আহাদ মিয়া গত কয়েকটা রাত একদমই ঘুমাতে পারছে না। কেন তিনি নিরবচ্ছিন্ন ঘুমাতে পারছে না। এর কারণটা ঠিকঠাক ধরতেও পারছে না। কখনও গভীর রাতে স্বভাবগতভাবেই চোখটা ক্লান্তিতে বুজে আসতে চাইলেও কোনো এক অজানা আতঙ্কে ছটফট করে বিছানা ছেড়ে নেমে পড়ে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখে উঠানের এক কোণে নারকেল গাছের পাতারা বাতাসের সঙ্গে কেমন মাখামাখি করছে সেটা দেখে ভেতরের উত্তেজনাকে চেপে।
পুরো বাড়িটা ঘুমে নিস্তব্ধ। শুধু এই বাড়ি কেন, সব গ্রামের সব মানুষও এখন এই গভীর রাতে ঘুমের অতলে। গোয়ালের গরু, খোঁয়াড়ের মুরগি, খোপের কবুতর-সব প্রাণীই ঘুমাচ্ছে। শুধু আহাদ মিয়া পারছে না ঘুমাতে। দুটো চোখ জ্বলে যাচ্ছে নির্ঘুমে।
আরও একটা প্রাণী ঘুমাচ্ছে না। এই গ্রামেরই বাসিন্দা সে। সে সড়কে বসে কেঁদেই চলছে। ইদানীং প্রতিরাতেই সে কেঁদে চলে। তার অঘুমা কান্দারোগ হয়েছে। আগে গ্রামের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত দৌড়ে পাহারা দিত। আর এখন সড়কে বসে বসে কাঁদে।
মধ্যরাতে যখন কুকুরটা কাঁদতে বসে গেল এতদিনের ঘুম না আসার কারণটা স্পষ্ট হলো। কুকুরের কান্নার আতঙ্কই তাহলে আহাদ মিয়ার ঘুমকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। ছোটবেলায় দাদি আর মায়ের কাছে শুনেছে, গভীর রাতে কুকুরের কান্না নাকি অমঙ্গল ডেকে আনে। দুঃসংবাদের পূর্বাভাস কুকুরের কান্না। সময়ের মঙ্গল অমঙ্গল নাকি কুকুরই আগে বুঝতে পারে। হতে পারে আল্লাহ কার ভেতরে কোনো ইন্দ্রিয় শক্তি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, তিনিই ভালো বলতে পারেন। তিনি অসীম, মনুষ্যজ্ঞান তো সসীম।
কুকুরটা আবার কাঁদছে। এত বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে যে ভেতরটা অজানা আতঙ্কে কেঁপে উঠছে। মনে পড়ে যায় দাদীর চেহারাÑএকাত্তরেও বেশ শক্তসামর্থ্য ছিলেন। একদিন সন্ধ্যায় খেলার মাঠ থেকে ফিরে আহাদ, কতই-বা বয়স হবে ওর। এসএসসি পরীক্ষার টেস্ট দেয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে উঠোনের এক কোণে লাউয়ের মাচার কাছে দাঁড়িয়ে দাদি আর মা কী যেন বলাবলি করছে। এগিয়ে যায় নেহাত কৌতূহলে।
হ গো বউ, আমিও তো হুনতাছি। কয়দিন ধইরা কুত্তাডা নিশে রাইতে কান্দে।
হ মা, হ্যার কান্দন হুইনা বুকের ভেতরটা কাঁইপা ওঠে।
কুত্তার কান্দন ভালা না। হে আগাম বুঝবার পারে; বুঝলা বউ, কপালে যে কী আছে ক্যারা জানে।
আমি তো আপনার বড় পোলা আর বড় নাতিরে নিয়া চিন্তা করি। দেহেন হেগো ভাবসাব। স্কুলের মাঠে বেবাকের লগে কী যে প্যাঁচাল পারে। আবার কুত্তাডাও বিনাইয়া বিনাইয়া কান্দে।
আহাদ হাসতে হাসতে দাদিকে জড়িয়ে ধরে।
দাদি তোমার কুত্তাও কি ইয়াহিয়া হইয়া গেছে। দ্যাশে কী ঘটব, তা লইয়া ভুট্টোর লগে আলাপ করতাছে। বাঙালিগো আড়াল কইরা তাদের এই আলাপ।
রাখ ইয়াহিয়া গো কতা। হেরা তো কুত্তারও অধম তিনডাইÑইয়াহিয়া, টিক্কা আর ভুট্টো।
