নাকপোড়া বারুদের গন্ধে
সোলায়মান আহসান
প্রকাশক : মাতৃভাষা প্রকাশ
প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০২২
প্রচ্ছদ : মোহাম্মদ তোয়াহা
মূল্য : ২০০ টাকা।
নাকপোড়া বারুদের গন্ধে’ একটি সরল বাক্য। কিন্তু এই সরল বাক্য যখন হয় কবিতার শিরোনাম, কিংবা হয় একটি কাব্যগ্রন্থের নাম তখন ভাবতে হয় নতুন করে। তার গূঢ়ার্থ উদ্ধারে সময় দিতে হয়। কবিতা বোদ্ধাদের মতে কবিতার পঙক্তিতে, কবিতার শব্দে সরল অর্থের বাইরেও থাকে ভিন্ন আরেক অর্থ। কবিতার অর্থ আপাতত একরকম মনে হলেও তরজমায় দাঁড়িয়ে যায় অন্য আরেক অর্থ। কবিতার গমনাগমন বহুমুখী।
তরজমাও হয় ভিন্নজনের কাছে ভিন্নরকম। আবার কবিতার সঠিক অর্থ স্থির করাও দুরূহ হয়ে পড়ে পাঠকের জন্য। এরও কারণ আছে। অন্যতম হলো কবির তৃতীয় চক্ষু এবং ঐশ্বরিক অনুভব। এজন্য সরল পঙক্তিও ব্যাঙ্ময় হয়ে ধরা দেয় পাঠকের মনমস্তিষ্কে।
‘নাক পোড়া বারুদের গন্ধে’ বাক্যে কবি প্রয়োগ করেছেন গন্ধ শব্দ। গন্ধ ও ঘ্রাণে আছে পৃথক দ্যোতনা। ঘ্রাণ বলতে নাসারন্ধ্রে অনুভূত হয় ইতিবাচক অনুভব। গন্ধ শব্দে বিরাজ করে নঞর্থের অস্তিত্ব। আর নাক হলো মানুষের পঞ্চেন্দ্রিয়ের অন্যতম। নাকপোড়া বলতে তাহলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বুঝাতে চেয়েছেন কবি অবশ্যই। বারুদ শব্দে ইঙ্গিত করেছেন ভয়াবহতর কোনকিছু। প্রশ্ন থেকে যায় গন্ধটি কার? বারুদের নাকি পোড়া নাকের? উত্তরটি অমীমাংসিত।
বারুদেরও একটি ঝাঁজালো গন্ধ আছে, আছে পোড়া নাকেরও একটি উৎকট গন্ধ। বারুদকে আক্ষরিক বারুদ বা আগ্নেয়াস্ত্রের উপাদান না ধরে কেউ যদি শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে তাহলে কবিতা মোড় নেয় অন্য দিকে। এবং গ্রহণ করা যায় আধুনিকতা বা বিজ্ঞানের প্রতিনিধি হিসেবে। তখন নাক হতে পারে সভ্য সমাজের জেগে থাকা বিবেক, হতে পারে মানুষ ও মানবতা। আবার সমাজ ও প্রকৃতির প্রতিনিধিও হতে পারে।
এবার আমরা মনোনিবেশ করি কবি সোলায়মান আহসানের কবিতাগ্রন্থ ‘নাকপোড়া বারুদের গন্ধে’ কবিতা গ্রন্থের নাম কবিতায়। কবিতায় চিত্রিত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদের থাবায় ক্ষতিগ্রস্ত পৃথিবীর বর্ণিল চিত্র। বর্ণিত হয়েছে বোমা বারুদে ধ্বংস হওয়া মানুষের আহাজারি। একটি কবিতার ভিতরেই লুক্কায়িত হাল জামানার বিস্তৃত ইতিহাস। একটি কবিতা মূলত সময়ের ঘটনাপুঞ্জি। প্রায় এগারো পৃষ্ঠা দীর্ঘ এই কবিতার দেহ। দীর্ঘ এ কবিতাটিতে আছে ঘটনার পরম্পরা।
বিশ্বযুদ্ধদ্বয়ের ভয়াবহতা, মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার তা-ব, ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিনের বিধ্বস্ত চেহারা চিত্রিত হয়েছে এই কবিতায়। ‘নাকপোড়া বারুদের গন্ধে’ কবিতা মূলত কবি সোলায়মান আহসানের বোধের জগৎকে নাড়া দেয়া গোলা- বোমা- বারুদে ক্ষত বিক্ষত পৃথিবীর বিবৃত কাব্য বয়ান।
