পূর্বসূত্র :বর্ষণসিক্ত দিনে একা একা ঘরে বন্দী জীবন কাটে মমিনের। সময় কাটায় বই পড়ে। আর মনে পড়ে স্বজনদের কথা। বিশেষ করে তার মায়ের মৃত্যুর দিনের কথা। সেদিন ভীষণ বর্ষণ। ভাইদের সঙ্গে সে-ও মাঠে পাট কাটতে গিয়েছিল। দুপুরে বাড়ি ফিরে দেখে মা মরে পড়ে আছে। ইবরাহীম ম-ল তাকে নামাজের জন্য ডাকলে তার স্মৃতির সুতা ছিঁড়ে যায়। মসজিদে গিয়ে আজান দিয়ে আসরের নামাজ পড়ে ওরা। তারপর মসজিদে বসেই গল্প করে। মাগরিবের একটু আগে পর্দাঘেরা টমটমে চড়ে এক যুবক এসে নামে। তাকে ছাতা ধরে এগিয়ে নেয় তারা। ইবরাহীম ম-ল জানায় এই সুদর্শন ছেলেটি আজিম ম-লের একমাত্র পুত্রসন্তান। পরদিন বড়বাড়ির এক বউকে জ্বিনে ধরে। তার জ্বিন ছোড়াতে ডাক পড়ে মমিনের। তাকে দেখে মেয়েটি তাকে ভাই বলে সম্বোধন করে। সে দোয়াদরূদ পড়ে ফুঁ দেয়। মেয়েটি শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
সাত
সাত সকালে একটা চার-পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে এসে হাজির। বৈঠকখানার বারান্দায় টুলে বসে ছিল মমিন। মেয়েটি শ্যামলা, হালকা-পাতলা গড়ন। একেবারে খালি গা, পরণে লাল রঙের একটা ছোট্ট ঘাগরা। তার মুখে-চোখে একটু লাজুক কিন্তু সপ্রতিভ হাসি। -মামা, লেন। বলে সে একটা বেতের সরা এগিয়ে ধরল। এবার মমিনের নজর পড়ে তার হাতের বেতের পাত্রের দিকে। মুড়ি, নারকেল আর গুড়। কিছুটা উদ্বেল হয়ে পড়ে মমিন। সে দ্রুত হাত বাড়িয়ে পাত্রটা নেয়। তাদের বাড়িতে, কেবল তাদের বাড়িতেই নয়, পদ্মার ওপারে তাদের গোটা অঞ্চলেই সকালবেলা মুড়ি খাওয়ার প্রচলন আছে। তার সঙ্গে গুড়, না হয় নারকেলের লাড়–, কিংবা লবন-মরিচ-পেঁয়াজ, কিংবা খালি মুড়ি, যার যা জোটে। এখানে এসে সে দেখছে এখানকার লোকেরা সাত-সকালে পান্তা অথবা কড়কড়া ভাত খেয়ে মাঠে যায়। পান্তা তারাও খায়, সুতরাং তার এমন কোনো অসুবিধা হয়নি। তবে মুড়ি খায়নি অনেকদিন। মুড়ি দেখে তাই তার লালচ হয়। কিন্তু মুড়ির পাত্র হাতে নিয়ে তার অন্তরের সম্ভ্রম বোধ জেগে ওঠে। একটা অপরিচিত বাচ্চা মেয়ে এনে দিল, কে দিল, কেন দিল, তার কিছু না জেনেই সে মুড়ি খেতে শুরু করে দিবে তা হয় না। সে মেয়েটিকে কাছে ডাকে। হাসছে মেয়েটি। তার হাসি পরিচিতের মতো, তাতে যেন কিছু রহস্য জড়ানো।
-কে তুমি?কে পাঠিয়েছে তোমাকে?
মেয়েটি কেবল হাসে। তার হাসি দেখে মমিনেরও হাসি পায়। -কী ব্যাপার, খালি হাসছ যে? তুমি কথা বলত পারো না?
-পারি, পারি। সে দ্রুত খলবল করে উঠল। ভাবখানা এমন যেন দেরি হয়ে গেলে তার কথা বলার ক্ষমতা সত্যি-সত্যিই চলে যাবে।
-তাহলে বলছ না যে? কে পাঠিয়েছে তোমাকে?
বৈঠকঘরের কোণার দিক থেকে একটা ফিসফিসে আওয়াজ ভেসে আসে তখন- এই ছুঁড়ি, বুল্।
মেয়েটি পেছন ফিরে বলে, বুল্নু তো। তারপর মমিনের দিকে তাকিয়ে তার সেই হাসি।
-কই বুল্লি?বুল্, মা পাঠায়ছে।
মেয়েটি এবার সত্যিই শরম পায়। কিন্তু লজ্জায় গলে যাবে, কিংবা টেঁসে যাবে সে রকম মেয়ে সে নয়। একটু এগিয়ে এসে সে আবার বলে, মা পাঠায়ছে। খান।
তার যত রকম খাওয়া-দাওয়া সব আজিম মণ্ডলের বাড়ি থেকেই আসে। আর সেসব খাবার-দাবারও মূলত তিন সন্ধ্যের মূল খাবার। এরকম নাস্তা-পানি তেমন একটা আসে না।
-আপনি কে?সামনে আসেন না?
