জাহাজ ঘাটের শানবাঁধা লাভা সিঁড়িটা সোজা নেমে গেছে পানির নিচে। সিঁড়ির পশ্চিম পাশে ব্লক বসানো বরইগাছের ছায়া। একপাশে নয়নতারা আর দেশি গাঁদাফুল এবং আরেক পাশে মোরগটুমি ফুলের দৃষ্টিনন্দন বাহার। এসবই জহিরুদ্দির নিজের প্রচেষ্টায় করা। মাঝে মধ্যে পদ্মায় বেড়াতে আসা লোকেরা জহিরুদ্দির এমন সৌন্দর্য-পিপাসু শৈল্পিক কাজ দেখে অবাক হয়ে যায়! এমন একজন অল্পশিক্ষিত মানুষ কোথা থেকে এতো সৌন্দর্যের জোস খুঁজে পায়? তার চেয়ে বড় কথা জহিরুদ্দির পরিবর্তন!
পাড়ার কেউ ভাবতে পারেনি সে, বিয়ের পর জহিরুদ্দির এমন পরিবর্তন হবে। এমন ছেলে জাহাজ ঘাটে আছে যে বিড়ি খাওয়া পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছে। হাজার হাজার বোতল ফেন্সি সে ভারত থেকে আনতো, আজ সে শুধুমাত্র নদীতে মাছ ধরে, চরে ফসল করে জীবিকার্জন করে। এসবই সম্ভব হয়েছে বিয়ের পরে। তাহলে কি সতী ধর্মভীরু স্ত্রী আলতাবানুর কারণে? না আলতা বানু তেমন বিশেষণে বিশেষিত কোনো চরিত্র নয়। তবে আলতাবানু সাধারণ ঘরে জন্ম নিলেও রূপ ছিল মাশাআল্লাহ্! হিজল গাছের নিচে পুকুরের ঠাণ্ডা কালো জলের মত তার গভীর কালো চোখের দিকে তাকালে, মুহূর্তেই জীবনের বিষণ্নতা কেটে যায় যে কোনো মানুষের। যত কাজেই জহিরুদ্দি ব্যস্ত থাকুক না কেন, স্ত্রীর মুখ কখনও সে মন থেকে সরাতে পারতো না। তবে জহিরুদ্দির পরিবর্তন কিন্তু শুধু এসব কারণেই নয়।
কী সেই কারণ?
বিয়ের রাত্রে আলতাবানুর সঙ্গে কথাবার্তা শেষে ঘুমিয়ে যায়। হঠাৎ স্বপ্নে দেখে, পদ্মার কিনারে সে দাঁড়িয়ে। ভাবনা তার নতুন বউকে নিয়ে। না জানি বউটা কেমন হয়। পাশের বাড়ির রহমত চাচার জীবনটা কেমন ছারখার হয়ে গেল। একমাত্র রহিমা চাচীর কারণে! ঠিক এমন সময়ে একজন মুরব্বি এসে তার সামনে দাঁড়ালো। সাদা রঙের পরিষ্কার ঝকঝকে আলখিল্লা আপদমস্তক পরিহিত। হাতে তাসবিদানা, মুখে বকের পালকের মত ধবধবে সাদা দাড়ি।
হঠাৎ অচেনা একজন ধার্মিক লোক দেখে সহসা গাছ থেকে পিছলে পড়ার মতো চম্কে উঠে জহিরুদ্দি। বৃদ্ধ সরাসরি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, কি ভাবছো বেটা? ভেবে আর লাভ নেই। সাদি মোবারক তো হয়েই গেছে। আমি জানি, এই বউ তোকে সুখ দেবে না। ওর রূপ-ই এক সময় তোর জীবনে কাল হয়ে দাঁড়াবে।
ঠোঁট কামড়াতে কাঁমড়াতে হঠাৎ থতোমতো খেয়ে জহিরুদ্দি বলতে যায়, তা-তা-তা হলে বাবা-উপায়?
কিন্তু ওর মুখ দিয়ে কোনো এক অদৃশ্য কারণে, কোনো কথা বেরিয়ে আসে না। সামনে দাঁড়ালো মুরব্বি আবার বলে, ভাবছিস পরিত্রাণের উপায়! উপায় আছে রে, তবে এ বউ তোর হাড়ে চাল ভেজে ছাড়বে। হাজার হোক ও তোর প্রথম বউ-জীবনে ভুলতেও পারবি না। তাই বলি, নিজেকে বাঁচার চেষ্টা কর। এই মুহূর্ত থেকে সমস্ত অপকর্ম বাদ দে। মানুষের মত মানুষ হ।
জহিরুদ্দি কিছু বলতে যাচ্ছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে জাহাজঘাট মসজিদ থেকে ওর কানে ভেসে আসে আজানের ধ্বনি আল্লাহু আকবার। সঙ্গে সঙ্গে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে ওঠে জহিরুদ্দি। ওজু করে মসজিদে যায়। জহিরুদ্দির শ্বশুরবাড়ি ছিল, জাহাজঘাট থেকে সামনাসামনি ভারতের কাতলামারী গ্রাম। ৭১ সালের যুদ্ধের পর আলতাবানুর ছোট ভাই এর খেলা নিয়ে ঝামেলা হয় প্রতিবেশী এক বালকের সঙ্গে। আলতাবানুর ছোট ভাই বাচ্চার নাকে ঘুষি মারলে রক্ত বেরিয়ে আসে। দুই বালকের এই সামান্য ঝামেলা এক পর্যায়ে জাতিগত দাঙ্গায় রূপ নেয়। আলাতবানুর বাবা মোকশেদ আলীকে প্রতিবেশী মুকুল সরকার বলে, তোরা এতই যদি ভালো মানুষ, তাহলে ভাই-এ ভাই-এ যুদ্ধ কেন বাধে? ছোট একটা দেশ তার দু’ভাগ হলি, আর আমরা দেখ মহারাষ্ট্রে বাস করি।
এরপর মোকশেদ আলী সপরিবারে চলে আসে চারঘাট এর ইউসুফপুর গ্রামে। আর না এসে উপায়ও ছিলো না। যে দেশকে নিজের দেশ হিসেবে ভাবতে দেয় না মানুষে, জ্বালিয়ে দেয় বাড়িঘর, সে দেশে থেকে লাভ কী? রাতের অন্ধকারে পানির দামে সামান্য কটা টাকা নিতাইবাবু গুঁজে দেয় মোকশেদ আলীর হাতে। পরের দিন সূর্য ওঠার আগেই গ্রাম ছেড়ে চলে আসে বাংলাদেশে।
জহিরুদ্দি একদিন ব্যবসার কাজে যায় ইউনুসপুর। চোখে চোখ পড়ে আলতাবানুর। আয়ত গভীর কালো চোখের অবয়বে হারিয়ে যায় জহিরুদ্দি। ভিন্নগ্রামে যদিওবা চোখ সরিয়ে নিয়ে সেদিন এসেছিল বাড়ি, কিন্তু সেই চোখ থেকে মনকে সরাতে পারেনি। ঘটকের মাধ্যমে বিয়ে হয় জহিরুদ্দি-আলতাবানুর।
দেখতে দেখতে দু’দুটো ছেলে মেয়ের বাবা হয় জহিরুদ্দি। পদ্মানদীতে মাছ ধরে। নদীর ওপারে মিডিলচর। চরে ধান চাষ করে, চৈতালীও লাগায়। সংসারে সুখের জন্য পরিশ্রমকেই একমাত্র পথ হিসেবে বেছে নেয় জহিরুদ্দি। কিন্তু কেন সে এতো পরিশ্রম করে? কারণ আছে। ভুলে গেলে চলবে না সেদিন রাতের স্বপ্নের কথা। পবিত্র চেহারার অবয়ব সেই মুরব্বির কথা।
এখন জহিরুদ্দি ভাবে, দুটো ছেলেমেয়ে হলো। স্বপ্নে যা দেখে সে, সব রকম মন্দ কাজ ছেড়ে দিয়েছিল আলতাবানুর আচরণে তেমন তো কিছুই দেখছে না। তাহলে কি স্বপ্নটা মিথ্যা ছিলো?