আহাদ অবাক হয়ে তার নিরক্ষর রাজনীতি-অজ্ঞ দাদির দিকে তাকিয়ে থাকে। এই কয়দিনে বাবা আর ওর কাছ থেকে শুনে শুনে দাদিও দেশের অবস্থা বুঝতে শিখে গেছে। ওরা নিজেরাই তো শহরে কলেজ পড়–য়া বড়ভাইদের কাছ থেকে যা শোনে, তাই বোঝে। তাহলে রাজনীতি বোঝার জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন হলো নিজের ভেতরে দেশের জন্য ভালোবাসা জন্ম দেয়া। দেশের সার্বিক অবস্থা তো মনে হয় দিন দিন জটিলই হচ্ছে।
আবার কাঁদছে কুকুরটা। আহাদ মিয়ার বুকটা আবারও কেঁপে ওঠে। অচেনা আশঙ্কায়। ’৭১ দাদির বুকটাও কি এমন ভয়াবহ আতঙ্কে কেঁপে উঠত। তখন এই বাড়িটা ছিল বিশাল সীমানা নিয়ে। চাচা-ফুফুরা সবাই বেঁচে ছিল। এক হাঁড়িতে রান্না হতো সবার জন্য। বাড়ি গিজগিজ করত মানুষজনে। সত্তর সাল পর্যন্ত আহাদ তো কিশোরই ছিল। গ্রামের স্কুলের মাঠে কলেজপড়–য়া বড়ভাইদের কথা শুনে শুনে তাদের কর্মকান্ডে সহযোগিতা করতে করতে নিজের অজান্তে বড় হয়ে গিয়েছিল। তারপর তো কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমান তালে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে তাদেরই একজন হয়ে গিয়েছিল আহাদ। বিজয়ও নিয়ে এলো ছিনিয়ে। লাল-সবুজ পতাকার মালিক হলো বাঙালিরা।
আজ ওর বয়সী একজনও বেঁচে নাই এই গ্রামে। কেউ হয়ত শহরে গিয়ে বসবাস করছে। বিদেশেও চলে গেছে কেউ কেউ। কিন্তু গ্রামের জীবিত সবচেয়ে বেশি বয়স্ক মানুষটিই হলো আহাদ।
রাজধানীর কাছেই ওদের গ্রাম। বাপ-দাদার আমলে নৌকা দিয়ে নদীর পার হয়ে হেঁটে বাসস্ট্যান্ড অবধি পৌঁছে বাস ধরে চলে যেত শহরে। এখন নদীর ওপর সেতু তৈরি হয়েছে। গ্রাম বরাবর পাকা সড়ক হয়েছে। লাইন ধরে ঘরে ঘরে বিদ্যুতের খুঁটি দেয়া হয়েছে। ঘরে জ্বলছে আলো। চলছে ফ্রিজ, টেলিভিশন। ঘুরছে পাখা।
আগে এই গ্রামে শুধু একটা হাইস্কুল ছিল। ওরা সবাই এমপি সাহেবকে দিয়ে একটা কলেজও তৈরি করেছে। দশ গ্রামের ছেলেমেয়ে পড়তে আসে হাইস্কুলে ও কলেজে। ওদের পদচারণায় সকাল থেকে প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত মুখরিত গ্রাম। আগের রূপে না থাকলেও শ্যামল রূপে এখন যোগ হয়েছে অলঙ্কারের মতো অনেক সৌন্দর্য উপকরণ। স্কুলের মাঠের কোণে প্রতিদিন ভোর থেকে বেলা দশটা পর্যন্ত বাজার বসে। নদীর তাজা মাছ, মাচার লাউ, সবজি, গরুর দুধÑসবকিছুই মেলে। বাড়ির বউ-ঝিরা অটো করে পাশের শহরে গিয়ে নিজেদের পছন্দ মতো শাড়ি গহনা কসমেটিকস্ কিনে আনে। সব মিলে ওদের গ্রামীণজীবনে শহরের হাওয়া ঢুকে গেছে।
গ্রামের প্রধান সড়ক দিয়ে প্রতিদিনই হাঁটতে হাঁটতে শহরে চলে যায় আহাদ মিয়া। প্রতিবারই গ্রামের সীমানা অতিক্রম করার সময় হঠাৎ তার শরীরটায় একটা গরম হাওয়া ছুঁয়ে যায়। এতক্ষণের চেনা সুবাসটাও তিনি পান না। অচেনা গন্ধ শুঁকেই শহর অবধি হাঁটতে থাকেন। আবার ফিরতে শুরু করেন। গ্রামের চেনা সুবাস আর সুশীতল বাতাস ফুসফুসকে তাজা করেই ঘরে ফেরেন ঘাম ঝরাতে ঝরাতে।
প্রতিদিন ভোরেই ঘুম থেকে ওঠে। দুচোখ ভরে গ্রাম দেখেন। এই বয়সী চোখজোড়া কিনা দেখল! কত পরিবর্তন হলো এই দেশের। বদলে গেল ভূগোল। ইতিহাসও বদলাল কেউ কেউ। রাজনীতির ব্যাকরণ বদলাতে দেখলেন তিনি। অতকিছু নিয়ে তিনি ভাবেন না। তিনি নগণ্য একজন মানুষ। কী করতে পারেন রাজনীতির এত বড় বড় সমস্যার। একবার প্রয়োজন হয়েছিল বলে বুক চিতিয়ে অস্ত্রের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দেশ তার মা। মায়ের জন্য জান দিতেও পিছপা হননি সেদিন।