-আমি হানুফা ভাই, আপনে কাল আমার ব্যারাম সারায় দিলেন।
এবার বুঝতে পারে মমিন। কৃতজ্ঞতার উপহার এটা।
-এসবের দরকার নাই বহিন। আমার খাবার তো আসবেই। এর দরকার নাই।
-এ আর কী! ওই খাওয়ার আসতে দেরি আছে। যখুন আসপে তখুন খাবেন। অ্যাখুন ইট্টুক মুড়ি খান।
-না, মুড়ি খেতে আমার আপত্তি নেই, মানে মুড়ি খেতে আমি একটু ভালইবাসি। কিন্তু উনারাযদি কিছু মনে করেন।
-না, না, কিছু মুনে কইরবে না। আমি বড় মায়েক বুইলিছি।
-বড় মা কে?
-বড় মা, মানে বড় মা! মানে আপনে যারে বাড়িতে জায়গির আছেন।
বুঝতে পারে মমিন। বলে, দেখবেন এ নিয়ে যেন কথা না হয়।
এরকম একটা টানাহেঁচড়ার জটিলতায় একবার পড়তে হয়েছিল তাকে। বেলডাঙ্গারভাবতায় আসার পরপরই। সে যে বাড়িতে জায়গির পায় তাদের এক প্রতিবেশি তাকে মাঝে-মধ্যে ডেকে খাওয়াত। কখনো কখনো এটা-ওটা নিয়ে আসত তার জন্য। এ নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে একদিন ভীষণ ঝগড়া। জায়গিরদারের ধারণা প্রতিবেশি তাকে ভাগিয়ে নিতে চায়। কেন ভাগিয়ে নিতে চাইবে, ভাগিয়ে নিয়ে কী লাভ তা মমিন আজো বুঝতে পারেনি। প্রতিবেশির বক্তব্য হলো, ছেলেটাকে তার ভাল লাগে তাই ভাল-মন্দ এটা-ওটা খাওয়াতে চায়, এতে খারাপ কী আছে! শেষ পর্যন্ত গ্রামবাসীর হস্তক্ষেপে গোলমাল থামে। প্রতিবেশিকে হাত গুটিয়ে নিতে হয়। কিন্তু কেবল মমিনই জানতো প্রতিবেশি প্রৌঢ় খুব গোপনে মাদ্রাসায় আসা-যাওয়ার পথে অল্প-স্বল্প এটা-ওটা শুকনো খাবার, ফল-মূল তার পাঞ্জাবির পকেটে গুঁজে দিত। সে আজো বুঝে পায় না প্রতিবেশি লোকটা কেন এমন করতো। কিন্তু লোকটাকে তার খুব মনে পড়ে। তার জায়গিরদার লোকটিও ভালই ছিলেন। কিন্তু ওই প্রতিবেশি লোকটার মধ্যে আলাদা কিছু ছিল, তা সে নিজেও অনুভব করতে পারতো। তাই যদিও ভয় করতো যে জায়গিরদার টের পেলে খুব অসন্তুষ্ট হবেন, তবু তার ভালবাসা সে কখনো ইচ্ছে করে প্রত্যাখ্যান করতে পারেনি। সেখান থেকে তাকে তড়িঘড়ি করে চলে আসতে হয়েছিল। ওই প্রতিবেশির সঙ্গে তার দেখা হয়নি। তার কাছ থেকে বিদায় নেয়া হয়নি। এই কষ্ট এখনো তার বুকে বিঁধে। তার মন বলে সুযোগ পেলে ভাবতায় যাবে আবার, কেবল ওই লোকটার সঙ্গে একবার দেখা করার জন্য। তার দোয়া নেওয়া তার খুব প্রয়োজন।
মুড়ি চিবোয় আর ভাবে মমিন, মানুষের জীবনটা কেমন যেন। মানুষ তো আসলে সম্পূর্ণ একা, নিঃসঙ্গ, কেউ কারো নয়। তাকে আল্লাহ যখন সৃষ্টি করেছেন একাকীই সৃষ্টি করেছেন। তারপর মানুষকে তিনি পৃথিবীতে পাঠান। তখনো একাকীই পাঠান, কিন্তু পৃথিবীতে মানুষ একাকী বাঁচতে পারবে না, সেজন্য এমন একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিনি তাকে পাঠান যে সে একা হয়েও অনেকের সঙ্গে অনেক রকম সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। এই সম্পর্কসূত্রের সাহায্যে তিনি একেকজন মানুষকে অন্য সব মানুষ দিয়ে লালন করিয়ে নেন। আবার যখন সে মারা যাবে, একাকীই যাবে, আবার সে নিঃসঙ্গ হয়ে যাবে। তখন পৃথিবীর এত যে সম্পর্ক, প্রেম, ভালবাসা, বন্ধুত্ব, এমনকি শত্রুতা, কিছুই থাকবে না। কেউ তা স্বীকারই করতে চাইবে না, বা স্বীকার বা অস্বীকার করার প্রশ্নই উঠবে না। কিয়ামতের দিন যখন সকল মানুষকে একত্রিত করা হবে তখন দিশেহারা মানুষ স্বজনদের খুঁজে ফিরবে সাহায্যের জন্য, কিন্তু কোনো স্বজন তার পৃথিবীর সম্পর্ককে স্বীকার করতে চাইবে না- না পিতা, না মাতা, না ভাইবোন, না স্বামী, না স্ত্রী, না পুত্র-কন্যা, না আর কেউ। অথচ এই পৃথিবীতে মানুষ কত রকম সম্পর্কেই না বাঁধা। কোথাকার কে মমিন, মো. আব্দুল মমিন মোল্লা, সে কোথাকার কোন হুগলি, বেলডাঙ্গা, ভাবতা হয়ে রাজশাহীতে এসে ঠাঁই নিয়েছে। ঠাঁই দিয়েছে কারা?