এতো তাড়াতাড়ি যদি জীবনের অংশ মিলেই যেত, তাহলে তো স্বর্গের দরকার-ই ছিল না। পৃথিবী স্বর্গ হয়ে যেত।
পদ্মাতে এখন মাছের ভরা মৌসুম। এরপরও সে ডাল সিজনের কাজগুলো বাদ দেয়নি। সকালে ভ্যান চালাতে যায়, দুপুরে বিশ্বাম নিয়ে বেলা পড়লে মাছ ধরতে পদ্মায় নামে। এখানেই কাজের শেষ নয়, রাত আটটার পর যায় সাহেব বাজার। সারারাত মহাজনের মালামাল জোগায়। একবার অসুখে পড়ার পর আলতাবানুর অনুরোধে ভ্যানচালানো বাদ দেয়। কিন্তু মহাজনের দোকানে মালামাল জোগানোর কাজটা এখনও চালিয়ে যায়। গত মাস থেকে জহিরুদ্দি মাছ ধরার কাজে সহযোগিতার জন্য একজন মানুষ রাখে। নাম কলিমুদ্দি কিন্তু কালু নামেই সবাই ডাকে। বাড়ি চারঘাটের মিরগঞ্জ। সঙ্গে একটা পাড়াতো ভাতিজাকে গত সপ্তাহে সঙ্গে নিয়ে আসে। পড়াশুনা নাকি ঠিকমত করে না তাই ওর মা কালুর সঙ্গে একরকম ধরে বেঁধে পাঠিয়ে দেয়। তবে ক’দিনে জহিরুদ্দি যা দেখলো, তাতে পড়াশুনা না করলেও রুবেল ছেলেটা কাজে কামে, কলিমুদ্দির চেয়ে ঢের ভালো।
কলিমুদ্দি ওরফে কালু পাড়াতো ভাতিজা রুবেলকে নিয়ে পদ্মার ধারে ভ্যান্নাতলায় একটা ঝুপড়িঘরে থাকে। রুবেল এর বয়স বেশি না। খুব হলে চৌদ্দ-পনেরো। একদিন ভরা পূর্ণিমা, জোসনা রাত। চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ে পদ্মার পানিতে। ছোট ছোট ঢেউয়ের ওপর জোসনার রূপালি আলো খেলা করে নেচেনেচে। ঝুপড়ি ঘরে বেড়ার ফাঁক দিয়ে চোখ যায় রুবেলের। এক মনে দেখতে থাকে আলোর নাচোন। হঠাৎ খেয়াল করে, ওর চাচা কলিমুদ্দি ধাওট (বাঁশের মাচা) থেকে অতি সন্তর্পণে ওঠে পা টিপে টিপে নদীর কিনারে বসা ব্লকগুলো পার হচ্ছে। সিঁড়ির মত বিছানো ব্লকগুলো পার হয়ে সোজা রাস্তায় ওঠে। রুবেল মনে মনে ভাবে, ব্যাপারখানা কী? কালুচাচা এতো রাতে যায় কোথায়? এর আগেও ও খেয়াল করেছে, আরও কয়েকদিন এমনভাবে একা একা চোরের মত চুনাচুনা বিছানা ছেড়ে কোথায় যেন যায়।
রুবেল এবার ধসমস করে বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে ওঠে। এক মিনিট ভেবে নেয়। তারপর নিজে নিজেই বলে, না, আজ দেখতেই হবে চাচা কোথায় যায়। বিছানা ব্লকের কিনার ঘেঁষে রাস্তায় ওঠে। নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে এগোতে থাকে। এক সময় দেখে কলিমুদ্দি ঝাঁপ খুলে আলতাবানুর ঘরে ঢোকে।
গত সপ্তাহে দুটো নতুন ফাঁসজাল এনেছে জহিরুদ্দি। কিন্তু জাল আনলেইতো আর হবে না নতুন জাল নতুন বউয়ের মতো। গয়নাগাটি পরাতে হয়। যেমন মাকুতে সুতো পেঁচিয়ে কাঠি লাগানো, সোলা কেটে পাতা তৈরি করে জালের উমারের অংশে বসানো, মাঝে মাঝে একটা করে প্লাস্টিকের বোতল বেঁধে দেয়া ইত্যাদি। আজ পদ্মাতে জাল ফেলার কাজ বেলা চারটার মধ্যেই জাল তুললো রাত আটটা নাগাদ। নৌকোর হাল ধরে নিয়ন্ত্রণ করছে জহিরুদ্দি। জাল তোলা এবং মাছ খসানোর কাজ করছে কালু আর রুবেল। কিন্তু একি! নদীতে ডুবে থাকা জাল নৌকার ওপর ওঠাতেই জহিরুদ্দির চোখ ছানাবড়া! রুবেল তো ছোট মানুষ চাচা বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে! নতুন জাল পুরোটায় মাছে ভর্তি। মাছ দেখে জহিরুদ্দির বড় বড় চোখ রুপালি মাছের মত চকচক করে ওঠে। বুকে হাত রেখে মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে। বেশ কয়েক জাতের মাছ উঠেছে জালে। সবচেয়ে বেশি পেয়েছে বড়বড় চিংড়ি ট্যাংরা, বেলে, ইটা আর পিয়ালি। রুবেল বলে আজকের ট্যাংরাগুলো বেশ বড় তাই না চাচা। জহিরুদ্দি বলে বড় হয়া আর কি লাভরে বাবা, সব গালান তো ব্যাচাই লাগে।
মাছধরা শেষে জহিরুদ্দির বাড়ির সামনের ঘাটে নৌকা ভিড়ায় কালু। জহিরুদ্দি কালুকে জালগুলো মেলে দেয়ার কথা বলে, মাছের হাঁড়ি কাঁধে নিয়ে বাড়ি মুখে এগোতে থাকে। হঠাৎ লর্ড গাছের মাচার কাছে এসে থেমে যায় রুবেল। বলে চাচা, তুমি কি আমার একখান কথা শুনবা?