একাত্তরের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল আহাদ পরিবারের বড় ছেলে, কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি সেদিন আহাদের সিদ্ধান্তের কাছে। ছিনিয়ে এনেছিলেন বিজয় পতাকা।
স্বাধীনতার পর পরীক্ষা দিয়ে পাসও করেছিলেন। এমপি সাহেব ওকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে বলেন।
দাদার ছিল প্রচুর ধানিজমি। জন্মেও কোনোদিন সংসারের অভাব অনটন দেখেননি। এই চাকরিটা করবে কি না ভাবতে ভাবতেই ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ফেলেন। এবার কোনো চিন্তাভাবনা না করেই যোগ দেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তারপর বিএ পাস করলেন। পিটিআই ট্রেনিংও সমাপ্ত করলেন। দাদির পছন্দমতো পাত্রীকেই ঘরে তুলে আনেন।
এবার একান্নবর্তী সংসারে ভাগাভাগির ঝড় ওঠে। দাদার বিশাল সম্পত্তি ভাগ হয়ে যায় ছয় পুত্র আর দুইকন্যার মধ্যে। সম্পত্তি ভাগাভাগি হলেও সম্পর্কের ঐক্য ধরে রেখেছিলেন বাবা শক্ত হাতে। প্রয়োজনে হাঁড়ি আলাদা হয়েছে। সম্পর্ক আলাদা হওয়া একদমই অপ্রয়োজনীয়। ভাইবোন মেনে নিয়েছিল বড়ভাইয়ের কড়া নির্দেশ। বাবার দায়িত্ব এখন পালন করছে আহাদ মিয়া। তবে তেমন শাসালোভাবে নয়; বেশ ভঙ্গুর অবস্থায়। বাবার প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। সবাই ছিল একই মায়ের পেটের ভাইবোন। দীর্ঘকাল একই হাঁড়ির ভাত খেয়েছে। এক ঘরে ঘুমিয়েছে।
আহাদ মিয়ার চাচাতো, ফুফাতো ভাইবোন প্রায় ত্রিশজন। তাদের বেশির ভাগই উচ্চশিক্ষিত। দেশ- বিদেশে বড় বড় চাকরি করে। গ্রামে যারা বসবাস করে, তারা কেউ ব্যবসা করে, কেউ স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। প্রমোশন পেয়ে আহাদ মিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হয়েছিলেন বটে। তবে নিজেকে দেশ-বিদেশে ছড়ানো উচ্চশিক্ষিত পরিবারের প্রধান হওয়ার যোগ্য মনে করেননি। অবশ্য পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে তাকে সবাই মান্য করে। গ্রামীণ সমস্যার সমাধানেও সবাই তার কাছে আসে। গভীর বোধ-বিবেচনায় সেগুলো যথাযথ সমাধানও তিনি করেন। এইটুকুই তো আহাদ মিয়ার পরিবার থেকে পাওনা।
এক কথায় দাপুটে বাবার মতো শক্ত হাতে পরিবারকে ঐক্য ধরে রাখতে না পারলেও চেষ্টা তো করে যাচ্ছে। ঐক্য ক্ষয়ে গেলেও গ্রামের শিক্ষিত পরিবার হিসেবে এক নামে আহাদ মিয়াদের পরিবারকেই চেনে।
গ্রামে গোরস্থান, মসজিদ-মাদ্রাসা, মন্দির, শ্মশান, খেলার মাঠ, লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠায় আহাদ মিয়ার বেশ ভূমিকা ছিল।
কয়েক বছর আগে পাশের গ্রামের খোলা ফসলের ক্ষেতে বড় বড় হাউজিং কোম্পানি বড় বড় সাইন বোর্ড লাগানোর খুঁটি বসাতে জমি ভাড়া নেয়। হঠাৎ একদিন বড় বড় গাড়ি এসে বেশ কয়েকটি দরিদ্র পরিবার সরিয়ে দিয়ে ক্যাম্প বসায়। তারপর শুরু হয় নির্মাণকাজ। রাস্তা হচ্ছে বিদ্যুতের খুঁটি বসে যায়। পানি, গ্যাসের লাইনের কাজও শুরু হয়ে গেছে। এত আনন্দযজ্ঞের মধ্যে গরিব মানুষগুলো নিঃস্ব হয়ে গেছে। কেউ কেউ গ্রামে উ™£ান্তের মত ছুটে বেড়ায়। করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ওদের খোয়ানো জায়গায় বড় বড় তৈরি হতে যাওয়া বিল্ডিংগুলোর দিকে।