যাদের সে চিনত না কখনো, তার প্রতি তাদের সহানুভূতি ও ভালবাসার কী কারণ থাকতে পারে? সেটা ওই আরকি- মানুষ যত স্বতন্ত্রই হোক, তাদের প্রত্যেকের মধ্যে সৃষ্টিকর্তা গেঁথে দিয়েছেন মানবিকতা, প্রেম, সহানুভূতি, ভালবাসা, আত্মীয়তা। এইভাবে আল্লাহ তার প্রত্যেকটা সৃষ্টিকে লালন করিয়ে নেন। তাই মানুষকে ভাল না বেসে পারে নামানুষ। এই যে এই মেয়েটি, হানুফা, তার সমবয়সীই হবে, তাকে ভাই জ্ঞানে সেবা করতে এগিয়ে এসেছে, তা এরই ফল।
কিন্তু খ্যাতির বিড়ম্বনা আছে। আব্দুল মমিনের ঝাড়ফুঁকের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। প্রথমেই ডাক পড়ল খলিলের জন্য। সলেমান মণ্ডল নিজে এসে বললেন, মাস্টার সাইব, আমার ছেলিডার পায়খানা ক্যান ভাল হয় না দ্যাখেন তো। কেউ বুলে পুরাতন আমাশা, কেউ বুলে বান মাইরিছে কেউ। কী যে করি! একবার আল্লাহর কালাম পইড়ি ফুঁ দি’ দ্যাখেন তো।
ভদ্রলোক আজিম মণ্ডলের ছোট, কিন্তু দেখতে মনে হয় বড়। খানিকটা বেশি উঁচু, দাড়িও লম্বা, কপালে-চোখে-মুখে বয়সের ভাঁজ। ফর্সা মানুষ, কিন্তু রোদে পুড়ে তামাটে রং ধরেছে। পরিবারের কৃষিকাজটা তিনিই দেখভাল করেন। মাঠ-ঘাটে পাইট-মুনিষদের সঙ্গে সময় কাটে তার। খলিল তার প্রথম পক্ষের একমাত্র পুত্রসন্তান, জ্যেষ্ঠ সন্তানও বটে। ছেলেটা বুদ্ধিমান, চটপটে, এবং কর্মিষ্ঠ। মিষ্টি হাসি-খুশি ব্যবহারের কারণে সবার প্রিয়পাত্র। সেই ছেলেটার এমন একটা রোগ হলো যে তা আর সারে না। এই ভাল তো এই খারাপ। খলিলকে মমিনেরও ভাল লেগেছে। কদিন থেকে তার অসুখটা বেড়েছে। সে বাইরে আসে না। এরই মধ্যে শহর থেকে গোবিন্দ ডাক্তার এসে দেখে গিয়েছে একবার।
-এখন কেমন অবস্থা?
-আর কী অবস্থা বাপ! কখুনো মুনে হয় ভালই, আবার ইট্টুক পরই মুনে হয় খারাপ। তে আজ ইট্টুক উঠা-বসা কর্ইছে।
-হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করিয়েছেন কখনো?
আব্দুল মমিন হোমিওপ্যাথি কিছুটা জানে। ভাবতায় থাকতে তার এক শিক্ষকের কাছে থেকে শিখেছে। ওই শিক্ষক বলতেন, হোমিও ওষুধ রোগ সারায় ভেতর থেকে। রোগকে চাপা দিয়ে রাখে না। তার নিজের একবার একজিমা হয়েছিল। ওই শিক্ষক তার চিকিৎসা করেছিলেন। বলেছিলেন, ওষুধ খাওয়ার পর অসুখ প্রথমে বাড়বে, ভেতরে বিষ যা আছে সব বেরিয়ে যাবে, তারপর কমতে শুরু করবে।প্রায় সে রকমই হয়েছিল তার। তারপরই তার মধ্যে হোমিওভক্তি তৈরী হয়।
জলিলের চিকিৎসার জন্য সবই করা হয়েছে, জানালেন সলেমান মণ্ডল। ঝাড়-ফুঁকও কম হয়নি। আশপাশের বড় বড় মৌলবি-মওলানা-পীর-মুর্শিদ কারো দোয়া-দরূদ বাদ নেই। কিন্তু কিছুতে কিছু হয়নি।
-বাড়ির ম্যা মানুষ্গিলিন বুইল্ছে-আপনে একবার ফুঁ দি’ দ্যাখেন তো। বুলা তো যায় না আল্লা কার ওছিলাত্ কী করে।