সোলায়মান আহসান সাহিত্যিকজনের কাছে পরিচিত নাম। তিনি কবি। দশকওয়ারি পরিচয়ে গত শতকের আশির দশকের উজ্জ্বলতম নাম। কবি পরিচয় ছাড়াও তার পরিচিতি ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, চিন্তক ও সাহিত্যসমালোচক হিসেবে। ইতোমধ্যে প্রকাশ পেয়েছে ‘সুদূরের ভালোবাসা’, ‘অলক্ষে অগোচরে’, ‘লোহালিয়ার বাঁকে’, ‘চর শান্দার উপাখ্যান’ নামক উপন্যাসসমূহ। এছাড়া ‘অচেনা সুবাস’, ‘অবোধ্য প্রণয়’, ‘শোপিস’ ছোটগল্প গ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে তার। ‘দাঁড়াও সকাল বিরূপতা’, ‘কৃষ্ণস্বর প্রত্যুষের’, ‘শূন্য ও শূন্যতা’, ‘আশির দশক’ কাব্যগ্রন্থসহ অনেক বই-ই প্রকাশ হয়েছে কবি সোলায়মান আহসানের।
‘নাকপোড়া বারুদের গন্ধে’ তার ২০২২ ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত কবিতা গ্রন্থ। ‘নক্ষত্রের বিলাসিতা’ তার সনেট গ্রন্থ। নক্ষত্রের বিলাসিতায় কবির সনেটগুচ্ছ অন্য এক সোলায়মান আহসানকে পরিচয় করিয়ে দেয়। সোলায়মান আহসান তার প্রতিটি কিতাবেই নিজেকে মেলে ধরেছেন আপন মহিমায়।
জীবনের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে দিতে একদার সাহিত্যকর্মী পরিণত হয়েছেন সাহিত্য বটবৃক্ষ হিসেবে। সোলায়মান আহসান এখন প্রাজ্ঞজন। তার বটছায়ায় ইচ্ছে করলে বসতে পারবে একঝাঁক তরুণ সাহিত্যকর্মী। এবং তরুণ সাহিত্যকর্মীর জন্য পাঠ আবশ্যক সোলায়মান আহসান ও তার সহযোদ্ধারা। কবিতা লিখতে আসা, সাহিত্য করতে আসা তরুণতম কবিকর্মীর জন্য অনুসরণীয় কবি সোলায়মান আহসান।
সোলায়মান আহসান তরুণদের জন্য নিঃসন্দেহে গুরুবৃক্ষ।
কবি যখন কবিতায় বলেন,
“ফিলিস্তিন চেচনিয়া কাশ্মীর রোহিঙ্গা অতঃপর/ বন্দিদশা আফগান, রোরুদ্য সিরিয়া মিন্দানাও/ লিবিয়া কসোভো চাঁদ স্বাধীনতা পায়নি তারাও/ ছটফট দিন কাটে, চীনের বিপন্ন উইঘুর।”
তখন পাঠকের উপলব্ধিতে ধরা দেয় অতি সহজে কবির সময় যাতনার স্পষ্টত বেদনার্ত আর্তি। স্বদেশের সীমানা অতিক্রম করে বিশ্বে বিপন্ন মুসলমানদের নিপীড়িত আর্তনাদে কাঁদেন কবি।
তারপর স্বগতোক্তির মতোই বলেন
“আর কতো রক্তপাত, মুসলিম মানচিত্র জুড়ে/ আর কতো লিখা হবে অজানা কাহিনী নিপীড়ন/ আসবে সালাদিন সিংহদিলীর মাটি ফুঁড়ে/ আবার জিহাদ হবে, গাজওয়া হিন্দ মহারণ/(সময় যাতনা ২)
বারুদের মিথ্যা মরশুমে মারণাস্ত্র সংগ্রহে পাল্লা দেয়া নীরব সন্ত্রাসের দিকে কবি তখন তাকিয়ে থাকেন বিপন্ন বিষাদ চোখে।