জহিরুদ্দি বলে, কী?
বাড়িতে ছাগল আছে, মুরগি আছে, তোমার রাতে বাজারে ডিউটিতে যাওয়ার কাম কী? তোমার পানিতে ভেজা শরীর। বাড়িতে আরাম করো, চাচীও খুশি হবে।
এক সপ্তাহ পর রুবেল দেখলো, চাচা যখন ওর কথা শুনলই না তখন আবার বলে, চাচা, তোমার মাকে অন্য ঘরে না রেখে চাচীর সঙ্গে রাখো। চাচীর হয়তো রাইতে একা একা ডর করতে পারে!
ব্যাস আর কিছু বলা লাগে নি রুবেলের। এবার মস্তিষ্কে নাড়া দেয় জহিরুদ্দির। বিছানায় শুয়ে ভাবে, রুবেলের একথার অর্থ কি? ও কেন চায় না আমার বউ একা একা রাত্রে ঘরে থাকুক। কি এমন দেখতে পেল যা ওর কিশোর মনে দাগ কেটেছে? পরের দিন জহিরুদ্দি রুবেলকে বলে, নৌকায় উঠতো রুবেল, ওপারে যাবো। হঠাৎ হনহন করে নদীর ধারে এসে ‘ওপারে যাবো’ কথাটা শুনে রুবেলের কচি বুকটা ধাপ করে ওঠে। মনে মনে ভাবে, গতকাল কথাটা বলে কি ও ভুল করলো? পদ্মার ওপারে গিয়ে নৌকা বেঁধে সোজা উঠে এলো মিডিলচর। ঝাউগাছটার নিচে এসে জহিরুদ্দি থামে। তপ্ত ঘামের কণা কপাল চুইয়ে নামে। রুবেল মনে মনে ভাবে, এই বুঝি এখুনি এই নির্জন ফাঁকা মাঠে বেধড়ক মার খেয়ে মরতে হবে।
এবার জহিরুদ্দি বলে, বাবা, তোকে খোদার কসম লাগে, সত্যি করে বল, তুই কি এমন বিষয় নিজ চোখে দেখেছিস,- যা বারবার আমাকে আকারে ইঙ্গিত বোঝাতে চাইছিস? রুবেলের দুরুদুরু বুকের কাঁপন এতোক্ষণে কিছুটা হলেও কমে। মুখ তুলে বলে, চাচা দু’দিন আমি দেখেছি। রাত একটু গভীর হলে আমার পাড়াতো চাচা কালু তোমার ঘরে ঢোকে। চাচী ওকে পান বানিয়ে দেয়, আবার হেসে হেসে খোশ গল্পও করে। অনেক রাতে চাচীর ঘর থেকে বেরিয়ে ঝুপড়া ঘরে আসে।
ভাতিজার কথা শুনে জহিরুদ্দির মস্তিষ্কে অসংখ্য চিন্তার পোকা ঘাই মারতে থাকে। এরপরও মাথা ঠাণ্ডা রেখে পরিকল্পনার ছক আঁকে। দিন শেষে রাত আসে। রাতের খাবার খেয়ে নৈশ প্রহরীর চাকরিতে যায় সাহেববাজার। কিন্তু রাত দশটার পর গুটিগুট পায়ে ফিরে আসে বাড়ির দরজায়। বাড়িতে ঢোকার মূল দরজার পাশেই ছিল একটা কাঁঠাল গাছ। চুপিচুপি ঐ কাঁঠাল গাছের তেফাঙড়িতে বসে থাকে সারারাত। শেষ রাতে যখন আশপাশের মসজিদগুলোতে আজান হতে থাকে, তখন দরজা খুলে বেরিয়ে আসে জহিরুদ্দির বোন হালিমা। আকাশ একটু ফর্সা হওয়ায় হালিমা গাছের উপর দেখতে পায় মানুষের মত কলো ছায়া। জহিরুদ্দি ভাবে, সর্বনাশ, এখন কী হবে? এই মুহূর্তে যদি না নামে, তুলকালাম কান্ড ঘটিয়ে বসবে হালিমা। সঙ্গে সঙ্গে সাত পাঁচ না ভেবে দুম করে লাভ দেয় গাছ থেকে। বড়বোন হালিমার মুখ চেপে ধরে বলে, বুবু আমি জহিরুদ্দি কাউকে বলিস না। হালিমা বলে, তাহলে বল, সারারাত কেন তুই গাছে ছিলি? জহিরুদ্দি বলে, এক জনাকে ধরব লাইগ্যা এখানে বইসে আছি। শালাকে পাইলে কাইট্যা দু’খান কত্তুক।
বেলা হলে নদীর ঘাটে কলিমুদ্দির সঙ্গে দেখা হয় হালিমার। হালিমা কথায় কথায় জহিরুদ্দির গাছে ওঠার বৃত্তান্ত মুখ ফসকে বলে ফেলে। অবশ্য পরে অনুনয় করে বলে, কালু ভাই, তুমি য্যান কাউকে কহিও না কেমুন?