মহা ফাঁপরে পড়ে মমিন। সে জানে, তার মধ্যে এমন কোনো অলৌকিক শক্তি নেই। হানুফার ব্যাপারটা রহস্যজনক, তার দোয়ার কারণেই সে সুস্থ হয়েছে ব্যাপারটা তা না-ও হতে পারে। বার হয়তো হতেও পারে, জ্বিন-ভূতের ব্যাপারে দোয়ার কার্যকারিতা থাকতে পারে। কিন্তু খলিলের অসুখ তো জ্বিন-ভূতের ব্যাপার নয়। কিন্তু সলেমান মণ্ডলের অনুরোধ এড়াতেও পারে না সে।
খলিলের সঙ্গে তার দেখা নেই প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেল। এর মধ্যে সে আরো শুকিয়ে গিয়েছে। মুখটা করুণ আর ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। সে যাচ্ছে শুনে বাড়ির মেয়েরা সব গিয়ে জড়ো হয়েছে সেখানে। ঘরউপচে বারান্দায় নেমেছে ভিড়।
এ বাড়ির মেয়েরা পর্দানশীন, পরপুরুষের সামনে বের হয় না। কিন্তু চাকর-বাকর, নিকটাত্মীয়দের বাড়িতে অবাধ প্রবেশ। সেক্ষেত্রে শালীন পোশাককেই তারা যথেষ্ট মনে করে। বাড়ির বাইরে কোথাও গেলে বোরখা, বা চাদর গায়ে দিয়ে নেয়। ঘোড়াগাড়ি, গরুর গাড়ি যাই হোক, চাদর দিয়ে ঢেকে নেওয়া হয়। তার সামনে এরা ঘোমটায় ভাল করে মুখ ঢেকে আছে। তবু লজ্জা লাগে মমিনের। এত এত পরনারীর মাঝখানে তার অস্বস্তি হয়।
-এত মানুষ কেন? রোগী তো মানুষ দেখেই ভড়কে যাবে।
সলেমান মণ্ডলের স্নায়ু কাজ করে ধীরে। মমিনের ইঙ্গিতটা তিনি ধরতে পারলেন না। অগত্যা সে তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, দু’চার জন বাদে সবাইকে চলে যেতে বলেন।
সলেমান মণ্ডল ধড়ফড় করে উঠলেন- আমিও তাই বুলি… এত মানুষ ক্যান? এই, যা তুরা, পরে আসিস, যা।
কেউ কেউ স্বেচ্ছায় গেল, কাউকে কাউকে ঠেলে পাঠাতে হলো। থাকলেন কেবল সলেমান মণ্ডলের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী আর আজিম মণ্ডলের বউ খোদেজা বিবি।
ঘরটায় কেমন যেন উটকো গন্ধ। মমিনের মনে হয়, ঘরটা বোধ হয় খোলা হয় না। সে নিজ হাতে ঘরের জানালা খুলে দিল। শেষ আষাঢ়ের বিকেল বেলা। তবু ঘরটা হালকা আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
আয়াতুল কুরসি, আর তিন ক্কুল সুরা পড়ে খলিলের চোখে-মুখে-শরীরে ফুঁ দিয়ে দিল মমিন, হাত বুলিয়ে দিল তার সারা শরীরে। তারপর একান্ত মনে হাত তুলে দোয়া করল সে খলিলের রোগমুক্তির জন্য।
খলিল বলল, আমা বাহিরে যাওয়া হবে না মাস্টার ভাই? আমার আর ঘরের ভিতর শুই থাইক্তে ভাল লাইগ্ছে না।
-কেন পারবে না? চলো বাইরে আমার সাথে।
তার কথায় কেউ আপত্তি করে না। দিনটা সেদিন বেশ ভাল। সকালের দিকে কিছু বৃষ্টি হলেও বাকি সারাটা দিন রয়েছে শুষ্ক। আকাশে মেঘও বেশ হালকা। তবে বর্ষা কাল বলে কথা। সে খলিলের হাত ধরে বাইরে নিয়ে গেল। বাড়ির মধ্যেকার মাইঠালের ধারে খানিকক্ষণ দাঁড়াল ওরা। কিন্তু সেখানে বাড়ির মেয়েরা আসা-যাওয়া করে। তাই খলিলকে নিয়ে বৈঠকঘরে গেল মমিন।
বৈঠকঘরের সামনের খাদটা পানিতে টইটম্বুর। অসংখ্য ব্যাঙের লাফালাফি সেখানে। কত রকম যে তাদের ডাক।
-দেখ খলিল, আল্লার সৃষ্টির কী বৈচিত্র।এই ব্যাঙের কথাই ধরো। কত রকম ব্যাঙ! কত রকম তাদের আকার, গঠন, আর রং। সুবহানাল্লাহ।
খলিলের শরীর ভাল নেই। তার হয়তো এসব গুরু-গম্ভীর কথা ভাল লাগবে না, ভাবল মমিন।কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে খলিল বলল, মানুষের জীবনও কি কম বিচিত্র, বুলেন! কারু মা আছে বাপ নাই, কারু বাপ আছে মা নাই। কারুর আবার বাপ-মা কেউই নাই। মানুষ ক্যান মরে বুইল্তে পারেন মাস্টার ভাই?
