্যা। বেঈমানি শিখি নাইকা বালের জন্মে। যাই একটারে লইয়া আছি। তুমার বেটার বৌ তুমারে ডরায়। মংলার মা ঝাঁট দিতে দিতে কইল, ‘নিয়া যা মাইঝাটারে। রোদে রাহিস না কইলাম। যা … যা…।’
সোহাগী মাইঝা বাচ্চাটারে কোলে লইয়া শাহবাগের মোড়ে আসে। অবিইত্যা সোহাগী মায়ের দরদ দিয়া বাচ্চাটারে আদর করে। চুমা খায়। মোড়ে জন্মের গাড়ি রিকশা, সি. এন.জির জন্মের গেরা। এমুন জিলাপির প্যাঁচ দেইখ্যা খুশির খেয়ালে সোহাগী কয়ে ওঠে, ‘আল্লাহ মাবুদ চতা তুইল্যা চাইছে গো।’ যতো জট ততো পরসা। এ গাড়ি, ও গাড়ি দয়ার শরীর মানুষ কিছু না কিছু দেবেই। ঝিলমি নামের বাচ্চাটারে ফিডারে দুধের সঙ্গে ঘুমের বড়ি গুঁড়া মিশইয়া খাওয়াছে ট্যাটনা বেটি। কী ঘুম সরতাছে মাইয়াডা? লারালুলা দিয়া খাড়খাল পিছলা ঘাটলা বানাইছে। বানাক গা। এই আমার বরকত গো।
বিকেলে যখন রোদ নরম হইয়া পৃথিবীর গায়ে হাত বুলায়ে দিতেছে। তখন সোহাগী ঝিমলিরে জমা দিয়া টাকার ভাগ দিয়া ফেরে। ফিরতে পথে সে গায়েনরে খোঁজে। সাধুমানুষটা নওজোয়ান। বাবরি চুরের ঘরে সুন্দর নাক নক্শা। হঠাৎ দেখা হয়াও যায়। সাধুব্যাটার চক্ষুদুইটা যেন বা কয়েক হাজার তাজা জোনাকি লোক।
ভরা পূর্ণিমার রাত। শরৎকালের পূর্ণিমা, কোজাগরি পূর্ণিমা। শাহবাগের ফুলের পশারিরা কেবল ঝাল গন্ধ করতাছে। গায়েন খোলা গলায় গান ধরছে, ‘মন জানো না তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা।’ কী গলাখান আল্লাহ্পাক দিছেন। মিছরি গুঁড়া শরবত। দোতারার টুঙ্গুর টুঙ্গুর য্যান বানুড়ি পাথরের ঝর্ণার জলতরঙ্গ। গায়েনের বুকের ভিতরে আগুনের ঝলকানি! এই মহাপূর্ণিমার ছল, গায়েনের সুরবাহার, দোতারার টুঙ্গুর টুঙ্গুর। কী দাম দিবে জমায়েত ফুল কারবারিরা! বাসি ফুলের মালা তারা গায়েনরে দেবো না।
তখন কণ্ঠে বাজে, ‘তিন পাগলে দেখা হইল নদেয় এসে’… আর কী! মানুষ কিন্তু বেশির ভাগ শয়তানের জমডা। কিন্তু উপরি শয়তানের ভিত্রে বইয়া রইছে এক মোলায়েম মাটির মানুষ! ভাবের পাগল- তারে বাইর করতে ‘এলেম’ লাগে গো!
সোহাগী ভিড়ের মইধ্যেই ছিল। কখন জানি তার চাচের বেড়ার ঘরে গেছে- এক্ষণে তরাসে দৌড়াইয়া আসছে।
একখান চিকন চিক্কুর।
‘গায়েন- গায়েন-। আবার ডাক পারে ‘গায়েন- গো।’ গায়েন শোনে সে কলকলানি ডাকের শব্দ। সোহাগির ত্রিরিভুবনে কেউ নাই। তার বাচ্চা টোকানিটার জন্যে মানুষে গালাগালি করে। কী করবো সে! প্যাটের খিদার উপরে আরো কোন কথা তো সে জানে না। সোহাগী মুরুক্ষু! সে পাপ করতাছে গো।
ভিড় ভাট্টা কমে গেছে। রাত ঘন হইছে! এইবার সোহাগী চাঁদ মিয়া গায়েনের তাপ্পিমারা খামচে ধরে।
‘এমুন গান তো আগে শুনাও নাই। গায়েন গো তুমি ইহজন্ম পরজন্ম খাইয়া নিলা আমার, আজকা এই পূর্ণিমার চাঁদে।’
চাঁনমিয়ার দুই চক্ষুতে বানের স্রোত বয়।…
‘কান্দ যে!’
‘কান্দি কই সোহাগী? ভাবের ঘরে ডাকাইত পরছে!’
থম মেরে থাকে দুইজন। …
মানুষ ভজলে মানুষ পাবা গায়েন?…
আৎকা গায়েন চিক্কুর দিয়া ওঠে,
আল্লার কিরা- কিরা কিরা- আল্লাহ্পাকের কিরা।
সোহাগী পোড়া অন্তরের গহীন অতল থেইকা গর্জায়, আল্লাহ্র কিরা- আল্লাহ্র কিরা!
কিরা কসম কাটে ক্যা গায়েন? মন ঢিপ ঢিপ করে।
গায়েন নিজের বুক চেপে ধরে, মাথায় চাপড় মারে, ‘ওরে আল্লাহপাক আমিতো আমি নাই। আমি তো সুরুজ গায়েন! বাপে পুরাই ভর করছে আমার ভিত্রে। সুরতা গায়েন আমার নয় কুঠুরি সাত দরোজায় পহরায় আসছে।
শোন একখান ওজনের কথা, একমণ লোহার ওজন! আমার মায় নাগর ধরছিল, সেইমতো হইলে জিন্দা থাকবি না সোহাগী।
দুইজনে একসাথে যেন জিকির করে, আল্লাহ্র কিরা!