ইদানীং আহাদ মিয়া গ্রামের হাওয়া ঠিকঠাক বুঝতে পারে না। আজও আনমনে হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের শেষ মাথায় দাঁড়ায়। গত পনেরো দিন সর্দি জ্বরে কাবু হয়ে ঘরেই পড়েছিল।
সকালে জ্বরটা শরীর থেকে পালিয়েছে। তাই বিকালের খোলা হাওয়ায় হাঁটতে বেরিয়েছে। এই কয়েক দিনেই চেনা গ্রামটা কেমন যেন নতুন অচেনা হাওয়া লেগেছে। সড়কসংলগ্ন নিচু জমিটায় মাটি ফেলে সড়ক সমান উচ্চতায় এনে তুলেছে। তাতে সড়কটাকে বেশ ছড়ানো লাগছে। বেশ বড় বড় জমি, অনেক ধান হয় ওই জমিতে। মাটি ফেলে উঁচু করা হলো কেন বুঝতে পারে না। জমিটা তো কেয়ামত খাঁয়ের।
এগিয়ে যায়। সন্ধ্যার মুখে কাজ সম্পন্ন করে দিনমজুর কর্মস্থল ত্যাগ করেছে। আহাদ মিয়া নতুন মাটিতে পা ফেলে ফেলে এগিয়ে যায়, দিনমজুররা সারা দিন কায়িক শ্রম করে এখন ক্লান্ত অবসন্ন ক্ষুধার্ত। এক বয়সী লোক দাঁড়ায় আহাদ মিয়ার ডাকে। ওর কাছেই জানতে পারে এই জায়গায় মার্কেট তৈরি হবে। তার জন্য মাটি ভরাট হচ্ছে।
দিনমজুররা গেছে অনেকক্ষণ। তবুও দাঁড়িয়ে থাকে আহাদ মিয়া। মার্কেট তৈরি করবে কেয়ামত খাঁ। মার্কেটের বিল্ডিং তৈরি করার জন্যই তো অনেক টাকার প্রয়োজন। এত টাকা কোথায় পেল। সর্বসাকুল্যে জমিই তো এটুকুনই। ভিটা-বাড়িরও জীর্ণদশা। মোট কথাÑ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা।
মসজিদে আজান হচ্ছে। আর দাঁড়ায় না, পা চালিয়ে হেঁটে না গেলে জামাত ধরতে পারবে না। মাগরেবের নামাজ শেষ করে বেশ খানিকটা সময় মসজিদেই কাটায় আহাদ মিয়া। একেবারে এশার নামাজ শেষ করে বাড়ি ফেরে। মাঝখানে উঠে সামনের চায়ের দোকান থেকে এককাপ লাল চায়ে চুমুক দেয়। চায়ের তেষ্টা প্রবল হতেই উঠে পড়ে, হাতের তজবিহটা পকেটে পুরে।
চায়ের দোকানে দেখা হয় কেয়ামত খাঁয়ের সঙ্গে। চেনাই যাচ্ছে না। প্রায় নতুন পরিষ্কার কাপড় পরা। বেশ কায়দা করেই পরেছে। জবজবে তেলভর্তি চুলে বাহারি সিঁথি কেটেছে। আহাদ মিয়ার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই বেশ লাজুক ভঙ্গিতে চোখ সরিয়ে নেয়। আহাদ মিয়াই এগিয়ে যায়।
কেমন আছ গো খাঁয়ের পো?
দাঁতে-জিভে গোঁফ আটকে জবাব দিল। ভালো করে বুঝতেই পারল না আহাদ মিয়া। দ্বিতীয় কথা জিজ্ঞেস করার আগেই লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে যায়। চা-বিক্রেতা এতক্ষণে মুখ খোলে।
চাচা মিয়া, দেখছেন কেমন ঘাট অঘাট হইতাছে, অঘাট ঘাট হইতাছে। দুনিয়ার নিয়মই তো এইটা।
কেন কী হইছে রে। এই কথা কস ক্যান।
আমাগো কেয়ামইতারে দেহেন। দুদিন আগেও চায়ের খালি কাপটা ফেরত দিত, লগে পয়সা দিবার পারত না। আর অহন দিনের মইদ্যে কতবার চা বানাই হ্যার লিগা। নতুন পাঞ্জাবি পইরা কেমন করিয়া যে চায়ের কাপে চুমুক দেয়, দেখলে চাচা কইবেন কী!
তুই দামটা ঠিকমতো পাইতাছস কি না হেইডা ক। অত কথার কাম কী তর।
হ চাচা অগ্রিম দাম দিয়া রাখছে সে। বড় বড় দুইটা নোট।
কস কী, অগ্রিম দাম!