মমিনের ভেতরটা কেঁপে ওঠে তার কথা শুনে। সে কি তাহলে মৃত্যুর চিন্তা করছে? সে কি ভাবছে তার মৃত্যু আসন্ন? এতটুকু একটা ছেলের মনের এই অবস্থার কথা ভেবে সে-ও ভেঙ্গে পড়ে ভেতর ভেতর।কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সামলে নেয় নিজেকে। খলিলের ঘাড়ে হাত রেখে বলে, মানুষ তো আসলে মরে না, সে ফিরে যায় তার আসল ঠিকানায়।
করুণ চোখে তার দিকে তাকায় খলিল। -তবু দ্যাখেন, এই জীবনডাও তো কত মধুর। কত সুন্দর এই পৃথিবী। আল্লা চাইলে সগলাক্ একসাথেও তো লিতে পার্ইতো।
খুব অবাক হয় মমিন। অসুখে ভুগতে ভুগতে এই নাবালক কিশোর ছেলেটাও বুঝে ফেলেছে তার হয়তো আর বেশিদিন বেঁচে থাকা সম্ভব হবে না। তাই তার মাথায় জীবন আর মৃত্যুর রহস্যের চিন্তা ঢুকেছে। সে কি জানে না এ চিন্তার কোনো শেষ নেই? কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব নয়? পিতার কথা তার মনে নেই, কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর তার মনের ভেতরেও এরকম চিন্তা তোলপাড় করেছে অনেকদিন। আল্লাহর কেন ইচ্ছা হলো যে মানুষ তার আসল ঠিকানা ছেড়ে কিছুদিনের জন্য এই পৃথিবীতে বসবাস করবে, আর জড়িয়ে পড়বে এত-এত মায়া-মমতার সম্পর্কে!
খলিলের মন ভাল করার জন্য তাকে বাইরে নিয়ে এসে মুশকিলেই পড়েছেমমিন। কী বলে বোঝাবে তাকে সে? ওই একই প্রশ্ন যে তার মনেও ঘুরপাক করে।
ইবরাহীম মণ্ডল এসে উদ্ধার করল তাকে।-কী রে বাপ, শরীলডা অ্যাখুন কী রকুম লাইগ্ছে?
-আগের চেয়ে একটু ভাল, তাই না খলিল?
খলিল মাথা নাড়ে।
মাগরিবের নামাজের ওয়াক্ত হয়ে গেছে কখন তারা বুঝতেই পারেনি। ইবরাহীম মণ্ডলের চিকন কণ্ঠে আল্লাহর মহত্ব ও বড়ত্ব ঘোষিত হলো। ধোঁয়াচ্ছন্ন সন্ধ্যার শীতল বাতাসে আজানের ধ্বনি কেমন যেন করুণ রসে সিক্ত হয়ে বাজে। খলিলকে নিয়ে মসজিদে যায় মমিন। ¯্রষ্টার সন্তুষ্টি চায় সে, আর দোয়া করতে চায় খলিলের জন্য। খলিলও তার নিজের রোগমুক্তির জন্য দোয়া করুক আল্লার কাছে।
আট
ভোরে বাহিরবাড়িতে মাচানের ওপর বসে নিমডালের দাঁতন ঘষছেন আজিম মণ্ডল। একটু আগে মাঠ বেড়িয়ে এসেছেন। কাদা-পানি ভেঙ্গে আজ বেশিদূর যাননি। মাঠে তার না গেলেও চলে। কারণ মাঠ-ঘাট ফসল-পানির দিকটা মূলত তার মেজভাই সলেমান মণ্ডলই সামলান। তবু কৃষকের ঘরের ছেলে বলে কথা। মাঠ-ঘাট, ফসল-বাগান, পুকুর-দীঘির সঙ্গে তাদের আত্মার সম্পর্ক। তাই তার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হওয়া চলে না। মাঠে একবার না গেলে ভাল লাগে না। মনে হয় দিনের কাজ অসম্পূর্ণ থেকে গেল।
সেই মতো আজও ফজরের নামাজের পর বেরিয়েছিলেন আজিম মণ্ডল। বর্ষা শেষ হয়ে আসছে। বর্ষণের জোরও কমে আসছে। তবু মাঠ-ঘাট এখনো পানিতে থইথই করছে। কেউ কেউ পাট কাটতে শুরু করে দিয়েছে। পাটের আবাদ এখানে খুব বেশি হয় না। আউশ ধানের আবাদই বেশি। ধান এবার ভালই হবে, ধানগাছের ডাঁটা-পাতা দেখে তাই বোধ হয়।
মাঠ ঘুরে এসে মাইঠালে হাত-পা ধুয়ে মাচানে বসেছেন আজিম মণ্ডল। একটা বড় ল্যাংড়া আমগাছের নিচে বাঁশের বাতা দিয়ে বানানো বেশ বড়-সড় মাচানটা। সকাল-বিকাল বাড়ির লোকেরা এখানে বসে আড্ডা দেয়। মাঝে মাঝে সকালে এবং সন্ধ্যায় এখানে বসেন আজিম মণ্ডল। বাড়ির লোকেরা এই সময় তার সঙ্গে মতবিনিময় করে। বাড়িতে সালিশ-বিচার হলে এখানেই বসে। জায়গাটায় বাতাস খেলে ভাল। দক্ষিণে মাইঠাল, পশ্চিমটাও অনেকটাই ফাঁকা। উত্তরে, বৈঠকঘরের প্রায় লাগোয়া বিশাল গোয়ালঘর। সেটা বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নই থাকে। তবু গরু-মোষের বাস বলে কথা। সেখান থেকে মাঝে মাঝে বাতাসে দুর্গন্ধ ভেসে আসে। কিন্তু পাড়া-গাঁর গৃহস্থবাড়ির লোকেদেরএটা নিত্যদিনের ব্যাপার, তাদের গা-সহা হয়ে গিয়েছে। মাইঠালের দক্ষিণ আর পশ্চিম ধার জুড়ে পানিছিটকির আকাট জঙ্গল। পানিছিটকির ডালে ডালে জ্বলজ্বলে হলুদ স্বর্ণলতা লেপ্টে থাকে। এই জঙ্গলে ডাহুক পাখির বাস। কখনো কখনো রাতভর ডাকতে থাকে এই ডাহুক পাখি। তখন তাদের মিলনের সময়। ডাকতে ডাকতে কখনো কখনো কণ্ঠনালি ছিঁড়ে রক্ত বেরিয়ে আসে। লোকেরা বলে সেই রক্ত ডিমের ওপর পড়লে তবেই নাকি সেই ডিম থেকে বাচ্চা ফোটে।
এই জহির মণ্ডল এসে বসলেন তার পাশে।আজগর আর আকবর মণ্ডলের বড় ভাই তিনি। বেশ শান্ত-সৌম্য চেহারা। মাচানটার পশ্চিম পাশে, মাইঠাল থেকে একটু দূরে বাড়ি করেছেনতিনি। তার বাড়ির পেছনে ও দুপাশে আম-কাঁঠালের বাগান, আর জঙ্গুলে গাছপালার আদাড়। বাড়ির সামনে দক্ষিণপাশে আনাজিকলার ঝাড়, অন্যপাশে দুটো ফজলি আমের গাছ। বোঝা যায় বাগান ও জঙ্গল পরিষ্কার করে নতুন ভিটের পত্তন করা হয়েছে।
-আজু, আমার বিহায়েরা যে দাওয়াত কইরিছে, তার কী করা যাবে?