সমগ্র সাহিত্যিক জীবনে কবি সোলায়মান আহসান যাপিত জীবনের পঞ্চাশ বছর অতিক্রম করেছেন। কবির ভাষায় “শতাব্দীর পরিক্রমায় অর্ধগোলক পেরিয়ে গোলক ধাঁধায় আটকে গেছি।” বয়সে মানুষ আলস্যেও আটকে যায়। চিন্তায় পরিপক্বতার সাথে অনেকের স্থবিরতায়ও আটকে পড়েন। কবি সোলায়মান আহসান অবশ্য এখনও সচল আছেন তার সৃজনে, সৃষ্টিশীলতায়। এখন তারুণ্যের শক্তি নিয়ে চলমান কবি কবিতায় স্বাতন্ত্র্যের জোয়ার আনতে বদ্ধপরিকর। স্বাতন্ত্র্যের উজ্জ্বলতা দেখাতে চেষ্টা করেন চিন্তায় ও কবিতার প্রকরণে। কবিতার প্রকরণে যুক্ত থাকে ছন্দ-মাত্রা-তাল-লয়ের সাথে উপমা উৎপ্রেক্ষা, অনুপ্রাসসহ কবিতার গড়নে গঠনের নানা অনুষঙ্গ। প্রবীণ প্রাজ্ঞ কবির কবিতায় প্রকাশ পায় বক্তব্যের বলিষ্ঠতা। আমরা কবি সোলায়মান আহসানের কবিতায় বক্তব্যের সে বলিষ্ঠতায় বিমোহিত হই।
আবার “রূপালি গড়ন তাই টুকটুকে লাল মুখপানা” বা “পানশি নৌকোর মতো ফিনফিনে মসৃণ বয়ন” পাঠে পঙক্তির উপমা মিশ্রিত আঁটসাঁট বর্ণনায় সন্তুষ্টির জলে সিক্ত হই। কবির পাঠক হিসেবে তার বয়সের প্রৌঢ়ত্ব হিসাবে রেখে প্রতি কবিতায় এসবকে তখন তুচ্ছজ্ঞান করে বক্তব্যের বিজ্ঞতাকেই কবিতার আবিষ্ট লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করি। কবি তার চিন্তা প্রকাশ করেন কবিতায়। কবি তার বিশ্বাস বয়ান করেন কবিতায়। আমরা দেখি তার বিশ্বাস, স্বপ্ন, চিন্তার সংযোগে কিভাবে কতটুকু পরিবর্তন চান সমাজের। কাব্য বক্তব্যে সমাজকে সত্যি কী ঘুরিয়ে দিতে চান কবি!
তখন আমাদের কানে বাজে তার সোচ্চার বক্তব্য-
“আজ আমাদের দাঁড়াতে হবে এক ময়দানে/ ঐক্যের সুকঠিন বেষ্টনীতে বানাতে হবে দুর্ভেদ্য দুর্গ/ ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে মিলিত সহ-অবস্থানে-/মানবতার শত্রুদের ওপর।” (এখন, কী ও কেন)
এবং এই ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে তিনি শুরুতেই প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন- “এখন আমাদের কী করার আছে?/ কাকের চোখের ন্যায় ঘুরিয়ে দৃষ্টি প্রশ্ন করি নিজেকেই।” (ঐ)
কবিতায় কাকের চোখের ন্যায় বলতেই আমরা অতি পরিচিত দৃশ্যের সাথে নতুন করে সম্মোহিত হই। হয়তো কাক দেখেছি, গভীরভাবে অবলোকন করিনি কাক চক্ষু। উপমা, উপমান আর চিত্রকল্পের দৃশ্যায়ন হয় কবির একটি শব্দ প্রয়োগে। তার সরল পঙক্তিতেও সরব উপস্থিতি চিত্রকল্পের দৃশ্যায়ন।
“দেখছ না আমার হাতে কড়া-পায়ে শিকল/… নদীতে স্রােত নেই” (একটি কবিতা চাই)।
শেষতক আমরা তার সরল বয়ানেই স্থিত হই কবির বক্তব্যের বলিষ্ঠতায়।
“আমিও সেরকম একটা কবিতার অপেক্ষায় আছি/ যে কবিতা একটা স্বাধীন মানচিত্র আঁকবে।” (একটা কবিতা চাই)
কবিতা নিয়ে কবি সোলায়মান আহসানের আছে আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছু কথা। একজন তরুণ কবিযশোপ্রার্থী যখন ছুটে যান প্রাজ্ঞ এ কবির কাছে তখন তার বক্তব্য পেশ করেন কবিতা নিয়ে। এ বক্তব্য দিতে দিতেই তিনি উপলব্ধি করেন কবির উপর যেন ঢেলে দেয়া হয়েছে অদৃশ্য বিধিনিষেধের কালো ছায়া। কবি অনুভব করেন তাকে যেন বলা হয়েছে কি লেখা যাবে আর কি লেখা যাবে না।