বাড়িতে দালানও তুলব। এক্কেবারে আসমান ছুঁইয়া।
মার্কেটও তো করব শুনলাম।
বেশ ভালোই তো।
চাচা, বেশ বেশ সাব্বাস কইয়েন না। গেরামে তো হে …বলেই চুপ হয়ে যায়।
শুনতেই হয়। একটু চেপে ধরতেই সব বলে দেয় বিশেষ বাহিনীর বাসস্থানের জন্য জমি দরকার। কেউ একজন বড় অফিসারকে দায়িত্ব দিয়েছে। সেই যোগাযোগ করছে কেয়ামত খাঁয়ের সঙ্গে। টাকাপয়সাও দিয়েছে কিছু। কেয়ামত গ্রামের দরিদ্র লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটিয়ে দিয়েছে।
এবার কেয়ামত খাঁয়ের মার্কেট আর বারোতলা বাসস্থানের রহস্য ভেদ হয়ে যায় আহাদ মিয়ার কাছে। বেশ বড় বড় কয়েকটা চিন্তার ভাঁজ পড়ে কপালে।
এশার নামাজের পর গ্রামের কয়েক জন মুরুব্বির কানে কথাটা তোলে। সবাই কানাঘুষা শুনছে কিন্তু বিষয়টা এত দূর এগিয়েছে ভেবে দেখেনি কেউ। ঠিক আছে দেখবে সবাই মিলেই।
আহাদ মিয়া কেয়ামত খাঁয়ের বাড়িতে যায়। কেয়ামতের উঠোনে চকচকে দুটো ঘর ঝকঝক করছে। ঘরে ঢুকে তো চোখ ভড়কে যায়। দামি দামি আসবাবপত্র, বিছানায় নতুন চাদর। বেশ শান-শওকতেই আছে।
বিষয়টা খুইলা ক তো দেখি।
কেন, কী কমু? আমে প্যাড ভইরা মাছ দিয়া ভাত খাইতাছি, হেইডা সইবার পারতাছেন না। বুইড়া হইয়া গেছেন, এক পাও কবরে। অহন অত দেহাদেহির কী আছে। মসজিদে যাইবেন। নামাজ পড়বেন। বাড়িতে গিয়া খাইয়া ঘুমাইবেন।
কেয়ামতের গলার আওয়াজ এত উঁচু কেন? কাকে কী বলছে? কেন বলছে?
বুঝে বলছে তো! নাকি টাকার গরম গলায় বাসা বেঁধেছে। এই ভাবনার মধ্যেই কেয়ামতের মা ঘরে ঢোকে।
কি গো মিয়ার বেডা তুমিও কি জমি দিতাছ নাকি? হ্যারা তো কয় বেকেরই বুইলে দালান তুইলা দিব। এক্কেবারে বিদ্যাশ হইয়া যাইব আমাগো গেরাম। মেলা মানুষ তো আহে কেয়ামতের কাছে।
চোখ দুটো লাল করে মায়ের সামনে দাঁড়ায়। টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় ভেতরে। উহ-আহ শব্দ শুনতে শুনতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে আহাদ মিয়া। আহারে বুড়িটা যে আজ কী অবস্থা হবে, কে জানে? যেটুকু তথ্য বুড়ি দিয়েছে সেটুকুই অনেক।
আহাদ রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ায়। কী করবে এখন। গ্রামের কেউ কেউ তো অবশ্যই যোগ দিয়েছে। কেয়ামতের শক্তি যে বেশ খানিকটা জোরালো হয়েছে, সেটা বুঝতে পারে। এই হাঙ্গরের পেট থেকে কিভাবে রক্ষা করবে ওদের সাত পুরুষের গ্রামকে। বিঘার পর বিঘা ফসলের মাঠ। কী চমৎকার ধান ফলে ওদের জমিতে।
এই ঊনষাট বছরের অনেকটাই নিস্তেজ শরীর। এই শরীর নিয়ে কিভাবে লড়বে বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে? কাল রাতেও কুকুরের কান্না শুনে আতঙ্কে সিটিয়ে ছিল। একাত্তরের এ কথা মনে ঝলসে ওঠে।
জোছনার আলোতে দু’হাত সামনে মেলে ধরে শীর্ণ বলহীন হাত দুটো। আবার চোখের মনিতে ঝলসে ওঠে জীবনের সোনালি সময়।
বাড়ি ফেলে এগিয়ে যায়। যাদের সঙ্গে মসজিদের প্রাঙ্গণে কথা হয়েছে তাদের বাড়িতে। সবার সঙ্গে কথা বলে বুকে বেশ কিছুটা আত্মবল পায়। কিন্তু মজিদ মিয়ার বিপরীত কথায় কিছুটা দমে গেলেও আবার নিজেই নিজের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনে।