পরিস্থিতি বুঝে কালু, জ্বরের উসিলায় রওনা দেয় নিজগ্রাম মীরগঞ্জ। কালুর জন্য তিনদিন অপেক্ষা করে জহিরুদ্দি নিজেই পৌঁছে যায় মীরগঞ্জ। কারণ, কালুকে তার খুব প্রয়োজন। জহিরুদ্দি যখন কালুর সামনাসামনি দাঁড়ায়, কালু তখন সুনামি-আক্রান্ত ব্যক্তির মত আশ্চর্য রকম চমকে উঠে! চোখ মুখ দেখে বোঝা যায় কেমন একটা অপরাধবোধ ওর সমস্ত শিরা-উপশিরায় কাজ করছে। জহিরুদ্দি ওকে কাজে যাওয়ার কথা বললে কালু বলে, না, আমার ওখানে থেকে কাজ পোষাচ্ছে না। এখুন থাইকে এখেনেই কাজ করবো। তুমার মনে তুমি মানুষ খুঁজে লেও।
এরপর জহিরুদ্দি মনের জিঘাংসা মনে পুষে রেখেই ফিরে আসে জাহাজঘাট। কালু চলে যাওয়ার পর আর কোনো লোক রাখেনি জহিরুদ্দি। ছেলে মনাকে নিয়েই মাছ ধরতে যায়। একদিন নদী থেকে আসার পর জহিরুদ্দির প্রচন্ড পেট ব্যথা। ডাক্তারের কাছে জানা গেল অ্যাপেন্ডিসাইড। অপারেশন করে জহিরুদ্দি এখন বাড়িতে। ভাগ্যিস হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে টাকা কটা জমিয়েছিলো। কিন্তু সে টাকাও শেষের পথে, কি করবে এখন জহিরুদ্দি? ধীরে ধীরে সংসারে জেঁকে বসে অভাব-অনটন! দুটো সন্তান নিয়ে আর ক’দিন চলে?
অবশেষে আলতাবানু বায়াতে কাজ নেয় একটা বিস্কুটের ফ্যাক্টরিতে। পাশের বাড়িতে হযরত। ভাবী বলে ডাকে। ঐ একই ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। সংসারের অবস্থা দেখে ম্যানেজারকে বলে কাজটা ঠিক করে দেয়। কিন্তু এতখানি পথ প্রতিদিন যাওয়া-আসা খুব কষ্ট হয় ওর। অনেক ভেবে-চিন্তে বায়া’তেই একটা ঘরভাড়া নেয় আলতাবানু। সপ্তাহে একদিন বাড়ি আসে।
দেখতে দেখতে জহিরুদ্দিন কষ্টের দিনগুলো একরকম শেষ হয়ে আসছে। শরীর সম্পূর্ণ সুস্থ না হলেও এখন অনেকটায় ভালো। গত সপ্তাহে আলতাবানু বাড়ি আসেনি। সাত-পাঁচ না ভেবেই জহিরুদ্দি চলে আসে বায়া’তে। কারণ একটাই। এর আগে কখনও সে আলতাবানুকে না দেখে এতদিন থাকতে পারেনি। কাজ শেষে আলতা স্বামীকে নিয়ে ভাড়াবাড়িতে ওঠে। ছোট্ট একচিলতে ঘর। তবে ঘরখানা বেশ পরিচ্ছন্ন ছিমছাম। চৌকির দু’পাশে দুটো সুন্দর চকোলেট রঙের সাউন্ডবক্স। আলতা সুইচে চাপ দিতেই সূরের মূর্ছনায় ভেসে যায় ঘরখানা। তৃপ্তি আর গর্বে বুকটা ভরে ওঠে জহিরুদ্দির।
দিন পাঁচেক থাকার পর জাহাজঘাটে যাওয়ার জন্য মনটা কেমন করে ওঠে জহিরুদ্দির। বিকেলে দাওয়ায় বসে ভাবছে আলতাবানুর কথা। বায়া’তে এসে অনেক পরিবর্তন হয়েছে ওর। মুখের কথাও বদলে গেছে অনেকটায়।
হঠাৎ একটা লোক আসায় ওর ভাবনার ছন্দপতন ঘটে। বলা নাই, কওয়া নাই বাইরের একটা মানুষ হুটকরে ঘরে ঢুকে গেল? হাতে অবশ্য একটা পরিচয় আছে ইন্সুলেটর জড়ানো প্লায়ার্স। লোকটার সঙ্গে আলতাবানুর বেশ ঢলাঢলি আর মশকারা দেখে জহিরুদ্দি ভেতর ভেতর বেশ আহত হয়। এবার মস্তিষ্কের পাখিরা খানিকটা নড়ে চড়ে ওঠে। বুঝতে পারে কার জন্য চকচকে বিছানা আর ঘরময় সুরের মূর্ছনা। আলতাকে খানিকটা চড়া গলায় বলে, এ লোকটাকে সেদিনও দেখলাম, আজও দেখছি তোর ঘরে ব্যাপারটা কী? তোর কি নিয়মিত মেহমান?
আলতাবানু শুকিয়ে যাওয়া গলা খানিকটা ভিজিয়ে নেয়ার মতো ঢোক গিলে হকচকিয়ে ওঠে। ভয়ার্ত অথচ শান্ত ধীর গলায় বলে, ঐ যে, আমাহারে ফ্যাক্টরিতে কারেন্টের কাম করে। ঠুকঠাক তার ছিঁড়ে গেলে বাড়িতে আইসে জুত কইরি দেয়।
জহিরুদ্দি বলে, তাহিলে তুই অকে লিয়েই থাক, আমি চলনু। আলতাবানু আর ঐ লোকের চলাফেরায় সব বুঝতে পারে জহিরুদ্দি। বুঝে পাথরচাপা দিয়ে, জমানো ভালোবাসা বস্তায় পুরে, হৃদয়ের উচ্ছ্বাস পদ্মার বুকে ভাসিয়ে সোজা চলে আসে পৈতৃক নিবাস জাহাজঘাটে। হা হা পদ্মার খোলা বুকের দিকে তাকিয়ে শুধু মনে পড়ে তার ইউসুফপুর গ্রামের সেদিনের সেই স্মৃতিকথা। বাঁকাচোখের চাহনি, সুরেলা ঠোঁটের ভঙ্গি, আর নানান ভঙ্গিতে ভ্রুকুটি। এখন তার একমাত্র ভরসা হচ্ছে পদ্মা। সবাই ঠকিয়ে চলে যায়, কিন্তু পদ্মা তাকে ঠকায় না। ভরসার প্রেরণা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। পদ্মাকে সাক্ষী রেখে দু’হাত উঠিয়ে বলে, আমার আলতা আর আমার থাকলো না।