জহির মণ্ডলের মেয়ে আবেদার বিয়ে হয়েছে এ গাঁয়েরই আরেক প্রান্তে। তার ভাশুরের ছেলের বিয়ে। তারা বিয়ে দিচ্ছে হানাফি পরিবারে। সেই নিয়েই বিপত্তি। ওদের নিজেদের সমাজে এ নিয়ে হইচই চলছে। তাদের সমাজ যদিও আলাদা, তবু ওই বিয়ে খেতে গেলে তাদের সমাজেও কথা উঠবে সেটা নিশ্চিত। অথচ মেয়ের ঘর, না গেলেও চলে না।
-অ্যাতো বুলনু এই বি’ দিয়েন না।
-কী কর্ইবে, ছেলি যে শুইন্ছে না।
-না, না, সেডি না। আসল কথা হইলো সম্পত্তি। সম্পত্তির লোভ সামলাতে পারছে না বিহায়েরা। বিরক্তি ঝরে পড়ে তার কণ্ঠ থেকে।
-তা ঠিক। বিহায়ের লোভ তো কম না। যতোই দ্যাও কিছুতেই প্যাট ভরে না। জহির মণ্ডলের মুখটা একটু কষটে হয়ে ওঠে। অভিজ্ঞতার চিহ্ন ফুটে ওঠে তার কপালের ভাঁজে।
-হুঁম! ঠিক আছে, এক কাম করো ভাই, ভাবি আর দু’চারডি ম্যা ছেলিপেলিক পাঠায় দ্যাও।
-মুরুব্বি দু’একজন না গেলে কি ঠিক হবে?
-তা অবশ্য ঠিক। তাহিলে তুমি যাও, আর আজগর ভায়েক লি’ যাও। আর বেশি মানুষ যেন্না যায়।
আস্তে আস্তে সেখানে বাড়ির বড়-ছোট, ছেলে-মেয়ে অনেকেই এসে জড়ো হলো। দাওয়াত খেতে কে কে যাবে তাই নিয়ে আলোচনা চলতে লাগল।
আজ তার রাজশাহী শহরে যাওয়ার কথা। ভুবন দাস দেখা করার জন্য খবর পাঠিয়েছে। তিনি এই শহরের একজন বড় মুদি ব্যবসায়ী। তার গদিতে আজিম মণ্ডলের ওঠা-বসা রয়েছে। বড় ধরনের কেনা-কাটা সেখানেই করে তারা। গোসল সেরে খাওয়া-দাওয়া করে তারপর বেরবেন তিনি। বাড়ির ভেতরে গিয়ে খোদেজা বিবির সঙ্গেই প্রথম দেখা। ছোটখাট একহারা গড়নের মানুষ তার স্ত্রীটি। গায়ের রং হালকা ফরসা। মুখটা কিছুটা লম্বাটে। বেশ শ্রী আছে মুখটায়। তারা পরস্পর খালাতো ভাইবোন। ঘরে ঘরে বিয়ে হয়েছে। আহলে হাদিস জামাতের অনুসারীরা সাধারণত অন্য জামাতের লোকদের সঙ্গে বিয়ে-শাদি দেয় না। বিপত্তি হচ্ছে আহলে জামাতের লোক এ অঞ্চলে যথেষ্ট নেই। সে কারণে এই জামাতের লোকদের বেশিরভাগ আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যেই বিয়ে দিতে হয়। আজিম মণ্ডল আর খোদেজা বিবির ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।
স্বামীর দিকে তাকিয়ে খোদেজা বিবি বললেন, আইজ কুনুঠে যাবে, নাকি?