নানা দুশ্চিন্তায় কেটে যায় রাত। মসজিদে ফজরের নামাজের শেষে আবার মিলিত হবার কথা। একটু আগেই মসজিদে যায়। নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বেরুচ্ছে তক্ষণি বাড়ির বারমাসি কামলা ছুটতে ছুটতে কাছে এসে দাঁড়ায়। ওর কাছে জানতে পারে কেয়ামত খাঁ দু-তিনজন পোশাক পরা লোকসহ বাড়িতে অপেক্ষা করছে। তার মানে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। যুদ্ধটা চাপিয়ে দিলো গ্রামবাসীর ওপর। দ্রুত নিজের কর্তব্য ঠিক করে ফেলে।
যা আসছি।
কামলা দৌড়ে চলে যায়। এই ফাঁকে নিজেও অন্যপথ ধরে। আজকের মধ্যেই সবাইকে সংগঠিত করতে হবে। পুরো গ্রাম ঘুরে ঘুরে বোঝাতে হবে বিষয়টার গুরুত্ব।
হাঁটছে আইল ভেঙে। কখনও পেছন বাড়ি দিয়ে কারও বাড়িতে ঢুকছে। কখনও সরাসরি পথেই। কথা বলছে ছোট বড় সবার সঙ্গে। এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি। এক মানুষ থেকে অন্য মানুষ। কেউ কেউ আতঙ্কে উঠে দাঁড়াতেই পারে না। এত বড় বাহিনী। যদি ঝড়ে বংশ শেষ করে দেয়। জমি নেয় নেবে। তবু ছেলেপুলে নিয়ে জীবনটা তো বাঁচবে। কী আছে ওদের! কী দিয়ে লড়বে এই বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে। বুড়োরা তো দাঁড়াতে গিয়েও বসে পড়ে। তরুণরা বেশির ভাগ বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় পাশে। কেউ কেউ ফ্ল্যাটবাড়ির আশায় কাত হয়ে বসে থাকে।
তরুণরা লাফ দিয়ে সামনে দাঁড়ায়। না, কিছুতেই ওরা ওদের গ্রামের একটু অংশও ছাড় দেবে না। ওরা পারবে। বিরোধীদের কাছে যদি মূল্যবান অস্ত্র থাকে তাহলে ওদের তো এই মূল্যহীন প্রাণটা আছে, তাই দিয়েই ওরা মরণপণ যুদ্ধ করবে। যুদ্ধ করেই ওরা ওদের সাত পুরুষের গ্রাম রক্ষা করবে। তবু তো প্রাণটা কোনো কাজে লাগল।
যা হোক, সারাটা দিন এমনই সব কথাই হয় সবার সঙ্গে। এর মধ্যে তিন-চারবার কেয়ামতের নম্বর ঢুকে যায় আহাদ মিয়ার মোবাইলে। ‘দেখা হবে, এখন ব্যস্ত আছি’ বলে কেটে দেয়। কেউ কেউ বলে সুইচ অফ করতে বলে। আহাদ মিয়া রাজি হয় না। অনেক রকমের ভাবনা ভেবে। ফোনে ব্যস্ত থাকলে অন্য কোনো সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধান্বি^ত হবে। কিছুটা হলেও সময় তো পার হবে এমন করে। আর নম্বর বন্ধ রাখা তো এক রকম পলায়নই। জীবন থাকতে আহাদ মিয়া পালাতে পারে না।
মাগরিবের আজান হয় মসজিদে। দীর্ঘকাল এক ওয়াক্ত নামাজ কাজা করেনি। গির্জার সামনে খোলা জায়গায় নামাজ আদায় করে নেয়। নামাজ শেষ করে বসে পড়ে। দেখে সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে হেঁটে আসছে তিন-চারজন যুবক। নড়েচড়ে বসে আহাদ মিয়া। কাছাকছি আসতেই বোঝা গেল ওরা আহাদের পক্ষেরই। পাক্কা খবর, আজ শেষরাতেই বিশেষ বাহিনী দখল নেবে গ্রামের জমি। যারা জমি বিক্রি করতে সম্মত হয়েছে, ওরা কালকেই জমি হস্তান্তর করবে।