দীর্ঘদিন স্ত্রীর সঙ্গে জহিরুদ্দির কোনো যোগাযোগ নেই। কিছুদিন পর আলতাবানু ফিরে আসে জাহাজঘাটে। তবে স্বামীর বাড়িতে নয়। একটা ঘর ভাড়া নেয় হযরতের বাড়িতে। মাঝে মধ্যে হুট-হাট করে আসে জহিরুদ্দির ঘরে। চেষ্টা করে স্বামীর সঙ্গে ভাব করার। অনেক সময় জহিরুদ্দির গায়ের ওপর ঢলে পড়ে। জহিরুদ্দি তবুও কোনো পাত্তা দেয় না।
আলতাবানুর শেষ অস্ত্রটা সম্ভবত শাশুড়ি। কোনো উপায় না দেখে ভরসন্ধ্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ে, শাশুড়ির পা’য়ের ওপর। এবার আর জহিরুদ্দি না করতে পারে না। কারণটা সবই জানে। মাকে ও ভীষণ ভালোবাসে। অবশেষে জীবনের নানা স্মৃতি-বিস্মৃতি উপেক্ষা করে জহিরুদ্দি আলতাবানুকে ঘরে তোলে। পদ্মার অমৃত সুপেয় হাওয়া সাঁ সাঁ করে জহিরুদ্দির ঘরে ঢুকে।
আজ জহিরুদ্দি পদ্মার তলা থেকে দ্রুত পা চালিয়ে আসে। মনের ভেতর দারুণ এক অনুভূতি কাজ করে। ফাঁসজাল ঝাড়া শেষ। কাঁধের উপর মাছের পাতিল। মনে মনে ও আজ ভীষণ খুশি। দুটো বড়বড় আইড় আর তিনটা কালবাউশ পেয়েছে। এ ছাড়াও বাইলা- টেংরা, পিয়ারী সব মিলে কম করে আরও পাঁচ কেজি তো হবেই। কালবাউশ আর আইড় আলতার খুব পছন্দ। মাছের পাতিলটা উঠোনে রাখতেই দেখে বাড়িতে এক নতুন ভাইরাসের আমদানি। ভাইরাস? তা কেন? ওতো মাসুদ- আলতাবানুর আপন খালাতো ভাই। ভারত থেকে বেড়াতে এসেছে।
ধৈর্য ধরুন। ভাইরাস কেন- অপেক্ষা করলেই টের পাবেন। সিমেন্ট-বালু-পাথর দিয়ে জমানো চারকোণ বিশিষ্ট এই বস্তুগুলোর নাম ব্লক। ব্লক দিয়ে বাঁধানো পদ্মার পাশঘেঁষা ব্লক এর তৈরি রাস্তা। রাস্তার পাশেই জহিরুদ্দির টঙঘর। এখানে বসেই জহিরুদ্দি তার সমস্ত অভিযোগ, রাগ, ক্ষোভ, আশা-ভরসা পদ্মাকে জানায়। বিকেলে পদ্মার উঠে আশা হালকা হাওয়ায় বসে কাজ করে জহিরুদ্দি। ছেঁড়া জালের ঘাঁই গুলোতে সুতো জড়ানো মাস্টার চালায়। এমন সময় শ্যালক মাসুদ এসে সামনে বাঁশের ধাওটে বসে। কথায় কথায় দুম করে বলে বসে, দুলাভাই, আমার জন্য একটা বউ দেখো তো বউ ছেলে সবই আছে বিয়ে করবি মানে?
না দুলাভাই, আমার মনে সুখ নাই। অকে আমি ডির্ভোস দেবো, তুমি বউ দেখো। তা কি করে সম্ভব! যদি বনাবনি না হয়, প্রকৃতই বিয়ে করতে চাস, ডিভোর্সের কাগজ দেখা? এরপর মাসুদ কাতলামারী চলে যায়। কাতলামারী হচ্ছে জাহজাঘাট বরাবর পদ্মার ওপারে ভারতের একটি গ্রাম। সেখান থেকে চলে আসে আলতাবানুর বাবা সপরিবারে। কাতলামারী থেকে মাসুদ ফোন দেয় আলতাবানুকে। ঘরে বসে আলতাবানুর কথা শেষ হয় না, ফোন নিয়ে বেরিয়ে আসে কাঁঠালতলায়। চলে লম্বা সময় শুধু কথার ফুলঝুরি। এভাবে বেশ কিছুদিন ধরে ওদের চলতে থাকে মুঠোফোনের আলাপ। একদিন আলতার পেছন পেছন জহিরুদ্দিও বের হয়ে আসে। হেসে হেসে জহিরুদ্দি সব বুঝেও চুপ থাকে।
কিছুদিন পর ডিভোর্সের কাগজ নিয়ে মাসুদ চলে আসে বাংলাদেশে। দুলাভাইকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বউ দেখে, কিন্তু পছন্দ হয় না। আলতাবানু মেয়েকে লক্ষ্মীসোনা, যাদু মনি বলে হাত-পা ধরে বুঝিয়ে রাখে। ক্রমান্বয়ে জহিরুদ্দি বিষয়টা আঁচ করতে পারে। মস্তিষ্কের ভাবনাগুলো ক্রমশ উর্বর হতে থাকে। বুঝতে পারে আসল খেলা। এ বাড়িতে থাকার জন্য ‘বউদেখা’ এটা ওর একটা উসিলা মাত্র। আরও জানতে পারে, আলতার বিয়ের আগে থেকেই ওর মাসুদের সাথে সম্পর্ক। একদিন তো জহিরুদ্দি ধরেই বসে, বলে, কি স্বামীর সামনে বলা যাবে না? ফোন নিয়ে দৌড়ে যাস কাঁঠাল তলায়?
ইদানীং জহরিুদ্দি বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বেরোই না। বাদ দিয়েছে সাহেব বাজারে মহাজনের ঘর জোগানোর কাজ। শুধু সুযোগের অপেক্ষায় আধার দিয়ে বড়শি ধরে বসে থাকে। মনে মনে একটায় প্রতিজ্ঞা একবার যদি ওকে হাতে নাতে ধরতে পারে- এক কোপে শেষ!