কবিরা নির্ভীক। কবিরা সত্যের পক্ষে। সত্যের পক্ষে থেকেই তিনি শ্লেষাত্মক ভঙ্গিমায় পেশ করেছেন “কী লেখা যাবে কী লেখা যাবে না” পারা না পারা “লেখার তালিকা চাই”।
একজন কবির কোন সান্ত্রী সেপাই নাই। আছে শব্দ ও বাক্য তৈরির লব্ধ জ্ঞান। সে জ্ঞানে তিনি সুচারুভাবে প্রকাশ করেন নিজের বক্তব্য। বিকাশ করেন চিন্তা। প্রচার করেন আপন আদর্শ। দেশপ্রেম ও দেশ সেবার মহান কর্মও শব্দে বাক্যে ও ছন্দের হুঙ্কারে প্রচার ও প্রকাশ করেন কবি। দুর্বোধ্যতার বেড়াজালে পাঠককে ঘুরপাক খাওয়ানো কবির কাম্য নয়। তাই সরল বয়ানে কবিতার ছত্রে নির্মাণ করে যান কবি তার কবিতার ভুবন। সে ভুবনে অন্তর্ভুক্ত হন দেশ, কওম ও বিশ্বমানবতা। এ জন্য কবি সোলায়মান আহসান বাংলাদেশে বাস করে অনুভব করেন পৃথিবীর সমস্ত নির্যাতিত মানুষের আর্তনাদ। বিজ্ঞানের কল্যাণে মানুষের আয়ত্তে এসেছে আধুনিক সব উপকরণ। সাম্রাজ্যবাদের অপশক্তি সেই উপকরণের করেছে অপপ্রয়োগ। ধ্বংস হচ্ছে মানুষের গড়ে তোলা শান্তির আবাস, স্বপ্নের ঠিকানা।
মানুষ অবিনশ্বর নয়। তবে অমরতার আশা মানুষ লালন করে অন্তরে। অমরতা লাভ করে মানুষ তার স্বীয় কীর্তির মাধ্যমে। মানুষ চায় তার রেখে যাওয়া কর্মে সুন্দর হোক আগামীর পৃথিবী। কল্যাণ হোক পরবর্তী প্রজন্মের। কবি ক্রমাগত বয়স অতিক্রম করে জীবনের শেষ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। এখন তিনি ত্রিকোণ পথের মোড়ে। এই মোড়ে এসে তার নাসারন্ধ্র পৃথিবী অনিষ্টকারীদের আগুনে পোড়া গন্ধে অতিষ্ঠ হয়েছেন। পুড়ছে সভ্য দুনিয়ায় অঙ্গ, পুড়ছে সভ্যতার কীর্তিসমূহ, পুড়ছে দিকে দিকে শান্তিকামী মানুষ। বিভক্ত হচ্ছে সমাজ, রাষ্ট্র, দেশ মহাদেশ তথা সমগ্র পৃথিবী। এতো কিছুর পরও কবি হতাশ নন। আমরা শুরু করেছিলাম ‘নাকপোড়া বারুদের গন্ধে’। আবার শেষও করছি নাকপোড়া বারুদের গন্ধেই। এই উৎকট গন্ধের ভেতরই কবি বপন করেন আশার বীজ। কবি উচ্চারণ করেন আশা জাগানিয়া শব্দগুচ্ছ। তিনি নিপীড়ক ঐসব ক্ষমতাধর অবৈধ শাসকদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন- “হে… অবৈধ ক্ষমতাধর নিপীড়ক শাসক,/ জেনে নাও তোমাদের পুরনো নিয়মে বিশ্ব চলবে না আর/ চিরদিন শোষক উৎপীড়কের বিজয় হয় না- হতে পারে না/… এবার উড়বে দেশে দেশে শান্তির পতাকা- সাদা এবং সবুজ/ পৃথিবী শান্ত হবে, রক্তপাত বন্ধ হবে।” (নাকপোড়া বারুদের গন্ধে)
আর দিকে দিকে তখন ছড়িয়ে পড়বে প্রেম-ভালোবাসার পুষ্পকলি। পুষ্পকলি প্রেম রচিত আলোচ্য কবিতা গ্রন্থের নাম
‘নাকপোড়া বারুদের গন্ধে’ প্রকাশ করেছে মাতৃভাষা প্রকাশ। প্রকাশকাল ২০২২ ফেব্রুয়ারি। প্রচ্ছদ শিল্পী মোহাম্মদ তোয়াহা। বিনিময় মূল্য ২০০ টাকা। বইটি নিজেরা কিনুন। অন্যদের কিনতে বলুন। সম্ভব হলে অন্যকে উপহার দিন। কবিতার জয় হোক।