ভেতরটা কেঁপে ওঠে আহাদ মিয়ার। একবার যদি গ্রামের একখন্ড জমি ওদের হাতে চলে যায়, তাহলে পাঁচ-দশ বছরের মধ্যে পুরো গ্রাম চলে যাবে ওদের দখলে। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে ওদের পূর্বপুরুষের সকল চিহ্ন। নিঃস্ব হয়ে যাবে গ্রামের মানুষ, পৃথিবী থেকে চিরকালের মতো হারিয়ে যাবে গ্রামের ঐতিহ্য। না, সেটা কোনোভাবেই হতে পারে না। হতে দেয়া যাবে না। তাহলে এই গ্রামের আলো হাওয়ায় বড় হওয়া আহাদ মিয়া বড় অকৃতজ্ঞ হয়ে মৃত্যুবরণ করবে। গ্রামের জন্মঋণ মাথায় নিয়েই যেতে হবে পরপারে।
পূর্বপাড়ার কাছাকাছি চলে আসে আহাদ মিয়া। এ পাড়া মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের বসবাস। ওদের নেতৃস্থানীয়দের সঙ্গে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে কথা বলে। একটু পর যোগ হয় পশ্চিমপাড়ার মুসলমান সম্প্রদায়, দক্ষিণ পাড়ার মুসলমানেরা। উত্তরপাড়ার খ্রিস্টান। মোটামুটি গ্রামের মধ্যে একতা গড়ে ওঠে। সবাই বসে পরিকল্পনা গুছিয়ে ফেলে।
এশার নামাজ আদায় করে নেতাই কর্মকারের ঘরে। এক পাশে নেতাইয়ের মায়ের পুজোর সরঞ্জাম। অন্যপাশে নেতাইয়ের ধোয়া কাচা ধুতি পেতে নামাজ আদায় করে নেয়। দীর্ঘক্ষণ দু’হাত তুলে মুনাজাতে নিমগ্ন থাকে।
নেতাইয়ের স্ত্রী রান্না করা খাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়ে পথে।
আজ রাতটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চারদিকে নজর রাখতে হচ্ছে। ওদের পরিকল্পনার একটা শুকনো পাতাও যেন মৃদু ঝড়োহাওয়ায় উড়ে কেয়ামত খাঁয়ের ঘরে গিয়ে না পড়ে। তাহলে সব ভন্ডুল হয়ে যাবে।
আহাদ মিয়ার পেছনে যোগ হচ্ছে এক-দুজন করে। ওদের দিকে তাকিয়েই আহাদ মিয়ার শরীরে জেগে ওঠে একাত্তর। সাতই মার্চের ভাষণ। গ্রেনেড, ব্রাশফায়ার, বেয়োনেট, এলএমজি।
জাহাজ মারার যুদ্ধের সেই স্বর্ণোজ্জ্বল সকালের কথা। গোসল করতে গিয়েছিল নদীতে। হঠাৎ দেখতে পায়, নদীতে ভাসছে একটা জাহাজ। শত্রুবাহিনীর জাহাজ এটা বুঝতে পারে। একটুও সময় নষ্ট না করে দৌড়ে যায় ওর কমান্ডারের কাছে। ওরা শুধু দেশপ্রেম আর বুদ্ধিকে সম্বল করেই ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রায় খালি হাতেই। পরাস্ত করে শত্রু বাহিনীকে। বিশাল জাহাজভর্তি অস্ত্র আসে ওদের হাতে। যুদ্ধে বড় কাজে লেগে ছিল সেগুলো।
স্কুল মাঠে জড়ো হলো সবাই। তিনটা ভাগ করে নেয় দলকে। একদল নদীর ঘাটে। আরেক দল রেলস্টেশনে, তিন নম্বর দলটা গ্রামে ঢোকার মুখে সড়কপথে।
মাথায় লাল গামছা বেঁধে মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়ায় তরুণরা, দাঁড়ায় গ্রামের সবচেয়ে বয়সী মানুষটার সঙ্গে। আহাদ মিয়া ঘাড় সোজা করে তাকায় তার বাহিনীর দিকে। শত শত মানুষ তার সামনে দাঁড়িয়ে। প্রশান্তিতে ভরে যায় মন।
রাত পোহাবার আর অল্প কিছুক্ষণ বাকি। একটু পরই লাল হয়ে সূর্য আসবে পৃথিবীতে। নতুন দিনের সূচনা হবে। আজানের শব্দ পাশ কাটিয়ে গাড়ির শব্দ উচ্চকিত হয়। সারি সারি গাড়ি ঢুকছে সড়কে।
টানটান হয়ে দাঁড়ায় মানুষগুলো। সারিবদ্ধ হয়ে মানবপ্রাচীর হয়ে যায় গ্রামের সীমানাজুড়ে। গাড়ি এগোতে পারে না। শক্ত কাপড়ের পোশাক পরা মানুষগুলো লাফ দিয়ে নামে সড়কে। হুইসেল বাজাতে থাকে। তাতেও দুলে ওঠে না মানবপ্রাচীর।
পদবিধারী এক অফিসার নেমে আসেন।
তোমাদের নেতা কে?
বাঘ যেন ডাকছে কণ্ঠে?