কিন্তু শেষ বললেই কি কাউকে শেষ করা যায়? ততদিনে মাসুদ ওর শেকড় গেড়ে বসেছে বাংলাদেশে। নতুন একটা ভ্যান কিনেছে। ভ্যান চালায় সারাদিন আর জহিরুদ্দির বাড়িতে থাকে রাতে। ঐ ঘটনার পর মাসুদ একদিন হঠাৎ ওর সমস্ত মালামাল ভ্যানে তুলে। জহিরুদ্দি বলে, কোথায় যাচ্ছিস? মাসুদ কান চুলকাতে চুলকাতে বলে, কতদিন আর খালাতো দুলাভাই এর বাড়ি থাকা যায়। ফুলতলার ওপারে একটা ঘর লিয়েছি। এখন থেকে ওখানেই থাকপো।
জহিরুদ্দির মনে মনে বলে, যাক ভালোই ভালোই আনাদয়ী বিদায় হলো। আসলে কিন্তু তা হয়নি। আপদ আরও বিপদ হয়ে ওর কাঁধে জেঁকে বসেছে। পরের দিন দৈনিক পত্রিকায় খবর এলো, ‘জাহাজ ঘাটের আলতাবানু খালাতো ভাই এর সঙ্গে উধাও’! জহিরুদ্দি লোক মারফত জানতে পারে, ফুলতলার অদূরে একটা গোপন জায়গায় আপাতত ওরা থাকে। পরবর্তীতে ফুরসত বুঝে হয়তো কেটে পড়বে অন্য কোথাও।
একবার সে এই ভেবে হতাশ হয় যে, পুরনো খাঁচায় যে পাখির মন টেকে না, তাকে খুঁজে এনে জোর করে বেঁধে রেখে কি লাভ। পদ্মার দিকে হা করে তাকিয়ে অভিযোগ করে, বড় বড় দুটো ছেলে-মেয়ে রেখে ও এমন কাজটা করতে পারলো? দিন-রাত হাড়ভাঙা পরিশ্রম কি শুধু নিজের জন্য করেছে? পনেরো দিন বিশ্রাম না নিয়ে অতিরিক্ত কাজ করে ওকে বালুচুড়ি শাড়ি এনে দিয়েছে। কেন দিয়েছে? ওর মুখে যেন আলতা রঙের হাসিটা সব সময় লেগে থাকে। ওর পছন্দের মাছ কালবাউশ ধরার জন্য জীবনের পরোয়া না করে, জাল নিয়ে চলে যায় পদ্মার গভীরে। এই কি তার প্রতিদান?
জহিরুদ্দি কিছুটা সাহিসী এক উদার মনের হওয়ার কারণে এলাকার বেশ কিছু লোক দুর্দিনে ওর পাশে থাকে। বিশেষ করে যাদের সঙ্গে মাছ ধরে এবং অন্যান্য ‘বশায় জড়িত’। হঠাৎ জহিরুদ্দি পদ্মার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে গর্জে ওঠে! পদ্মা যেন ওর ফরিয়াদ শুনে বলে ওঠে, কেনরে, জহিরুদ্দি, তোর শরীরে কি শক্তি কম? ও যদি একটা ভিন দেশের নাগরিক হয়ে ছ্যাক্কা দিয়ে তোর মূল্যবান জিনিস নিয়ে যায়- তুই আমার কোলে সাঁতার কাটিস, আমার কোলেই মানুষ। আমার গতিশীল প্রবাহের ঝঙ্কার তুই দেখিস নি? বড়বড় মাটির চাপ, গাছের গুঁড়ি কিভাবে খড়-কুটোর মতো ভাসিয়ে দেয়। যদিও ভারত আমার চলার প্রবাহকে রুখে দেয়ার জন্য ফারাক্কা নামক ফাঁদ পেতেছে। কিন্তু তাই বলে কি আমার ছুটে চলার আকাক্সক্ষা দাবিয়ে রাখতে পেরেছে? না। আষাঢ়-শ্রাবণে কখনও খেয়াল করেছিস। আমার মা’য়ের বুকের বরফগলে যখন কান্না হয়ে আমার মস্তিষ্কে রক্তের সঞ্চালন করে, ফারাক্কা তখন জোর দেখিয়েও আমাকে আটকে রাখতে পারে না। কারণ, আমার ভাই গঙ্গা তখন দ্বিগুণ শক্তিতে ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওরা তখন ফুঁসে ওঠার ভয়ে আমার কোমরে পেঁচিয়ে রাখা দড়িগুলো একটা একটা করে খুলে ফেলে। সেই ভারতের বাসিন্দাকে দেখে আজ তুই ভয় পাচ্ছিস? আমি না তোর বাল্যবন্ধু? আর দেরি নয়। জহিরুদ্দি লোক গুছিয়ে প্রস্তুতি নেয় ওদের ধাওয়া করার। পাশাপাশি বসত হওয়ার সুবাদে জহিরুদ্দির ভাইবউ বুঝতে পারে ওদের, হাতের নাগালে পেলে দু’জনকেই খুন করবে। এমন সময়ে বুড়ি কিসিমের এক মহিলা ফুলতলা থেকে মাছ কিনতে আসে জহিরুদ্দির ভাইয়ের বাড়িতে। জহিরুদ্দি সব সময় নদীতে মাছ বেশি পায়। শুধু এই কারণে ভাই বউয়ের গা-জ্বালা করে। বুড়িকে পেয়ে শরীরের জ্বলন নিবৃত্ত করার একটা সুযোগ পেয়ে গেলো। কানে কানে বলে, আলতাকে দেখতে পেলে বোলো, আমার ভাসুর দলবল নিয়ে আসছে। ওরা যেন জান নিয়ে পালিয়ে যায়। জহিরুদ্দি পাঁচ, ছয়জন ছেলে ছোকরা নিয়ে ফুলতলার গোপন আস্তানায় হাজির। কিন্তু একি! কোথায় আলতাবানু আর কোথায় মাসুদ? অদৃশ্য হয়ে গেল কোথায় ওরা? বাড়ি এসে জহিরুদ্দি পরিকল্পনা করে কিভাবে ওদের ধরা যায়। ওর বন্ধুদের কাজলা-বিনোদপুর-তালাইমারী-আমজাদের মোড়-মির্জাপুর-বউবাজার-সুরাফানের মোড় সবখানেই গোয়েন্দার মত অনুসন্ধানে ছড়িয়ে দেয়। কাউকে কাউকে ফোন করেও জানিয়ে দেয়। কিন্তু মতিহার থানায় কেন বললো না জহিরুদ্দি সেটায় এক রহস্য।
একদিন পরে বল্টু জহিরুদ্দিকে ফোন দেয়, বন্ধু, আমাদের পাড়ায় তোর বউ আর খালাতো শালাকে দেখলাম। গোলেজানের ঘরে ভাড়া থাকে। যদি তুই দ্রুত আসিস বিয়েটা ঠেকানো যাবে। জহিরুদ্দি বলে, এতকিছু জানলি কিভাবে? বল্টু বলে, বন্ধু তোর কথামত আমার এক চেলাকে ফিট করেছিলাম। বউবাজার থেকে এই মেয়েটা বাজার করে কোন বাড়িতে ঢুকে তুই দেখ। ও আমাকে ঠিক ঠিক সন্ধান দেয়। গোলেজান বেওয়ার বাড়িতে এখন ওরা থাকে। তবে তোর খালাতো শ্যালক দিনে খুব একটা বাড়িতে থাকে না। ভ্যান লিয়ে কামে যায়।
পরের দিন সকালে জহিরুদ্দি ওর দল নিয়ে হাজির মির্জাপুর বউবাজারে। কিন্তু এখানেও ওদের ধরা গেলো না। বল্টুকে চোখ দিয়ে চাবিয়ে খাবে জহিরুদ্দি, এমন সময় বল্টু বলে, কিভাবে যে ওরা টের পেয়েছে ঝুজাকি থাকতেই (খুব ভোরে) কোথায় যেন চলে গেছে। রাতেও ওরা এ বাড়িতে ছিল আমি শিওর। এরপর বল্টু ফুড়ুৎ। নেশাখোর লোক এই আছে এই নেই। এদিকে বউবাজারের চা-দোকানদার কেরামত জহিরুদ্দিকে ইশারায় কাছে ডাকে। জহিরুদ্দি এগিয়ে গেলে বলে, শোনো ভাই, আসল খবর তো আমার কাছে। তোমার বন্ধু বল্টু, ঐ শালা তো আস্ত একটা হারামি। অধের কাছে টাকা পেয়ে ও নিজেই অধেরকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আসে। হ্যাঁ, কাম পাওনি, শিয়ালকে মুরগি জোগাইতে দিয়্যাছো। জহিরুদ্দি ভাবে, ঠিক-ই তো বড় মারাত্মত ভুল হয়েছে!