-হ্যাঁ, বাজারে যাব। বললেন আজিম মণ্ডল।
বাজার মানে রাজশাহী শহর। এই শহরের প্রাণকেন্দ্র সাহেববাজার। রাজশাহী অঞ্চলের লোকজন বহু আগে থেকেই এই শহর বলতে সাহেব বাজারকেই বুঝে থাকে। সংক্ষেপে তারা একে বাজার বলে। আশপাশে বড় হাট-বাজার তেমন একটা নেই। পুবে বানেশ্বরে একটা বড় হাট বসে, সেটা সপ্তাহে মাত্র দুদিন। এই গ্রাম থেকে সেটা একটু দূরেই, অন্তত সাত-আট মাইল হবে। সে তুলনায় রাজশাহী শহর কাছে, মাইল চার-পাঁচেক হতে পারে। আর সেটা প্রত্যেকটা দিন খোলা থাকে বলে সুবিধা। এদিককার লোকেরা পদ্মা নদীর ধার দিয়ে পাবনা রোড ধরে হেঁটেই যাতায়াত করে রাজশাহী শহরে। আজিম মণ্ডলের কথা অবশ্য ভিন্ন। জমিদার বা জোতদার না হলেও তার মধ্যে সেই রকম একটা আভিজাত্য বোধ রয়েছে। তিনি একটা ঘোড়াগাড়ি কিনেছেন বেশ কিছুদিন হলো। শহর বা দূরে কোথাও যেতে হলে তিনি সেই ঘোড়াগাড়ি করেই যান। পরিবারের অন্যরাও ব্যবহার করে গাড়িটা। বিশেষ করে ছেলে এরফান বেশি ব্যবহার করে।
-আমাক ত্যাল দাও তো, গা ধুই আসি। পরনের ফতুয়া এবং গেঞ্জি খুলে উঠোনের বাঁশের ডাপে ঝুলিয়ে রাখলেন। -এগ্লিন ধুই দিয়ো, ঘামে গন্ধ কর্ইছে।
খোদেজা বিবি রান্নাঘরের সামনে থেকে কিছু আবর্জনা সাফ করছিলেন, স্বামীর দিকে তার নজর ছিল না। তিনি বললেন, ডাপে রাইখি দ্যাও, বুড়ির মা ধুই দিবেনি।
-হুঁম, ত্যাল দাও।
সরষের তেল মেখে গোসল করা অভ্যাস আজিম মণ্ডলের। গ্রামের প্রায় সবারই এই স্বভাব। সরষের তেলের ভেষজ গুণ অনেক। বিশেষ করে শরীরে ও নাকে-মুখে এই তেল মেখে একটু রোদে দাঁড়ালে জ্বর-সর্দি-কাশি কাছে ঘেঁষে না, যদি হয়ও তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে যায়। পূর্বপুরুষদের অভিজ্ঞতা থেকে শেখা এটা। ঘাড়ে গামছা-লুঙ্গি নিয়ে পুকুরের উদ্দেশে হাঁটা দিলেন তিনি।
বড়বাড়ির মধ্যে যে ছোট পুকুর, যাকে মাইঠাল বলে সবাই, সেখানে সাধারণত বাড়ির মেয়েরাই গোসল করে। পুরুষরা যায় বড় পুকুরে। সেটা বড়বাড়ির পুবে। প্রায় তিন বিঘের জলকর, দীঘি বলাই সঙ্গত। কিন্তু লোকেরা এটাকে বড় পুকুরই বলে।অনেক কালের পুরনো পুকুর। মধ্যপাড়া, মৌলবি পাড়া এবং গোয়ালপাড়ার প্রায় সকল পরিবারেরই অংশ আছে এতে। তবে বড় ভাগীদার বড়বাড়ি আর মৌলবি পাড়ার মণ্ডলরা।
খোদেজা বিবি সেই যে ফজরের ওয়াক্তে ওঠেন, আর বিছানায় পিঠ পাতেন না। নামাজের পর আজিম মণ্ডল যেমন মাঠের দিকে যান তিনি তেমনি বাড়ির টুকটাক কাজগুলোয় হাত দেন। মুরগি ছাড়া, কাজের মেয়েগুলোকে কাজ বুঝিয়ে দেওয়া, এইসব। এইসব করতে করতেই সূর্য রোদ ছড়িয়ে মুখ তুলে দাঁড়ায়।দুই জা ততক্ষণে এসে উপস্থিত হয়। ছেলেমেয়েদের কেউ কেউ ওঠে আরো একটু দেরি করে।
এরফান নতুন ঘর থেকে বের হয়। মাকে দেখে বলে, আব্বা কী বুইললো রে মা? বাজারে যাবে?
-হুঁ, তাই তো বুইললো। ক্যান?তুইও যাবি নাকি?
-যাতু তো। আব্বা কখুন যাবে?
-গা ধুতে গেল। মুনে হয় খাওয়া-দাওয়া কইরিই বাহির হবে। গেলে বাপ-ব্যাটা একসাথেই যা।
এরফান কিছু বলল না। সে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গেল।
খোদেজা বিবি জা দুজনকে তাড়া লাগালো। -দ্যাখো তো পান্থা কতটুক্ আছে। নাহিলে ভাত চড়াও।
কাজের মেয়েরা সবাই এসে উপস্থিত। কাজ তারাই করবে। বউগুলোকে শুধু দেখে নিতে হবে।
ঠিক সে সময় বাড়িতে ঢোকে হাসনা বেগম। কোলে তার বড় মেয়ে। খোদেজা বিবি খুশি হন মেয়ে-নাতনিকে দেখে, কিন্তু কিছু অবাকও হন। কারণ এত সকাল সকাল মেয়ে কখনো আসে না।
হাসনা সোজা হন হন করে মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। -মা, বাপ নাই?
-আছে। বস।
-বইস্পো না। বাপ কুন্ঠে?