আমি।
শব্দটা ব্রাশফায়ারের মতো ছড়ছড় করে ছুটতে থাকে এ মুখ থেকে অন্য মুখে।
তোমরা সরে যাও নইলে গুলি চালাতে বাধ্য হব।
চালান গুলি।
অনড় মানববন্ধন সুদৃঢ় হয়। কেয়ামত বিপক্ষের পক্ষ হয়ে অনেক লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে আসে। তাকিয়ে থাকে মানুষগুলো। এবার ভয় দেখাতে শুরু করে। ভাবলেশহীন মানুষগুলো বরফ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে।
হঠাৎ একটি গুলির শব্দ হয়, সচকিত হয় মানববন্ধন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দশ বছরের এক কিশোর লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। লাল টকটকে রক্তে ভিজে যায় গ্রামের শুকনো ধূলি। মেঘের মতো গর্জে ওঠে মানববন্ধন।
ধর ধর ধর। গাছের ডাল ভেঙে নিয়ে দৌড়ায় গাড়ির দিকে। খবর চলে যায় গ্রামের ঘরে ঘরে। বউ-ঝিরা ঝাড়–-বঁটি-কুড়াল নিয়ে দৌড়ে আসে গাড়ির দিকে।
ফেসবুকের মাধ্যমে খবর চলে যায় দেশ-বিদেশে। ছুটে আসে সাংবাদিকরা।
চষাক্ষেত থেকে মাটির ঢেলা ছুঁড়ে মারতে থাকে। গোয়ার বিশেষ বাহিনী এগোতে থাকে। বাহিনী যত এগোতে থাকে মাটির ঢেলার বর্ষণ ততই ঘন হতে থাকে। হঠাৎ আরেকটা গুলি ছোঁড়ে। এক কিশোরী ঢলে পড়ে মাটিতে। এবার শিশু-কিশোর বাহিনীও যোগ হয় গ্রামরক্ষা বাহিনীতে।
শহরে খবর চলে যায়, সাংবাদিকদের বড় একটা দল ক্যামেরা নিয়ে ছুটে আসে। ডিসি, এসপি বিশেষ বাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা সবাই ছুটে আসে।
গ্রামরক্ষা বাহিনী কারও সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয় না। অবশেষে ডিসির মধ্যস্থতায় মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়।
বিশেষ বাহিনীর কর্মকর্তা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে ময়লা কাপড়পরা অভুক্ত স্বল্পশিক্ষিত অস্ত্রহীন ক্ষমতাহীন একদল গ্রাম্য মানুষ কেমন অনায়াসে ক্ষমতাবান মানুষের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকল প্রখর রোদে।
বেলা যখন বিকেলের রেখায় দাঁড়ায় তখনই রণেভঙ্গ দেয় বিশেষ বাহিনী। স্কুলের মাঠে চেয়ার-টেবিল সাজিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, মন্ত্রী, আহাদ মিয়া, মসজিদের ইমাম, মন্দিরের পুরোহিত, গির্জার ফাদার, যুব ক্লাবের নেতারা-সবাই বৈঠকে বসে। নারীও থাকে কেউ কেউ। কাগজ-কলমে স্বাক্ষর হয়। বিনাশর্তে বিশেষ বাহিনীকে চলে যেতে হবে ওদের আবাসন প্রজেক্ট গুটিয়ে।
রেডিও, টেলিভিশনে প্রচার হয় এই সবুজ শ্যামল গ্রামের কথা। তাদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কথা। সচিত্র খবর।
রাত নেমে আসে। ক্লান্ত অবসন্ন অভুক্ত মানুষগুলো চলে গেছে যার যার বাড়িতে। অবসন্ন শরীরটা টেনে হাঁটছে আহাদ মিয়া। দুই-দুইটা প্রাণ অকালে ঝরে গেল। ওদের রক্তের ঝাপ্টা এসে লাগে চোখেমুখে। ঝাপসা হয়ে আসে দৃষ্টি। আবার ঝাপ্টা লাগে রক্তের। এবার একটু জোরেই রক্তের ঝাপ্টা লাগে। ভিজিয়ে দেয় বুকের বসন।
আকাশে চোখ তুলে তাকায়। পূর্ণিমায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। চাঁদের আলোতে আহাদ মিয়ার হাত ধরে কিশোর-কিশোরীরা। যাদের রক্তে ওরা এই গ্রাম ফিরে পেল। সাত পুরুষের গ্রাম ওদের। আহা! আহাদ মিয়া বসে পড়ে। আহাদ মিয়ার পাশে দু’জন বসে পড়ে, আহাদ মিয়ার শরীরে ধুলো লেগে যায়। ধুলোতে এত সুবাস কেন। প্রাণ জুড়িয়ে যায় আহাদ মিয়ার। মাটির সঙ্গে মিশে দিতে চায়, আরও! চাঁদের আলোতে তিনটে শরীর ধুয়ে যাচ্ছে। হ