জহিরুদ্দির পাশের বাড়ি রবু শেখ। তরমুজের ব্যবসা করে। এই রবু শেখ আফাজকে জানায়, তোর বউকে দেখলাম নাটোর রেল স্টেশনে। জহিরুদ্দি মনে মনে ভাবে, নাটোর তেবাড়িয়া হাটের পাশে আলতার এক চাচার বাড়ি আছে। ওরা নিশ্চয় ওখানেই গেছে। জহিরুদ্দি এবার আর কালক্ষেপণ না করে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে নাটোর। ওর একটায় এরাদা। ও শুধু আলতাকে পাওয়ার জন্য এতো ছোটাছুটি করছে না। ও সরাসরি জহিরুদ্দির চোখে চোখ রেখে বলুক স্বামী হিসেবে সে তাকে চায় না। আর ওর দোষটা কী এটা ওকে নিজ মুখে বলতে হবে। তারপর ও চলে গেলেও কোনো আপত্তি করবে না।
নাটোর পৌঁছে জহিরুদ্দির মনটা বিষাদে তেতো হয়ে উঠলো। চাচা শ্বশুর সব শুনে বলে, না বাবা, বিশ্বাস করো, আলতা আমাদের এখানে আসেনি। ও ভুল করলে তো আমরা করতে পারি না। তোমার দুটো সন্তান আছে আমি চাই না তোমার সংসারটা নষ্ট হোক। বরং যদি এখানে আসে, আমি কথা দিচ্ছি, ওকে যে করেই হোক বুঝিয়ে তোমার সংসারে ফিরিয়ে দেবো।
বিশ্বস্ত শরীরে জহিরুদ্দি এবার হতাশ হয়ে ফিরে আসে জাহাজঘাট। বাড়ি এসে পদ্মার কিনারে বসে ভাবে, আর সে আলতার খোঁজে কোথাও যাবে না। দিন দুই পরে মির্জাপুর বউবাজারে চা-দোকানদার কেরামত ফোন দেয় জহিরুদ্দিকে। বলে, আজ রাত আটটার সময় তোমর বউ অটো থেকে নামলো মির্জাপুর পুলিশ ফাঁড়ির সামনে, জহিরুদ্দি নিয়ত করেছিলো, সে আর ছুটবে না অদৃশ্য মরীচিকার পেছনে। কিন্তু খবর পেয়ে ওর, সারারাত ঘুম আসে না। বহু চেষ্টা করেও বশে আসে না মন। সকালবেলা জহিরুদ্দি কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে চলে আসে গোলেজান বেওয়ার বাড়িতে। কিন্তু এবারও বিধিবাম। কাউকেও পাওয়া গেল না। গোলেজান বলে ওরা তো বাবা এখানে থাকে না। এসেছিল শুধু ওদের রেখে যাওয়া কিছু জিনিস নেওয়ার জন্য।
জহিরুদ্দি বুকে পাথর চাপা দিয়ে ফিরে আসে বাড়িতে। নিত্য দিনের আলতামাখা স্মৃতিগুলো বারবার ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে। হঠাৎ ফোন আসে ওর মামাতো ভাই আলফাজের। বলে, তোর আলতা এখন ইউসুফপুরে। ওরা রাতারাতি চলে এসেছে এখানে। কাল হয়তো ওপারে পালিয়ে যেতে পারে। এরপর জহিরুদ্দি তিনজন মাছমারা সহযোগী নিয়ে পৌঁছে যায় ইউসুফপুর। সে দৌড়াতে থাকে। দুটো ছেলে-মেয়ে সামনে দেখতে পেয়ে দ্রুত ধাওয়া করে। কিন্তু কাছে দিয়ে দেখে, না, ওরা অন্য কেউ। আবার দৌড়। এক সময় পৌঁছে যায় ঘাটে। জহিরুদ্দি ঘাটের মাঝিকে পুরো বিবরণ দেয় এমন এমন দুটো ছেলেমেয়ে আজকি ঘাট পেরিয়েছে? মাঝি বলে, এখন থেকে চল্লিশ মিনিট আগে ওরা ঘাট পেরিয়ে ওপারে পৌঁছে গেছে। মেয়েটা বললো-ওরা কাতলামারী গ্রামে যাবে। কাতলামারী গ্রাম শুনে জহিরুদ্দির ভেতরটা আর্তনাদ করে উঠে! অস্ফুটে উচ্চারিত হয় এবারও ফসকে গেল? তবে যতই ফসকে যাক ওর ভেতরের ওয়াদাটা কখনও ফসকে যেতে দেবে না। প্রতীক্ষায় থাকে কোন এক সময় অর্থাৎ যখনই মাসুদ বাংলাদেশে আসবে প্রতিশোধ নেবেই। এরপর জহিরুদ্দি এগারোটি বছর এমনিভাবে সঙ্গীবিহীন পার করে দেয় এক ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে। আবার সে বাইরের সব কাজ বাদ দিয়ে পদ্মা নদীকে জীবনের সঙ্গী হিসেবে বেছে নেয়। সেই থেকে আলতাবিহীন শূন্যঘরে আর কখনও শুতে যায়নি। নদীর সমস্ত প্রকার বিভীষিকাময় অনাকাঙ্ক্ষিত ভয়কে উপেক্ষা করে রাত কাটায় টঙঘরে। জীবনের লম্বা সময়গুলো পার করে নদীতে মাছ ধরে, ব্লকের ডাগর লাউগাছ লাগিয়ে, আর নদীর কিনার ঘেঁষা ডেরা বানিয়ে রাজহাঁস পালন করে।
নদীর পানে, নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধু ফরিয়াদ জানায়, স্ত্রীর শঙ্খিনী আচরণের জন্য। এই এগারো বছরে কত তন্বী-তরুণী প্রত্যেককে তাড়িয়ে দিয়েছে দূর দূর করে। বড় মেয়েটা কতবার বলেছে বাবা আমি চলে গেলে কে তোমায় রেঁধে দেবে? বয়স বাড়ছে তোমার দেখাশুনার একজন মানুষতো লাগবেই, নাকি? প্রতিবার-ই জহিরুদ্দি নির্বাক! শুধু পদ্মার দিকে হা-হা শূন্যতায় তাকিয়ে অদৃশ্য কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করে। এই তাকিয়ে থাকার মানে কি এখনও সে প্রত্যাশা করে আলতাবানু কোনো একদিন তার জীবনে ফিরে আসবে? জীবন তো একটাই, তবে কেন সে তিলতিল করে নিজেকে নিঃস্ব করে দিচ্ছে? এতদিন পরেও কি সে স্ত্রীকে এখনও ভালোবাসে?