এবার সত্যি সত্যি বিস্মিত হন খোদেজা বিবি। তার মুখে-চোখে তার ছাপ পড়ে। -ক্যান রে মা, কী হয়ছে?
মায়ের উদ্বেগে ধাতস্থ হয় মেয়ে। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলে, না, ত্যামন কিছু না। ইট্টুক্ দরকারি কথা বুইল্বো।
-কী কথা!
-বাপজান নাই নাকি? এই সাত-সকালেই বাইর হয় গেইল্ছে?
-না, বাহিরে যায়নি। পুখোরে গা ধুইতে গেইল্ছে।
-ও, তাহিলে তো দেরি হবে।
আজিম মণ্ডল গোসল করতে গেলে বেশ একটু দেরিই হয়। পুকুর পাড়ে লোকজন থাকে, তাদের সঙ্গে গল্প-গুজব করতে হয়। গাঁয়ের আর পাঁচ-দশজনের ভাল-মন্দ খবর সেখান থেকেই পাওয়া যায়। সে বিষয়টা বাড়ির মানুষের সকলের জানা।
-তাহিলে মা, এদিক আয় তো। মেয়ে আগেই কোল থেকে নেমেছে। সে ছুটে গিয়েছে হেঁশেলে চাচাতো দুই নানীর কাছে। হাসনা বেগম এখন ঝাড়া হাত-পা। মাকে সে একরকম হিঁচড়ে-টেনে ঘরের মধ্যে নিয়ে যায়।
ঘরের মধ্যে তারা দুটি প্রাণী ছাড়া আর কেউ নেই। তবু এদিক-ওদিক চোখ ফেলে দেখে নেয় হাসনা বেগম। তারপর ফিসফিস করে বলে, মা, শুন্, বাপেক সাবধানে চলাফিরা কর্ইতে বুলিস। ষড়যন্তর হোছে কিন্তুক।
-কিসের ষড়যন্তর?
-অরা বাপেক মার্ইবে।
-মার্ইবে? কারা?
-কারা আবার! যারে সমস্যা কর্ইছে তারা। পরার লেগি শত্রু বাড়ায় কী লাভ? বাপ বুঝে না ক্যান?
আজিম মণ্ডলের শত্রু বাড়ছে তা বাইরের লোক তো বটেই এই বাড়ির লোকজনও বুঝতে পারছে। মণ্ডল নিজেও বোঝেন না এমন নয়। নিশ্চয়ই বোঝেন। সে রকম জ্ঞান-বুদ্ধি তার আছে। কিন্তু পাত্তা দিতে চান না। বলেন, লোকে সবকিছু ইট্টুক্ বাড়ায় বুলে, বুঝলি?রাগ-ঝাল হইলে মানুষ ইট্টুক্ হুমকি-ধামকি দি’ কথা বুলে। ওই কথার সবকিছু ধর্ইতে হয় না।
তার কথা মিথ্যে নয়। মানুষ রাগের মাথায় কত কথাই না বলে। তার প্রায় সবটাই অবান্তর। রাগ কমলেই সব ভুলে যায়। সুতরাং রাগের কথা ধরতে নেই। এই সমাজে বসবাস করতে গেলে কত জনের সঙ্গে কত ঝামেলা হয়। হবেই। এড়ানো সম্ভব নয়। আর স্বার্থে ঘা লাগলে মেজাজ কার না খারাপ হয়। তখন কিছু গালাগাল, হুমকি-ধামকি হতেই পারে।
এমনকি মারামারি কাটাকাটি পর্যন্তও গড়াতে পারে। অবশ্য সেটা খুব কমই হয়। আজিম মণ্ডল নিজের বিষয় নিয়ে কারো সঙ্গে বিবাদ করেছেন এমনটা হয়নি এখনো। সমাজে মাতব্বরি করতে গেলে অন্যের বিষয়কেও নিজের বিষয় করে নিতে হয়। তা না হলে সমাজে শাসন ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না। সেটাই করেন তিনি। তখন স্বাভাবিক ভাবেই কারো না কারো স্বার্থে ঘা লাগে। তারা ক্ষুব্ধ হয়। নানান কথা বলে। রাগ ঝাড়ে। যা বলার নয় তা-ও বলে অনেকে। তারপর আস্তে আস্তে ভুলে যায়। এমনটাই হয়ে আসছে কালে কালে।
-না মা, বাপেক এবির সাবধান হইতে বুল্। আমার শাশ্ড়ি লিজের কানে শুইনিছে।
হাসনার শাশুড়ি মানে তার আপন খালাও বটে। মাটির মানুষ। ভাই-অন্ত প্রাণ। তিনি নিজের কানে শুনে স্থির থাকতে পারেননি।
-আমি অ্যাখুন দাঁড়াতে পারছিনি। তুমি বাপেক বুইলো, আমি আরেক সুময় আস্পোনি।
স্বামী কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেছে। প্রত্যেকদিন সকালে তাকে দোকানে যেতে হয়। সকালের খাওয়া তো আছেই, দুপুরের খাবারও বেঁধে নিয়ে যায়। তার যোগাড়-যন্ত্রণার ব্যাপার আছে।
-উই থাকইক্লো। নানা নানা কইরি পাগলএক্খিবারে!
উই মানে তার মেয়েটি, ইফফাত আরা, যে এখন হেঁশেলে চাচাতো নানিদের সঙ্গে আসর জমিয়েছে। নানার চোখের মণি।
[চলবে]