বড় মেয়েটাকে অনেক কষ্টে একটা ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দেয়। জামায় চাকরি করে বোল্ডস্টোরে। এক সময় ছেলেটাও বউ নিয়ে আলাদা হবে। সব কিছু ভেবেই জহিরুদ্দি এই টঙঘরে একা থাকে। তবে একা বললে ভুল হবে, অনেক রাত অবধি সে কথা বলে পদ্মার সঙ্গে। এগারো বছর পর আলতাবানু পা রাখে বাংলাদেশের মাটিতে। মা’য়ের অসুখ। মা’কে দেখার জন্যই আসা। সঙ্গে মাসুদও এসেছে। মাসুদ কি তাহলে এসেছে স্ত্রীকে পাহারা দেয়ার জন্য? এতো বছর পর স্ত্রী সম্পর্কে এমন ভয় কি কারও থাকার কথা? তা ছাড়া এতো দিনের পুরনো কথা আজ মনে রাখার নয়, শুধুই স্মৃতি।
আলতা-মাসুদ দেশে এসেছে, কথাটা কেমন করে যেন জহিরুদ্দির কানে আসে। তবে বড় রকমের কোন প্রতিক্রিয়া বোঝা যায় না। বিকেলে জাল নিয়ে বেরোই জহিরুদ্দি। অনেক দিন পর ফুলতলার ঘাট বরাবর নদীতে নামে। জাল ফেলে নৌকাটা ছেলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ওপরে উঠে আসে। বড়ই তলায় এসে দাঁড়িয়েছে। এমন সময় ওর সামনের দৃশ্য দেখে বিস্ময়ে চমকে ওঠে! আলতা আর মাসুদ ওর সামনে। এই দিনটাকেই জহিরুদ্দি মনে মনে এগারো বছর ধরে চাইছিল।
এদিকে ভেতর ভেতর শরীরে কম্পন ওঠে মাসুদের। তবে সাহসে ভর দাঁড়িয়ে থাকে, যেহেতু ওর সঙ্গে আলতা আছে। মাসুদ পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে জহিরুদ্দি বলে, দাঁড়াও। কোথায় যাচ্ছো? বলেছিলাম না, শেষ দেখাটা একদিন হবে। তুই সুখে ছিলি, আর আমাকে তুষের আগুনে জ্বালিয়েছিস। আমার পিপাষার্ত হৃদয়ের কষ্টের সাধটা গ্রহণ করবি না। আমি তো সেদিন-ই মরে যেতাম, কিন্তু কেন বেঁচে আছি জানিস? আজকের এই দিনটির প্রতীক্ষায়।
এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। সিঁদুরে লাল সূর্যটা ধীরে ধীরে নদীর পানিতে তলিয়ে যায়। কয়েকটা হাঁস ওদের মাথার ওপরে চক্রাকারে ওড়াউড়ি করছে। আলতাবানু ভয়ে ভয়ে বলে, রাস্তায় কথা না বলে, কোথাও বসে বললে ভালো হয় না? জহিরুদ্দি সে কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে কোমরে হাত চালায়। চকচকে ছুরিটা উঠে আসে ওর হাতে। এমন সময় আলতার মুঠোফোনে কল আসে। ঠিক সেই সময় ধারালো ছুরির তীক্ষè ফলাটা সাঁই করে ঢুকে যায় মাসুদের ডান পাঁজরে।
আলতাবানু ফোন রেখে সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এটা তুমি কী করলা? জহিরুদ্দি বলে, এগারো বছর আগে যেটা করার ছিলো- আজ সেটায় করলাম। কিছুক্ষণ নির্বাক থাকার পর আলতাবানু বলে, তুমি দাঁড়িয়ে এখনও কী করছো? তাড়াতাড়ি পালাও। – না আমার আর একটা কাজ আছে তোমার কাছে। সে দিন আমার কী অপরাধ ছিলো- বলো?
সে সব পরে হবে। এখন তুমি পালাও। হয় তো পুলিশ ও এসে পড়বে। এই বলে আলতাবানু খুব দ্রুত মাসুদের রক্তঝরা পেট থেকে ছুরিটা বের করে হাতে নেয়। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে ঝাঁকে ঝাঁকে লোক এসে জড়ো হয়। গোল হয়ে অসংখ্য মানুষের জটলা, ভিড় ঠেলে কয়েকজন উৎসুক জনতা জানতে চায়- খুন কে করলো? জহিরুদ্দিন বলে আমি করেছি। রক্তমাখা ছোরা হাতে নিয়ে আলতাবানু বলে, না, খুন আমি করেছি। আমাকে পুলিশের কাছে নিয়ে চলুন। এই দেখুন, অস্ত্রটা এখনও আমার হাতেই রয়ে গেছে। জনতার ভেতর থেকে একজন বলে, আপনাকে দেখে তো মনে হয় না আপনি খুন করেছেন। – মানুষের বাইরের কী সব? খুন আমি একটা নয়, দু’দুটো করেছি, আজ থেকে এগারো বছর আগে একটা জাহাজঘাটে, আর আজ, এখন, এই মুহূর্তে করলাম-ফুলতলায়। জহিরুদ্দি শুধু হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে-ঘামে জবুথবু আলতাবরণ মুখখানার দিকে।